২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

এখনো কি আমরা অর্বাচীন থেকে যাবো?

এখনো কি আমরা অর্বাচীন থেকে যাবো? - ছবি : নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জ-নগর-বন্দর ও শহরে বহু জীবনঘনিষ্ঠ প্রবাদবাক্য ছড়িয়ে রয়েছে, যা থেকে অনেক কিছু শেখার আর বোঝার আছে। এমন একটি প্রবাদবাক্য হচ্ছে- ‘ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়’। এই প্রবাদটির মধ্যে যে গূঢ় তত্ত্ব অন্তর্নিহিত রয়েছে, তার যদি সরল ব্যাখ্যা খোঁজা হয়, তবে এটাই সম্ভবত অর্থ হবে যে, মানুষ তার বাস্তব জীবনে যে ভালো-মন্দের অভিজ্ঞতা অর্জন করে, সেই সঞ্চয়ের আলোকে যদি পথ চলা হয়, তবে ভবিষ্যতে অনেক আপদ-বিপদকে এড়িয়ে চলা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, জীবনের নানা অভিজ্ঞতায় আমরা ক’জন তা স্মরণে রেখে বিভিন্ন বালা-মসিবত নিজেরা এড়িয়ে যেতে পেরেছি? দুর্বল স্মৃতি, আর অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে অনভ্যস্ততার কারণে জীবনযুদ্ধে আমরা বহুবার বিপদগ্রস্ত হই। এটা নিছক যে কেবল ব্যক্তিজীবনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তা নয়। জাতীয় জীবনেও অতীতের বিভিন্ন আপদ-বিপদ থেকে সঞ্চিত অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের নেতৃত্ব দেশকে বিপদ থেকে মুক্ত রাখতে কি সক্ষম হয়েছেন? এমন নজির খুব কম ক্ষেত্রেই রয়েছে। ব্যক্তিজীবনে এমন দুর্ঘটনার জন্য অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিই দায়ী। কিন্তু জাতীয় জীবনের প্রসঙ্গ এলে তার দায় সমাজ বা রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন নেতাদের পক্ষে এড়ানো সম্ভব নয়। দায় এড়ানোর ক্ষেত্রে এমন দুর্বলতার জন্য তাদের নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা যোগ্যতা নিয়ে সমালোচনা করা অযৌক্তিক নয়। নেতৃত্ব দানের গুণাবলি অর্জন ব্যতিরেকে দায়িত্ব নেয়া একান্ত গর্হিত ব্যাপার। আর এভাবে দায়িত্ব পেলে বুঝতে হবে সমাজে দায়িত্ব পাওয়া বা দেয়ার প্রক্রিয়ায় অনেক বড় ত্রুটি রয়েছে। এমন ত্রুটি রেখে ভালো কোনো ফল পাওয়ার আশা করা অর্বাচীনের চিহ্ন। আমাদের জাতীয় জীবনে পূর্বাপর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে পরিষ্কার হবে, আমাদের ফল বঞ্চিত হওয়ার কারণ কী। আমাদের নেতারা ক্ষমতাকে উপভোগ করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা তথা দায়িত্বের বিষয়টি উপভোগের নয়, উপলব্ধির। এই উপলব্ধি যদি চেতনাকে শাণিত করে তবে দায়িত্ব পালনের গতানুগতিকতা দেখা যাচ্ছে, তথা নিজ গোষ্ঠীচিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারা। ক্ষমতা যখন দায়িত্বে পরিণত হবে তখন তা আপনা আপনি পদতলে লুটিপুটি খাবে। নেতৃত্ব আর চাইতে হবে না, জনগণ স্বেচ্ছায় তা দেবে।

জাতীয় নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত সাধারণের চেয়ে বহু গুণ বেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করে সমৃদ্ধ হবেন এটাই সবাই আশা করে। নেতৃবৃন্দের এই অর্জন থেকে সাধারণ মানুষ সমৃদ্ধ হতে কতটা উদ্বুদ্ধ করতে তারা পেরেছেন সেটাও বিবেচ্য বিষয়। তবে কথা হচ্ছে নেতৃবৃন্দ আজ প্রতিকূল আর নেতিবাচক পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে নিজেরা কি তাদের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার পূর্ণ করতে পারছেন? প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে আরো একটা প্রবাদবাক্য বিবেচনায় চলে আসে। সেই প্রবাদবাক্যটি হলো- ‘আপনি আচরি ধর্ম অপরে শিখাও’। এভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে: জাতীয় নেতৃবৃন্দ সমাজ ও সামগ্রিক পরিবেশ-পরিস্থিতি থেকে নিজেদের কতটা সমৃদ্ধ করতে পেরেছেন যে, দেশবাসীকে তারা সে আলোকে চলতে পরামর্শ দেবেন। আজ এ কথায় কেউ হয়তো দ্বিমত করবেন না যে, দেশের আর্থসামাজিক জীবনে শান্তিশৃঙ্খলার এক নিদারুণ সঙ্কট আর চরম অনটন চলছে। এই পরিস্থিতির জন্য সমাজের নেতৃত্বের আসনে যারা রয়েছেন তাদের পক্ষে তখনই কেবল দায়িত্ব পালিত হবে, যখন তাদের প্রজ্ঞা আর বিবেচনার সুবাদে সমস্যা থেকে উতরে যাওয়ার জন্য অভিজ্ঞতা আর অভিজ্ঞানে সঞ্চিত ভাণ্ডার থেকে তারা একটা সুষ্ঠু সমাধান বের করে আনতে সক্ষম হবেন। কিন্তু পরম পরিতাপ আর আক্ষেপের বিষয়, তারা তা করতে পারেননি। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে যে গরল নেতারা স্বয়ং ঢেলে দিয়েছেন, তা তারা শোধন করতে পারেননি। যদি নেতারা স্বয়ং সমাজকে বিষাক্ত করেন, মানুষের প্রতি তাদের ভালোবাসার নজির এটা নয়। কোনো সুবিবেচনার অধিকারী সাধারণ ব্যক্তির পক্ষেও এমন কাজ করতে গেলে তার বিবেকে বাধবে। নেতারা সমাজ বা রাষ্ট্রকে যেভাবে গড়ে তুলতে চান বা চেয়ে থাকেন সেভাবেই তো সমাজ গড়ে উঠবে। তাদের সদিচ্ছা এবং তা নিয়ে চর্চা সাধনা থাকলে তবেই শুধু সমাজের মানুষ শান্তি-স্বস্তি অনুভব আর কল্যাণ সমৃদ্ধি লাভ করতে পারত।

তা ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যদি তারা এভাবে গড়ে তুলতেন, যেখান থেকে নীতিবোধ সম্পন্ন যুবকরা সমাজে প্রবেশ করতে পারত, তাদের সেই শিক্ষা সমাজের বুক থেকে যত দুরাচার আর কদাচার দূর করতে সক্ষম হতো। কিন্তু যেসব প্রতিষ্ঠান তারা নিজেদের ভাবনার আলোকে সৃষ্টি করেছেন সেখান থেকে এখন যে তরুণ প্রজন্ম বের হচ্ছে তারা এমন কোনো বোধ বিবেচনা আর সত্য-নিষ্ঠার অনুশীলন করতে যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে দীক্ষা যেমন পায়নি; তেমনি দিচ্ছেও না, যাতে সমাজ থেকে অন্ধকার দূরীভূত হতে পারে। বরং সমাজপতিরা নিজেদের অবস্থান মজবুত করা আর প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যেকোনো গর্হিত পথে চলতে সামান্য দ্বিধাবোধ করেন না। এসব দুষ্কর্মে নিজেদের সহগামী করছেন তাদের হাতে গড়া তরুণ প্রজন্মকে নিজেদের মধ্যে এমন দুরাচার রেখে।

তাদেরই নেতৃত্বে শুদ্ধাচারের আন্দোলন সৃষ্টির স্বপ্ন কি কেউ দেখতে পারে? আর শুদ্ধাচারের বিষয়টি রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানেই এগিয়ে নিতেই হয়, অন্যান্য দেশেও সেটাই হয়েছে। বিভিন্ন দেশ শুদ্ধাচারের ভিত্তি করে থাকে সামাজিক মূল্যবোধকে। অনেক আগে বাংলাদেশেও শুদ্ধাচারকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সরকারি উদ্যোগের কথা আমরা শুনেছি। এ জন্য বিধিবিধান প্রণয়নের চেষ্টার কথাও জেনেছি। কিন্তু তারপর আর কোনো অগ্রগতি নেই। বস্তুত বাংলাদেশে গত পাঁচ দশকে নীতিনৈতিকতার উৎকর্ষের জন্য জাতীয় নেতৃত্ব বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় ছিলেন বা এখন রয়েছেন, তাদের এ জন্য কিছু করতে দেখা যায়নি, যে কথা উপরেই উল্লেখ করেছি। সম্ভবত এর কারণ এটাই যে, দলের দাপট এবং শক্তির উৎস হচ্ছে তাদের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের ‘মাসলম্যান’ তথা ক্যাডাররা। এই ‘ক্যাডার’ হওয়াটাই এখন তাদের পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা তো আর কোনো কাজের উপযুক্ত নয়, তাই কোনো কর্মে নিযুক্ত বা কোনো পেশার সাথে সংযুক্ত নয়, তাদের আয়-রোজগারটা হবে কিভাবে? তারা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে চাঁদাবাজি এবং অন্যান্য গর্হিত পথ থেকেই অর্থ সংগ্রহ করে ঠাট বজায় রেখেই চলে। এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলে মূল সংগঠন তথা ক্ষমতাসীনরা ক্যাডার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে। যখনই যারা ক্ষমতাসীন হয়েছে তাদের শক্তির ভিত্তি এমন ক্যাডাররাই। ক্ষমতাসীনরা এমন কোনো কাজ খুব কমই করেছেন, যা মানুষের কল্যাণে এসেছে। মানুষ তবে কোন কারণে ক্ষমতাসীনদের ভিত্তি হিসেবে দাঁড়াবে? আর আজকাল তো ভোটের সময়ও সাধারণ মানুষের খুব একটা প্রয়োজন হয় না। কেননা বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে নির্বাচনের যে নতুন রীতি-পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়েছে, সে জন্য ভোটার নয়, ক্যাডারদের দরকার হয়। সে জন্য সাধারণ ভোটারদের সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির কোনো গুরুত্ব নেই। আইনের কেতাবে নির্বাচনের যে ধারণা আর বিধিবিধান, পথ-পদ্ধতির কথা রয়েছে, তা এখন শুধু কেতাবে স্থায়ী হয়ে রয়েছে। বাস্তবে নেই তার কোনো চর্চা, অনুসরণ, অনুশীলন। একদা ভোটচর্চার কথা হয়তো আজকের প্রজন্ম শুনেছে। কিন্তু বাস্তবে দেখছে ভিন্ন ব্যাপার। ক্যাডারদের নৈশ অভিযানে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে যায়। সে এক অভিনব ব্যাপার : পূর্ব রাত্রি নামার পর ভোট কেন্দ্রগুলোর বাইরে কঠোর প্রহরা। ভেতরে সুনসান নীরবতা।

এরই মধ্যে দলীয় ক্যাডাররা ভোট সম্পন্ন করছে। ভোটের নির্দিষ্ট সময়ে সাধারণ ভোটারদেরই ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। যে শুদ্ধাচারের কথা বলে এসেছি, তা যদি রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে কায়েম হয় তবে এসব নেতা ও তাদের ক্যাডারদের ‘কেরামতি’ শেষ হয়ে যাবে। সমাজ যদি শুদ্ধাচার নিয়ে সচল হয় তবে আজকের নেতা ও তাদের সহযোগী ক্যাডাররা তো অচল হয়ে পড়বে। নিজের এমন সর্বনাশ করার চিন্তা তো তাদের মাথায় আসতে পারে না। আজকে ক্যাডাররা যে রাজসিক জীবনযাপন করে আসছে কোনো শ্রম সাধনা ছাড়াই, সেই সুখ-আনন্দের জীবন থেকে বৃন্তচ্যুত হওয়ার কল্পনাও তাদের আসতে পারে না।

আসলে আজকে সমাজপতিদের হাল অবস্থা দেখে এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হতে হবে যে, তারা একান্ত নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপারে নিতান্ত অন্ধ। তাদের পক্ষে সাধারণ মানুষের উন্নতি-প্রগতির পক্ষে চিন্তা সাধনা এবং তার জন্য কাজ করা আদৌ সম্ভব নয়। তাই এই জনপদের সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য তাদের শুভাকাক্সক্ষীদের এগিয়ে আসা ভিন্ন কোনো বিকল্প নেই; সাধারণ মানুষের প্রতি যাদের প্রীতি প্রতিশ্রুতি শুভেচ্ছা রয়েছে। ক্ষমতার দণ্ডটা তাদের হাতে তুলে দেয়ার যে স্বাভাবিক দিকনির্দেশনা সংবিধানে রয়েছে তথা সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা আজ কিন্তু বড় কঠিন করে ফেলা হয়েছে। এর ইঙ্গিত এ লেখায় রয়েছে। তারপর দেশ ও দশের জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। তবে এই কঠিন অবস্থায়ও তার ক্ষীণ একটা আলোকরশ্মি দেখা যাচ্ছে। তাকে উজ্জ্বলতর করে তোলার জন্য ব্যক্তি ও ছোট-বড় সব সংগঠনকে নিজেদের মধ্যকার বিভেদ আর মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। সরকার এবং পক্ষ-বিপক্ষ সবার এখন সময় এসেছে এটা বোঝার যে, দেশকে আসলে এগিয়ে নেয়া যাচ্ছে না। প্রশাসনের সাথে জন সম্পৃক্তি ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। প্রশাসনের এই জনসম্পৃক্তি বৃদ্ধি করা এখন একান্ত অপরিহার্য। তা না হলে আমাদের ভোগান্তি কেবল বাড়তে থাকবে।

সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তিটা আজ এমন এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তাতে বিশ্বসমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর নৈতিক শক্তিটা কোথায়? আমরা এখন বরং অচ্ছুত হওয়ার পথে। ইদানীং সমাজপতিদের কণ্ঠে এ কথা বারবার শুনে আসছি যে, আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তাদের এই ‘এগিয়ে যাওয়া’র কথাটার অর্থটা যে কী আর তার পথ-পন্থাই বা কোনটা, তা তো সাধারণের বোধগম্য নয়। তারা যে ধ্যানধারণা নিয়ে যেখানে অবস্থান করছেন, সেখানে সত্যিকার অর্থে এগোনো-পিছানোর বিষয়টি উপলব্ধি করা খুব কঠিন। সার্বজনীন বোধ-বিবেচনা তথা সরল অর্থে বর্তমান অবস্থান থেকে উপরে উঠে আসা অত্যন্ত কঠিন একটি ব্যাপার। কেননা ইতোমধ্যে সমাজকে নেতারা যে অতলে নিয়ে গেছেন, সত্যিকার অর্থে উপরে ওঠার জন্য যদি কোনো বড় পরিবর্তনের ধারণা নিজেদের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত করতে না পারা যায়, ওঠার সিঁড়ি এখন এতটা পিচ্ছিল হয়ে আছে যে, তা থেকে কেবল পিছলে পড়ে হাত-পা ভাঙার উপক্রম হবে। ওপরে ওঠার স্বাভাবিক যে পথ তাকে রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।

বিশ্বের বহু দেশ সাম্প্রতিককালেই আমাদের চেয়ে অনেক উপরে উঠে গেছে। তাদের পথপরিক্রমটা আসলে প্রথমেই আমাদের জানতে বুঝতে ও শিখতে হবে। তার আর কোনো বিকল্প নেই। পথ না চিনতে পারলে পথ হারানোর ভয় তো থাকবেই। অন্যান্য দেশের এগিয়ে যাওয়ার কারণটা হলো, নীতিনৈতিকতা ও বৈষয়িক সততার বিষয়গুলোকে সমান্তরালভাবে তারা এগিয়ে নিয়ে গেছে। সেসব দেশের নেতৃবৃন্দ প্রকৃত অর্থেই জনগণের উন্নত জীবনের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাই আমাদের এখানে প্রথমে সব কিছু পাল্টে ফেলতে হবে। নেতাদের মধ্যে এই বিবেচনা পুষ্ট করতে হবে যে, দেশটা দশের। এই দশের যদি ক্রমাগত অবনতি ঘটতে থাকে, সেই ব্যর্থতা দশের কাণ্ডারিকেই বহন করতে হবে। না হয়, একসময় পরিস্থিতি কারো নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। সবাইকে অতলে নিমজ্জিত হতে হবে।
বিশ্বে যারা বৈষয়িক উন্নতির পথে দ্রুত এগিয়ে গেছে, তারা নীতিনৈতিকতা আর জবাবদিহিতার ষোল আনাই চর্চা করে। তারা নীতিচ্যুত যাতে না হয় সে জন্যই জবাবদিহিতার অনুশীলন হয়ে থাকে কঠোরভাবে। এমন জবাবদিহিতার আরো কারণ রয়েছে। জনগণের প্রতি যে দায়বদ্ধতা সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্ণধারদের রয়েছে সেটাও তারা এভাবে সম্পন্ন করে থাকেন। জনগণের আস্থা-বিশ্বাস নেতাদের ওপর এভাবে অটুট রাখার চেষ্টা করা হয়। কখনো কোনো নেতার এতটুকু বিচ্যুতি ঘটলে তার প্রতিবিধান করতে সামান্যতম অনুরাগ বা অনুকম্পা দেখানো হয় না। শুদ্ধাচারের যে সার্বজনীন নীতি তা থেকে দূরে সরে আসার কথা ভাবাই হয় না। সেখানে জনপ্রতিনিধিদের পরিষদ সরকার ও তার প্রশাসনের সার্বক্ষণিক তদারকিতে থাকে। শুধু সাধারণ রুটিন কাজই নয়, অর্থনৈতিক দিকসহ সব স্পর্শকাতর বিষয় অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়। তাই সেসব দেশের নেতাদের নিছক মুখে এগিয়ে যাবার কথা বলে পরিত্রাণ পাওয়া জো নেই।

আমাদের জনশক্তি নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা পূর্বে করে এসেছি। আসলে বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যা নিয়ে মাথাব্যথার যেমন কারণ রয়েছে তেমনি সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের পথও রয়েছে। বিশ্বের বহু দেশ তার বিপুল জনশক্তিকে প্রশিক্ষণ আর দীক্ষা দিয়ে সম্পদে পরিণত করেছে। পৃথিবীতে এমন বহু দেশ আছে যারা বাইরে থেকে জনশক্তি নিজেদের দেশে নিয়ে গিয়ে তাদের আয় উন্নতিকে ত্বরান্বিত করছে। আমরা যদি আমাদের জনশক্তিকে নিয়ে কোনো সুষ্ঠু চিন্তাভাবনা না করি, তবে সেই জনশক্তি এক উচ্ছৃঙ্খল বিকৃত জনতায় পরিণত হবে। তখন সমাজ ও রাষ্ট্র সব কিছু ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। আমরা হয়তো ভুলে গিয়েছি, এই দেশের স্থপতি রূপকার এবং তার যোগ্য সতীর্থরা গোটা জীবন এ দেশকে সৃষ্টির জন্য অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা আর সংগ্রাম করেছেন। জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। দেশটাকে শুধু অর্জন করেই দেননি। তাকে সুষ্ঠুভাবে গঠন করার জন্য রূপরেখা তৈরি করে দিয়ে গেছেন। তার উত্তরসূরিদের ভুল-ভ্রান্তির কারণে দেশের স্থপতির সেই স্বপ্ন যদি মরীচিকায় পরিণত হয় তবে আজকের দায়িত্বশীলরা তার দায় এড়াতে পারবেন না। অতীতে আমরা বহু ভুল করেছি। বিশেষ করে দেশের স্বপ্নদ্রষ্টা পথ চলার যে দিকদর্শন দিয়ে গেছেন তা থেকে আমরা অনেক দূরে সরে গেছি।

সে কারণে আগে ব্যর্থ হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর প্রকৃতপক্ষে এখন কিন্তু সে পথেই রয়েছি। আমাদের পূর্বসূরিদের প্রখর মেধা বিবেচনা আমরা দেখেছি। কিন্তু আজ মেধা বুদ্ধি খাটিয়ে তার দ্রুত সমাধান দিতে পেরেছেন এমন নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। পঞ্চাশ বছর হতে চলেছে, আমরা স্বাধীন হয়েছি। এই সময়টা তো কম নয় কোনো দেশের ভাগ্য বদল করার জন্য। বিশ্বের বহু দেশ গত ৫০ বছরে তাদের এতটা উন্নতি করতে পেরেছে যে, যেসব দেশের নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান যেন ‘আকাশ ছোঁয়া’র মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই উন্নতির পেছনে যে কেবল তাদের লুক্কায়িত খনিজসম্পদ বড় অবদান রেখেছে তা নয়। সুষ্ঠু পরিকল্পনা আর তার পেছনে মেধা পরিশ্রম আর সৎ নেতৃত্বই তাদের এগিয়ে নিয়েছে। আমরা কি বলতে পারব, আমাদের কোনো সুষ্ঠু যুৎসই পরিকল্পনা এখন আছে? আমাদের যতটুকু অর্থসম্পদ তা নিয়ে অহরহ চলেছে লুটপাট। দুর্নীতিতে বিশ্বে আমাদের ‘নাম-ডাক’ এতটাই যে তার খবর সবার নখদর্পণে।

এগিয়ে যাবার কথা শুধু মুখে উচ্চারণ করলে চলবে না। তার যত প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সবার কাছে যা চিহ্নিত। সেসব তথা দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিকে দেশ থেকে নির্বাসনে পাঠাতে হবে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, কোভিড থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য টিকা নিয়ে গোটা বিশ্ব যেখানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে- কে প্রথম তাদের নাগরিকদের নিরাপদ করার জন্য টিকা সংগ্রহ করবে, আর এখানে অভিযোগ উঠেছে যে, টিকা নিয়ে স্বজনপ্রীতির ঘটনা ঘটেছে। ফলে টিকা পেতে আমরা জটিল সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি যে টিকার সাথে মানুষের এখন জীবন মরণ সমস্যা জড়িয়ে আছে; সেখানে এমন অভিযোগ চরম দুর্ভাগ্যের। শুধু তা-ই নয়, টিকা নিয়ে আমাদের একদেশদর্শিতা লক্ষ করা গেছে। টিকা নিয়ে কোনো জরুরি পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তার কোনো বিকল্পের চিন্তা প্রথমে মাথায় রাখা হয়নি। এটা অবশ্যই প্রশাসনের অদূরদর্শিতার একটি নজির। বিষয়টির গুরুত্ব তারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হননি। এ দায়িত্ব বুঝতে না পারাটা প্রকৃতপক্ষে চরম অদক্ষতা। এমন ঘটনা অন্য যেকোনো দেশে ঘটলে দায়িত্বশীলদের নাস্তানাবুদ হতে হতো।
আমরা যে প্রবাদবাক্যটি নিয়ে এই লেখার সূচনা করেছি তার রেশ ধরে এ লেখা শেষ করতে চাই। সুদূর অতীতে এ দেশের বিজ্ঞজনরা তাদের জীবন সঞ্জাত অভিজ্ঞতার কথা মনে রাখার জন্য বলে গেছেন। আজ এই প্রগতি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে আমরা যে এখনো কত অর্বাচীন রয়ে গেছি তার ভূরি ভূরি প্রমাণ রেখে চলছি।

ndigantababor@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement
২৩ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ১৭২ কোটি ৬৩ লাখ ডলার বান্দরবানের গহীন জঙ্গলে কেএনএ’র গোপন আস্তানার সন্ধান হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে ডিসি মশিউর ও এডিসি জুয়েল বরখাস্ত গাজীপুরে আরো এক মামলায় খালাস পেলেন তারেক রহমান রাজশাহীর ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে আইসিইউ ইউনিট উদ্বোধন ডেঙ্গুতে এক দিনে বছরের সর্বোচ্চ মৃত্যু, হাসপাতালে ১০৭৯ পার্থ টেস্টে জয়ের সুবাস পাচ্ছে ভারত ব্যবসায়ী জালাল উদ্দীন হত্যা : শেখ হাসিনাসহ ১২৯ জনের নামে মামলা ডিসেম্বর থেকে যাত্রীবাহী ট্রেন চলবে ঢাকা-নড়াইল-খুলনা রুটে নারায়ণগঞ্জে ১৬ কোটি টাকার ভারতীয় কাপড় উদ্ধার গলাচিপায় জালে ধরা পড়ল ২০০ বছরের জলপাইরঙ্গা কাছিম

সকল