ফিলিস্তিন এখন রক্তাক্ত প্রান্তর
- সৈয়দ আবদাল আহমদ
- ১৭ মে ২০২১, ২০:১১, আপডেট: ১৭ মে ২০২১, ২৩:১৯
‘মৃত্যু চিনতাম না;
যদি না রিফিউজি ক্যাম্পে বোমা বর্ষণ না দেখতাম।
কাটা হাত-পা, মুণ্ডু, কবন্ধে
গর্ত ভরাট। মুখ নেই,
শুধু কান্না মুছে যাওয়ার ছাপ রয়ে গেছে।’
ফিলিস্তিনি কবি রেমি কানজির এ কবিতার বর্ণনার চেয়েও নৃশংস চলমান ইসরাইলি আক্রমণ। ফিলিস্তিনে গত এক সপ্তাহ ধরে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল যে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম একে স্মরণকালের সবচেয়ে বিধ্বংসী ধ্বংসযজ্ঞ বলে উল্লেখ করেছে।
ফিলিস্তিন এখন এক রক্তাক্ত প্রান্তর। ওপর থেকে পড়ছে বোমা, চারদিক থেকে আসছে গোলা। ইসরাইলি বিমান ও পদাতিক বাহিনী হামলা চালাচ্ছে সমানতালে। আকাশে ১৬০টি জঙ্গি বিমান ঝাঁকবেঁধে হামলায় নেমেছে। আর স্থলপথে ট্যাংক, কামান, আর্টিলারি ও গানবোট থেকে হচ্ছে হামলা। ইসরাইলের নিক্ষিপ্ত গোলা ও বোমায় প্রতিদিন ফিলিস্তিনের রাতের আকাশ জ্বলে উঠছে।
আল আকসা মসজিদে শবেকদরের নামাজ পড়তে জড়ো হয়েছিলেন ফিলিস্তিনিরা। নামাজেই হামলা চালায় ইসরাইলি বাহিনী। এর প্রতিবাদে জুমাতুল বিদার নামাজে শরিক হন হাজার হাজার ফিলিস্তিনি। ইসরাইলি বাহিনী আরো বেপরোয়া হয়ে হামলা চালাতে থাকে। গত এক সপ্তাহে ইসরাইলি সন্ত্রাসী হামলায় রোববার পর্যন্ত ৪১ শিশুসহ ১৭০ জন ফিলিস্তিনির নির্মম মৃত্যু হয়েছে। ঈদের দিনও ইসরাইলি হামলা থেকে রেহাই পায়নি ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষ-শিশুরা। ঈদ উপলক্ষে ভাই-বোনদের একটি পরিবার একত্র হয়েছিল। কিন্তু ইসরাইলি বোমা ঈদের পোশাক পরা ফিলিস্তিনি শিশুদের প্রাণ কেড়ে নেয়। তিনতলা একটি ভবন নিমিষেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। গাজা উপত্যকায় আটটি শরণার্থী শিবিরের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম শিবিরের নাম শাতি। এখানে ৮৫ হাজার ফিলিস্তিনি শরণার্থীর বাস। এ শিবিরে হামলা চালিয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে। একজন ফিলিস্তিনি বলেন, ‘আমাদের সন্তানদের জন্য রাতগুলো ভয়ঙ্কর। আমার বাড়ি যেকোনো সময় কবরে পরিণত হতে পারে। হামলায় আহত মানুষ কাতরাচ্ছে, শিশুরা কাতরাচ্ছে। এ পর্যন্ত সহস্রাধিক নারী-পুরুষ-শিশু আহত হয়েছে।’
কারো হাত উড়ে গেছে, কারো পা উড়ে গেছে। মুখ ঝলসে গেছে, দেহের নানা জায়গা ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। ইসরাইল এ পর্যন্ত ৮০০ ফিলিস্তিনি স্থাপনায় হামলা করেছে। ইতোমধ্যে ১০ হাজার ফিলিস্তিনি বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। শুরুর কয়েকদিন প্রাণহানি হচ্ছিল মূলত গাজায়। শুক্রবার পশ্চিমতীরেও হামলা ছড়িয়ে পড়েছে। শনিবার গাজায় ১০ তলার একটি মিডিয়া টাওয়ার বিমান থেকে বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আল জাজিরা, এপি এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের অফিস ভবনটিতে ছিল। ভবনের মালিককে আগেই হামলার কথা জানিয়ে দেয়া হয়। তিনি ১০ মিনিট সময় চেয়েছিলেন, কিন্তু তাকে সময় দেয়া হয়নি। রোববার হামলা চালিয়ে ৩৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এর জবাবে গাজা থেকে হামাস রকেট হামলা চালায়। এতে ১০ ইসরাইলি মারা যায়। গাজার হামাস প্রধান এখন ইসরাইলি হামলার প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছেন।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু রেডিও-টিভি ভাষণে ঘোষণা করেছেন, একের পর এক হামলা চলতেই থাকবে। এ হামলা বন্ধের কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন উল্টো ইসরাইলকে জোরালো সমর্থনের কথা বলেছেন। অন্যদিকে তিনি ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্টকে ফোন করে হামাসের রকেট হামলা বন্ধ করতে বলেছেন। দেশে দেশে মুসলমানরা ইসরাইলের এ বর্বর হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছেন, ইসরাইলকে সম্মিলিতভাবে এখনই থামাতে না পারলে আল আকসা থেকে তার চোখ পড়বে কাবা শরিফে। জাতিসঙ্ঘ এ নিয়ে রোববার বৈঠকে বসার কথা।
চলমান ঘটনার সূত্রপাত পূর্ব জেরুসালেম থেকে কয়েকটি ফিলিস্তিন পরিবারকে উচ্ছেদ দিয়ে হলেও নেপথ্য কারণ ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা চলছে। ঘুষ নেয়ার অপরাধে তার জেলে যাওয়ার কথা। সাম্প্রতিক নির্বাচনে তার দল ভালো ফল করেনি। কোনো ইসরাইলি নেতা বেকায়দায় পড়লে ফিলিস্তিনিদের নিশানা করে। নেতানিয়াহুও এ পথ বেছে নেন। ফিলিস্তিনিদের মধ্যে নানা উসকানির সৃষ্টি করেন। প্রথমে পূর্ব জেরুসালেমের শেখ জারাহ থেকে চারটি ফিলিস্তিনি পরিবারকে কোর্টের মাধ্যমে উচ্ছেদ করা হয়। এতে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। পুরনো শহরের দামেস্ক গেটে ফিলিস্তিনিরা জড়ো হয়ে ইফতার করত। এবার ইসরাইল তা বন্ধ করে দেয়। এতেও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। রমজানে ইসরাইলি পুলিশ বাড়াবাড়ি শুরু করে দেয়। শবেকদরের রাতে হামলা চালায়। এভাবেই হামলার প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়।
হামলার ফসল হিসেবে নেতানিয়াহু আরেকটি নির্বাচন করার পাঁয়তারা করছেন, যাতে ওই নির্বাচনে তার দল ভালো ফল করতে পারে। তবে নেতানিয়াহুর এ আশা কতটা পূরণ হবে তা সময়ই বলে দেবে।
বোমা আর গোলার আঘাতে ঝাঁজরা হওয়ার পরও ফিলিস্তিনিরা দলবেঁধে আল আকসা মসজিদে আসছেন। নারী-শিশুরা ইসরাইলি সেনাদের দিকে পাথর ছুড়ছে। ইসরাইলি হামলার জবাবে হামাস রকেট ছুড়ছে।
ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশ কবিতায় লিখেছেন, ‘বিষণ্ন আমার দেশ আবার ফিরে আসবে। উদিত হবে নতুন সকাল’। দাবিন তাতোর লিখেছেন, ‘প্রতিরোধ করো, আমার জনগণ। ওদের প্রতিরোধ করো।’ মুক্ত ফিলিস্তিন পৃথিবীর বুকে একদিন দাঁড়াবেই। যার রাজধানী হবে জেরুসালেম।
ইসরাইলের হায়রে আত্মরক্ষা!
