আইন যখন ‘কচুপাতার পানি’
- তৈমূর আলম খন্দকার
- ০৭ মে ২০২১, ২১:০৩
‘আইন নিজস্ব গতিতে চলে’ এটি একটি বহুল প্রচলিত ও প্রচারিত আপ্তবাক্য, কিন্তু অন্যান্য অনেক ‘বেদ’বাক্যের মতো এ উক্তিটি মিথ্যা ও বানোয়াট। সুবিধাভোগী মহল আইনের নিজস্ব গতি আছে মর্মে প্রচারের মাধ্যমে নিজেরা লাভবান হচ্ছে, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অসহায় মানুষ যাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বা মামা বা টাকার জোর নেই। রয়েছে শুধু বুকফাটা কান্না এবং চোখে-মুখে হতাশা। ‘আইন’ একটি নির্জীব পদার্থ। তবে প্রয়োগের মাধ্যমে এর সরব গতি ফিরে আসে। নিজস্ব গতিতে নয়, বরং আইন যারা প্রয়োগ করে, তাদের গতিতেই আইন চলমান হয় এবং আইন প্রয়োগকারীর প্রয়োগ করার ইচ্ছাশক্তির ওপরই নির্ভর করে আইনের গতি কতটুকু কার্যকর।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, গত ২৮ এপ্রিল গুলশান থানাধীন অভিজাত ফ্ল্যাটে নিহত কলেজছাত্রী মোশারত জাহান মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান তানিয়ার অভিযোগ- তার ছোট বোন মুনিয়াকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু দেশবাসী দেখল যে, গুলশান থানায় মামলা রেকর্ড করা হয় দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারায়। (সূত্র : গুলশান থানা মামলা নং-২৭(৪)২০১১ ধারা ৩০৬ দণ্ডবিধি)। অর্থাৎ মামলাটি করা হয়েছে ‘আত্মহত্যার প্ররোচনা দেয়া’। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত হত্যা নয়, আত্মহত্যার অজুহাত পুলিশ দেখাতে পারে।
কিন্তু বাস্তব অবস্থা কী সেটাই পর্যালোচনার বিষয়। ইতঃপূর্বে সংশ্লিষ্ট শিল্প গ্রুপের মালিকের এক পুত্র সাব্বির হত্যার আসামি হয়েছিলেন, সে মামলার ফলাফল কী হয়েছে, দেশবাসী এখনো তা জানতে পারেনি। মামলাটি এখন ডিপ ফ্রিজে। মুনিয়ার এ মামলা কখন কোথায় হারিয়ে যাবে, তাও আঁচ করা যাচ্ছে না। আইন কখনো কখনো রুদ্রমূর্তি ধারণ করে এবং কোনো কোনো সময় তা কর্পুরের মতো বাতাসের সাথে মিশে যায়। তবে আইন কখন কোন মূর্তি ধারণ করবে, তা নির্ভর করে ভিটামিনের ওপর। ভিটামিন (টাকা) যে যত ঢালতে পারে সে আইনের মজা তত লুটতে পারে। আগেই বলেছি, আইন নির্জীব জড় পদার্থের মতো, যে যেভাবে খুশি এর প্রয়োগ করে। তবে এ ক্ষেত্রে ‘সরকারি দল’ এবং ‘ভিটামিন’ যদি একত্র হয়, তবে হয়ে যায় ষোলকলা পূর্ণ।
কোনো ঘটনা ঘটলেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সেতুমন্ত্রী বলে থাকেন, ‘কাউকে ছাড় দেয়া হবে না’। কিন্তু ছাড় তো তারা দিয়ে দিয়েছেন। পত্রিকায় প্রকাশ- ঘটনার দুই দিনের মধ্যে প্রধান আসামি, ওই গ্রুপের এমডি ও তার পরিবারের মোট আট সদস্য বিশেষ চার্টার্ড বিমানে দুবাই চলে গেছেন; যেমন ঘটেছিল আরেক গ্রুপের দুই পুত্রধনের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পরও। বিশেষ ব্যবস্থায় বাংলাদেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন, দেশে ফিরেছেন পিতার মৃত্যুর পর। দেশে ফিরেই আবার জামিন পেয়ে গেছেন। কারণ তারা বাংলাদেশের অন্যতম বড় ধনী। ফলে এটাই বলা বাহুল্য যে, আইন কখনো কখনো কচুপাতার পানিতে পরিণত হয়। এ জন্য প্রয়োজন শুধু ভিটামিন, অর্থাৎ টাকা, টাকা এবং টাকা, যা প্রতিরোধে কোভিড-১৯-এর মতো কোনো বিকল্প পন্থা এখনো আবিষ্কার হয়নি, বিশেষ করে বাংলাদেশে। ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড় না দিলে আসামিদের নিয়ে বিমান আকাশে উড়ল কিভাবে? এরপরও ‘ছাড়’ না দেয়ার জন্য মন্ত্রীর হুমকি-ধমকি কোথায় থাকে? এগুলো কি লোকদেখানো বুলি মাত্র?
রাজধানীর পার্শ্ববর্তী উপজেলা রূপগঞ্জে প্রথমোক্ত গ্রুপের প্রধান একটি আতঙ্কের নাম। তার হাউজিং কোম্পানি সাইনবোর্ড এখন রূপগঞ্জের আনাচে-কানাচে সর্বত্র। খাল-বিল, নদী-নালা, তিন ফসলি জমি, গোরস্তান, ঈদগাহ, মসজিদ, স্কুল সবই তারা বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলছে। বাধা দিতে গিয়ে গুম হওয়ার ঘটনাও রয়েছে। কৃষকদের কাছ থেকে জমি ক্রয় না করে ভরাট করে ফেলায় হাইকোর্টে গ্রামবাসী রিট করে দীর্ঘ শুনানির পর হাইকোর্ট বালু ভরাট বন্ধ রাখার জন্য তাকে নির্দেশ দিলেও হাইকোর্টের আদেশ কার্যকর হয়নি, বরং জমি ভরাটের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে।
বহু আক্ষেপ করে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি বলেছেন, আমরা কনটেম্পট করতে করতে হয়রান। এতেই প্রতীয়মান হয় যে, আইন কখনো কখনো কচুপাতার পানিতে পরিণত হয়, যার জন্য বিচার বিভাগের অবদান কম নয়। উল্লিখিত শিল্প গ্রুপের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এলাকাবাসী বহুবার মানববন্ধন করেছে, প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের ডিসি, এমপি, টিএনওর কাছে ধরনা দিয়েও কোনো প্রতিকার পায়নি। দৃশ্যত মনে হয় রাষ্ট্র যেন ধনী লোকদের পকেটে চলে গেছে।
এ দিকে নিহত মুনিয়ার ভাই সরকারদলীয় হুইপ ও চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য পুত্র শারুনের বিরুদ্ধে বোনের হত্যাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করে ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মামলা করেছেন। ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয় বলেছেন, তিনি ‘নথি দেখে আদেশ’ দেবেন। ধনী বা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হলেই ‘নথি দেখে আদেশ’ দেয়ার প্রশ্ন উঠে। ফলে ওপরের নির্দেশই ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে মামলার ভাগ্য নির্ধারিত হয়। তবে এ মর্মে আইনি বিধান নিম্নে উল্লেখ করা হলো। ফৌজদারি কার্যবিধির ২০৫(ঘ) ধারায় উল্লেখ রয়েছে-
‘১. পুলিশ রিপোর্ট ছাড়া অন্য প্রকারে দায়েরকৃত মোকদ্দমার (অতঃপর নালিশি মামলা বলে উল্লিখিত) অনুসন্ধান বা বিচার চলাকালে যদি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দৃষ্টিগোচর করা হয় যে, তাহার আদালতে অনুসন্ধান বা বিচারাধীন অপরাধটি সম্পর্কে একটি পুলিশি তদন্ত চলিতেছে, তখন ওই ম্যাজিস্ট্রেট তার দ্বারা পরিচালিত অনুসন্ধান বা বিচারকার্য স্থগিত রাখিবেন এবং ওই বিষয় সম্পর্কে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার রিপোর্ট তলব করিবেন। ২. যদি তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা ধারা ১৭৩-এর অধীন রিপোর্ট পেশ করেন এবং এরূপ রিপোর্টের ভিত্তিতে ম্যাজিস্ট্রেট যে ব্যক্তি নালিশি মোকদ্দমার আসামি তার বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নেন, তাহা হইলে ম্যাজিস্ট্রেট নালিশি মামলা এবং পুলিশ রিপোর্টের ভিত্তিতে দায়েরকৃত মোকদ্দমা একই সাথে অনুসন্ধান বা বিচার করিতে পারিবেন যেন উভয় মামলাই পুলিশ রিপোর্টের ভিত্তিতে দায়ের হইয়াছে।
৩. পুলিশ রিপোর্টে যদি নালিশি মোকদ্দমার কোনো আসামি জড়িত না হয় বা পুলিশ রিপোর্টের ভিত্তিতে ম্যাজিস্ট্রেট যদি কোনো অপরাধ আমলে গ্রহণ করেন, তাহা হইলে তিনি যে অনুসন্ধান বা বিচার স্থগিত রাখিয়াছিলেন, অত্র কার্যবিধির বিধান অনুসারে সেই অনুসন্ধান বা বিচার কার্যে অগ্রসর হইবেন।’
যাদের ক্ষমতা ও টাকা আছে তাদের কাছে ‘আইন’ কচুপাতার পানির মতোই মনে হয়। হত্যার মতো ঘটনা ঘটলেও তারা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। হুইপপুত্রের প্রথম স্ত্রী তার অত্যাচারে তাকে তালাক দিয়েছে বলে প্রকাশ পেয়েছে। মেয়েটি যদি নারী নির্যাতনের জন্য স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করত তবে হয়তো ‘নথি দেখে আদেশ’ দেয়ার মন্তব্য করে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট থেকে নেমে পড়তেন। তালাক দেয়া প্রথম স্ত্রী জানিয়েছে, তাকে দেনমোহরের টাকা পর্যন্ত দেয়া হয়নি। প্রভাবশালী ধনী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা নেয় না- এমন বহু প্রমাণ আছে। দৃশ্যত মনে হয় পুলিশ ও ধনী ব্যক্তিদের জন্যই যেন দেশটি স্বাধীন হয়েছিল, কারণ এ দু’টি শ্রেণীই সুখে ও নিরাপদে আছে, বাকি জনগণ রয়েছে জিম্মি অবস্থায়।
‘আইনের’ দুমুখী আচরণের কারণে আইনের প্রতি গণমানুষ আস্থা হারাচ্ছে। ফলে ‘আইন’ সবাইকে সুফল দিতে পারছে না। যারা সুফল ভোগ করছেন তারা আইনের বাম হাতকে (Left Hand of the Law) ব্যবহার করেই আইনি সুবিধা ভোগ করছেন। এ মর্মে নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা (যিনি সেতুমন্ত্রীর ছোট ভাই হয়েও মন্ত্রীর প্রতিপক্ষ) আইন কিভাবে দুমুখী আচরণ করে তার একটি নমুনা উল্লেখ করেছেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার নেতাকর্মীদের জামিন চাইলে এক সপ্তাহ পরপর শুনানির তারিখ দেয়া হয়, কিন্তু জামিন হয় না। অন্য দিকে বাদলের (সেতুমন্ত্রীর অনুগত) মামলার শুনানি ২৫ মার্চ নির্ধারণ করা হলেও এক ঘণ্টা পর দু’টি মামলায় জামিন হয়।’ এ মর্মে মেয়র প্রধান বিচারপতির কাছে প্রশ্ন রেখেছেন, ‘এটি কেমন বিচারব্যবস্থা?’
প্রধান বিচারপতির কাছে কাদের মির্জা যে প্রশ্ন রেখেছেন- এ প্রশ্ন আজ স্বাধীন বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের, যারা আইনের যাঁতাকলে আইন প্রয়োগকারীদের দুমুখী আচরণের শিকার। মাননীয় প্রধান বিচারপতির সরল স্বীকারোক্তি প্রশংসার দাবি রাখে বটে, কিন্তু দায়িত্বে ব্যর্থতার দায় কেউ এড়াতে পারেন কি? বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি আইন প্রয়োগে হয়রান হয়ে থাকেন যদি, তবে ভুক্তভোগী জনগণের অবস্থা কী দাঁড়ায়। স্বাধীনতার সুফল সার্বিকভাবে দেশের সব মানুষ ভোগ করতে পারছে না, মুষ্টিমেয় ভাগ্যবান ছাড়া। খেয়ে দেয়ে যাদের পেট মোটা হয়ে গেছে, সে পেট আরো মোটা করার জন্য প্রতি জেলায় চলছে শাসক দলে ভাগ বাটোয়ারার লড়াই, সে লড়াইকে সরকার বন্ধ করতে পারছে না। শুধু শোনা যাচ্ছে ‘কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা