২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

দিলীপ কুমার : কিছু স্মৃতি, কয়েকটি কথা

দিলীপ কুমার : কিছু স্মৃতি, কয়েকটি কথা - ছবি- সংগৃহীত

ষাটের দশকের মাঝামাঝি আমার এক তরুণ নিকটাত্মীয় স্টাইল করে চুলের ছাঁট দিতেন ‘কুমার’ নামের একজন অভিনেতার অনুকরণে। ফিল্মি অঙ্গনের। তবে উপমহাদেশের সেরা ‘কুমার’ ছিলেন বলিউডের ‘ট্র্যাজেডি কিং’ দিলীপ কুমার। তিনি এবার অবশেষে চিরবিদায় নিলেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন; অর্থাৎ ‘নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহরই জন্য এবং তাঁর কাছেই আমাদের প্রত্যাবর্তন।’ মহাগ্রন্থ পবিত্র আল কুরআনের এ অমোঘ বাণী তার বেলায় উচ্চারণের কারণ, দিলীপ কুমার আসলে ‘দিলীপ’ কিংবা ‘কুমার’ কোনোটাই ছিলেন না। তার আসল নাম ‘মুহাম্মদ ইউসুফ খান’। বর্তমান পাকিস্তানের সরহদ বা সীমান্ত অঞ্চল, তথা এই উপমহাদেশের সর্ব উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের বর্তমান খাইবার পাখতুন খোয়া প্রদেশের পাঠান তিনি। ব্রিটিশ যুগে ভাগ্যান্বেষণে এসেছিলেন বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) নগরে। পেশোয়ারের বাজারে তার বাবা গোলাম সারোয়ার খান ফল ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি নিজেও ফল ব্যবসায়ের উত্তরাধিকার পেয়েছেন। তবে বোম্বের চিত্রজগৎ বলিউডে একাধারে কয়েক দশকের পদচারণায় যে ফল পেয়েছেন, তা অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়কর। দিলীপ কুমার সেখানে কেবল ‘রাজকুমার’ হননি। ‘রাজা’র সম্মান ও মর্যাদা, গৌরব ও খ্যাতি অর্জন করে গেছেন।

উল্লেখ্য, তার মতোই বর্তমান পাকিস্তানের সাবেক উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে ভারত ও মুম্বাইতে পাড়ি দিয়েছিলেন চলচ্চিত্রের কাপুর পরিবার (পৃথ্বিরাজ, রাজ কাপুর, শশীকাপুর, শাম্মিকাপুর, কারিশমা, কারিনা, রনধীর গং) এবং সাহিত্যের মুলক রাজ আনন্দের মতো ব্যক্তিরা। ১৯৯৪ সালের শেষ দিকে দিলীপ কুমার ঢাকায় সংক্ষিপ্ত সফরে এসেছিলেন। তখন বিমানবন্দর ও প্রেস ক্লাবে তাকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছি। সাংবাদিকতা পেশার সুবাদে তেমনি অন্য সময়ে দেখা পেয়েছি ভারতের মান্না দে এবং পাশ্চাত্যের ইউসুফ ইসলাম বা ক্যাট স্টিভেন্সের মতো শিল্পীদের।

আমাদের ছোটবেলায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক দিকে করাচি-লাহোরের উর্দু ছবি ও গান; অন্য দিকে ভারতের বলিউড-টালিউডের হিন্দি-বাংলা ছবি ও গানের ব্যাপক প্রভাব ছিল। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরের পাক-ভারত যুদ্ধ পর্যন্ত ঢাকা রেডিওর (তখন রেডিওর সবই সরকারি) বেলা ১টা ৫ মিনিটে প্রচারিত ‘পাঁচ মিশালি’ আসর এবং বেলা ২টা ২০ মিনিটের অনুরোধের আসর পশ্চিমা ও ভারতীয় গানে ভর্তি থাকত। সে যুগে কলকাতার ছায়াছবির উত্তম কুমার ও প্রদীপ কুমার এবং মুম্বাই চিত্রজগতের দিলীপ কুমার ছিলেন নিউ জেনারেশনের ‘হার্টথ্রব’। পাশাপাশি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের অভিনেতা কে, কুমারের নামও কিছুটা শোনা যেত। দিলীপ কুমার বিয়ে করেছিলেন দেরিতে। সম্ভবত নায়িকা মধুবালার সাথে তার রোমাঞ্চপূর্ণ দীর্ঘ প্রেমের খবর প্রচারিত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৬ সালে ৪৪ বছর বয়সে দিলীপ কুমার বিয়ে করেন বলিউডের অতীত দিনের অভিনেত্রী নাসিম বানুর মেয়ে এবং পর্দা কাঁপানো চিত্রনায়িকা, ২২ বছরের সায়রা বানুকে। এটি ছিল ভারতের মতো বাংলাদেশেও ব্যাপকভাবে আলোচিত বিষয়। দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে তাদের কোনো সন্তান হয়নি। তবে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তারা বিশেষত আশির দশকের পরে প্রশংসিত হয়েছেন। প্রখ্যাত অভিনেতা রাজকাপুর ছিলেন দিলীপের বাল্যবন্ধু এবং পেশোয়ারের প্রতিবেশী।

‘ইউসুফ খান’ কেন মুম্বাই গিয়ে ‘দিলীপ কুমার’ হয়ে গেলেন? হয়তো তার প্রথম প্রযোজকের অনুরোধে, তা না হলেও তিনি পরিচিতি পেতেন। তবে সমকালীন উপমহাদেশের অপ্রিয় বাস্তবতা অর্থাৎ একশ্রেণীর মানুষের সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতা, তাকে বাধ্য করেছিল জন্মগত মুসলিম পরিচয় লুকাতে। তা না হলে প্রথম বাঙালি মুসলিম চিত্রপরিচালক (পরে প্রখ্যাত সাংবাদিক) ওবায়েদ-উল-হক কেন ‘হিমাদ্রি কুমার’ আর সমকালের অভিনেতা ফতেহ লোহানী ‘কিরণ কুমার’ কলকাতায় ছদ্মনাম নিয়েছেন?

দিলীপ কুমারের মধ্যে হীনম্মন্যতাবোধ ছিল না। এ জন্য বিশেষ করে পরবর্তী জীবনে লুকোচুরি না খেলে বারবার বলেছেন, আমি আসলে ইউসুফ খান। আমার ছদ্ম পরিচয় হলো ‘দিলীপ কুমার’। ঢাকায় এসেও জাতীয় প্রেস ক্লাবের অনুষ্ঠানে কোনো রাখঢাক না করে তিনি বলে গেছেন, ‘ও ধস ণড়ঁংঁভ কযধহ. ওঃ'ং সু নড়ফু ধহফ উরষরঢ়শঁসধৎ রং রঃং ংযধফড়.ি’ তার বিখ্যাত আত্মজীবনীর নামেও (ঃযব ংঁনংঃধহপব ধহফ ঃযব ংযধফড়)ি নামেও শ্যাডো বা ‘ছায়া’ কথাটা।

যখন ভারতের কোনো এক মুসলিম চিত্রনায়ক একজন পাকিস্তানি পীরের মুরিদ হন এবং মাকে নিয়ে হজ করে আসেন, আবার ঘরের বৌ ও সন্তানের নাম থাকে অমুসলিমদের মতো; যখন চরম মুসলিমবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক ‘বজরঙ্গ’ দলের ইমেজ উন্নয়নে মুসলিম সন্তান চিত্রনায়ককেই সাফল্যের সাথে ব্যবহার করা হয়, তখন দিলীপ কুমার সংশ্লিষ্ট রিলিফ কমিটির নেতারূপে ভারতের সংখ্যালঘুদের মৌলিক ও মানবিক অধিকারের সপক্ষে বারবার সোচ্চার থেকেছেন। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত সাহস ও দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেন।