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে ফোন করেছেন। হোয়াইট হাউজের বিবৃতিতে বলা হয়, বাইডেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, গাজা থেকে হামাস ও অন্যান্য সন্ত্রাসী পক্ষের রকেট হামলা ঠেকাতে ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। আর এই অধিকারের প্রতি তার একনিষ্ঠ সমর্থন অব্যাহত থাকবে।
আর ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে বাইডেন বলেন, ইসরাইলকে লক্ষ্য করে গাজা থেকে হামাস যেন রকেট হামলা বন্ধ করে।
এই হলো আমেরিকা। প্রেসিডেন্ট বদলায় কিন্তু ইসরাইল প্রশ্নে আমেরিকার নীতি বদলায় না। ক্লিনটন, বুশ, ওবামা, ট্রাম্প কিংবা বাইডেন- এরা সবাই এক।
ইসরাইলের তথাকথিত আত্মরক্ষা নিয়েই এদের যত মাথাব্যথা। ইসরাইল গাজায় ঝাঁকে ঝাঁকে জঙ্গি বিমান দিয়ে বোমা হামলা করে নির্বিচারে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, আমেরিকার চোখে তা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নয়, আত্মরক্ষার অধিকার।
অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদ তাদের চোখে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। নারী-শিশুসহ নিরীহ ফিলিস্তিনি হত্যার প্রতিবাদে গাজা থেকে হামাস বা অন্যান্য স্বাধীনতাকামী সংগঠন রকেট ছুড়লে সেটা সন্ত্রাস।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক ডক্টর আসিফ নজরুল যথার্থই বলেছেন, ‘যদি ১০০ জন ফিলিস্তিনি মারা যায় আর এর জবাবে ফিলিস্তিনিরা রকেট ছুড়ে তাতে যদি ইসরাইলের একজন মারা যায় তাহলে তা জঙ্গি তৎপরতা। যদি একজন ইসরাইলি মারা যাওয়ার জবাবে ইসরাইল বোমা মেরে ১০০ ফিলিস্তিনি মেরে ফেলে সেটা তখন আত্মরক্ষা। অনেক তথাকথিত সভ্যদেশও এভাবেই দেখে বিষয়টা। জাতিসঙ্ঘ আর মানবাধিকারের মাতব্বররা চালাকি করে দু’পক্ষকে বলে আত্মসংবরণ করতে। ৭০-৮০ বছর ধরে পৃথিবীতে এ ধরনের ভণ্ডামিই হচ্ছে।’ তিনি ফেসবুক পোস্টে আরো লিখেন, ‘আল জাজিরা, এপি আর সংবাদ মাধ্যমগুলোর অফিসে মিসাইল দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় শনিবার ঠিক ৩টায়। সাংবাদিকরা মাত্র ১০ মিনিট বেশি সময় চেয়েছিলেন তাদের সরঞ্জামগুলো বের করে আনার জন্য। এক সেকেন্ডও বেশি সময় দেয়া যাবে না, জানিয়ে দেয়া হয়। ঠিক ৩টায়ই মিসাইল অ্যাটাক হয়। নিশ্চিত থাকেন এটাকেও কেউ কেউ বলবে ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার।’
প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ফোনালাপে ইসরাইলের আত্মরক্ষার কথায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। আগেই বলেছি, যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট বদলালেও নীতি বদলায় না। ইসরাইলের ব্যাপারে তোতাপাখির মতো একই কথা আওড়ায় তারা। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সেখানে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। বাইডেন ট্রাম্পের ওই নির্দেশ বদলে দেননি। ১৯৭০ সাল থেকে ইসরাইল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্যের শীর্ষস্থানীয় প্রাপকদের একজন। মার্কিন সহায়তায় ইসরাইল বছরে তিন বিলিয়ন ডলার আয় করে।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা বিশ্ব কিংবা মানবাধিকারের তথাকথিত মাতব্বররা যা-ই বলুন, করুন কিংবা তৎপরতা চালান না কেন, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ব্যাপারে ফিলিস্তিনিরা নিজেকে উৎসর্গ করতে এক মুহূর্তও দ্বিধা করে না। এ মাটিতে একটি ফিলিস্তিনি শিশু জন্ম নিয়েই দেখে হত্যা। মা-বাবারাও তাকে সেভাবেই গড়ে তুলেন।
মিডিয়া টাওয়ারের ওই ভবন মালিককেই দেখুন। ইসরাইলি বোমায় তার ভবনটি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সেই ভবনের ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘এই ত্যাগ আমি লড়াইয়ের জন্য উৎসর্গ করলাম’। কী অসাধারণ মনোবল।
জেরুজালেম, পবিত্র মসজিদ আকসা
কুরআনুল কারিমের সূরা বনি ইসরাইলের ১ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘পবিত্র মহান সেই সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে এক রাতে তাঁর কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখানোর জন্য নিয়ে যান (মক্কার) মসজিদুল হারাম থেকে (জেরুসালেমের) বরকতময় পরিবেশপূর্ণ মসজিদুল আকসায়। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বশ্রেষ্ঠ।’
জেরুসালেমের পবিত্র মসজিদ যা বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসা নামে পরিচিত, মুসলমানদের কাছে খুবই সম্মানিত। পবিত্র কুরআনে উপরে উল্লিখিত আয়াতে এই মসজিদের কথা বলা আছে।
আমাদের প্রিয় নবীজি সা: মিরাজের রাতে মসজিদুল হারাম তথা কাবা শরিফ থেকে মসজিদুল আকসা তথা বায়তুল মুকাদ্দাসে ভ্রমণ করেন যা ‘ইসরা’ বা রাতের ভ্রমণ হিসেবে পবিত্র কুরআনে এসেছে। প্রিয় নবী সা: মিরাজে গমনের সময় সব নবী-রাসূলকে নিয়ে এই মসজিদে নামাজ পড়েছেন।
নামাজে তিনি ইমামতি করেন। এ জন্য মহানবী সা: ইসামুল আম্বিয়া, সাইয়্যিদুল মুরসালিন বা সব নবী-রাসূলের সর্দার হিসেবে স্বীকৃত। জেরুসালেমের এ এলাকা বহু নবী-রাসূলের স্মৃতিবিজড়িত। এখানে তাদের কবর রয়েছে। ফলে প্রতিটি মুসলমানের হৃদয়ে এ পবিত্র ভূমির প্রতি ভালোবাসা বিদ্যমান রয়েছে।
হজরত আবুজর গিফারি রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:কে জিজ্ঞাসা করলাম, বিশ্বের সর্বপ্রথম মসজিদ কোনটি? তিনি বললেন, ‘মসজিদুল হারাম’। তারপর বললাম, এরপর কোনটি? তিনি বললেন, ‘মসজিদুল আকসা’। আমি জিজ্ঞেস করলাম এই দুই মসজিদের নির্মাণের মধ্যে কত দিনের ব্যবধান রয়েছে? তিনি বললেন, ‘৪০ বছর’। অর্থাৎ কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর ‘আল আকসা’ মসজিদটি নির্মিত হয়। হজরত ইবরাহিম আ: কাবাঘর নির্মাণ করেন। তার পুত্র হজরত ইসহাক আ:-এর সন্তান হজরত ইয়াকুব আ: ফিলিস্তিনের জেরুসালেম নামক স্থানে ‘আল আকসা’ মসজিদ নির্মাণ করেন। এরপর তার ছেলে হজরত ইউসুফ আ: এবং বংশধর হজরত দাউদ আ:-এর সন্তান হজরত সুলাইমান আ: আল আকসা মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করেন। একই সাথে তিনি রমজান মাসের শেষ শুক্রবার জেরুসালেম নগর প্রতিষ্ঠা করেন। কাবা শরিফ প্রথমে কিবলা থাকলেও মসজিদুল আকসা নির্মিত হলে এটিই কিবলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। মহানবী সা:-এর হিজরতের দেড় বছর পর এ কিবলা পরিবর্তন হয়ে কাবা শরিফ কিবলা হিসেবে নির্ধারিত হয়ে ওহি নাজিল হয়। মদিনার যে মসজিদে নবীজি সা:-এর নামাজরত অবস্থায় কিবলা পরিবর্তন হয় সে মসজিদের নাম মসজিদে কিবলাতাইন।
মহানবী সা:-এর হাদিসে বলা হয়েছে- একমাত্র তিনটি মসজিদেই জিয়ারতের নিয়তে যাওয়া যায়। মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববী ও মসজিদুল আকসা। এর মধ্যে মসজিদুল হারামে নামাজ পড়লে এক লক্ষগুণ সওয়াব, মসজিদে নববীতে ৫০ হাজার গুণ সওয়াব, মসজিদুল আকসায় ২৫ হাজার গুণ সওয়াব হয়।
দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর রা:-এর সময়ে ৬৪৮ সালে বায়তুল মুকাদ্দাস, জেরুসালেমসহ পুরো ফিলিস্তিন সম্পূর্ণরূপে মুসলমানদের অধিকারে আসে। ১০৯৬ সালে খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা সিরিয়া ও ফিলিস্তিন জবরদখল করে নেয়। ১১৮৭ সালে মুসলিম বীর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি রহ. পুনরায় জেরুসালেম শহর মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন। এরপর থেকেই খ্রিষ্টান ও ইহুদি চক্র ফিলিস্তিনে ইসরাইলি রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। সুকৌশলে ফিলিস্তিনে ইহুদি সংখ্যা বাড়াতে থাকে।
আড়াই শ’ বছর ফিলিস্তিন মিসরের একটি প্রদেশ ছিল। এরপর এটি অটোম্যান সাম্রাজ্যের অধীন হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোম্যানদের পরাজয়ের পর ব্রিটেন ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তখন ফিলিস্তিনে বসবাসকারীদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠরা ছিল আরব মুসলমান এবং সংখ্যালঘু ছিল ইহুদি। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকায় পশ্চিমা সম্প্রদায় ব্রিটেনকে দায়িত্ব দেয় ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। আরবদের দাবি এই ভূমি তাদের। কিন্তু ইহুদিরা দাবি করে এই ভূমি তাদের পূর্ব পুরুষদের।
১৯২০ থেকে ১৯৪০-এর দশকে ইউরোপ থেকে দলে দলে ইহুদি আসতে থাকে ফিলিস্তিনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ইহুদি নিধনযজ্ঞের সময়ও অনেক ইহুদি পালিয়ে এখানে আসে। আরব ও ইহুদিদের মধ্যে সঙ্ঘাত চলতে থাকে। ১৯৪৭ সালে জাতিসঙ্ঘ ফিলিস্তিনকে দু’ভাগে বিভক্ত করে আরব তথা মুসলমান ও ইহুদি দুটি রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পাস করে। কিন্তু কুচক্রী ইংরেজরা জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাব পাস না করে ফিলিস্তিন ত্যাগ করে। পরিস্থিতি অনুকূল পেয়ে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরাইল একতরফাভাবে ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইল ফিলিস্তিনের পূর্ব জেরুসালেম ও পশ্চিম তীর এবং সিরিয়ার গোলান মালভূমি, গাজা এবং মিসরের সিনাই অঞ্চল দখল করে নেয়। তারা নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে জবরদখল করে ইহুদি বসতি স্থাপন করে।
গত ৫০ বছর ধরে ইহুদি বসতি স্থাপন অব্যাহত রয়েছে। ফিলিস্তিনিরা তাদের জন্মভূমির স্বাধীনতার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। পূর্ব জেরুসালেম, গাজা এবং পশ্চিমতীরে যে ফিলিস্তিনিরা বসবাস করছে তাদের সাথে ইসরাইলের সংঘর্ষ চলছেই। এবার ইসরাইল যে হামলা চালায় তা গত কয়েক বছরের মধ্যে ভয়াবহ।
১৯৬৭ সালে অবৈধ সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরাইল ‘মসজিদুল আকসা’ জবরদখল করে। মুসলমানরা পুনরায় এই মসজিদে উদ্ধার এবং ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে- মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ঐক্যের অভাবের কারণে এখনো মসজিদুল আকসা উদ্ধার করা যায়নি। ইরানের মরহুম ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ঐক্যের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন, মুসলিম ভ্রাতৃত্ব তথা রাষ্ট্রগুলো যদি এক হয় তবে লড়াইয়ের প্রয়োজন নেই, প্রত্যেক মুসলমান যদি এক বালতি করে পানি ঢেলে দেয় তাহলেই ইসরাইল নামের ইহুদি রাষ্ট্র তলিয়ে যাবে। তার আহ্বানেই প্রতি বছর আল কুদস দিবস পালিত হয়। আল আকসা উদ্ধারে এখন প্রয়োজন মুসলিম বিশ্বের ঐক্য। প্রয়োজন গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবির মতো একজন মুসলিম বীরের।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা