২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বহুরূপী করোনাভাইরাস আতঙ্ক

-

সারা বিশ্ব প্রায় দেড় বছর ধরে করোনা অতিমারীতে আক্রান্ত। চীনের উহানে ডিসেম্বর, ২০১৯ প্রথম শনাক্ত হয়েছিল এ ভাইরাস। এখন পর্যন্ত অতি ক্ষুদ্র অদৃশ্য ভাইরাসটি পৃথিবীর ২২২টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়েছে। এতে বিশ্বের ১৭ কোটিরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। করোনার মৃত্যুসংখ্যা এক সপ্তাহ আগে ৩৫ লাখ ছাড়িয়েছে। মৃত্যুসংখ্যা এখন ৩৬ লাখের ঘরের দিকে এগোচ্ছে। কোনো একটি অঞ্চলে করোনার সংক্রমণ কমলে, বাড়ছে অন্য অঞ্চলে। অর্থাৎ করোনা অতিমারী অবসানের কোনো লক্ষণই আপাতত দেখা যাচ্ছে না। বরং নিত্যনতুন রূপে আবির্ভূত হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিজ্ঞানী করোনাভাইরাসকে একটি ‘বহুরূপী ভাইরাস’ বলে মন্তব্য করেছেন। অর্থাৎ ভাইরাসটি প্রতিনিয়ত নিজের রূপ বদলাচ্ছে। বাংলাদেশে ষাট-সত্তরের দশকে একটি সিনেমা হয়েছিল, নাম ‘একই অঙ্গে এত রূপ’। করোনাভাইরাসকে এমন বহুরূপীই বলতে পারি। ২০১৯ সালে ভাইরাসটি দেখা দেয়ার পর এর হাজারো রূপান্তর ঘটেছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। তবে এসব ধরনের মধ্যে করোনাভাইরাসের পাঁচটি ধরন বা ভ্যারিয়েন্ট বিশ্বব্যাপী শঙ্কার সৃষ্টি করেছে। এগুলো বেশি সংক্রামক এবং মারাত্মক। করোনাভাইরাসের প্রথম ধরনটি চিহ্নিত হয় যুক্তরাজ্য, দ্বিতীয়টি দক্ষিণ আফ্রিকায়, তৃতীয়টি ব্রাজিলে এবং চতুর্থটি ভারতে। গত শনিবার ভিয়েতনামে ধরা পড়ে করোনাভাইরাসে পঞ্চম ধরন বা ভ্যারিয়েন্ট। এটি করোনাভাইরাসের ‘হাইব্রিড ভ্যারিয়েন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্যবিদরা। এ জন্য হাইব্রিড, এটি ভারতীয় এবং যুক্তরাজ্য ভ্যারিয়েন্টের মিলিত রূপ ও সংমিশ্রণে হয়েছে। প্রতিটি ভ্যারিয়েন্টই একটির চেয়ে আরেকটি বেশি সংক্রামক। যেমন যুক্তরাজ্য দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রাজিলের করোনাভাইরাস ধরনের চেয়ে বেশি মারাত্মক ভারতীয় ধরন। এটিকে চিকিৎসকরা উদ্বেগজনক ধরন হিসেবে চিহ্নিত করেন। এ ধরনের কারণে ভারতে এখন বেসামাল অবস্থা। দেশটিতে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ৮০ লাখ। মৃত্যু সোয়া তিন লাখ। কয়েক দিন আগেও প্রতিদিন গড়ে সাড়ে চার হাজার মানুষ মারা গেছে। আক্রান্ত হয়েছে প্রতিদিন গড়ে চার লাখ করে। বর্তমানে আক্রান্তের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। তবে মৃত্যু প্রতিদিন সাড়ে তিন হাজার করে হচ্ছে। ভারতের এ ভ্যারিয়েন্ট বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে গেছে। তবে প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যই এ ভ্যারিয়েন্ট ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেপালে ইতোমধ্যে ভারতীয় ধরন দ্রুত ছড়িয়ে দেশটিতে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ভারতের সাথে সীমান্ত বন্ধ রেখেছে। তবুও ভারতীয় ধরনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়নি। প্রথমে ভারতীয় করোনাভাইরাস ধরনে আক্রান্ত সাতজনকে চিহ্নিত করা হয়। তারা ভারত থেকে এসেছিলেন। বর্তমানে দেশে ভারতীয় ধরনের সামাজিক সংক্রমণও শুরু হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে সম্প্রতি বেশ কিছু ব্যক্তিকে দেখা গেছে, তারা ভারতীয় ধরনে আক্রান্ত।

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা: মুশতাক হোসেন জানান, বাংলাদেশে যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারতীয় এই তিন ধরনের করোনা রোগী চিহ্নিত হয়েছেন। অর্থাৎ ক্ষতিকর তিনটি ধরনই বাংলাদেশে সক্রিয়। তিনি বলেন, মহামারী ঠেকানো যায় না। এর গতি কমানো যায়। বাংলাদেশকে সতর্কতা অবলম্বন করে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। যেমন সীমান্ত বন্ধ রাখা এবং লকডাউন বেশ কাজে দিয়েছে। ভারতীয় ধরনটির কথা মাথায় রেখে সীমান্ত বন্ধের সিদ্ধান্ত আরো এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়েছে। এটা করতে না পারলে আমাদের অবস্থাও নেপালের মতো হতো। পরীক্ষায় দেখা গেছে, যুক্তরাজ্য ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টটি বেশি সংক্রামক। তাই আমাদের আরো বেশি সতর্ক হতে হবে।

শনিবার ভিয়েতনামে করোনাভাইরাসের যে ভ্যারিয়েন্ট চিহ্নিত হয়েছে তাকে করোনাভাইরাসের ‘হাইব্রিড ভ্যারিয়েন্ট’ নাম দেয়া হয়েছে। ভারতীয় ও যুক্তরাজ্য ভ্যারিয়েন্টের সংমিশ্রণে হওয়া এ ‘হাইব্রিড ভ্যারিয়েন্ট’ বাতাসে দ্রুত ছড়াচ্ছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ভিয়েতনামের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এই ভ্যারিয়েন্টকে ‘ভয়াবহ বিপজ্জনক’ বলে উল্লেখ করেছেন। ভিয়েতনাম করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। কিন্তু এই ভ্যারিয়েন্ট নতুন উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে দেশটিতে। সেখানে এখন কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা ছয় হাজার ৭০০ জন।

করোনা রোগীদের মধ্যে ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ দেখা দেয়ায় এটাও নতুন করে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসার পর ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। বাংলাদেশেও ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে সংক্রমিত রোগী চিহ্নিত হয়েছে বারডেম হাসপাতালে। এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। রোগটি সংক্রামক নয়। এর লক্ষণ হচ্ছে নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, চোখ ব্যথা করা, চোখের পাতা ফুলে যাওয়া, নাকের চামড়ার চারপাশে কালো ছোপ ছোপ দাগ হওয়া ইত্যাদি। দিল্লিতে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের শিকার হয়েছেন হাজার হাজার করোনা রোগী। এর ফলে দিল্লিজুড়ে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসকেও মহামারী ঘোষণা করা হয়েছে।

যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় অঞ্চলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে এলেও এশিয়ায় বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় বেড়েই চলেছে। শুক্রবার রয়টার্সের রিপোর্টে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশ ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপে করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা তিন কোটি ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বে যত করোনা রোগী এর ১৮ শতাংশই এই ছয় দেশে। বিশ্বে করোনায় মোট মৃত্যুর ১০ শতাংশও এই ছয় দেশে। সংক্রমণ এবং মৃত্যুতে অবশ্য শীর্ষে ভারত।

এই মহামারী এবং করোনার নতুন নতুন ধরন থেকে বাঁচার উপায় কী? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপ অঞ্চলের পরিচালক হ্যানস ক্লুগে শনিবার বলেছেন, বিশ্বের অন্তত ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে না পারলে অতিমারী নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কিন্তু কোভিড-১৯ টিকাদান খুব ধীরগতিতে হচ্ছে। ইউরোপ অঞ্চলের অন্তর্গত ৫৩টি দেশ ও অঞ্চলে মাত্র ২৬ শতাংশ টিকার প্রথম ডোজ নিতে পেরেছে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলো টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছে ৩৬ শতাংশ। ভারতে টিকা পেয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ। আগামী ডিসেম্বর নাগাদ ভারতে ১০৮ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা থাকলেও তা বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশও টিকা নিয়ে সমস্যায় রয়েছে। শুরুতে বাংলাদেশ মাত্র একটি উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুল করেছিল। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি টিকা বেক্সিমকোর মাধ্যমে আনার চুক্তি করেছিল। কিন্তু ৭০ লাখ ডোজ টিকা আসার পর ভারত বাংলাদেশে টিকা রফতানি বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে ভারতে করোনা সংক্রমণে বিপর্যয় দেখা দেয়ায় টিকা প্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ চীন এবং রাশিয়া থেকে টিকা আনার সিদ্ধান্ত নেয়। চীনের পাঁচ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশ উপহার হিসেবে পেয়েছে। চীন থেকে বাংলাদেশ এক কোটি ডোজ টিকা আনার চুক্তি করেছে। প্রতি ডোজের দাম পড়বে ১০ ডলার। এই টিকা সহসাই এসে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে এক লাখ ডোজ ফাইজারের টিকা এসে পৌঁছেছে। বাংলাদেশের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরো টিকা পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্য থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ৪০ লাখ ডোজ আনার জন্য বাংলাদেশ অনুরোধ জানিয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাজ্য সরকার অপারগতা প্রকাশ করেছে।

দেশের ১৬ লাখ মানুষ অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার প্রথম ডোজ দিয়েছে, আর টিকা নেই। তাই তাদের জন্য অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগীদের জন্যও এ টিকা বেশি কার্যকর। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, যুক্তরাজ্য ভ্যারিয়েন্ট ও ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগীদের জন্য ফাইজার-বায়োএনটেক এবং অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এ জন্যই এ টিকা বাংলাদেশের জন্যও প্রয়োজনীয় বলে স্বাস্থ্যবিদরা মত প্রকাশ করেছেন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক,
জাতীয় প্রেস ক্লাব


আরো সংবাদ



premium cement