রোহিঙ্গা ইস্যু ও মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকার
- মুজতাহিদ ফারুকী
- ২৯ জুন ২০২১, ২০:০৮
মিয়ানমারে সামরিক জান্তাবিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধ চলমান রয়েছে। সেটি ক্রমশ রক্তক্ষয়ী হয়ে উঠতে শুরু করেছে। তার পরও গত পাঁচ মাস ধরে জান্তা সরকার অনেকটাই স্বস্তির সঙ্গে বহালতবিয়তে ক্ষমতায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রধান তিন শক্তি রাশিয়া, চীন ও ভারতের সমর্থন নিয়ে এখন সব বিরোধিতা নির্মূল করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে পারছে। এ ক্ষেত্রে চীন-রাশিয়ার আধুনিক অস্ত্র জান্তার বড় পুঁজি। সম্প্রতি দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থান ও গণতন্ত্রকামীদের ওপর নির্যাতন নিপীড়নের নিন্দা করে অস্ত্র বিক্রি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে। মহাবিস্ময়ে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশ ওই প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থেকেছে। এই বিরত থাকার যুক্তি হিসেবে রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে প্রস্তাবে নির্দিষ্ট করে কোনো বক্তব্য না থাকার বিষয়টি সামনে এনেছে বাংলাদেশ।
এ যুক্তির সারবত্তা কিছু আছে কি না সে বিষয়ে বিবেচনায় যাওয়ার আগে এমন ধারণাই মনে জেগে ওঠে যে, এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অসহায় অবস্থাটি সামনে এসেছে। অসহায়তার কারণ একটিই। চীন, রাশিয়া, ভারতের অবস্থানের বিপরীতে কিছু করা ঢাকার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। আবার রোহিঙ্গা ইস্যুর জট ছাড়াতে কার্যকর কোনো ভূমিকাও পালন করতে পারছে না। রোহিঙ্গা ইস্যুর একটিই সমাধান, সেটি হলো তাদের সম্মানের সাথে, মর্যাদার সাথে এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তাসহ নিজ বাসভূমিতে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করা। সে ক্ষেত্রে যে কোনো বিবেচনায়ই হোক এর বড় দায় মিয়ানমারের। সু কির সরকার তবু প্রকাশ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবার কথা বলত। এখন জান্তা সরকার সে রকম কোনো ভান ধরেনি।
বাংলাদেশের মুখের সামনে দরাম করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। বলে দিয়েছে, অবৈধ বাংলাদেশীদের ফিরিয়ে নেয়ার কোনো প্রশ্নই নেই। অথচ বাংলাদেশ কিন্তু মিয়ানমারের সামরিক জান্তার প্রতি সদিচ্ছার প্রমাণ দিয়েছে আগেই। গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থান ঘটায় সামরিক বাহিনী। আর গত ২৭ মার্চ দেশটির সশস্ত্র বাহিনী দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে নেপিডোতে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে যোগ দেন। যদিও বেশির ভাগ দেশ ওই অনুষ্ঠান বর্জন করে। ওই ঘটনায় দেশটির গণতন্ত্রকামীরা ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানবাধিকারকর্মী এবং গণতন্ত্রপন্থীরাও হন বিস্মিত।
একটি বিষয় স্পষ্ট যে, মিয়ানমারের জান্তা সরকারের প্রতি প্রীতি দেখালেও বিনিময়ে বাংলাদেশের এখনো কিছুই অর্জিত হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কি গণতন্ত্রকামী জাতীয় ঐক্য সরকারকে (এনইউজি) সমর্থন দিতে পারে? গত এপ্রিলে গঠিত ঐক্য সরকার এরই মধ্যে প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তুলেছে। রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করেছে। তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছে। বিনিময়ে তাদের প্রতি এই সরকারের সাথে হাত মেলানোর আহ্বান জানিয়েছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলতে চেয়েছেন যে, বাংলাদেশ এনইউজিকে সমর্থন দেয়ার দিকে যেতে পারে। কিন্তু এটি বাস্তবসম্মত বলে আমাদের মনে হয় না। বিশ্বের কোনো দেশই এখনো এনইউজিকে স্বীকৃতি দেয়নি। বাংলাদেশ প্রথম দেশ হিসেবে এটি করার ঝুঁকি নিতে পারে না। এখানেও ঢাকাকে সতর্কতার সাথে পা ফেলতে হবে, যাতে তার কোনো পদক্ষেপ সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষকে বিরূপ করে। এ বিষয়ে চীন, ভারত নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ।
মিয়ানমারের পাল্টা সরকার বা এনইউজি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন চেয়ে আবেদন জানিয়েছে। কিন্তু তাতে শিগগিরই কোনো সাড়া পাবে এমন মনে হচ্ছে না। বরং কঠোর বিরোধিতা এসেছে খোদ মার্কিন কংগ্রেস সদস্যের কাছ থেকে। গত মে মাসে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতে এক শুনানিতে অংশ নিয়ে কংগ্রেস সদস্য টেড লিউ বলেন, মিয়ানমারের ঐক্য সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের সরকারে শরিক না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি এই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার যেকোনো প্রচেষ্টা প্রতিহত করবেন। ভাষাটা কত তীর্যক লক্ষ করার মতো। স্বীকৃতি দেবো না এইটুকু বলে থামেননি। বলছেন, স্বীকৃতি দেয়ার যেকোনো চেষ্টা রুখে দেবেন। এটা সত্য যে, নাগরিকত্ব দেয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে বিকল্প সরকার চাচ্ছে রোহিঙ্গারা তাদের সাথে হাত মেলাক। সরকারে রোহিঙ্গাদের শরিক করেনি তারা। শুধু তাই নয়, জান্তা সরকারের পতন হলে রোহিঙ্গাদের দেশের ভূমিজ সন্তান হিসেবে স্বীকতি দেয়ারও প্রতিশ্রুতি দেয়নি। মিয়ানমারে ১৩৫টি জাতিসত্তা ভূমিজ সন্তান হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু সে তালিকায় রোহিঙ্গাদের জায়গা হয়নি। যদিও বার্মার স্বাধীনতা সংগ্রামে অং সানের সাথে রোহিঙ্গারাও মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন। মার্কিন কংগ্রেস সদস্য টেড লিউ (ডেমোক্র্যাট-ক্যালিফোর্নিয়া) এক টুইট বার্তায় বলেন, ‘নতুন জাতীয় ঐক্য সরকার রোহিঙ্গাদের সরকারে নেয়নি। এটা না পাল্টানো পর্যন্ত আমরা তাদের সমর্থন দিতে পারি না।’ এ দিকে গণতন্ত্রপন্থী কর্মী ও বিক্ষোভকারীদের অনেকে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন নিপীড়নের সময় নিশ্চুপ থাকায় তাদের ওই আচরণের জন্য এখন সামাজিকমাধ্যমে ক্ষমা চাইছেন। কিন্তু এই আবেগ কতটা নির্ভেজাল তার প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। রোহিঙ্গাদের প্রতি দেশজুড়ে যে বিদ্বেষ গত কয়েক দশকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে এর অবসানে গণতন্ত্রপন্থীরা কী ভূমিকা নেবেন সে বিষয়ে কেউ একটি কথাও বলছেন না। জান্তা সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসতে দেশের সব জাতিগোষ্ঠীর ঐক্য যখন খুবই জরুরি; তখনো যদি বিভেদ জিইয়ে রাখা হয়; তাহলে তাদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। সেই প্রশ্ন এরই মধ্যে উঠেছে। বর্মীরা খুব বিশ্বাসযোগ্য এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। সু চির গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং পরে ক্ষমতায় গিয়ে ভিন্ন চরিত্রের উন্মোচনই এর একমাত্র প্রমাণ নয়। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর মিয়ানমার রাষ্ট্র যাদের নিরলস শ্রমে ঘামে সমৃদ্ধ হয়েছে সেই ভারতীয়দের বিতাড়িত করা হয় সবকিছু কেড়ে নিয়ে। সেই সব মানুষকে সারা জীবনের অর্জিত সব অর্থকড়ি, সম্পদ ফেলে রেখে শুধু প্রাণটুকু নিয়ে একবস্ত্রে পালিয়ে আসতে হয়েছিল। পলায়নপর অসহায় বহু মানুষ তখন প্রাণ হারান বর্মীদের হাতে, পথশ্রমে, অনাহারে এবং প্রাকৃতিক কারণে।
এটা তো নিকট অতীতের ইতিহাস। মাত্র ৭০-৭২ বছর আগের ঘটনা। অতএব, রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে গণতন্ত্রকামী বিকল্প সরকারের আন্তরিকতা কতটা নিখাঁদ তা প্রমাণসাপেক্ষ।
ফেব্রুয়ারির সেনা অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের মানুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রতিবাদ বিক্ষোভে অংশ নেন। পেশাজীবী, শিক্ষক, পুলিশ এমনকি ধর্মীয় নেতারাও অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও অনেকে বিদ্রোহ করেন। বিপরীতে সেনাবাহিনী চরম নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা নিতে শুরু করে। দমন অভিযানে গত পাঁচ মাসে অন্তত এক হাজার বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ কারাবন্দী। এ ছাড়া সেনা ও প্রতিরোধ যোদ্ধাদের রক্তক্ষয়ী সঙ্ঘাতের মুখে অন্তত দুই লাখ ৩০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন বলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের আলামত। আমরা এটিকে গৃহযুদ্ধ না বলে মুক্তি সংগ্রামও বলতে পারি। পরিস্থিতি তো অনেকটাই আমাদের ১৯৭১ সালের মার্চের পরবর্তী সময়কালের মতো।
সামরিক জান্তার আক্রমণ দমনে গড়ে ওঠা পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (পিডিএফ) সাথে সামরিক বাহিনীর সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেছে। মধ্য মিয়ানমারের মাগউই অঞ্চলে সামরিক জান্তা ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘর্ষের পর সৈন্যরা একটি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। এতে ওই গ্রামের বাসিন্দা এক প্রবীণ দম্পতি আগুনে পুড়ে নিহত হয়েছে। দেশটির মিন রাজ্যে কারেন বিদ্রোহীরাও এখন বিকল্প সরকারের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে। কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ) মিয়ানমারের অন্যতম বৃহত্তম সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর সশস্ত্র সংগঠন। খবর হলো, কারেন রাজ্য থেকে এরই মধ্যে এক লাখ ৭৭ হাজার মানুষ অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে।
ইয়াঙ্গুন, মান্দালয় ইত্যাদি শহরে গণতন্ত্রপন্থী কিশোর-তরুণদের পিপলস ডিফেন্স ফোর্স বা ‘পিডিএফ’ রীতিমতো সক্রিয়। তাদের অ্যামবুশে গত ২৩ জুন মান্দালয় ও সাগাইনে সেনা সরকারের এক অফিসারসহ প্রায় ২০ জওয়ান নিহত হন। শিন প্রদেশে ১০ জুন একজন আর্মি ক্যাপ্টেনসহ ২৭ সেনা নিহত হন শিনল্যান্ড ডিফেন্স ফোর্সের সাথে সংঘর্ষে। এরা নতুন গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ফলে উজ্জীবিত তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই সংগ্রাম ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ গতি পাবে না; যতক্ষণ না তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়। বাংলাদেশ কেন সেই সমর্থন দিতে পারছে না আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত যেভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল; এখনকার বাংলাদেশ সেভাবে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতে পারবে না বোধগম্য কারণেই। তেমন নেতৃত্ব এ দেশে অনুপস্থিত।
তাহলে বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে এই যে, রোহিঙ্গা সমস্যা কার্যত একটি ঝুলন্ত ইস্যু হয়েই থাকছে। আর মিয়ানমারের বিকল্প সরকারকে সেনাবাহিনীর চরম সন্ত্রাস সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াই করে এগিয়ে যেতে হবে শুধুই জনগণের সমর্থন নিয়ে। অন্তত এখন পর্যন্ত, জনসমর্থনই কেবল তাদের টিকে থাকার নিশ্চয়তা।
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা