২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বিবেকহীন প্রাণিজগৎ ও মানুষ

সময়-অসময়
বিবেকহীন প্রাণিজগৎ ও মানুষ - ছবি : সংগৃহীত

সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে ১৮ হাজার প্রাণী সৃষ্টি করেছেন। তাদের সবারই প্রাণ আছে, কিন্তু দৈহিক গড়নে কারো কারো সাদৃশ্য থাকলেও সব বিষয়ে হুবহু মিল নেই। বাঘের সাথে বিড়ালের সাদৃশ্য আছে, কিন্তু সব বিষয়ে মিল নেই বরং খাদ্যাভাসে সবাই আলাদা। প্রাণিবিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে ৩০০ প্রজাতির বানর রয়েছে যাদের একে অপরের সাথে সাদৃশ্য থাকলেও সবারই আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে, যা থেকে তাদের আলাদা করা যায়। সমুদ্রের অতল গহ্বরে পাথরের নিচে থেকে শুরু করে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ হিমালয়ে প্রাণীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়, শুধু বিভিন্ন গ্রহে শারীরিক কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব এখনো পাওয়া যায়নি। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআন মাজিদে যে সূত্র পাওয়া যায়, সেখানে সৃষ্টিকর্তা নিজেই বলেছেন, ‘তিনি পৃথিবীকে সৃষ্ট জীবের জন্য স্থাপন করেছেন।’ (সূরা আর রহমান, আয়াত-১০) [মাওলানা মোহাম্মদ মোবারক করিম (দেওবন্দ) কর্তৃক বঙ্গানুবাদকৃত নূরানী কুরআন শরিফ থেকে উদ্ধৃত] পৃথিবীর শক্তিমান রাষ্ট্রগুলো কোটি কোটি বিলিয়ন ডলার খরচ করে চন্দ্র, মঙ্গল গ্রহসহ অনেক গ্রহ-নক্ষত্র পরীক্ষা করে এখন পর্যন্ত কোনো জীব বা প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছে না। প্রসঙ্গত, ইসলাম ধর্মের বিরোধিতাকারী বিধর্মীরা বহু চেষ্টা করেও পবিত্র কুরআন মজিদের কোনো বাক্য মিথ্যা প্রমাণ করতে পারেনি এবং পারবেও না, ইনশা আল্লাহ। কারণ আল্লাহপাক কুরআন মজিদ সম্পর্কে নিজেই বলেছেন, ‘এ সেই কিতাব, যাতে কোনো সন্দেহ নেই’। ( সূরা বাকারা, আয়াত-২)

মানুষের মুখের চামড়ার ভেতরে এক প্রকার ক্ষদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী বসবাস করে বলে সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন। পৃথিবীতে অনেক সৃষ্টজীব রয়েছে যা এখনো বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে পারেননি। নাম, ধরন, গঠন প্রকৃতি, আচরণ, যাই হোক না কেন, যার জীবন আছে সেটাই প্রাণী। প্রাণিজগতে দুই শ্রেণির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। এক শ্রেণীর প্রাণী স্বভাবগতভাবে হিংস্র। আরেকটি শ্রেণী রয়েছে যারা আত্মরক্ষার জন্য হিংস্র হয়ে ওঠে। জানা মতে, পৃথিবীতে এক প্রকার প্রাণী রয়েছে যারা শুধু বাতাস খেয়ে বাঁচে। অন্যরা কেউ মাংসভোজী বা কেউ তৃণভোজী।

কুরআন মজিদে স্বীকৃত মতে, জিন ও মানুষ আল্লাহ পাক সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। জিন কিন্তু ধরা বা ছোঁয়া যায় না, তবে কথিত আছে- জিন যেকোনো প্রাণীর রূপ ধারণ করতে পারে। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু ২০০ বছর আগে আবিষ্কার করেছেন, ‘গাছেরও প্রাণ আছে’। পবিত্র কুরআন মজিদে এক হাজার ৫০০ বছর আগে উদ্ধৃৃত করা হয়েছে যে, ‘গাছ সৃষ্টিকর্তাকে সেজদাহ করে’। (সূরা আর রহমান, আয়াত-৬)

মানুষ একপ্রকার প্রাণী বা জীব। সব প্রাণীর মতোই যার জন্ম এবং মৃত্যু রয়েছে। তবে মানুষ সামাজিক জীব। কারণ মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে জীবন ধারণ করে। পৃথিবীর অনেক প্রাণী রয়েছে যারা দলবেঁধে চলাফেরা করে। বিভিন্ন প্রজাতির পাখি রয়েছে যারা দলবেঁধে আকাশে বিচরণ করে। তবে মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা বিবেচিত হলো কেন? কারণ মানুষকে যে বিবেক, বুদ্ধি বা চিন্তা করার শক্তি দেয়া হয়েছে তা অন্য কোনো প্রাণীকে দেয়া হয়নি। মানুষ একটি জীব বা প্রাণী এবং মানুষের বিবেকসম্মত মানবিক গুণাবলির কারণেই মানুষ সৃষ্টির সেরা। অথচ বিবেকহীনতা এবং অমানবিকতা টপ টু বটম অনেক মানুষের মধ্যেই বেশি যা হিংস্র প্রাণীর চেয়েও বেশি।

এখন বিবেচনায় নিতে হবে যে, শারীরিক গঠন মানুষ আকৃতির হলেও যদি তার মধ্যে বিবেক ও মানবিক গুণাবলি না থাকে তবে তাকে কি সৃষ্টির সেরা মানুষ বলা যায়? ‘সৃষ্টিকর্তা তার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন। (সূরা বাকারা, আয়াত-৩০) অথচ প্রতিনিধিত্ব করার পরিবর্তে পৃথিবীর যত ধ্বংস সব মানুষ দ্বারাই হয়েছে। একজন মানুষ এবং একজন পশু বা অন্য প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য কোথায়? মানুষের চেয়ে অনেক প্রাণীর দৈহিক ক্ষমতা বা সক্ষমতা অনেক বেশি। তারপরও মানুষ শ্রেষ্ঠ এই কারণে যে, সৃষ্টিকর্তা মানুষকে বিবেক ও বিচার-বুদ্ধি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। দৈহিকভাবে সক্ষম শক্তিশালী হলেও যে মানুষের বিচার বিবেচনা করার বুদ্ধি নেই তাদেরকে প্রতিবন্ধী বলা হয়ে থাকে এবং প্রতিবন্ধীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য রাষ্ট্রীয় খরচে বিশ্বব্যাপী কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। কিন্তু যে মানুষ তার বিবেকের সাথে প্রতারণা করছে সৃষ্টির সেরা ‘মানুষ’ হিসেবে তার অবস্থান কোথায়?

চোখের সামনে অনেক ঘটনা ঘটছে, অথচ প্রতিবাদ করার মানসিকতা মানুষ হারিয়ে ফেলেছে, এ ঘটনাগুলো ঘটছে সবল-দুর্বল সবার বেলায়। সমাজে যারা প্রভাবশালী, ক্ষমতাবান তারাও তো একই রোগের রোগী। এখন কেউ ‘সত্য’ বলতে চায় না। স্বার্থের দ্বন্দ্বে ক্ষমতাশালীরা হয় সঙ্ঘাতে (Conflict) জড়াচ্ছে, নতুবা আপস মীমাংসা (Compromisc) করে চলছে, যার পেছনে একটিমাত্র কারণ- স্বার্থ আর স্বার্থ। ন্যায়-অন্যায়ের এখানে কোনো বাছবিচার নেই। সত্য-মিথ্যার ধার এখন কেউ ধারতে চায় না। শুধু স্বার্থ হাসিল হলেই হলো।

আইন যারা প্রণয়ন করেন (ক্ষমতাসীনরা) তারা বলেন, ‘জনস্বার্থে আইন প্রণয়ন করা হলো’। অথচ আইন যারা প্রয়োগ করেন তারা যা করেন তা শুধু ক্ষমতাসীনদের তাঁবেদারি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগে ‘বিবেক’ কোনো কাজ করে না। শুধু টুপাইস কামাই এবং ক্ষমতাসীনদের তুষ্ট রেখে সিনিয়র ডিঙ্গিয়ে প্রমোশন নেয়াটাই যেন আইন প্রয়োগকারীদের একমাত্র কাজ, যারা এ কাজটুকু করতে পারে না তাদের প্রমোশন বা লোভনীয় পদে পোস্টিং হয় না। যারা বিরোধী দলে রয়েছে তারা আহত বা কোনো প্রকার ক্ষতিগ্রস্ত হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে থানায় তাদের মামলা নেয় না। পুলিশ কথায় কথায় বলে, ওপর থেকে নির্দেশ নিয়ে আসেন। যত ওপরে যাবেন সেখানেই ক্ষমতাসীনদের তাঁবেদার বেশি সংখ্যক পাওয়া যাবে।

রাষ্ট্রের পক্ষে যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদের প্রতিটি কর্ম জবাবদিহিমূলক, সে জবাবদিহি শুধু উপরস্থ কর্মকর্তার কাছে নয় বরং নিজের বিবেকের কাছেও জবাবদিহিমূলক হতে হবে। কেউ যদি তার বিবেকের কাছে সঠিক সিদ্ধান্ত চায় তবে ‘বিবেক’ সত্য ও ন্যায়ের পক্ষেই সাড়া দেয়। কোনো মানুষের কাছে স্বার্থ যখন বড় হয়ে দেখা দেয় তখন বিবেক পরাজিত হয়ে যায় এবং তখনই ঘটে ক্ষেত্র বিশেষে বিপর্যয়।
বিজ্ঞানীরা রোবট আবিষ্কার করেছেন, ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী এর কর্মপরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষের মতোই অঙ্গভঙ্গি করে রোবট নির্ধারিত কর্ম সম্পাদন করে যা মানুষের Replacement হয়। কিন্তু মানুষের যা রয়েছে তা রোবটের নেই, তা হলো ‘বিবেক’ এবং মানবিক গুণাবলি। একটি প্রোগ্রাম সেট করে রোবটকে যে নির্দেশাবলি দেয়া হয় এর বাইরে সে কিছু করতে পারে না। কারণ তার নিজস্ব কোনো চিন্তাশক্তি নেই, যা মানুষের মধ্যে রয়েছে এবং অন্যান্য প্রাণীর মধ্যেও নেই, অন্যান্য প্রাণী শুধু গতানুগতিক চলাফেরা করতে পারে। আমাদের দেশের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একটি রোবটের মতোই জড়পদার্থে পরিণত হয়েছে। মুষ্টিমেয় হাতেগোনা কিছু লোক ছাড়া সবাই রোবটের মতো প্রোগ্রাম ফলো করে যারা বিবেক বা মানবিক গুণাবলি দিয়ে কোনো কিছুই বিচার-বিশ্লেষণ করে না। তারা মনে করে, ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবহ থাকতে পারলেই অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরবর্তী বংশধরসহ তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ থাকবে। তারা ন্যায়-অন্যায়ের ধার ধারে না, ক্ষমতাসীনদের তোষামোদি ও তাঁবেদারির প্রতিযোগিতায় তারা ব্যস্ত। রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যতীত পৃথিবীতে সর্বত্রই চলছে রাজনৈতিক সরকার। রাজনৈতিক সরকারগুলো মুখে মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও কোথাও কোথাও গণতন্ত্রের ‘গ’ বলতে কিছুই নেই, মুষ্টিমেয় কিছু রাষ্ট্র ব্যতীত। লিখিত-অলিখিত সব রাষ্ট্রের সংবিধান রয়েছে, যাতে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হলেও পরবর্তীতে নিবর্তনমূলক আইন করে সংবিধানের মৌলিক অধিকার সংবলিত ধারাগুলোকে প্রতিহত করা হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই বরং অগ্রগামী। এ কারণেই বিশ্ব পরিক্রমায় গণতন্ত্রের চর্চায় রাষ্ট্র তালিকায় বাংলাদেশের স্থান একেবারে তলানিতে। মন্ত্রীদের মুখে মুখে গণতন্ত্রের যে ফেনা ওঠে, বাস্তবতা তার উল্টো। যে রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মানবিক মূল্যায়ন ও বিবেক দ্বারা তাড়িত না হয়ে রোবটের মতো তাদের দায়িত্ব পালন করে তখন সে রাষ্ট্রের ভিন্নমতাবলম্বীদের পরাধীন রাষ্ট্রের নাগরিকের মতো জীবন ধারণ করতে হয়। স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হয়েও স্বাধীনতার সুফল দল-মত নির্বিশেষে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছায় না। তখন ক্ষমতাসীনদের সাথে রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা ভোগ করে তাদের আজ্ঞাবহ আমলা অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় বেতনভুক্ত কর্মচারীরা, যারা তাঁবেদারির দৌড় প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকে তাদের প্রমোশন বা লোভনীয় পদে পোস্টিং উভয়ই ভাগ্যে জোটে না। একজন ব্যক্তি তখনই ‘মানুষ’ হিসেবে বিবেচিত হবে যখন তার বিবেক ও মানবিক গুণাবলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর থেকে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবে। একজন মানুষের প্রধান পরিচয় তার বিবেক ও মানবিক গুণাবলি। সাংবিধানিকভাবে ‘স্বাধীন’ ও ‘নিরপেক্ষ’ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যখন ‘বিবেক’ বিক্রি করে ফেলে তখন কাগজ-কলমে যা-ই থাকুক না কেন, বাস্তবে হয় তার উল্টো এবং বাংলাদেশে তাই ঘটছে।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
৮ মেগা প্রকল্পের নথি তলব দুদকের প্রত্যেক ধর্মের শান্তির বাণী নিজের মধ্যে স্থাপন করতে হবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ছক আ’লীগের গণহত্যায় জড়িতদের জায়গা হবে না বিএনপিতে : ফখরুল আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানো সাবেক এমপি ও ৪ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পরোয়ানা আমাদের শাসক আমরা ঠিক করব ভারত নয় : ডা: শফিক প্রত্যর্পণের অনুরোধের বিরুদ্ধে হাসিনাকে কোর্টে যেতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের পরামর্শ স্বতন্ত্র বিচার বিভাগ ও বিচারপতি নিয়োগ কাউন্সিল গঠন দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত শেখ হাসিনা-জেল সুপারসহ ৬৩ জনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন চিঠির জবাব পেলে হাসিনাকে ফেরানোর পরবর্তী পদক্ষেপ

সকল