১৯৯৫ সালে দিলীপ কুমারকে ঢাকা সফরের দাওয়াত দিতে গিয়েছিলেন এক সময়ের ছাত্রনেতা ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি এবং বিখ্যাত ভিকারুননিসা নূন স্কুল গভর্নিং বডির সাবেক সদস্য মরহুম এ কে ফিরোজ নূন। তিনি প্রেস ক্লাব অঙ্গনে দিলীপের সংবর্ধনা সভায় বলেছিলেন নিজ অভিজ্ঞতার কথা। বলেছেন, মুম্বাইতে এই কিংবদন্তি চিত্রনায়কের বাড়িতে গিয়ে তিনি হতবাক! কারণ তখন সেখানে ছিল আটাসহ নানা রকম ত্রাণসামগ্রীর অনেক বস্তার স্তূপ এবং সেই সাথে দাঙ্গাগ্রস্ত বিভিন্ন এলাকার বহু মুসলিম নর-নারী এসে সে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের সবাই ছিলেন মুসলিমবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অসহায় শিকার।

১৯৯৪ সালের শেষ দিকের একদিন রাতে আমাদের দৈনিক পত্রিকা অফিসের চিফ রিপোর্টার সালাহ উদ্দিন বাবর ভাই আমাকে বিশেষ ধরনের একটা অ্যাসাইনমেন্ট দিলেন। সেটি হলো, প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নায়ক দিলীপ কুমারের কর্মব্যস্ত ঢাকা সফর কাভার করা। নিজে চলচ্চিত্র অঙ্গনের ঘনিষ্ঠ নই। অতএব, প্রথমে কাজটি বেশ কঠিন মনে হলো।

প্রথমেই দিলীপ কুমারের ঢাকা আগমন এবং বিমান থেকে অবতরণ। আমরা গুটিকয়েক সাংবাদিক শহর থেকে দূরে (শাহজালাল) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আগেভাগেই গিয়ে হাজির। বলিউড কিংয়ের বিমান ভিড়তেই আমাদের ছোটাছুটি। বিমানবন্দরের এক স্থানে দিলীপভক্ত জনৈক প্রবীণ অভিনেতাকে দেখলাম গদ গদ কণ্ঠে উর্দু ‘শের’ বা কবিতা আবৃত্তি করতে। দিলীপ কুমার বিমান থেকে নেমে বেশি কথা না বলে বিশ্রাম নিতে চলে যান। তখন তার বয়স ৭২ বছর।

পরে এ বিখ্যাত চিত্রনায়কের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হলো জাতীয় প্রেস ক্লাব অঙ্গনে; তোপখানা রোডে। সে দিন অনেক আগেই সেখানে গুণমুগ্ধদের সমাগম। ক্লাবের মূল ভবনের বাইরে প্যান্ডেল ও স্টেজ। অনেক সাংবাদিক এসেছেন সস্ত্রীক। দিলীপকে দেখে তারা হারানো দিনের ছায়াছবির দৃশ্যগুলো যেন ফিরে পেলেন। দিলীপ কুমার মূলত মুসলমান, এটি তার বক্তব্যের ভাষা-ভঙ্গিতে ছিল স্পষ্ট। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভারতের নাগরিক হয়েও তিনি নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস লুকাননি। তার এ মনোভাব সাম্প্রদায়িকতা নয়, সৎসাহস। তিনি সবাইকে মুসলিম হিসেবে সালাম জানিয়ে; নিজের প্রকৃত পরিচয় দিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন সে দিন।

দিলীপ কুমারকে বলা হয় ‘বলিউডের প্রথম খান’। কারণ তার পরে বিশেষত তিন খান (শাহরুখ, সালমান ও আমির) এখন বলিউডে রাজত্ব করছেন। দিলীপের অভিনীত, ইতিহাসভিত্তিক ছায়াছবি ‘মুঘল-ই-আজম’ (১৯৬০) পেয়েছিল দারুণ জনপ্রিয়তা। একটি পত্রিকা তার মৃত্যুর পরে লিখেছে, ‘এটি ভারতের সর্বকালের সেরা সিনেমাগুলোর একটি।’ ছবিতে সেলিম (পরে সম্রাট জাহাঙ্গীর) এবং তার প্রেমিকা আনারকলির ভ‚মিকায় ছিলেন যথাক্রমে দিলীপ কুমার ও মধুবালা। এ ছবির জন্য নাকি দিলীপ ছিলেন না ‘প্রথম পছন্দ’। শোনা গেছে, প্রযোজককে রাজি করিয়ে ছবিটিতে তিনি নাম লিখিয়ে ছিলেন।

দিলীপ কুমার ও বলিউডের এখনকার বিখ্যাত চিত্রনায়ক শাহরুখ খান পরস্পর আত্মীয়। আর ঢাকায় দিলীপের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হলেন ঢাকার ছবিতে বিগত ষাটের দশকের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নায়ক হারুন। তিনিই ‘হারুন ডায়েরি’ খ্যাত ব্যবসায়ী এবং মরহুম কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের বিজনেস পার্টনার ছিলেন।

বাংলা ভাষায় তেমন দক্ষ না হলেও উর্দুভাষী দিলীপ কুমার বাংলা ভাষাকে ভালোবাসতেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতেন তিনি। ১৯৪৬ সালে তার অভিনীত একটি ছবি মুক্তি পায়, যা তাকে বানিয়ে দেয় ‘তারকা।’ এর নাম ‘মিলন’ এবং এটি রবিঠাকুরের উপন্যাস ‘নৌকাডুবি’র হিন্দি সংস্করণ। ১৯৯৫ সালে ঢাকা এসে প্রেস ক্লাবের সংবর্ধনায় তিনি দর্শকদের অনুরোধে চলচ্চিত্রে তার গাওয়া একটি বাংলা গানের অংশবিশেষ গেয়েছেন- ‘কাঁচা ঘুম ভাঙলে কেন? কেন? কেন? কেন?’ ভারতের বিখ্যাত পরিচালক তপনসিংহের ‘সাগিনা মাহাতো’ (১৯৭০) নামের বাংলা ছবিতে বিখ্যাত অভিনেতা দিলীপ কুমার সস্ত্রীক অভিনয় করেছেন। তবে চার বছর পরে তপন বাবু তাদের নিয়েই সাগিনা নামে এর ‘রিমেক’ বানালেও তা ব্যবসা সফল হতে পারেনি। ‘সাগিনা মাহাতো’র শুটিং হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ি এলাকা কার্শিয়াংয়ে।

গত বুধবার টিভির চ্যানেলগুলোর ব্রেকিং নিউজে দিলীপ কুমারের মৃত্যু সংবাদ জানানো হয়েছে। আর দুই বছর বাঁচলে বয়সের সেঞ্চুরি করতে পারতেন তিনি। কিন্তু কথায় বলে, ‘মানুষ ভাবে এক, খোদায় করে আরেক।’ তিনিই সর্বশক্তির অধিকার হিসেবে জগতের সৃষ্টিকুলের জীবনমৃত্যুর বাগডোর ধরে আছেন। অতএব, তার ইচ্ছায় আত্মসমর্পণের বিকল্প নেই। ১০ বছর ধরে দিলীপ কুমারের বারবার হাসপাতালে গমন ইঙ্গিত দিয়েছে তার চির বিদায়ের। টিভির ব্রেকিং নিউজে এটি জেনে নিঃসন্দেহে অসংখ্য লোকের হার্টব্রেক হয়েছে। বিশেষত, ভারতের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকবলিত এবং বিপন্ন বিপর্যস্ত সংখ্যালঘুদের মর্মান্তিক হার্টব্রেকিং (হৃদয় ভঙ্গ হওয়া) থেকে কে বাঁচাবে?


আরো সংবাদ



premium cement