২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

দেশে গবেষণার পরিবেশ

দেশে গবেষণার পরিবেশ - ছবি : সংগৃহীত

“আমরা মেধাকে রাজনীতিকরণ করছি। আমরা এখন ছাত্রদের বিজ্ঞান পড়ানোর চেয়ে বিবিএ পড়াতে বেশি আগ্রহী। আমরা গবেষক তৈরি করতে চাই না, চাই ব্যবসায়ী তৈরি করতে। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যথাযথ মূল্যায়ন করতে না পারলে দেশকে প্রকৃত অর্থে সমৃদ্ধ করতে পারব না। দেশের পরিচালকরা এটা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন তত মঙ্গল। অর্থনৈতিকভাবে দেশ অনেক এগিয়েছে। আমরা মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে চলেছি। তাই গবেষণা ও উন্নয়ন খাতের প্রতি আমাদের নীতিনির্ধারকদের আরো ঘনিষ্ঠ মনযোগ ও সুদৃষ্টি দিতে হবে”

ছেলেবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল গবেষক হওয়ার। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ঠিক আগে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগে ভর্তি হই। ১৯৭২ সালে ক্লাস শুরু হয়। ১৯৭৫ সালে আমাদের অনার্স শেষ হয় এবং প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়ার সুবাদে আমি উচ্চতর গবেষণা করার সুযোগ পাই। তখন মাত্র একজন ছাত্রকেই ওই সুযোগ দেয়া হয়েছিল। আমার গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা বিজ্ঞানী প্রফেসর আব্দুল জাব্বার। তাকে ফার্মেসি বিভাগের জনক বলা হয়। তার নেতৃত্বে ১৯৬৪ সালে এই বিভাগ যাত্রা শুরু করে। আমি মাস্টার্স পর্যায়ে দুই বছর গবেষণা করার সুযোগ পাই। আমাদের দেশে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে কোনো গবেষণা হয় না। আমার গবেষণার বিষয় ‘ন্যাচারাল প্রডাক্ট কেমিস্ট্রি’ (plant products chemistry)। উদ্ভিদ থেকে রোগ নিরাময় বা মানুষের জন্য উপকারী রাসায়নিক উপাদানগুলো খুঁজে বের করতে বিজ্ঞানের এই শাখার গবেষকরা কাজ করেন। আমার প্রথম গবেষণা ছিল উদ্ভিদ থেকে ক্যান্সার-প্রতিরোধক উপাদান খুঁজে বের করা। আমি টগর ফুলের বীচি থেকে ক্যান্সার প্রতিরোধক উপাদান নিষ্কাশন করি। পরে জাব্বার স্যার আমাকে আমের বীচি থেকে ক্যান্সার প্রতিরোধক উপাদান বের করার কাজ দিয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালে প্রথম শ্রেণীতে এম ফার্ম ডিগ্রি লাভ করি। একই বিভাগের শিক্ষক হিসেবে আমার কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৭৮ সালের জানুয়ারিতে।

আমাকে এই পেশায় যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করেছেন আমার বাবা সাবেক আইন সচিব বিচারপতি মো: আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী। তিনি আমাকে কখনো সরকারি চাকরির জন্য উৎসাহিত করেননি, বিসিএস দিতে বলেননি বা জুডিশিয়াল সার্ভিসেও যেতে বলেননি। বলতেন, তুমি ভালো ছাত্র, পিএইচডি করো, শিক্ষকতা করো। তাই আমি বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নিয়ে শিক্ষক হয়েছি। সুযোগ পেয়ে শিক্ষক হইনি। আমার অন্য পেশায় যাওয়ার সুযোগ ছিল, বিদেশে চলে যাওয়ার অনেক সুযোগ ছিল। আমার সহপাঠীদের প্রায় সবাই এখন ইউরোপ আমেরিকায় সুপ্রতিষ্ঠিত। আমি নিজের সফলতা তুলে ধরতে এই কথাগুলো বলছি না, এগুলো বলছি তরুণ প্রজন্মকে গবেষণায় উৎসাহিত করার জন্য। দেশে কেন গবেষণা কম হচ্ছে, এর ভবিষ্যৎ কি, ইত্যাদি সম্পর্কে অনেক পাঠক আমার কাছে জানতে চেয়েছেন। তাদের জন্যও কিছু কথা বলা।

গবেষণাজগতে ‘ড্রাগ ডিসকভারি’ নামে একটি পরিভাষা আছে। সেই প্রাচীনকাল থেকে মানুষ রোগ নিরাময়ে উদ্ভিদ ব্যবহার করছে। এখনো বিশ্বে যত ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে তার প্রায় ৬০ শতাংশ এসেছে গাছপালা থেকে। কোন উদ্ভিদের উপাদানে কোন রোগ নিরাময় ক্ষমতা রয়েছে সেটি আবিষ্কারের জন্য গবেষণা করেন প্রধানত ন্যাচারাল প্রডাক্ট কেমিস্টরা। তারা ওই সব উপাদান নিষ্কাশন ও সেগুলোর রাসায়নিক-গাঠনিক কাঠামো নির্ণয় করেন। এটি করা হয় মূলত উপাদানটি কৃত্রিমভাবে উৎপাদনের জন্য। কারণ উদ্ভিদ থেকে সংশ্লিষ্ট উপাদান নিষ্কাশন করে তা দিয়ে আমাদের চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। শুধু উপাদানের গাঠনিক কাঠামো নির্ণয়ই নয়, এটি মডিফাই করে গুণাগুণ বৃদ্ধি করা হয়। এরপর আরো নানা পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কার্যকর প্রমাণিত হলে সেটি যথাযথ ওষুধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে নিয়ে আসা হয়। বিশ্বের অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠান ‘ড্রাগ ডিসকভারি’ প্রোগ্রামে জড়িত। বিশ্বে ওষুধ আবিষ্কারের প্রায় ৮০ শতাংশ হয়েছে আমেরিকায়। বাকি ২০ শতাংশ সারা বিশ্বে। চীনারাও এ ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে। প্রাচীনকাল থেকে তারা ভেষজ ওষুধের জগতে সমৃদ্ধ। চীনের মহিলা বিজ্ঞানী তু ইউইউ (Tu Youyou) ম্যালেরিয়া নিরাময়ে খুবই কার্যকর ওষুধ আর্টিমিসিনিন (Artemisinin) আবিষ্কার করেছিলেন ‘সুইট ওয়ার্মউড’ নামক (বৈজ্ঞানিক নাম Artemisia annua) গুল্মজাতীয় গাছ থেকে। চীনের দেশীয় বা প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতিতে ম্যালেরিয়া নিরাময়ে প্রাচীনকাল থেকে এই গাছ ব্যবহৃত হচ্ছে। মজার বিষয় হলো, তু ইউইউ তার আবিষ্কারটি করেছিলেন ১৯৭২ সালে, তরুণ বয়সে। তাকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় ২০১৫ সালে, বয়স যখন আশির কোটায়।

উদ্ভিদ নিয়ে কাজ করতে আমার উৎসাহের পেছনে ছিল বাংলাদেশের সমৃদ্ধ উদ্ভিদ-বৈচিত্র। আমাদের হেকিম, কবিরাজ বা গ্রাম্য চিকিৎসকরা যেসব গাছগাছালি দিয়ে চিকিৎসা করেন সেগুলোর রোগনিরাময় ক্ষমতাকে বৈজ্ঞানিক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে এসে আরো সমৃদ্ধ উপায়ে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানোর চেষ্টা ছিল আমার। আমি পেপে পাতাকে ক্যাপসুল আকারে ব্যবহারযোগ্য করে নিয়ে আসি, যেটি একজন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ রোগিদের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর এর উপর লেখা বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ একটি জার্নালে প্রকাশ করি। বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদনের পর সম্প্রতি ‘পাপায়া’ নামে বাংলাদেশের একটি কোম্পানি এই ওষুধ তৈরি ও বাজারজাত করছে। এটি রক্তে প্লাটিলেট (platelet) বাড়ায়। কেউ ক্যান্সারে বা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তার প্লাটিলেট কমে যায়। ফলে তাকে প্লাটিলেট ঠিক রাখার জন্য ওষুধ খেতে হয়। বিদেশ থেকে এই ওষুধ কিনতে হলে অনেক দাম পড়ে যায়। ওষুধটি দেশে এখন সস্তায় তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। পেপে পাতার এই গুণ সম্পর্কে আমাদের দেশীয় হেকিম-কবিরাজরা আগে থেকেই জানতেন।

১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে পিএইচডি করতে আমি যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোতে স্ট্র্যাথক্লাইড বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। সেখানে গিয়ে আমার বড় যে উপকারটি হয়েছে তা হলো সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে শেখা। ব্রিটেন আরঅ্যান্ডডি (রিসার্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট) ব্যয়কারী শীর্ষ ১০টি দেশের একটি। এই খাতে তারা বছরে প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে। এরপরও তারা কৃচ্ছ্রতার মধ্যে কাজ করতে অভ্যস্ত। গবেষণাকাজে কী পরিমাণ দ্রাবক ব্যবহার করব, কতটুকু রাসায়নিক যৌগ ব্যবহার কর যাবে সব কিছুতে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ ছিল। জাপান সেরকম নয়। সেখানে গবেষকদের ইচ্ছে মতো গবেষণার উপাদান ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। ১৯৯০ সালে পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপ করতে আবারো স্ট্র্যাথক্লাইড বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। আমার অনেক কলিগ ও ছাত্র একই বিষয়ে সেখানে গবেষণা করেছে এবং করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আমি গবেষণা শুরু করি তখন সমস্যার অন্ত ছিল না। ছাত্র-গবেষক আমি একা। প্রয়োজনীয় সব রাসায়নিক উপাদান মেলে না। যন্ত্রপাতি নেই। পিএইচডি করে দেশে ফেরার পরও অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়নি। ৮০’র দশকের কথা বলছি। প্রথমদিকে আমি যৌগের গাঠনিক কাঠামো বের করার জন্য (spectrometric techniques) ইংল্যান্ডে আমার পিএইচডি প্রফেসরের কাছে স্যাম্পল পাঠাতাম। সম্ভবত ১৯৯২ এর দিকে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি বাংলাদেশে আসে। তখন বিস্কুটের মোড়ক থেকে প্লাস্টিকের ফয়েল কেটে তাতে ৩, ৪ বা ৫ মি. গ্রাম স্যাম্পল ভরে ছুরির অগ্রভাগ আগুনে গরম করে ফয়েলের চারদিক আটকাতাম। এরপর সেটা চিঠির সাথে স্কচ টেপ দিয়ে লাগিয়ে খামে পুরে পাঠাতাম। অনেকদিন পর প্রাপ্তি স্বীকার আসত। এরপর উদগ্রীব হয়ে থাকতাম কখন আসল জবাবটি আসবে। পোস্ট অফিসে খোঁজ নেয়া, পিয়নকে বলে রাখা, ইত্যাদি চলতো। আরো মাসখানেক পর দেখা যেত বড় খাকি রঙের খামে করে জবাব এসেছে। তখন যে কি আনন্দ হতো তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমরা এভাবে আমরা সহযোগিতার মাধ্যমে (collaborative research) গবেষণা করেছি, পাবলিকেশন করেছি। আমার একজন মেধাবি ছাত্র যুক্তরাষ্ট্রের একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার হিসাবে কাজ করে। তার সাথে যৌথভাবে বাইয়োলজিক্যাল (এটি ক্যান্সার)সাইকোটক্সি গবেষণা কাজ শুরু করি। বর্তমানেও এটি অব্যাহত রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করতে গিয়ে নানা সমস্যার কারণে মাঝে মধ্যে মনে হতো যদি বিদেশী কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করতাম তাহলে অনেক বেশি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করতে পারতাম। বিজ্ঞানী হিসেবে আরো বেশি প্রতিষ্ঠিত হতে পারতাম। কিন্তু আজ এ কথা ভেবে তৃপ্তি পাই যে, দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে বিপুলসংখ্যক ছাত্র তৈরি করেছি যারা আজ সারা বিশ্বে সুনামের সাথে গবেষণা করছে। বিদেশে চলে গেলে এদেরকে তৈরি করতে পারতাম না।

বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে আমার অনেক ছাত্র উচ্চ বেতনে চাকরি করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক পদে কেউ যোগ দিলে তিনি শুরুতে বেতন পান মাত্র চল্লিশ হাজার টাকার মতো। এরপর তিনি অধ্যাপক হলে বেতন গিয়ে বড় জোর লাখ খানেক টাকায় দাঁড়ায়। অথচ ফার্মেসি ডিপার্টমেন্টের ছাত্ররাই দশ-বার লাখ টাকা বেতনে দেশের মধ্যে চাকরি করছে।

গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশের ব্যাপারে আমার বরাবরই উৎসাহ ছিল। আমি যে কাজটি করছি তা সেখানে তুলে ধরতে পারছি। একজন গবেষকের অন্যতম বড় কাজ তার গবেষণা নিবন্ধ। যা আসলে কোনো মৌলিক গবেষণা। সেখান থেকে বাছাই করে মানুষের ব্যবহারের উপযুক্ত প্রযুক্তি আসে। একে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাপ্লিকেশন বলা হয়। গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। আমার জানা মতে গত বছর প্রতিষ্ঠিত জার্নালগুলোতে এখান থেকে আট হাজারের মতো নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ভারতের হয়েছে দুই লাখ। পাকিস্তানের সংখ্যাও আমাদের চেয়ে বেশি। যখন কোন আন্তর্জাতিক জার্নালে আমার গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে তখন মনে হয়েছে সেখানে আমি বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছি। আন্তর্জাতিক জার্নালে আমার দেশের কারো প্রকাশনা দেখলে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় বা আরো একান্তভাবে ফার্মেসি বিভাগের কোনো প্রকাশনা দেখলে গর্বে আমার বুকটা ভরে যায়। আমার আরেকটি গর্বের জায়গা হলো মুসলিম গবেষক হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করা। অন্যরা যখন বলে মুসলমানরাও তো ভালো গবেষণা করছে তখন আনন্দের সীমা থাকে না।

গবেষণার প্রতি ভালোবাসা আমাকে সব সময় উদ্বুদ্ধ করেছে। কেউ সিনেমা দেখে, কেউ খেলাধূলা করে বা কেউ আড্ডা দিয়ে, আনন্দ পায়। কিন্তু একজন ভালো ছাত্র পড়াশুনা করে আনন্দ পায়। আগামী প্রজন্মকে গবেষণার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত, উদ্বুদ্ধ করতে আমার নিজের জীবন থেকে কথাগুলো বলা। আমি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ কাজ চালিয়ে যেতে চাই। ১৯৯২ সালে আমি যখন অধ্যাপক হই তখন আমার গবেষণা প্রকাশনা ছিল ৫৪টি। অধ্যাপক হওয়ার পর চাকরির জন্য আমার কোনো প্রকাশনা থাকার দরকার ছিল না। কিন্তু ২০২০ সালে অবসর গ্রহণকালে আমার গবেষণা প্রকাশনা সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯০টি। আজো আমার গবেষণা থেমে নেই।

আমরা অনেক মেগা প্রকল্প করছি অথচ উন্নয়ন টেকসই করার জন্য মৌলিক গবেষণা বাড়াতে পারছি না। বাংলাদেশের জিডিপি যদি ৩০০ বিলিয়ন ডলার হয় তাহলে আমরা গবেষণার পেছনে এর কত শতাংশ খরচ করি? আমরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ, আরঅ্যান্ডডি ও অ্যাপ্লাইড রিসার্চ বৃদ্ধি, দেশীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে না পারলে উন্নয়ন টেকসই করতে পারব না। আমাদের কোয়ালিটি স্টুডেন্ট আছে, ভালো গবেষক আছে। আমাদের বহু ছাত্র বিদেশে পিএইচডি করছে। এদের বেশির ভাগ দেশে ফিরে আসে না। আমাদের ছাত্রদের মেধা নিয়ে প্রশ্ন নেই। অথচ এদের অনেকে গবেষণায় না গিয়ে পুলিশে যোগ দিয়েছে। আমলা হয়েছে। এমনও দেখেছি প্রফেসর হওয়ার পর অনেক শিক্ষক গবেষণা কর্ম থেকে এক প্রকার বিদায় নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া বেতন জীবনযাত্রার সাথে মানানসই হয় না। ফলে তারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যান। সরকারকে এই অবস্থা পরিবর্তনে মনযোগী হতে হবে। ভালো গবেষণার জন্য সরকার পুরস্কার দিতে পারে। এক-দুই লাখ টাকা পুরস্কার দেয়া তো সরকারের জন্য কঠিন কিছু না। ভালো গবেষণাপত্র প্রকাশের জন্য উৎসাহব্যাঞ্জক প্রণোদনা থাকা উচিত। আর্থিক টানাপড়েন মানুষের জীবনকে এগিয়ে নেয়ার পথে একটি বাধা। এই বাধা থাকলে ভালো গবেষণা হবে না।

সম্প্রতি চীন থেকে পিএইচডি করে এসেছে আমার এক ছাত্র। সে জানায়, চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্স ১২৩টি বিশ^বিদ্যালয় নিয়ে কাজ করে। তারা এখন গবেষণা প্রকল্পগুলোতে আমেরিকা থেকে বেশি পয়সা দিচ্ছে। একজন গবেষককে মাসে দুই-তিন লাখ টাকা স্কলারশিপ দেয়া হয়। এমনকি বাইরের দেশগুলোতে নামকরা যেসব চীনা বিজ্ঞানী কাজ করছেন তাদের কোটি টাকা বেতন দিয়ে দেশে ফিরিয়ে এনে মৌলিক গবেষণা করানো হচ্ছে। চীন ২০২০ সালে আরঅ্যান্ডডি খাতে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। যার প্রায় ৮% বা ৪০ বিলিয়ন ডলার শুধু মৌলিক গবেষণার জন্য।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আমরা মেধাকে রাজনীতিকরণ করছি। আমরা এখন ছাত্রদের বিজ্ঞান পড়ানোর চেয়ে বিবিএ পড়াতে বেশি আগ্রহী। আমরা গবেষক তৈরি করতে চাই না, চাই ব্যবসায়ী তৈরি করতে। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যথাযথ মূল্যায়ন করতে না পারলে দেশকে প্রকৃত অর্থে সমৃদ্ধ করতে পারব না। দেশের পরিচালকরা এটা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন তত মঙ্গল। অর্থনৈতিকভাবে দেশ অনেক এগিয়েছে। আমরা মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে চলেছি। তাই গবেষণা ও উন্নয়ন খাতের প্রতি আমাদের নীতিনির্ধারকদের আরো ঘনিষ্ঠ মনযোগ ও সুদৃষ্টি দিতে হবে।

লেখক : ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স এবং সাবেক ডিন ও অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মেইল : cmhasan@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement