২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

তৃতীয় বিশ্বে অবস্থানের তকমা খুলে ফেলতে হবে

তৃতীয় বিশ্বে অবস্থানের তকমা খুলে ফেলতে হবে - ছবি : সংগৃহীত

জীবনে যারা নানা ক্ষেত্রে সাফল্যের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে যান তাদের এমন অসামান্য কৃতিত্বের পেছনে অনেক কারণ আর হেতু থাকে। তাদের অনেক গুণের মধ্যে নিজের দায়িত্ব পালন নিয়ে আত্মপর্যালোচনা তথা স্বীয় ভুলভ্রান্তিকে খোঁজেন এবং তা চিহ্নিত করে সেগুলো শুধরে নেন। এমন ব্যক্তিরা তাদের সমালোচকদের প্রতি কখনো বিক্ষুব্ধ হন তো নাই, বরং তাদের নিজের কল্যাণকামী বলেই মনে করেন। তবে হ্যাঁ, সেই সমালোচনা অবশ্যই ছিদ্রানুসন্ধানের বা নিন্দা ছড়ানোর জন্য যেন না হয়। তা হতে হবে গঠনমূলক। নিন্দা বা অপবাদ নয় বরং সেটি হবে সহানুভূতির প্রকাশ আর তার (পথকে) আরো মসৃণ করে তোলার প্রয়াস। তবে এ কথা ঠিক, আমাদের সমাজে এমন উদারচিত্তের মানুষকে দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েই খুঁজতে হবে। কারণ অন্যের সাফল্যে ঈর্ষাকাতর হয়ে ওঠা মানুষের সংখ্যাই বেশি। এদের খেয়েদেয়ে কোনো কাজ না থাকলে নিন্দা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে বেড়ানোই তাদের কর্ম।

সেই চূড়ায় ওঠা মানুষ এ কথা নিশ্চয় অনুভব করেন যে, প্রতিটি মানুষের বহু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই বোধ থেকেই নিজের কাজের মূল্যায়ন করেন এবং ভিন্নজনের গঠনমূলক সমালোচনাকে স্বাগত জানান। মানুষের সীমাবদ্ধতা এতটাই যে, সে তার নিজের চেহারাটাও আরশির সাহায্য ছাড়া দেখতে পর্যন্ত পারে না। মানুষের শেখার কোনো শেষ নেই, যারা যত বেশি শেখেন তাদের জগৎ ও জীবন সম্পর্কে উপলব্ধি আর জ্ঞানের ভাণ্ডার উন্মোচিত হয়। সেটি ব্যক্তিজীবনকেই শুধু সমৃদ্ধ করে না, সমাজকেও আলোকিত করে থাকে। কিন্তু এমন অগ্রসর মানুষের আকাল থাকায় সমাজে জমাট বাঁধা অন্ধকার কাটছে না। বস্তুত সমাজ তো রাষ্ট্রেরই একটা কমপোনেন্ট। সে জন্য রাষ্ট্রও নানাভাবে দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণ সহজ নয়। যে সমাজ-রাষ্ট্র এই সঙ্কট দূরীভূত করার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে সক্ষম হয়েছে তারাই সাফল্যের ক্ষেত্রে নানা ‘অবস্ট্রাকল’ থেকে নিজেকে মুক্ত করে আনতে পেরেছে। তাতে মানুষের শান্তি স্বস্তি ও সমৃদ্ধি অর্জিত হয় এবং ইহজগতের বহু সমস্যা থেকে মুক্তি লাভ করে।

তবে এ কথা ঠিক, মানুষের উদাহরণ তুলে ধরে এ লেখা সূচনা করেছি তেমন যোগ্য আর মহৎপ্রাণ মানুষের সন্ধান দূরীবক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে পেতে হবে তা আগেই বলা হয়েছে। পক্ষান্তরে আমাদের সমাজে এমন মানুষের সংখ্যাই বেশুমার যারা নিরন্তর অপকর্ম করে চলছে, তাদের অহর্নিশ চিন্তা, মানুষের অকল্যাণ আর নিষ্কলুষ ব্যক্তিগোষ্ঠীর শান্তি-স্বস্তিতে ব্যাঘাত ঘটানো, মানুষের কর্মকাণ্ডের কূট সমালোচনা করা। এসব ব্যক্তির দুষ্কর্মের প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা তাদের নিয়ে আভাস ইঙ্গিত করাও বিপজ্জনক। কেননা এতে তারা ক্ষিপ্ত এবং অসহিষ্ণুতার আগুনে জ্বলে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে এবং প্রতিশোধস্পৃহায় উন্মত্ত হয়ে পড়ে। এসব ব্যক্তির প্রায় সবার রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা থাকে, তা বলাই বাহুল্য। তারা সব সময়ই ক্ষমতাধরদের সাথেই গভীর সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। তাদের দাপট সাধারণের কাছে চরম অসহনীয় আর কটু বা তিক্ত হলেও তা হজম করতে হয়। এদের দৌরাত্ম্য শুধু সমাজকেন্দ্রিকই থাকে না সে গণ্ডি পেরিয়ে প্রশাসনিক পর্যায়েও প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশে রাজনীতিকদের জনসম্পৃক্ততা ক্ষীণ আর ভিত্তি দুর্বল হওয়ায় সমাজের এসব নিন্দিত ব্যক্তির প্রতি তাদের নির্ভরতা সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি এমন হয় যে, এসব অপশক্তির সহায়তা দ্বারাই তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি পদযুগলের কাছে এসে দাঁড়ায়। মানুষের ওপর নির্ভরতার সেই কাল এখন নেই। আগে রাজনীতিতে নিয়ামকের ভূমিকায় ছিল সাধারণ মানুষ। অনেক দিন থেকে এ ধারার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন তা যেন পূর্ণতা লাভ করেছে।

রাজনীতিতে তথা রাষ্ট্রীয় আচারে জনবিচ্ছিন্নতা কোনোক্রমেই জাতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। যেখানে আমাদের সংবিধানে দেশের মালিক হিসাবে জনগণকে অভিষিক্ত করা হয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রাচারে জনসম্পৃক্ততা বিচ্ছিন্ন হলে সেটি হবে শুদ্ধাচারের নীতির পরিপন্থী। দেশের কখনো কোনো বড় সঙ্কট হলে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে তা থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে না বরং সমস্যা চরম হয়ে উঠতে পারে। সে সময় বসন্তের কোকিলের মতো রাজনীতির সেই খল সহযোগীদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজ কোভিড নিয়ে দেশ এক দুর্যোগকাল অতিক্রম করছে। এ সময় প্রশাসন মানুষকে নানা বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য আহ্বান জানিয়ে আসছে। কিন্তু তাতে খুব একটা সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে হয়তো একে সচেতনতার অভাবই বলবেন। হতেও পারে তা অস্বীকার করব না। কিন্তু সেই সাথে এটাও বিবেচনা করা দরকার যে, রাষ্ট্রযন্ত্রের নৈতিক বাঁধনটা শিথিল হয়ে পড়েছে কি না। প্রকৃত জনপ্রতিনিধিদের এমন আহ্বান হয়তো বেশি কার্যকর হতে পারত। এসব বিষয় নিয়ে এখন বোধ হয় ভাবনাচিন্তার সময় এসেছে। কোনো দুর্যোগকালে যদি মানুষ সচেতনতার পরিচয় না দেয় তবে এই ঘাটতি অবশ্যই দূর করার উদ্যোগ নেয়া উচিত। এখানে বিলম্ব ঘটলে শুধু আজ নয় আগামীতেও বিপদ এলে মানুষের নির্লিপ্ততা অসহনীয় পরিণাম ডেকে আনবে।

আমাদের যে চিকিৎসাব্যবস্থা রয়েছে, তা সাধারণ জনগণের হাতের নাগালে নেই। এসব মানুষ রোগাক্রান্ত হয় আর কোনো ওষুধপথ্য ছাড়াই ভুগতে ভুগতে সেরে ওঠে। সে জন্য বোধ হয় কোভিডকে তেমনি কোনো অসুখ ভেবে আমল দিচ্ছে না। অনেকসময় অভিমানের সুরে তারা বলে, গরিবের করোনা হয় না। এসব দরিদ্র মানুষের কাছে চিকিৎসাসুবিধা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা দরকার। তবেই তাদের চিকিৎসা নিতে আগ্রহ সৃষ্টি হবে এবং রোগ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হতে পারে। তা ছাড়া মানুষের চিকিৎসা পাওয়াটা তার অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। এ দেশে সরকারি চিকিৎসাসুবিধা খুব অপ্রতুল। হাসপাতালে ওষুধপথ্য রোগীদের নিজের অর্থ ব্যয় করে জোগাড় করতে হয়। যাদের সে সঙ্গতি নেই, তাদের রোগযন্ত্রণা কাতর করে তোলে। দেশের জনসংখ্যার তুলনায় সরকারি হাসপাতালে শয্যার সুবিধাও কম। সেখানে চিকিৎসা নিতে গিয়ে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয় রোগীদের। চিকিৎসা ক্ষেত্রের সমস্যাগুলো তুলে ধরার অর্থ নিন্দা বা নিছক সমালোচনা নয়। চিকিৎসাপ্রাপ্তির জন্য রাষ্ট্রের যে নীতি তার যেন বরখেলাপ না হয়, সে লক্ষ্যে প্রশাসনের দুর্বলতাগুলো তুলে ধরার চেষ্টাই হয়েছে। যাতে সমস্যার জট জটিল হয়ে সুরাহার সুযোগটা হাত ছাড়া হয়ে না যায়। কিন্তু পরম পরিতাপের বিষয়, প্রশাসন তাদের কাজের ব্যাপারে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য প্রকাশ করা হলে তা তাদের কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। আমরা আগে উল্লেখ করে এসেছি, কোনো মানুষই ভুলের ঊধের্ব নয়। এর বিপরীত বোধ বিবেচনাকে অহমিকাই বলতে হবে।

গণতান্ত্রিক দেশের অনেক সৌন্দর্যের মধ্যে প্রশাসনিক কার্যক্রমে কোনো ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে তা নিয়ে মুক্ত আলোচনাকে শুধু স্বাগতই জানান হয় না; সেই সাথে আলোচক বা আলোচকদের প্রতি কোনো বিদ্বেষপ্রসূত আচরণও করা হয় না। গণতান্ত্রিক দেশগুলোর এমন বিবেচনা তাদের (শুদ্ধতার) সোপানে পৌঁছাতে সাহায্য করে থাকে। তা ছাড়া রাষ্ট্রাচারে নাগরিকদের অংশগ্রহণের সুযোগ হয়। নাগরিকদের দেশ নিয়ে ভাবতে এবং তার কল্যাণে নিজেদের ভূমিকাকে আরো সক্রিয় ও সচেতন হওয়ার অনুভূতি জাগ্রত করে। পশ্চিমের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সুযোগ এ দেশের বহুজনের হয়েছে। তারা সেসব দেশের মানুষের দায়িত্বানুভূতির প্রশংসাসূচক অনেক কথাই বলে থাকেন। তবে সেসব দেশের জনগণের এমন চেতনার বিকাশ এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। এ জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ আর প্রশাসনের দীর্ঘ চেষ্টা সাধনা রয়েছে। নাগরিকদের শৃঙ্খলাবোধ তা কোনো পুলিশি ব্যবস্থায় হয়নি। অবশ্য তাদের পুলিশের ভূমিকা এতটা ইতিবাচক যে, মানুষ তাদের বন্ধু বলেই মনে করে।

আমরা সে তুলনায় কোথায় আছি তা ভেবে কূলকিনারা করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে আমাদের ‘শটকামিং’ থাকার বহু কারণ রয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের যারা কাণ্ডারি তাদের দুর্বলতা সীমাহীন। আমরা লক্ষ্য নির্ধারণের ব্যাপারে যথার্থ পথকে অগ্রাধিকার দিতে পরিপক্বতার পরিচয় দিতে পারিনি। রাষ্ট্রযন্ত্রের পেছনে থাকা মানুষটি তথা ‘ম্যান বিহাইন্ড দ্যা মেশিন’ বাছাই করতেও পারিনি। ‘শিশু জন্ম নিলেই মানুষ হয়ে যায় না’ বলে কথা প্রচলিত আছে। পদে পদে শিক্ষা-দীক্ষা দিলেই সে প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারে। শিক্ষা মানেই প্রচলিত ধ্যানধারণা দেয়া নয়। জ্ঞানবিজ্ঞান প্রযুক্তি নীতিনৈতিকতা মূল্যবোধ দায়িত্বানুভূতি আর ভালোবাসার যে জাগরণ পৃথিবীকে সমৃদ্ধ আর আলোকিত করেছে, সে সম্পর্কে আমাদের তরুণদের ধারণা দিতে হবে উপযুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায় তরুণদের যোগ্য আলোকিত আর বিশ্বমানের মানুষ হওয়ার জন্য। তেমন পাঠ্যক্রমও নির্বাচন করা জরুরি এবং অগ্রাধিকারের দাবি রাখে। জানি না, দেশের কাণ্ডারিদের সে বোধ বিবেচনা কতটা রয়েছে। তার স্ফুরণ তো লক্ষ করা যাচ্ছে না। পৃথিবীর উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমৃদ্ধ গবেষণার নানা ফলাফল পৃথিবীতে বহু অবদান রাখছে। আমাদের মেধার ঘাটতি থাকা বিশ্বাসযোগ্য নয় বরং তারা উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান আর পরিবেশের সঙ্কটে নিমজ্জিত। এ দেশের বহু কৃতী সন্তান নানা দেশে তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে প্রশংসিত হচ্ছেন।

সরকারপ্রধান দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে দিতে চান। তার এমন ভিশনের কথা আমরা জানি। তার কিছু ছাপও লক্ষ করা যায়। তবে তা কোনো পূর্ণাঙ্গ আর সমন্বিত পরিকল্পনার অধীনে হচ্ছে কি না তা আমরা জানি না। কেননা এ ব্যাপারে সরকারের পরিকল্পনা কমিশন কোনো রূপরেখা প্রকাশ করেছে বলে শুনিনি। মনে রাখতে হবে, সমন্বিত উন্নয়নে অনেক পূর্ব শর্তের পাশাপাশি মাল্টি ডাইমেনশনের বিষয়াদি পরিকল্পনায় সংযুক্ত করতে হবে। তা না হলে বিচ্ছিন্ন কিছু প্রকল্প হয়তো বাস্তবায়িত হবে, কিছু লোক তাতে উপকৃত হতে পারে; কিন্তু গোটা দেশের পার্সপ্রেকটিভে তা কতটা অর্থপূর্ণ হবে আর দেশের সব শ্রেণিপেশার মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে কী অবদান রাখবে তা বিবেচ্য বিষয়। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে। গণতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝতে হবে, উন্নয়নের অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে সেসব মানুষের প্রয়োজনটা বিবেচনায় নিতে হবে। আমরা এখন পর্যন্ত এমন কোনো প্রকল্পের মানুষের কথা শুনতে পারিনি যা সরাসরি গ্রামের মানুষের জীবনমানকে সমৃদ্ধ করতে পারে। কোনো প্রকল্প হয়তো আংশিকভাবে গ্রামের কিছু উপকার করতে পারে কিন্তু সংবিধানের যে দিকনির্দেশনা নগর আর গ্রামাঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য দূর করার সেটা কী হবে? এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, কতকাল আর গ্রামের মানুষ এমন বৈষম্য নিয়ে জীবন অতিবাহিত করবে।

তা ছাড়া আরো বাস্তবতা হচ্ছে, উন্নয়ন কার্যক্রম সফল করতে এর পাইপলাইনে এখন যত ছিদ্র রয়েছে তা বন্ধ করতে হবে। পাইপলাইনে যে শতছিদ্র আছে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় তা যেন প্রশাসনের গা সহা হয়ে গেছে। সংবাদপত্রের পাতায় এমন সব তথ্যপ্রমাণসহ উপস্থাপন করা হচ্ছে যে, দেশের বিভিন্ন প্রকল্পে পুকুরচুরির ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এর কোনো প্রতিকার ও প্রতিবিধানের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, সে খবর জানানো হয় না। তা ছাড়া সম্পদ পাচার লুটপাটের কাহিনী মানুষ এখন শুনতে শুনতে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের (করের) পয়সা এভাবে লোপাট হওয়ার তথ্য মানুষকে এতটা হতবিহ্বল করেছে যে, তারা দেশের উন্নয়ন নিয়ে নির্বিকার আর নিরাসক্ত।

দেশে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম রয়েছে। এই ব্যবস্থাকে অধিকতর গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক বলা হয় এবং জনপ্রতিনিধিদের কাছে সরকার তথা মন্ত্রীবৃন্দ সম্মিলিতভাবে জবাবদিহি করা এই ব্যবস্থার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু বাংলাদেশে তা অনুপস্থিত। এটা কেন ঘটেছে তা বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে। সংক্ষেপে শুধু এতটুকু বলি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তথা জাতীয় সংসদ এখন কার্যকর নয় এবং এর গঠন প্রক্রিয়া অর্থাৎ নির্বাচন, তাও ত্রুটিপূর্ণ। সব মিলিয়ে এই শাসনব্যবস্থা তার চরিত্র পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে। এর অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে হাজারো সমস্যা সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে স্থবির করে ফেলেছে। সংসদীয় ব্যবস্থার পীঠস্থান ব্রিটেন আর ভারতে এই শাসন ব্যবস্থা কার্যকর। এই দুই দেশে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় পান থেকে চুন খসলে বিরোধী দলের সদস্যরা লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেন। এসব নিয়ে সরকার জবাব দিতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠতে থাকে। কখন কোন বিষয় নিয়ে সংসদ ধরে বসে সে সম্পর্কে প্রশাসন তটস্থ থাকে। সে কারণে ওই দুই দেশে রাষ্ট্রাচারে গতিশীলতা বজায় রয়েছে। তার সুফল জনগণ পায়। সেই আদলেই আমাদের সংসদীয় ব্যবস্থা গঠিত হলেও ওই দুই সংসদের কার্যক্রমের সাথে আমাদের সংসদের তুলনাই চলে না।

এ দেশের স্থপতি স্বপ্ন দেখতেন, এ দেশের সংসদ তেমন প্রাণবন্ত কর্মমুখর হয়ে উঠবে। তিনি আজীবন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম আর জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার আজন্ম লালিত স্বপ্নকে সফল করার জন্য কাজ শুরু করতে এতটুকু বিলম্ব করেননি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, তার সে আত্মত্যাগ আর স্বপ্নের প্রতি সম্মান দেখাতে আজ পর্যন্ত কেউই এগিয়ে আসেনি। সে কারণে রাষ্ট্রযন্ত্রে সীমাহীন গোলযোগ লেগেই আছে। মুখে অনেক কথাই বলা হয়; বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই বললেই চলে। তিনি মুক্তচিন্তা আর স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে অটল অনড় ছিলেন; মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, সব বৈষম্য দূর করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের অনন্য বৈশিষ্ট্যের সংবিধান। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছরের মাথায় জাতিকে সংবিধান দেয়ার মাধ্যমে দেশকে সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসেন যা এক বিরল ঘটনা।

কিন্তু আজ সেই সংবিধানের অনুসরণ করার ক্ষেত্রে নানা ব্যত্যয় ঘটছে। এই সংবিধানে অন্যতম মূল চেতনা ও বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণ ও শুদ্ধাচারের প্রতিষ্ঠাসহ আরো অনেক কিছু। কিন্তু এসব উপেক্ষিত হচ্ছে। এই উপেক্ষা আজ শুরু হয়েছে, বলব না। তার ধারাবাহিকতায় এর মাত্রা হয়তো বেড়েছে। যাই হোক, এই হ্রাস বৃদ্ধির ফেরে পড়ে মানুষের কষ্ট আর ভোগান্তি সীমাহীন। এ নিয়ে প্রশাসনের উদাসীনতার দরুন বারবার তাগিদ দেয়ার জন্য সমাজের সচেতন বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী আর পেশাজীবীদের ভূমিকা রাখতে হবে- ‘একবার না পারিলে দেখো শতবার’ এই নীতিবাক্যটির আলোকেই। সরকারের প্রতিপক্ষ সংগঠনগুলোকেও এসব বিষয়কে তাদের কার্যক্রমের এজেন্ডা ভুক্ত করা উচিত।

সমাজে বিরাজমান যেসব অনিয়ম দুর্নীতি রয়েছে সেগুলোও কোনো-না-কোনোভাবে জনগণের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে চলেছে। বোদ্ধাসমাজ ও সচেতন মহলকে তার প্রতিকারের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। তাদের বিবেক যতটা জাগ্রত হওয়া আমাদের কাম্য ছিল, তাও পরিলক্ষিত হয়নি। লেখার শুরুতে বলা হয়েছে, প্রতীকী একটা বিষয় তথা আত্মসমালোচনা পর্যালোচনা করে ব্যক্তি সমাজ আর প্রশাসনকে তার ত্রুটিবিচ্যুতি অনুধাবন এবং তা থেকে মুক্ত হওয়ার চেতনাকে জাগ্রত করতে হবে। সমালোচনার জন্য সমালোচনা নয়, নিন্দার জন্যও নয়; কেবল প্রশাসনকে পরিশুদ্ধ করার জন্য কথা বলতেই সমাজের অগ্রসর ব্যক্তিদের দায়িত্বানুভূতির দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মতোই বাংলাদেশও এমন সমস্যায় আছে যা এই লেখার বিভিন্ন স্থানে কিঞ্চিৎ উল্লেখ করা হয়েছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমা হয়ে থাকা যত অনিয়ম নিয়ে প্রশাসন নিজস্ব চ্যানেলের মাধ্যমে অবহিত হতে পারছে না কিংবা তেমন চ্যানেল প্রশাসনের থাকলেও তার সংযোগটা কোথাও ছিন্ন হয়ে আছে কি না তার অনুসন্ধান জরুরি। জাতীয় সংবাদমাধ্যম তথা সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক মিডিয়া সে ভূমিকা রাখতে চেষ্টা করছে। কিন্তু সংবাদকর্মীদের এ জন্য নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। অথচ এমন দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে তার প্রতিষ্ঠান থেকে যে সম্মানী পান তার বাইরে আয়, কারো অনুকম্পা বা কোনো সুবিধা তার কাম্যও নয়। সাংবাদিকতার নীতি আদর্শের পরিপন্থীও এসব। পেশার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা এবং দেশ ও জনগণের প্রতি অপরিসীম মমতা ভালোবাসায় তাকে তার দায়িত্ব পালনের পথে নানা বাধা বিপত্তি নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি অবিরাম অকুতোভয়ে কলম চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ ‘তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত’ দেশ বলে উল্লেখ করেছি। তবে সে জন্য নিজেই গ্লানি বোধ করি। যারা দেশের দিশারি তারা তৃতীয় বিশ্বে অন্তর্ভুক্ত থাকার তকমাটি থেকে বেরিয়ে আসার নিরন্তন চেষ্টাকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করার জন্য উদ্যোগ তীব্র তীক্ষ্ণ করবেন বলে জনগণের আশা। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার যে প্রত্যয়ের কথা জাতিকে শুনিয়েছেন, সে পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সব বাধা অতিক্রম করার চেষ্টার যাতে কোনো কমতি না হয়, তাতে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

ndigantababor@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
২৩ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ১৭২ কোটি ৬৩ লাখ ডলার বান্দরবানের গহীন জঙ্গলে কেএনএ’র গোপন আস্তানার সন্ধান হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে ডিসি মশিউর ও এডিসি জুয়েল বরখাস্ত গাজীপুরে আরো এক মামলায় খালাস পেলেন তারেক রহমান রাজশাহীর ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে আইসিইউ ইউনিট উদ্বোধন ডেঙ্গুতে এক দিনে বছরের সর্বোচ্চ মৃত্যু, হাসপাতালে ১০৭৯ পার্থ টেস্টে জয়ের সুবাস পাচ্ছে ভারত ব্যবসায়ী জালাল উদ্দীন হত্যা : শেখ হাসিনাসহ ১২৯ জনের নামে মামলা ডিসেম্বর থেকে যাত্রীবাহী ট্রেন চলবে ঢাকা-নড়াইল-খুলনা রুটে নারায়ণগঞ্জে ১৬ কোটি টাকার ভারতীয় কাপড় উদ্ধার গলাচিপায় জালে ধরা পড়ল ২০০ বছরের জলপাইরঙ্গা কাছিম

সকল