২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

করোনা আদিম রোগ, ডেল্টার দৌরাত্ম্য

করোনা আদিম রোগ, ডেল্টার দৌরাত্ম্য - ছবি : সংগৃহীত

করোনাভাইরাসে রোববার (২৭ জুন) বাংলাদেশে ১১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। ৮ মার্চ ২০২০ দেশে করোনার সংক্রমণ শনাক্তের পর থেকে এখন পর্যন্ত এক দিনে এটিই সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। সংক্রমণ ভারতে কমে এলেও বাংলাদেশে এখন করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দৌরাত্ম্য। অতি সংক্রামক ভারতীয় এ ধরনটি বাংলাদেশের মানুষকে সংক্রমিত করে চলেছে। প্রথমে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে এর সংক্রমণ দেখা দিলেও এখন ঢাকাসহ সারা দেশেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। দেশে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে করোনায় আক্রান্ত নতুন রোগী বেড়েছে ৪৯ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং মৃত্যু বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। এ অবস্থায় দেশব্যাপী কঠোর লকডাউনের ঘোষণা এসেছে। সোমবার থেকে সীমিত পর্যায়ে এবং বৃহস্পতিবার থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে কঠোর লকডাউন চলবে বলে সরকার ঘোষণা দিয়েছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর দেড় বছর ধরে বিশ্বব্যাপী চলছে করোনা মহামারীর দাপট। রোববার পর্যন্ত এ মহামারীতে বিশ্বে ১৮ কোটি ১২ লাখ ৬৯ হাজার ৬২০ জন আক্রান্ত হয়েছে। এ সময়ে বিশ্বে করোনায় মারা গেছে ৩৯ লাখ ২৭ হাজার ১৭৫ জন।

এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমণ ও মৃত্যু সবচেয়ে বেশি। মৃত্যুর দিক দিয়ে প্রথম পাঁচটি দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে ছয় লাখ ১৯ হাজার ১২৫ জন, ব্রাজিলে পাঁচ লাখ ১১ হাজার ২৭২ জন, ভারতে তিন লাখ ৯৪ হাজার ৫২৪ জন, রাশিয়ায় এক লাখ ৩২ হাজার ৬৮৩ জন এবং ফ্রান্সে এক লাখ ১০ হাজার ৯৩৯ জন। করোনায় মৃত্যুর দিক দিয়ে বাংলাদেশ ৩৮তম। শনিবার বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যু সংখ্যা ১৪ হাজার ছাড়িয়েছে। গত এক সপ্তাহে বাংলাদেশে করোনায় এক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশে করোনা রোগী শনাক্তের হার এখন ২০ শতাংশের বেশি। গত এক সপ্তাহে মৃত্যু ও রোগী বেড়েছে ৫০ শতাংশ। করোনায় ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টাই এখন আতঙ্ক।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রোয়াসু বলেছেন, করোনার সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো এই ভারতীয় ডেল্টা ধরনটি। এটি এখন বিশ্বব্যাপীই ছড়িয়ে পড়ছে। আফ্রিকায় গত সপ্তাহে আগের সপ্তাহের চেয়ে করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যু ৪০ শতাংশ বেড়েছে।

করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্রথম ভারতে শনাক্ত হয়। এটি দেশটিতে বিপর্যয় ডেকে আনে। এমনও দিন গেছে ভারতে করোনায় মৃত্যু ছয় হাজার ছাড়িয়েছে। অবশ্য বর্তমানে এ মৃত্যু হাজারে নেমে এসেছে। শনিবার ভারতে করোনায় মৃত্যু সংখ্যা ছিল এক হাজার ১৮৩ জন। গত ১৯ দিন ধরে করোনায় সংক্রমণও ৫ শতাংশের নিচে। তবে দ্বিতীয় ঢেউ স্তিমিত হয়ে এলেও ভারতে মাস দেড়েকের মধ্যে তৃতীয় ঢেউ ভয়াবহ করে তুলতে পারে বলে দেশটির বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিশেষজ্ঞরা ভারতে নতুন করে ‘ডেল্টা প্লাস’ ভ্যারিয়েন্টের আক্রমণের আশঙ্কা করছেন। এটি আরো মারাত্মক সংক্রামক।

করোনা মহামারীর অবসান কবে নাগাদ হতে পারে সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের সুস্পষ্ট কোনো ভবিষ্যদ্বাণী নেই। তবে তারা বলেছেন, ব্যাপক টিকাদানই একে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। টিকাদানে ধনী দেশগুলো এগিয়ে থাকলেও গরিব দেশগুলো বেকায়দায় রয়েছে। উদ্ভাবিত টিকার প্রয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি টিকাকে আরো উন্নত করারও প্রচেষ্টা চলছে। নতুন গবেষণায় বলা হয়েছে- করোনাভাইরাস একেবারে চলে যাওয়ার রোগ নয়। এই রোগ বহুকাল পূর্ব থেকেই যে প্রাদুর্ভাব ঘটিয়ে আসছে, তা আগে জানা ছিল না। বিজ্ঞানীরা এখন জানতে পেরেছেন।

করোনা অনেক পুরনো রোগ
করোনাভাইরাসের খুঁটি খুব গভীরে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ২০ বছর ধরে করোনাভাইরাস সৃষ্ট বেশ কয়েকটি প্রাদুর্ভাবের মুখোমুখি হয়েছে মানুষ। এর মধ্যে রয়েছে সার্স, মার্স ও কোভিড-১৯। করোনাভাইরাসের ইতিহাস অনেক পুরনো। সহস্রাব্দ বছর আগেও করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মুখোমুখি হয়েছিল মানুষ।

বিজ্ঞান সাময়িকী ‘কারেন্ট বায়োলজি’তে এ নিয়ে একটি গবেষণা নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। বিশ্বের ২৬টি জনগোষ্ঠীর দুই হাজার ৫০০ মানুষের জিনোম নিয়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, করোনাভাইরাস একটি আদিম জীবাণু। তারা মানব জিনোমে প্রথম করোনাভাইরাসের কার্যকলাপ বের করেন। এই গবেষণার সাথে জড়িত রয়েছেন অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের একদল গবেষক। সাময়িকীতে যে নিবন্ধ ছাপা হয়েছে তার প্রধান লেখক ড. ইয়াসিন সুইলমি বলেছেন, ২০ হাজার বছর আগেও যে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছিল তার প্রমাণ তারা পেয়েছেন। পূর্ব এশিয়ার আধুনিক সময়ের মানুষের ডিএনএতে এর জিনগত ছাপ রয়ে গেছে।

গবেষক সুইলমি বলেন, ভাইরাসটি নিজের প্রতিলিপি তৈরি করে কাজ চালিয়ে যায়। কিন্তু এই প্রতিলিপি তৈরি করতে তাদের নিজের কোনো টুল নেই। ভাইরাস তার হোস্ট বা ধারকের ওপর নির্ভর করে। এ কারণেই তারা হোস্ট বা ধারককে আক্রমণ করে তার কার্যক্রম ছিনিয়ে নিতে নিজের প্রতিলিপি তৈরি করে। ভাইরাসের মানবকোষ ছিনতাইয়ের বিষয়টি একটি ছাপ তৈরি করে, যা গবেষকরা এখন পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।

তাদের গবেষণা সম্পর্কে ড. সুইলমি বলেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা একসময় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং এর অভিযোজন ঘটেছিল। তার সুস্পষ্ট প্রমাণই গবেষণায় উঠে এসেছে। করোনাভাইরাস-সংক্রান্ত জিনগত সঙ্কেত চীন, জাপান ও ভিয়েতনামের পাঁচটি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কিত। তবে এই ভাইরাস অন্য অনেক দেশের জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেও ছড়িয়ে থাকতে পারে। এ নিয়ে গবেষণা হয়নি। গবেষণা হলে হয়তো এ সম্পর্কে তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে।

করোনাভাইরাসের আবিষ্কার
করোনাভাইরাস গোত্রের একটি জীবাণু ১৯৩০ সালে সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হয়। মুরগির খামারে চরম শ্বাসকষ্টজনিত রোগের কারণ খুঁজতে গিয়ে গবেষকরা ইনফেকসাস ব্রনকাইটিস ভাইরাস (IBV) চিহ্নিত করেন। এটি ১৯৬৮ সালে ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত হয়। এক গ্রুপ ভাইরোলজিস্ট এই গোত্রীয় ভাইরাসকে করোনাভাইরাস হিসেবে প্রথম নামকরণ করেন।

১৯৩০ সালে ইনফেকসাস ব্রোনকাইটিস ভাইরাস চিহ্নিত করার ১০ বছর পর ১৯৪০ সালে পশু ও পাখিতে সংক্রমিক আরো দু’টি করোনাভাইরাস, যা মাউস হেপাটাইটিস ভাইরাস (MHV) এবং ট্রাসমিজিবল গ্যাসট্রোয়েন্ট রিটিস ভাইরাস (TGEV) শনাক্ত করেন। এ তিনটি ভাইরাসই একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত বলে ভাইরালজিস্টরা ধারণা করেন।

এরপর ১৯৬০ সালে মানবদেহে সংক্রমণ ক্ষমতাসম্পন্ন করোনাভাইরাস আবিষ্কৃত হয়। এর নাম দেয়া হয় হিউমেন করোনাভাইরাস ২২৯ই এবং ও.সি.৪৩। এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সাধারণ জ্বর অনুভব করে। এরপর পর্যায়ক্রমে ২০০৩ সালে সার্স-কোভ, ২০০৪ সালে এইচসিওভি এনএল-৬৩, ২০০৫ সালে এইচকেইউ-১, ২০১২ সালে মার্স-কোভ এবং সর্বশেষ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সার্স-কোভ-২ আবিষ্কৃত হয়। এই করোনাভাইরাসই পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দেড় বছর ধরে। মানবদেহে সংক্রমণযোগ্য ছয়টি প্রজাতির করোনাভাইরাস এ পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে। চলমান করোনাভাইরাস মহামারীর ভাইরাসটির নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট মানুষকে আক্রান্ত করে অস্থির করে তুলেছে। ডেল্টা বা ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হিসেবে ইতোমধ্যে প্রমাণিত। বাংলাদেশের মানুষও এখন এই ভ্যারিয়েন্টের শিকার।

করোনাভাইরাসের আবিষ্কারক ড. আলমেইডার কথা
১৯৬৪ সালে স্কটিশ ভাইরোলজিস্ট ড. আলমেইডা প্রথম করোনাভাইরাস আবিষ্কার করেন। তবে তখন তিনি এর স্বীকৃতি পাননি। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে তার ধারণ করা ছবিগুলোকে বিচারকরা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের বাজে ছবি বলে উড়িয়ে দেন। কিন্তু পাঁচ দশক পর এই বাতিল বাজে ছবির ভাইরাসই বিশ্বজুড়ে মহাবিপর্যয় ডেকে আনে। এটিই আজকের কোভিড-১৯ মহামারী সৃষ্টিকারী সার্স-কোভ-২ ভাইরাস। ১৯৬৪ সালে লন্ডনের সেন্ট থমাস হাসপাতালের গবেষণাগারে ড. আলমেইডা প্রথম এই ভাইরাস শনাক্ত করেন। আজ নভেল করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ একটি নতুন ভাইরাস হিসেবে বলা হলেও এর আবিষ্কার হয় ১৯৬৪ সালে ড. আলমেইডার গবেষণাতেই।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক


আরো সংবাদ



premium cement