২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বাংলাদেশ থেকে মুদ্রা পাচার

বাংলাদেশ থেকে মুদ্রা পাচার - ছবি : সংগৃহীত

দীর্ঘদিন যাবৎ শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশী অনেকের টাকাই সুইস ব্যাংকে রয়েছে। অনেকের বিলাসবহুল বাড়িঘর রয়েছে উন্নত দেশে। আমেরিকা, লন্ডনের বাঙালিপাড়ায়, অস্ট্র্রেলিয়া, কানাডার বেগমপাড়ায়, মালয়েশিয়ায় সাহেবপাড়ায় কাদের বিলাসবহুল বাড়িঘর রয়েছে, এর একটি তালিকা দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে হাইকোর্ট তলব করেছেন। জানা মতে, দুদক এখনো সেই তালিকা পেশ করতে পারেনি, যদি তা সঙ্গোপনে করে থাকে তা হলে ভিন্ন কথা। তবে সে তালিকায় কাদের নাম রয়েছে তা জানার অধিকার জনগণের রয়েছে।

সুইজারল্যান্ডে বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশীদের টাকার পাহাড় জমা হয়ে আছে। বিভিন্ন সূত্রের খবর মতে, ২০২০ সালে এ অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৬ কোটি ২৯ লাখ ফ্রাংক। বাংলাদেশী মুদ্রায় যা পাঁচ হাজার ২৯১ কোটি টাকা। সুইজারল্যান্ডে ২৫৬টি ব্যাংকে বাংলাদেশীদের জমাকৃত আমানতের বছরওয়ারি একটি হিসাব এ রকম :

‘২০২০ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের আমানতের স্থিতি ৫৬ কোটি ২৯ লাখ ডলার। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে যা ছিল ৬০ কোটি ৩০ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৮ সালে ৬১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৭ সালে ছিল ৪৮ কোটি ১৩ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৬ সালে ৬৬ কোটি ১৯ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৫ সালে ৫৫ কোটি আট লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৪ সালে যা ছিল ৫০ কোটি ৬০ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৩ সালে ৩৭ কোটি ২০ লাখ ফ্র্যাংক, ২০১২ সালে ছিল ২২ কোটি ৯০ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১১ সালে ছিল ১৫ কোটি ২০ লাখ ফ্র্যাংক। তবে স্বর্ণালঙ্কার, শিল্পকর্ম এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র জমা রাখলে তার আর্থিক মূল্যমান হিসাব করে আমানতে যোগ হয় না।

এ ছাড়াও ২০১০ সালে ছিল ২৩ কোটি ৬০ লাখ ফ্র্যাংক, ২০০৯ সালে ১৪ কোটি ৯০ লাখ ফ্র্যাংক, ২০০৮ সালে ১০ কোটি ৭০ লাখ ফ্র্যাংক, ২০০৮ সালে ২৪ কোটি ৩০ লাখ ফ্র্যাংক, ২০০৬ সালে ১২ কোটি ৪০ লাখ ফ্র্যাংক, ২০০৫ সালে ৯ কোটি ৭০ লাখ ফ্র্যাংক, ২০০৪ সালে চার কোটি ১০ লাখ ফ্র্যাংক, ২০০৩ সালে তিন কোটি ৯০ লাখ ফ্র্যাংক এবং ২০০২ সালে ছিল তিন কোটি ১০ লাখ ফ্র্যাংক। ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের প্রায় সমান। একক বছর হিসাবে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে এক হাজার ১৫১ কোটি ডলার দেশীয় মুদ্রায় যা প্রায় এক লাখ কোটি টাকা সুইজারল্যান্ডে পাচার হয়েছে। এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে চারটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চারটি প্রক্রিয়ায় এ অর্থ পাচার হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রফতানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং), হুন্ডি ও অন্য মাধ্যমে বিদেশে লেনদেন এবং ভিওআইপি ব্যবসায়।’ (সূত্র : জাতীয় পত্রিকা, ১৯ জুন ২০২১)

অর্থনীতিবিদদের মতে, বিনিয়োগ না হওয়ায় পুঁজি বিদেশে পাচার অর্থাৎ মুদ্রা পাচার হচ্ছে। পুঁজি দেশে বিনিয়োগ না হওয়ার কারণ বাংলাদেশের আইন এবং দ্বীমুখীভাবে আইনের প্রয়োগ। যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকে বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার তাঁবেদার তারা পুঁজি বিনিয়োগে সরকারের যে আনুকূল্য পায়, ভিন্নমতাবলম্বীদের জন্য তা একেবারে উল্টো। সরকারি দলের লোকেরাও বিদেশে মুদ্রা পাচার বেশি করছে, ক্ষমতা হারালে ভবিষ্যতে যাতে দুদকের মামলার আসামি হতে না হয়। দেশের মানুষ ইনকাম ট্যাক্স দিতে চায়, কিন্তু ওই অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই ট্যাক্স আদায়ে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। কারণ ইনকাম ট্যাক্স অফিসের পিয়ন, কেরানি থেকে শুরু করে কর্মকর্তারা ইনকাম ট্যাক্সের দালালি করে। সরকারের ঘরে যে ট্যাক্স জমা না পড়ে তার চেয়ে বেশি টাকা জমা পড়ে দুর্নীতিবাজ ইনকাম ট্যাক্স অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পকেটে। অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিরত অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে চেম্বার খুলে ইনকাম ট্যাক্স প্র্যাকটিস করছেন, যা আইনসম্মত নয়। দায়িত্ব নিয়েই এ কথা বলছি।

বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য অনেক বেড়ে গেছে। যে ছিল একশ’ বিঘা জমির মালিক সে হয়েছে ৫০০ থেকে এক হাজার বিঘা জমির মালিক, পক্ষান্তরে যে ছিল পাঁচ থেকে ১০ বিঘা সম্পত্তির মালিক সংসারের ঘানি টানতে টানতে সে নিঃস্ব হয়ে ঢাকার বস্তিতে অবস্থান নিয়ে রিকশা চালায় বা দিনমজুরের কাজ করছে। দেশের বিত্তশালী মানুষগুলো হচ্ছে অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক এবং মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তরা দিন দিন নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। বিত্তশালীরা আরো ধনকুবেরে পরিণত হওয়ায় সব ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হচ্ছে। বাংলাদেশের ২২টি রাষ্ট্রীয়করণ জুট মিলকে সরকার প্রথমে বিরাষ্ট্রীয়করণ করে। তখন সরকার থেকে বলা হয়েছিল, জুট মিলগুলো লাভ করতে পারছে না। এটি অবশ্যই সরকারের ব্যর্থতা। সরকার ব্যর্থতা ঘোচানোর পরিবর্তে এখন ধনীদের আরো ধনী করার সুযোগ করে দিয়েছে। সরকার ১৭টি জুট মিল ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়ার জন্য আবেদনপত্র আহ্বান করেছে। তার মধ্যে ১৪টি জুট মিল লিজ নেয়ার জন্য ৫১টি আবেদন জমা পড়েছে। কোটি কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ এখন ব্যক্তিমালিকানায় চলে যাওয়ার সুযোগ সরকার নিজেই করে দিলো। রাষ্ট্রীয় সম্পদ পানির দরে এখন হস্তান্তর হবে।

বাংলাদেশে বর্তমানে যাদের টাকা নেই তাদের জন্য দুনিয়া অন্ধকার, হাভাতে দিন কাটাচ্ছে, সুচিকিৎসার অভাবে হাসপাতালের বারান্দায় কাতরাচ্ছে, সুশিক্ষার অভাবে সন্তানরা হচ্ছে বেকার ও বখাটে, অন্য দিকে যাদের টাকা আছে সুখে শান্তিতে আমোদ ফুর্তিতে দিন কাটিয়েও টাকা যখন উপচে পড়ছে তখন তারা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে গড়ে উঠা রিক্রিয়েশন ক্লাবগুলোতে মদ, জুয়া ও অবৈধ যৌনাচারে লিপ্ত। এ ক্লাবগুলোতে ভর্তি হতে মোটা অঙ্কের টাকা প্রয়োজন। পত্রিকায় দেখেছি, অন্যতম রিক্রিয়েশন ক্লাব ঢাকা বোট ক্লাবের সদস্য হতে ৬০ লাখ টাকা ভর্তি ফি লাগে। মনভরা কষ্ট নিয়ে আমাদের এ কথাও শুনতে হয় যে, ওই বোট ক্লাবের সভাপতি পদে রয়েছেন বাংলাদেশের পুলিশপ্রধান যিনি আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, মাদক প্রতিরোধ প্রভৃতি বেআইনি কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করা রাষ্ট্রের প্রধান কর্মকর্তা। অথচ সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশে মদ, জুয়া, গনিকাবৃত্তিসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে-

‘১. জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন এবং বিশেষত আরোগ্যের প্রয়োজন কিংবা আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট অন্যবিধ প্রয়োজন ব্যতীত মদ্য ও অন্যান্য মাদক পানীয় এবং স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।

২. গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেবেন।’

শিক্ষা বিস্তারের উন্নতি সাধন করা হচ্ছে বলে সরকার গলা ফাটিয়ে বলছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন, ঢাকার অলিতে গলিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি দিয়ে সরকার শিক্ষা প্রসারে জয়জয়কার ভাব দেখাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার পাশাপাশি যদি নৈতিকতা না থাকে তবে সে শিক্ষায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রোফাইল ভারী হতে পারে, কিন্তু দেশ ও জাতির কোনো কল্যাণে আসে না। দেশে বিভিন্ন স্থানের ক্লাবগুলোর আয়-উপার্জনের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে জুয়া ও দেশী-বিদেশী মদ বিক্রি। ক্লাবগুলো থেকে বলা হয়, এ জন্য সরকারের অনুমতি রয়েছে। সাংবিধানিকভাবে যেখানে মদ বা জুয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেখানে রাষ্ট্রীয় বেতনভুক্ত কর্মকর্তাদের ক্লাব পরিচালনায় পৃষ্ঠপোষকতা কতটুকু শোভন হতে পারে?

সাংবিধানিকভাবে যে বিষয় নিষিদ্ধ, রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সেসব সংগঠন বা ক্লাবগুলো গড়ে ওঠে কিভাবে? এ ধরনের বিনোদনমূলক ক্লাবে কী কী কর্মকাণ্ড চলে তা কি প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খবর রাখেন? সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে অনেকেই রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে অধিক উচ্চস্বরে ‘স্বাধীনতার চেতনার’ কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। বর্ণিত বিষয়গুলো কি স্বাধীনতার চেতনার পরিপন্থী নয়? বোট ক্লাবের জন্য তুরাগ নদী কোনো প্রকারে দখল হয়েছে কি না তা-ও এখন তদন্তের দাবি রাখে। উল্লেখিত বিষয়গুলোতে সরকারের একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ এখন সময়ের দাবি। যে রাষ্ট্রে জবাবদিহিমূলক সরকার রয়েছে সে রাষ্ট্রের নাগরিকরা স্পর্শকাতর বিষয়ে সরকারের শ্বেতপত্র বা সুনির্দিষ্ট বক্তব্য অবশ্যই দাবি করতে পারে।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement