বিশ্বব্যবস্থার মূল্যায়ন কি অপরিহার্য নয়
- সালাহউদ্দিন বাবর
- ২৯ মে ২০২১, ১৯:৪৮, আপডেট: ২৯ মে ২০২১, ১৯:৪৯
[গত সংখ্যার পর]
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েমের জন্য যে লড়াই ছাত্র-জনতাসহ সব শ্রেণীর মানুষ করছে, সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে তাদের পক্ষে বিশ্বসভার ভূমিকা কোথায়? দায়সারাগোছের শুকনো কিছু ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কোনো ভূমিকাই নজরে আসছে না। সাধারণ মানুষের এই লড়াইয়ে তাদের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়ার সাহস মুরাদ ও ইচ্ছা কোনোটাই সেই সংস্থার নেই। এমন একটা অথর্ব সংস্থার অস্তিত্ব বজায় রাখার সত্যিকার অর্থে কোনো যৌক্তিকতাই খুঁজে পাওয়া যায় না। এমন অথর্ব সংস্থার পক্ষে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়ে মানুষের শান্তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কল্পনাই করা যায় না। অথচ এ কথা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই যে, বিশ্বে দুই শতাধিক দেশের ৭০০ কোটির বেশি মানুষের সুরক্ষা শান্তিশৃঙ্খলা অগ্রগতির জন্য কার্যকর বিশ্বসংস্থার প্রয়োজন আছে। বিশ্ব আজ যে দ্রুত অধোগতির দিকে চলছে, তাতে এই গ্রহের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কার শেষ নেই। বিশ্বকে রক্ষার শত উদ্যোগ-আয়োজন আজ কতটা জরুরি এবং কী করতে হবে সেই প্রয়াস আর পরিকল্পনা এবং সব কিছুর সমন্বয় তো এমন একটি শক্তিশালী সংস্থার পক্ষেই সম্ভব। এই কাজের জন্য নৈতিক আর্থিক আর শৃঙ্খলা বিধানের ব্যবস্থা নেয়া সেই সংস্থার দায়িত্ব। এই ব্রহ্মাণ্ডের পরিবেশগত শোচনীয় অবস্থা নিয়ে যে চিন্তাভাবনা বড় কয়েকটি দেশ করছে তারও তাগিদ দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। তাও সংস্থার নজরে থাকা দরকার। কিন্তু তা কি এখন করা সম্ভব বর্তমান বিশ্ব সংস্থার অবস্থান থেকে। আজকের বিশ্ব ব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে অচল হয়ে পড়েছে। এটা পাল্টাতে না পারলে মহাবিশ্বের এই সুন্দর আর অনন্য গ্রহটিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো যাবে না।
জাতিসঙ্ঘ তার এক ঘোষণায় পৃথিবীর মানুষের নানা অধিকার সংরক্ষণের অঙ্গীকার করেছে। মানুষের এই অধিকার সংবলিত ঘোষণায় ধর্মীয় অধিকার, বাক ও স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকারসহ অনেক কিছুই রয়েছে। কাগজে-কলমে এসব বিষয় সন্নিবেশিত থাকলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তার কিছুই অনুশীলন হচ্ছে না। এই সংস্থার এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা আছে তা তারা এ পর্যন্ত প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি। পৃথিবীর বহু অঞ্চলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অকথ্য নির্যাতন আর হয়রানির সংবাদ হামেশাই কানে আসে। নানা নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুদের তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং ভাব ভাষা পাল্টে ফেলার মতো জঘন্য অপরাধের সব খবরই বিশ্বসভা অবহিত। কিন্তু তার প্রতিকারের জন্য তাদের পাশে দাঁড়িয়ে জাতিসঙ্ঘ সক্রিয় কোনো ভূমিকা রাখছে না। নানা দেশে রাজনৈতিক মতপার্থক্য নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর জুলুম-অত্যাচার চালায় ক্ষমতাসীনরা অথচ জাতিসঙ্ঘ এসব ক্ষেত্রে ন্যূনতম কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। নির্যাতনের খবর সংবাদপত্রে প্রকাশের ক্ষেত্রে শুধু বাধা প্রতিবন্ধকতাই নয়, সংবাদপত্রের টুঁটি টিপে ধরা এবং বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিকদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালানো হয়, বহু ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের জীবন সংহার পর্যন্ত করা হচ্ছে। আজকের বিশ্ব ব্যবস্থায় এমন হাজারো দুর্ভোগ আর সীমাহীন অত্যাচার মানুষকে সহ্য করতে হচ্ছে। ন্যায়নীতি শ্রদ্ধা সহানুভূতির কোনো অস্তিত্ব আজ আর নেই। প্রেমপ্রীতি মানবসত্তার কিছুর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নজির এখন আর নেই। এরপর সভ্যতার বড়াই করা কারো সাজে না।
সভ্যতা তো মানুষের নিরাপত্তা, বিশেষ করে নারীর সম্মান সম্ভ্রম রক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। কিন্তু গোটা বিশ্বে নারী ও মেয়ে শিশুদের ওপর চলছে মারাত্মক যৌন নির্যাতন। নারীদের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করছে, তাদের শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে চলছে ব্যবসা। যৌন পল্লীতে চরম অমানবিক জীবনযাপন করছে বিশ্বব্যাপী অগণিত নারী। এমন অত্যাচার সভ্যতার মুখে কালিমা লেপনের শামিল। আসলে এসব বিষয় প্রকৃতপক্ষে আদিযুগের নারীর ওপর যে বর্বরতা চলত এখন এই সভ্য যুগে সেটাই ফিরে এসেছে। এ নিয়ে বিশ্ববিবেক এতটুকু লজ্জিত অনুতপ্ত কি না তা বোঝার উপায় নেই। সবচেয়ে অবাক লাগে এই ভেবে যে, বিশ্বের সর্বত্র নারী নির্যাতন হচ্ছে বটে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে পশ্চিমের উন্নত বিশ্বে, যেখানে নারী-স্বাধীনতা নিয়ে সরকার ও প্রশাসন বেশি সোচ্চার, সেসব দেশেই নারীর প্রতি যৌন জুলুম সবচেয়ে বেশি। আর তার শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এটা চরম লজ্জা আর পরিতাপের বিষয় হলেও তাদের এ নিয়ে কোনো গ্লানিবোধ নেই।
নিজেদের সমাজ নিয়ে তাদের গর্ব আর অহমিকার শেষ নেই। অথচ নারীর প্রতি তাদের আচরণ মধ্যযুগের সমপর্যায়ে। এ খবর হর হামেশাই প্রকাশিত হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ সন্তানের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যে সমাজের ছেলেমেয়েরা পিতৃ সঙ্কটে ভোগে তাদের মানসিক যাতনাটা কতটা গভীর আর বেদনাদায়ক তা কি তারা বোঝে? বিত্ত-বৈভব এই যাতনার উপশম করতে পারে না। একই সাথে এটাও এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, যুক্তরাষ্ট্রে হাজার হাজার কুমারী মা রয়েছে। ভ্রূণ হত্যার সংখ্যাও অগণিত। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের কথাই বা বলি কেন? পশ্চিমের বহু উন্নত দেশের অবস্থা প্রায় একই রকম। সেখানেও ঘটছে নারীর প্রতি যৌন নির্যাতন। মা বধূ ও কন্যা হিসেবে নারীজাতির যে সম্মান প্রাপ্য, তা সেসব দেশে আজ ভূলুণ্ঠিত। আরো পরিতাপের বিষয়, নারী তার সম্ভ্রম নিয়ে সঙ্কটে রয়েছে অথচ নারী সংগঠন ও বিবেকবান পুরুষের কোনো ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াও নেই। এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, পাশ্চাত্যে এসব ঘটনাকে খুব স্বাভাবিক আর মামুলিভাবে গ্রহণ করা হচ্ছে। এটা যে শুধু কোনো দেশের নারীজাতির সঙ্কট তা নয়, সভ্যতার যে সাধারণ মূল্যবোধ তার চরম অবক্ষয়কে প্রতীয়মান করে তুলছে। আরো আশঙ্কার কথা, মূল্যবোধের এই অবক্ষয় প্রাচ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে প্রযুক্তির মাধ্যমেই তা সর্বত্র সংক্রমিত হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন এমন নৈতিক অধোগতির জন্যও। মানুষ নৈতিকতার দিক থেকে এমন দেউলিয়াত্বে পৌঁছলে স্বাভাবিকভাবে এর প্রভাব সর্বত্র নানা রূপে বিপর্যয় সৃষ্টি করবেই। তখন পশু আর মানুষের মধ্যে স্বভাবগত ব্যবধান আর থাকবে না। সভ্যতাকে হারিয়ে মানুষ আদিম যুগের দিকে হাঁটতে থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে যে কথা বলেছি তা আসলে আমাদের পক্ষে বলার নৈতিক অবস্থানে এখন আমরা নেই। নারীদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে আমরা ব্যর্থতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে চলেছি। পশ্চিমের নারী নির্যাতনের বিষয়ে যা উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে এ কথাও বলা হয়েছে যে, তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে এই ব্যাধি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের যে ভয়াবহতা তা শিউরে ওঠার মতো। গৃহবধূ কুমারী যুবতী কিশোরী আর মেয়েশিশুদের ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে। পত্রপত্রিকায় তা প্রকাশিত হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে নারীদের প্রতি এমন যৌন নির্যাতনের সাথে তুলনা করা যেতে পারে কেবল পশুস্বভাবের। এর ভয়াবহতা রোধের জন্য সরকার মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠোর আইন করেছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের ধরে বিচারের জন্য সোপর্দ করছে। কিন্তু তারপরও থেমে নেই এই অপরাধ। এ দিকে প্রতিক্ষণে নেটের মাধ্যমে এমন যৌন সুড়সুড়ি দেয়া হচ্ছে যা যুবকদের যৌন অনাচার করতে তাদের আকাক্সক্ষা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ দিকে ধর্ষণের কঠোর আইন করা আর অপর দিকে নেটের মাধ্যমে যৌন স্পৃহা জাগানোর ব্যবস্থা করার মাধ্যমে কী চরম বৈপরিত্ব এবং নীতিহীনতা জারি রাখা হচ্ছে না? বোঝা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে, আসলে এই ইস্যুতে প্রশাসনের অবস্থান সত্যিকার অর্থে কোথায়? আর এতে ঘৃতাহুতি ঘটাচ্ছে মাদক, যা এখন একটি সহজলভ্য পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশে।
কঠোর আইন করেও যখন পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হচ্ছে না তখন ভাবতে হবে সমস্যার গোড়াটা কোথায়। সেটা খুঁজতে হবে। সমাজবিজ্ঞানী, ধর্মীয় নেতাদের এ জন্য কাজ করতে অনুরোধ করা উচিত হবে। আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকের বোধবিবেচনায় এটাই মনে হয় যে, অতীতে সমাজে যতটুকু নীতি-নৈতিকতা বজায় ছিল তা এখন নিঃশেষ হওয়ার পথে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার পাঠক্রমে আগে নীতি-নৈতিকতার যত বিষয় সন্নিবেশিত ছিল এখন তার অস্তিত্ব নেই। আমাদের তরুণসমাজের কাছে কোনটা অপরাধ আর গর্হিত কাজ তার বাছবিচার করার বোধ হারিয়ে গেছে। তাদের চেতনা বিবেক সব কিছু যেন শেষ হয়ে গেছে। বর্তমানে সামাজিক অবস্থান ও তার মজবুতিটাও ঢিলেঢালা হয়ে গেছে। সমাজের নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি আর তাদের অনুশাসনের কারণে অপরাধপ্রবণতা ছিল নিয়ন্ত্রণে। এখন এসব বজায় নেই। নানা অবক্ষয় আমাদের চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। ধর্মীয় চেতনা আর মূল্যবোধ জাগ্রত রাখার ক্ষেত্রে আলেমসমাজের যে অবদান ছিল তা এখন নানাভাবে বাধাগ্রস্ত। তা ছাড়া আমাদের বুদ্ধিজীবীরা প্রগতির নামে যে দীক্ষা ছড়াচ্ছেন সেটা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমাজের সনাতন ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষার আর মূল্যবোধের প্রতি অবজ্ঞা অশ্রদ্ধা তৈরি করছে। যার কারণেই আজকের সমাজে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে নারী নেতৃত্বকে সাধারণভাবে শ্রদ্ধাভক্তি করা হয়। দীর্ঘকাল দু’জন শ্রদ্ধেয় নারী পর্যায়ক্রমে দেশের সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের প্রতি কোনো অবজ্ঞা অবহেলা তো নেই বরং সমর্থন দেয়া হয়। এ জন্য সত্যিই অবাক হতে হয়।
বিশ্বসংস্থার সামান্য কিছু বিষয় নিয়ে স্বল্প পরিসরে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো তাতে এই প্রতিষ্ঠানকে কোনো মর্যাদাবান কার্যকর সংস্থা হিসেবে অভিহিত করা যাবে কি না তা বিবেচনার বিষয়। এই কারণে যে, এটা মানবসমাজের কল্যাণ মর্যাদা ও শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী কোনো সংস্থা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। আর যেহেতু বহু রাষ্ট্র এই সংস্থার সভ্য, তাই তাদেরও বিশ্বসংস্থার এই ম্লান ভাবমর্যাদার শরিক হতে হবে। বিশ্বসংস্থার এমন অকার্যকারিতা স্থবিরতার দায়ভাগ সবার সমান না হলেও কোনো সভ্যের ভূমিকা কখনো এমন ছিল না। তারা সংস্থার স্থবিরতার জন্য প্রতিষ্ঠানের মোড়ল সেই সব সদস্যের সমালোচনা এবং একে জীবন্ত প্রতিষ্ঠানের রূপ দেয়ার জন্য কখনো খুব একটা জোর দিয়েছে বলা যাবে না। কোনো সদস্য দেশের ভাবনায় কখনোই এমন কিছুই প্রতিফলিত হয়নি যে, সংস্থাটি বিশ্বসমাজের কল্যাণে অবদান রাখতে পারছে না। এই সংস্থার শক্তিশালী সদস্যদের প্রায় সবাই আন্তর্জাতিক বলয়ে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠাকে তাদের মুখ্য লক্ষ্য হিসেবে ধরে নিয়ে কাজ করেছে।
বাংলাদেশও এই সংস্থার একটি সদস্য দেশ। বিশ্বসংস্থা যেসব কাজ করতে সক্ষম হয়নি, বাংলাদেশও তার ভূখণ্ডে ভালো কিছু প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়নি। সব দেশের প্রশাসন জনগণের সার্বিক কল্যাণ এবং উন্নতির চিন্তায় মগ্ন থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ সেই মগ্নতা প্রদর্শন করতে পারেনি প্রশাসন। এ যাবৎকালের কোনো সরকারই দেশকে তার ধ্যান জ্ঞানের মধ্যে আনতে পারেনি। এ দেশের সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি দুর্বলতা রয়েছে নতুন সম্পদ সৃষ্টি এবং তার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সততায়। শত শত দুর্বৃত্ত দেশের অর্থসম্পদ লুটেপুটে নিচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার করে দেয়া হয়েছে। দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর হর্তাকর্তাদের দুর্বলতা আর অদক্ষতা এমন কি অর্থ পাচারকারীদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে তারা অর্থপাচারে সহায়তা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নিকট অতীতের একটি মারাত্মক অর্থ কেলেঙ্কারির কথা স্মরণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিপুল অঙ্কের অর্থ বিদেশী দুর্বৃত্তরা স্থানান্তর করে নিয়ে গেছে। তা নিয়ে কিছুকাল হইচই হয়, খবরের কাগজে অনেক কিছু লেখালেখি হয়। কিন্তু এর ফলাফল তো তেমন ফলদায়ক হয়নি। এসব দুরাচার সংঘটিত হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সরে গেছেন বটে কিন্তু সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তার ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল কি না তা প্রকাশ্যে আসেনি। যেখানে অর্থসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে নিয়ত এত অঘটন ঘটে, তাতে তো এটাই প্রতিষ্ঠা পায় যে, দেশের অর্থসম্পদ সংরক্ষণ ও তার তদারকিতে কী ভয়ানক দুর্বলতা বিরাজ করছে।
প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, দেশে সুশাসন আর সুনীতির প্রতিষ্ঠা হয়নি। সে কারণে শুধু অর্থনৈতিক সেক্টরেই নয় রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের নানা জায়গায় জং ধরে গেছে। যন্ত্রে জং ধরায় খোদ রাষ্ট্রযন্ত্র এখন খুঁড়িয়ে চলছে। সুশাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রশাসন গতিশীল করে তোলা। সব ক্ষেত্রে গতি বজায় থাকছে কি না তার সুষ্ঠু তদারকি জারি রাখা। সিদ্ধান্ত গ্রহণ হলেও তা যথাযথভাবে কার্যকর করা। অথচ এমন তথ্য হরহামেশাই পাওয়া যায় যে, কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার পরও তা বছরের পর বছর ঝুলে আছে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন না হওয়ার যে অনিয়ম, তা এখন নিয়মে এবং স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এই ঢিলেমির ব্যাপারে শুধু যে তদারকি দুর্বলতা দায়ী তা নয়। এর পেছনে গভীর কারণও বিদ্যমান।
যেকোনো প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ে শেষ না হওয়ার পেছনে গূঢ় রহস্য হচ্ছে তাতে নির্মাণবাবদ যে ব্যয় ধার্য হয় তা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এ সুবাদে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের লাভের অঙ্ক লাফিয়ে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়ে যায়। সন্দেহ করা অমূলক নয় যে, সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা সেই প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট, ঠিকাদারদের কাছ থেকে তারাও মোটা অঙ্কের সেলামি পেতে পারেন। তাই তা নিয়ে গা করেন না। কার্যকর গতিশীল ন্যায়নিষ্ঠ প্রশাসনের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, অনুরাগ বিরাগের ঊর্ধ্বে থাকা এবং যোগ্য কর্মনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের পুরস্কার প্রদান আর অদক্ষ নীতিহীনদের তিরস্কৃত করা। কিন্তু এমন অভিযোগ নিয়তই পাওয়া যায় যে, বহু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কারণে বহু কর্মকর্তার প্রতি অনুরাগ প্রদর্শন এবং অদক্ষ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বহু অনুযোগ অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে। এসব যদি অব্যাহত থাকে তবে রাষ্ট্রযন্ত্রে যে জং ধরার কথা বলা হয়েছে, তা কখনোই ছুটবে না। দেশের যত সব সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে যা এখানে উল্লেখ করা হলো তা নিতান্তই সামান্য।
একটি কথা বারবার উল্লেখ করা হয়, দেশের সব কিছুই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের সমস্যা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় যে প্রতিষ্ঠান এসবের জবাবদিহি নেবে সেটাই এখন অকার্যকর। রাষ্ট্রের যে তিনটি অঙ্গ, তার অন্যতম হচ্ছে আইনসভা তথা জাতীয় সংসদ। সংবিধানে এই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, মন্ত্রিসভা সম্মিলিতভাবে তাদের দায়িত্ব পালন নিয়ে সংসদের কাছে জবাবদিহি করবে। স্মরণ করা যেতে পারে, মন্ত্রিসভার সদস্যরা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী।
জনপ্রতিনিধি হিসেবে তথা রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে তার মন্ত্রণালয়ের সার্বিক নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব তারই স্কন্ধে। সংসদে উপস্থিত থেকে সেখানে তার মন্ত্রণালয়ের যাবতীয় কার্যক্রমের বর্ণনা দেয়া এবং সদস্যদের যাবতীয় জিজ্ঞাসাবাদের জবাব দেয়া এবং আলোচনা পর্যালোচনা এবং সমালোচনা শোনা মন্ত্রীদের দায়িত্ব। আসলে সংসদের দায়িত্বটা এমন যে, কোনো নদীকে তার সঠিক ধারায় প্রবাহিত হওয়ার জন্য দুই কূলে যে বাঁধ দেয়া হয় তেমনই। সংসদেরও কাজ তেমনি সরকারকে তার কর্তব্যকর্মে নিবেদিত থাকতে ‘ওয়াচ ডগের’ মতো ভূমিকা পালন করা। সংসদ নিয়ে যে কথাগুলো বলা হলো তা প্রকৃতপক্ষে একটি আদর্শিক অবস্থান থেকে। বাংলাদেশের সংসদ বর্তমানে সেই অবস্থানে নেই। কারণ সংসদে বিরোধী দল মুখ্যত সরকারের দায়িত্ব পালন নিয়ে সেই কাজটি করে। এখন সংসদের প্রকৃত অর্থে কোনো বিরোধী দল নেই। কারণ সরকারি দল এবং তাদের নির্বাচনী শরিকরাই সংসদে মিলেমিশে আছে। তাই সরকারকে তাদের নির্বাচনী শরিকরা ঘাঁটাতে চায় না। এতে ক্ষতিটা হচ্ছে এই যে, সরকার কী করছে, কোথায় ত্রুটিবিচ্যুতি ঘটছে তা আর জনগণ জানতে পারছে না। সংসদীয় ব্যবস্থার মূল চেতনা ও বৈশিষ্ট্য যা তা আর এখন বজায় নেই। সবার স্মরণ আছে যে নির্বাচনের মাধ্যমে এই সংসদ গঠিত হয়েছিল। সেটা বলতে গেলে একটা ‘ফার্ম’। এই ‘ফার্ম’-এর আয়োজন করেছিল নির্বাচন কমিশন। দেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে গেছে তারা। নির্বাচন কমিশনের যে দায়িত্ব কর্তব্য সংবিধানে সুনির্দিষ্ট করা আছে তাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে।
কোভিড পরিস্থিতি নিয়েই এই লেখা শেষ করতে চাই। কোভিডের টিকা এখন কূটনীতিতে ঢুকে পড়েছে। বহু খেলোয়াড় এতে খেলতে নেমেছে। মানবিকতাসংক্রান্ত বিষয়টি এখন কূটনীতির খেলায় পরিণত হয়েছে। আমরা কোভিডে বিপর্যস্ত একটি দেশ কিন্তু দুর্ভাগ্য টিকার কূটনীতির খেলায় আমরা নিজেদের আনাড়ি খেলোয়াড় হিসেবে প্রমাণ করে ফেলেছি। যার কারণে টিকা পাওয়া তথা জনগণের নিরাপত্তা খুবই স্পর্শকাতর বিষয়টি অবহেলিত হচ্ছে।
গোড়া থেকে লক্ষ করা গেছে, আমরা দূরদর্শিতার প্রমাণ দিতে পারিনি। এ লেখা যখন লিখছি তখন কোভিডের টিকা সংগ্রহ নিয়ে আমাদের অনেকটা লেজেগোবরে দশা। সরকারের ভাষ্য মতে, টিকার জন্য প্রচুর অর্থ বরাদ্দ রয়েছে। টাকা থাকতেও পণ্য কিনতে না পারাটা অবশ্যই বুদ্ধিহীনতা আর সমন্বয়ের অভাব। এতসব দুর্বলতা সত্ত্বেও কখনো কখনো আমাদের মুখে অহমিকার সুর শুনেছি। কোভিডের প্রথম ঢেউয়ের পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে তখন কোনো কোনো কর্তৃপক্ষের কণ্ঠে অহমিকা লক্ষ করা গেছে। বিশ্ব কোভিডের ওঠানামা নিয়ে তারা যে লক্ষ্য রাখেননি সেটার কারণেই সম্ভবত তারা আহ্লাদিত হয়ে উঠেছিলেন এবং অর্বাচীনের মতো কথা বলেছিলেন। সে যাই হোক কোভিডের বিষয়টি জাতির জন্য শুধু স্পর্শকাতর বিষয়ই নয়, জীবন-মরণ সমস্যা এটা বুঝে কোভিডের টিকা নিয়ে যে কূটনীতি চলছে তাতে আনাড়িপনা নয় বুদ্ধিদীপ্ততার পরিচয় দিতে হতো। যোগ্যরাই পৃথিবীতে টিকে থাকার অধিকার অর্জন করতে পারে। অদক্ষ অযোগ্যদের ঝরে যেতে হয়। হাজার বছরের পথপরিক্রমার পর এই বিশ্ব যে উচ্চতর উৎকর্ষতার দ্বারে পৌঁছেছে, তা ধরে রাখার ক্ষেত্রে এখন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে। তার প্রধান কারণ বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার যত গর্হিত কর্মকাণ্ড, অমানবিকতা, নৈতিক অবক্ষয়, স্বার্থান্ধতা, মানুষের প্রতি মানুষের সম্প্রীতি সহানুভূতির ঘাটতি আর কয়েকটি দেশের ভয়ঙ্কর যত মরণাস্ত্র নির্মাণ ও তার অশুভ প্রতিযোগিতা। অথচ আদিম যুগ থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে শত শত বছরের অভিজ্ঞতা শুভবোধ সৃষ্টিসহ আরো অনেক সদগুণ অর্জন করে মানুষ তার জ্ঞান ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে পেরেছিল বলেই মানুষ সভ্যতার ক্ষেত্রে আজকের অবস্থায় উত্তীর্ণ হতে সক্ষম হয়েছে। আর যেসব কারণে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে সে কথার আভাষ ইঙ্গিত উপরে দেয়া হয়েছে। এ লেখার বিভিন্ন স্থানে আজকের বিশ্বব্যবস্থার মারাত্মক সব দুর্বলতার কিঞ্চিত আলোকপাতের চেষ্টা করা হয়েছে। বিশ্বের অধিকাংশ সাধারণ মানুষ এখনকার পতনশীলতার জন্য কোনোভাবেই দায়ী নয়। অথচ এ জন্য ভুগতে হচ্ছে তাদের। জানি না, কবে কখন বর্তমান এই ক্ষয়িষ্ণু বিশ্বব্যবস্থার মূল্যায়ন এবং তার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বিশ্বকে রক্ষা করা হবে। কবে বিশ্বের নাটের গুরুদের বোধোদয় ঘটবে।
বাংলাদেশীদের অতীত ইতিহাস নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে এগিয়ে এসেছে। এই জনপদের অতীত ইতিহাস শৌর্য বীর্য আর অকুতোভয় মানুষের সংগ্রাম আর লড়াইয়ের বীরত্ব গাথা। নিজেদের অধিকার আদায়ের আপসহীন দুরন্ত এক অভিযাত্রা। অতীতের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব সব ঝড়ঝঞ্ঝা মোকাবেলায় অদম্য সাহস, নিষ্ঠা আর একাগ্রতা দিয়ে সব প্রতিকূলতা জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাকে অকুতোভয় থাকতে সাহস জুগিয়েছিল মুহুর্মুহু ‘ইনশা আল্লাহ’ উচ্চারণের মাধ্যমে। আজকে যারা দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের ভুলত্রুটি দূর করা আবশ্যক পূর্বসূরিদের ধৈর্য বুদ্ধি প্রজ্ঞা অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞান আর প্রত্যয়কে পাথেয় করে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী এক কবিতার একটি চরণের অংশবিশেষ, ‘এ তুফান ভারী দিতে হবে পাড়ি নিতে হবে তরী পার।’ এই প্রত্যয় অনুক্ষণ স্মরণে আচরণে বজায় রেখে চলতে হবে। মনে রাখতে হবে ইতিহাসে পরাজিতদের স্থান হয় না। ইতিহাস এতটা নির্মম আর নৈর্ব্যক্তিক যে সে কাউকে অনুকম্পায় দেখে না। এটাই চিরন্তন সত্য।
ndigantababor@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা