২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

একটি রামছাগলের আত্মকথা

একটি রামছাগলের আত্মকথা - ছবি : সংগৃহীত

পুরান দিল্লির মেহরোলিতে যে সময়ে আমার জন্ম হয়েছিল, তখন তোমাদের দেশের টাউট-বাটপাড়, দুর্নীতিবাজ-আমলা-কামলা-রাজনীতিবিদরা সেনাবাহিনীর তাড়া খেয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছিল। এদের বিরাট অংশ দিল্লির নিজামউদ্দিন, কারলবাগ, পুরনো রেলস্টেশনসহ জনবহুল এলাকাগুলোতে লুকিয়ে থাকত। কেউ কেউ অবশ্য আজমীর, মুম্বাই, কলকাতা, আগরতলা ইত্যাদি অঞ্চলেও ছিল। কিন্তু যারা নিজামউদ্দিন এলাকায় বাস করত তারা বেশির ভাগ সময় চকবাজার, লালকেল্লা, শাহী মসজিদ এবং নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজারে ঘোরাঘুরি করত।

তোমরা যারা ওই সব এলাকায় গিয়েছ তারা নিশ্চয়ই জানো যে, ওখানে পৃথিবীর সুন্দরতম রামছাগলগুলো যেভাবে ঘুরে বেড়ায় তা পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে দেখা যায় না। দিল্লির মেহরোলির রামছাগলের নামডাক সারা ভারতবর্ষে মশহুর। এগুলো দেখতে খুবই সুন্দর-মায়াবী এবং আকার আকৃতিতে অনেকটা মাঝারি আকৃতির গরুর মতো হয়। এগুলোর শরীরের গন্ধ নেই বললেই চলে- গোশত খুবই নরম ও সুস্বাদু। ফলে মানুষ হরিণের মতো শখ করে এসব রামছাগল পোষে এবং পরে কোরবানির হাট-মন্দিরের বলি দান অথবা ভূরিভোজের জন্য ব্যবহার করে।

তোমাদের দেশের এক হাবাগোবা অথচ গোঁয়ার গোবিন্দ প্রকৃতির দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদের সাথে অতি শৈশবে আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। আমি দেখতাম, লোকটি সকাল এবং বিকেলের একটি নির্দিষ্ট সময়ে নিজামউদ্দিনের মাজার গেটের পান-সিগারেটের একটি দোকানে বসে বিষণ্ন মনে সিগারেট ফুঁকত এবং একের পর এক পান মুখে পুরে পানের পিক দিয়ে ফুটপাথ নষ্ট করত। লোকটাকে আমার বিরক্তিকর মনে হতো; আবার মায়াও লাগত। তাই একদিন তার কাছাকাছি গিয়ে তার শরীরের সাথে আমার শরীর আলতোভাবে ঘষাঘষি শুরু করলাম এবং অস্ফুট স্বরে ‘ম্যা ম্যা’ শব্দ করতে থাকলাম। লোকটি হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরল এবং পরম মমতায় আমাকে এমন আদর শুরু করল, যা সাধারণত রামছাগলের বাবা-মায়েরাই করে থাকে।

এ ঘটনার পর আমি সারাক্ষণ লোকটিকে সঙ্গ দিতে থাকি। আমার শিশুসুলভ লম্ফঝম্ফ, হাঁকডাক এবং চঞ্চলতা সম্ভবত তার প্রবাস জীবনের নিঃসঙ্গতার মহৌষধ হিসেবে কাজ করতে আরম্ভ করল। ফলে সে আমার প্রেমে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গেল যে, আমার মালিকের কাছ থেকে অতি চড়ামূল্যে আমাকে কিনে আমাকে তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী বানিয়ে নিলো। সে আমাকে তার শোবার ঘরে স্থান দিলো এবং আমার খাওয়াদাওয়া, বিশ্রাম, শরীরচর্চা নিয়ে এমন আদিখ্যেতা দেখাতে আরম্ভ করল যা দেখে তার পাড়া প্রতিবেশীরা তাকে আদর করে রামছাগলের বাবা বলে সম্বোধন শুরু করল। ফলে আমিও তাকে মনেপ্রাণে বাবা হিসেবেই তোয়াজ-তদবির অথবা মান্যগণ্য শুরু করলাম।

আমার মানুষরূপী বাবার কষ্টের দিন সম্ভবত শেষ হতে চলছিল। কারণ সে একদিন আমাকে বলল- বাবা কেষ্ট! আমরা দেশে ফিরে যাচ্ছি। তোমার বাবা এমপি হবে, মন্ত্রী হবে। তখন দেখবে জীবনে আনন্দ এবং ফুর্তি কত প্রকার এবং কী কী। তার কথাগুলো শোনার পর উদাস নয়নে তার দিকে তাকালাম এবং কণ্ঠে একধরনের বিচ্ছেদের বেদনা ফুটিয়ে তুলে করুণ কণ্ঠে ডেকে উঠলাম ‘ম্যাহাহা-ম্যাহাহা’। আমার বাবা আমাকে কোলে তুলে নিলো এবং বলল, তোর জন্য আলাদা পাসপোর্ট বানাব- তারপর প্লেনে করে তোকে রাজপুতের মতো দেশে নিয়ে যাবো।

বাবা অনেকটা সিনেমার স্টাইলে আমাকে কোলে করে দেশে ফিরলেন। তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য যত লোক বিমানবন্দরে এসেছিল তা দেখে আমি যতটা না আশ্চর্য হলাম তার চেয়েও বেশি আশ্চর্য হলো উপস্থিত লোকজন। তারা তাদের নেতার কোলে একটি রামছাগলের বাচ্চাকে দেখার পর যারপরনাই আশ্চর্য হলো এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। উপস্থিত লোকজনের মধ্যে কয়েকজন ছিল অতি চালাক, যারা সম্ভবত আমির খান ও নাসির উদ্দিন শাহ অভিনীত বিখ্যাত হিন্দি সিনেমা ‘সরফরাজ’ দেখেছিল। সেই সিনেমাতে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের ডন নাসির উদ্দিন শাহের কোলে যেভাবে একটি বাচ্চা রামছাগল শোভা বর্ধন করেছিল, ঠিক একইভাবে আমিও হয়তো আমার পিতার কোলের শোভা বর্ধন করেছিলাম।

দেশের মাটিতে পা রেখে পিতা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন। তিনি অশ্রুসজল নেত্রে আশপাশে তাকান এবং আমাকে সজোরে বুকের সাথে চেপে ধরে নিজের মানবিক আবেগকে পশুর স্পর্শে প্রকাশের চেষ্টা চালান। তার সঙ্গী-সাথীরা আমার গুরুত্ব বুঝে গিয়েছিল। সুতরাং তাদের মধ্যে দু-একজন সাহস করে এগিয়ে এলো নেতার কোল থেকে আমাকে তাদের কোলে তুলে নেয়ার জন্য। কিন্তু আমি তাদের কাউকে সে সুযোগ দিলাম না। কারণ ছাগল হলেও আমি এ কথা বুঝে গিয়েছিলাম যে, বাবার কোল ছেড়ে যদি তার চামচাদের কোলে উঠি, আমার পরিণতি ভালো হবে না। বাবা আমার মনের অবস্থা বুঝলেন। সুতরাং তিনি হাতের ইঙ্গিতে চামচাদের নিবৃত্ত থাকার নির্দেশ দিলেন এবং আমাকে কোলে করেই গাড়িতে উঠলেন ও রাজকীয় বহরসমেত তার বিলাসপূর্ণ প্রাসাদে ফিরলেন।

নিজের জন্মভূমি ছেড়ে বাবার ভূমিতে আসার পর ধীরে ধীরে শিশু থেকে কৈশোরে এবং কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ করলাম। আমার নাদুস নুদুস দেহ, উজ্জ্বল গায়ের রঙ এবং শক্ত মজবুত দুটো শিংয়ের সাথে মানানসই লম্বা দুটো কানের সৌন্দর্য যখন মানুষ দেখত তখন সবাই অবাক হয়ে দুটো কথাই বলত- রামছাগল যদি কেউ লালন পালন করতে চায় তবে দিল্লির মেহরোলির ছাগলই পালন করা উচিত। দ্বিতীয়ত, রমাছাগলের বুদ্ধি-প্রভাব এবং প্রতিপত্তি যে এত বেশি হতে পারে তা কেষ্ট বেটাকে না দেখলে কেউ আন্দাজ করতে পারবে না।

পিতৃভূমিতে আমার ক্ষমতা বা আধিপত্য বলতে গেলে জ্যামিতিক হারে বাড়তে লাগল। আমার ধর্মপিতা মনে করতেন, তার সৌভাগ্যের পেছনে রয়েছি আমি। কোনো অলৌকিক ক্ষমতা হয়তো আমার ওপর ভর করে আছে যার স্পর্শে দিল্লির নিজামউদ্দিন এলাকার ফুটপাথের পান বিড়ির দোকানে বসে অবহেলিত ও অপমানিত প্রবাস জীবন কাটানো একজন মানুষ নতুন করে সব কিছু ফিরে পেয়েছিল। আমার ধর্মপিতা গর্ব করে বলে থাকেন, তোমরা যাকে রামছাগল বলো সে মূলত আমার জীবন পরিবর্তনকারী একটি উপসর্গ। সেদিন কেষ্ট যখন ছাগলশাবকরূপে আমর কাছে এসে ওর শরীর দিয়ে আমার শরীরে ঘষা দিয়েছিল সেদিনই আমি বুঝেছিলাম যে, আমার অর্থ বিত্ত পদ-পদবি ক্ষমতা এবং প্রভাব প্রতিপত্তির বীজ রামছাগল শাবকরূপে কোনো শক্তিধর সত্তা আমার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো!

পিতৃদেবের কথা শুনে তার চ্যালা চামুণ্ডারা ভক্তিতে গদ গদ হয়ে আমাকে যেভাবে পুজো অর্চনা শুরু করে দিলেন, তাতে মনে হলো, পুরো রাজ্যটিই রামপাগলের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়ে গেছে। ছাগল নিয়ে মানুষের অভিমতের আদিখ্যেতা দেখার পর নিজেও বিভ্রান্ত হতে শুরু করলাম। আমার মনে হতে থাকে, আমাকে যারা তোয়াজ-তদবির করে আমি নিশ্চয়ই তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং তারা যেভাবে আমার লেজ শিং পশম ইত্যাদি নিয়ে বাড়াবাড়ি করে তা দেখে প্রথম প্রথম আমার ভারি লজ্জা হতো। অনেক বড় বড় মানুষ নিজেদের নিরাপত্তার জন্য আমার একটি লোম তাবিজের মধ্যে ঢুকিয়ে নিজেদের হাতে, গলায় বা কোমরে বুলিয়ে রাখত। অনেক দুর্বলচিত্তের মানুষ নিজেদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য খাঁটি সরিষার তেলের বোতল নিয়ে আসত। তারপর সেই বোতলের মধ্যে আমার একটি শিং ঢুকিয়ে বোতলের তেল পবিত্র করত এবং রাত-বিরাতের দুঃসাহসী কর্মে যাওয়ার আগে সেই তেল গায়ে মেখে তারপর ঘর থেকে বের হতো। তারা আমার লেজটিকে মনে করত, রক্ষাকবজ। জাদুটোনা-বদনজর ইত্যাদি থেকে বাঁচার জন্য তারা পরম ভক্তিভরে নিজেদের গাল, চোখ এবং বুকে আমার লেজের স্পর্শ লাগিয়ে একধরনের নিরাপত্তা বোধ করত। এসব কারণে আমার পিতৃদেবের এলাকার বেশির ভাগ মানুষের মানবিক সত্তা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে। বিশেষ করে আমার পিতৃদেব এবং তার ক্ষমতাধর চ্যালা চামুণ্ডারা বিবেক বোধ হারিয়ে ফেলেন। তাদের চাল-চলন, কথা-বার্তা, পোশাক-আশাক ইত্যাদির মধ্যে কোনো মানবিক যোগসূত্র ছিল না। নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য, বুদ্ধি-প্রজ্ঞা এবং শ্রম করার চিরায়ত অভ্যাসকে কবর দিয়ে তারা ছাগলকেন্দ্রিক নিয়তিনির্ভর হয়ে পড়েন। তারা এমন সব কর্ম শুরু করেন, যা দিল্লির রামছাগল দূরের কথা তোমাদের দেশের ক্ষুদ্রকায় বকরি খাসি বা পাঁঠারাও করে না। ফলে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার জনজীবনে গহিন অরণ্যের অন্ধকারময় বিভীষিকা ও নৈরাজ্য নেমে আসে।

প্রথম দিকে অতিমাত্রায় পাত্তা পেয়ে আমি একধরনের আত্মতুষ্টিতে ভুগতাম। কিন্তু কালের পরিক্রমায় বুঝতে পারি যে, এক ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে আমরা সবাই এগোচ্ছি যেখান থেকে পরিণতি ভোগ না করে ফিরে আসা সম্ভব নয়। আগেই বলেছি, আমার পিতৃদেব বোকাসোকা প্রবৃত্তির মানুষ। তার গোঁয়ার গোবিন্দ স্বভাবের কারণে মাঝে মধ্যে এমন সব কাণ্ড করে বসেন যা সাধারণত শয়তানরাও করতে সাহস পায় না। অন্য দিকে পিতৃদেব যেমন তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুটা রামছাগলের বাচ্চার অলৌকিক ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস রেখে করেছিলেন তদ্রুপ সঙ্গী সাথী হিসেবে তার চেয়েও বোকাসোকা ও গোঁয়ার গোবিন্দদের ক্ষমতা দিয়েছিলেন। ফলে তাদের জীবনে যখন মধুমাস চলছিল তখন তারা মানবিক কর্মকাণ্ড পরিহার করে পাশবিক আচার আচরণকে প্রাধান্য দিয়ে পুরো পরিস্থিতি এতটা জটিল করে ফেলেছেন যা সমাধান করার সাধ্য আমাদের কারো হাতে নেই।

এ পরিস্থিতিতে পুরো প্রকৃতি ও পরিবেশ ক্ষোভের আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে। মানুষ বৃক্ষলতা পশুপাখি কীট-পতঙ্গ, নদী-সমুদ্র পাহাড় অর্থাৎ প্রকৃতি ও পরিবেশের সব সদস্য আমার ওপর এবং আমার পিতৃদেবসহ তার চ্যালা চামুণ্ডাদের ওপর বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। ফলে যখন বৃষ্টি বা বজ্রপাত শুরু হয় তখন বুঝি, আকাশের ওই বারিধারা এবং আগুনের ফুলকির মধ্যে কী পরিমাণ প্রাকৃতিক ক্রোধ লুকায়িত রয়েছে। যখন সূর্যের খরতাপে বাতাসে জলীয়বাষ্পের অভাব দেখা দেয় অথবা ভূমিতে কাঁপন শুরু হয়, তখন রামছাগল হওয়া সত্ত্বেও আমি বুঝি যে, আমরা সবাই নিয়তির জালে আটকে গেছি। যখন দেখি, মানুষগুলো ছাগলের তাঁবেদারি করছে এবং ছাগলের হাতে নিজেদের ভাগ্য সঁপে দিয়ে বোবা ও বধিরের মতো আচরণ করছে তখন ভয়ে আমার খাওয়াদাওয়া হারাম হয়ে যায়। ফলে হাজারো ছাগলপ্রেমীর দায়দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে মৃত্যুভয়ে ক্রমাগত শুকিয়ে যাচ্ছি; অথচ আমার অনুসারীরা ঠিকই নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে এবং মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের সদস্য হয়ে এমন স্ফীত হচ্ছে যার মূল্যায়ন কেবল কোরবানির হাটেই হতে পারে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement
তিব্বতে বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ বাঁধ তৈরি করবে চীন মির্জাপুরে যৌথ অভিযানে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বনভূমি উদ্ধার সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ জামায়াতের কাকরাইল মসজিদে সাদপন্থীদের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ শ্রীনগরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে যুবকের মৃত্যু ভান্ডারিয়ায় জামায়াতের কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত ট্রাকচাপায় ফায়ার ফাইটার নিহতের ঘটনায় মামলা ইরানের কাছে ৩০০ বিলিয়ন ক্ষতিপূরণ দাবি করল সিরিয়ার নতুন সরকার সচিবালয়ে আগুন : ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে ৩ মন্ত্রণালয়ের কমিটি নিহত ফায়ার ফাইটার নয়নের পরিবারে শোকের মাতম এক কার্গো এলএনজি ও এক লাখ ৩০ হাজার টন সার কিনবে সরকার

সকল