২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

দাবা বিশ্বকাপ : নিয়াজ মোরশেদের জন্য শুভ কামনা

নিয়াজ মোরশেদ - ছবি : সংগৃহীত

‘দক্ষিণ এশিয়ায় তিনিই প্রথম
এশিয়াতে স্থান কোথা? সেও পঞ্চম।
বলছি নিয়াজ-কথা
এই দেশে তিনিই তো দাবার দিশারী
গ্র্যান্ড মাস্টার হন, বুদ্ধির ভেলায় দেন গাঙ পাড়ি।’

গ্র্যান্ড মাস্টার নিয়াজ মোরশেদকে নিয়ে কবি হাসান হাফিজের ছড়ার কয়েকটি লাইন। দাবায় বাংলাদেশের জন্য প্রথম সম্মান বয়ে এনেছিলেন নিয়াজ মোরশেদ। আমাদের সেই নিয়াজ মোরশেদ দাবায় আবারও আলোড়ন তুলতে যাচ্ছেন। আনন্দের খবর-দাবা বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন নিয়াজ। আগামী ১০ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট রাশিয়ায় অনুষ্ঠেয় দাবা বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন তিনি। করোনাভাইরাস মহামারী বাধা হয়ে না দাঁড়ালে বিশ্বকাপে নিয়াজ খেলবেন এবং বাংলাদেশের জন্য ফের সম্মান বয়ে আনবেন এ আশা আমরা করতেই পারি।
বিশ্বকাপে এটি নিয়াজ মোরশেদের দ্বিতীয়বার খেলা। ১৯৯৭ সালে হল্যান্ডে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলেছিলেন তিনি। কিন্তু সেবার সময়টা তার ভালো কাটেনি। ব্রাজিলের গিলবার্তো মিলোসের সঙ্গে দাবার লড়াইটা জমাতে পারেননি। ওই বিশ্বকাপ ১৯৯৬ সালে হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছিল দেড় বছর পর ১৯৯৭ সালে। নিয়াজ মোরশেদ সেই খেলা সম্পর্কে সাংবাদিকদের নিজেই বলেন, ‘তখন সবে বিয়ে করেছি। খেলার প্রতি মনোযোগ তেমন দিতে পারিনি। এটা ওটা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। ফলে সেই বিশ্বকাপ নিয়ে আমার একটা হতাশা আছে। সেই হতাশা এবার কাটাতে চাই। চব্বিশ বছর পর দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পাচ্ছি। সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাই না। এবার ভালো খেলতে পারি। প্রতিপক্ষের মধ্যে আমাকে হারানো সহজ হবে না। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক দাবারু আমাকে হালকাভাবে নিয়ে ধরা খেয়েছেন। আমি আশাবাদী এবার বিশ্বকাপেও প্রতিপক্ষকে ধরা খাওয়াব।’

বাংলাদেশের দাবায় নিয়াজ মোরশেদ এক অনন্য নাম। মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি জাতীয় দাবায় প্রথম অংশগ্রহণ করেন। এগারো বছর বয়সে হন জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। ১৯৮৭ সালে ২১ বছর বয়সে উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ড মাস্টার খেতাব অর্জন করেন নিয়াজ। তখন গোটা এশিয়াতেই গ্র্যান্ড মাস্টার ছিলেন মাত্র চারজন। ১৯৮৯ সালে দেশের প্রথম ক্রীড়াবিদ হিসেবে তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। দেশের জন্য বিরল সম্মান বয়ে আনায় এ পুরস্কার দেয়া হয়।

আশির দশকে দৈনিক বাংলা ভবনে প্রথম নিয়াজ মোরশেদকে দেখি। নিয়াজ মোরশেদকে সহকর্মী সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী দৈনিক বাংলায় নিয়ে আসেন।

কিংবদন্তিতুল্য ক্রীড়া সাংবাদিক মুহাম্মদ কামরুজ্জামানের সম্পাদনায় দৈনিক বাংলার ক্রীড়া পাতার তখন খ্যাতি ছিল পুরো সাংবাদিকতা জগতে। নিয়াজকে নিয়ে সেদিন ছাপা হয়েছিল অসাধারণ লেখা। বালক বয়সেই জাতীয় প্রেস ক্লাবে নিয়াজ মোরশেদ এক দাবা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে মাত করে দিয়েছিলেন। নিয়াজকে প্রেস ক্লাবের প্রতিযোগিতায়ও সালেহ ভাই-ই নিয়ে এসেছিলেন। নিয়াজ মোরশেদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী। আজ তিনি বেঁচে নেই। তিনি বেঁচে থাকলে নিয়াজ মোরশেদের বিশ্বকাপে খেলা নিয়ে হয়তো হইচই সৃষ্টি করে দিতেন।

বাংলাদেশে দাবার ইতিহাসে পথিকৃৎ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন। নিয়াজ মোরশেদ তার সঙ্গে দাবা খেলেছেন। আরো খেলেছেন কৃতী দাবাড়– অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে। দৈনিক বাংলায় আশির দশকে বাংলাদেশের কৃতী খেলোয়াড়দের নিয়ে একটি সাক্ষাৎকার সিরিজ ছাপা হয়েছিল। সাংবাদিক খায়রুল আনোয়ার মুকুল ও আমি সিরিজ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম।

দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায় একদিন আমার, আরেক দিন মুকুল ভাইয়ের নেয়া সাক্ষাৎকার ছাপা হতো। নিয়াজ মোরশেদের সাক্ষাৎকারটি তার ধানমন্ডির বাসায় গিয়ে আমি নিয়েছিলাম। এক ঘণ্টারও বেশি সময় তার সাথে কথা বলে আমার খুব ভালো লেগেছিল। তাই আজ যখন নিয়াজ বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন, খুব ভালো লাগছে। নিয়াজের জন্য দেশবাসীর শুভকামনা রয়েছে। দাবার ঘুঁটিতে আশা করি তিনি এমন চাল দেবেন যা বাংলাদেশকে আবার আনন্দে ভরে দেবে। যেমন নিয়াজ প্রথম গ্র্যান্ড মাস্টার হওয়ার পর আনন্দে দুলছিল বাংলাদেশ। প্রতিবেশী ভারত দাবায় প্রথম গ্র্যান্ড মাস্টার পেয়েছিল বাংলাদেশের পরের বছর বিশ্বনাথ আনন্দকে। অবশ্য আনন্দ ২০০৭ সালে দাবায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে দীর্ঘ ৬ বছর সেই শিরোপা ধরে রেখেছিলেন।

দাবা ফেডারেশনের এক সময়ের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সাবেক সচিব সৈয়দ সুজাউদ্দিন। তার সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম দাবায় ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে পড়েছে। তিনি বলেছিলেন, ভারতে অনেক স্পন্সর আছে। তারা দাবাড়–দের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে। দাবাড়–দের আর্থিক বিষয়ে চিন্তাই করতে হয় না। আমাদের এখানে এ সুযোগ নেই। দাবাকে এগিয়ে নিতে স্পন্সরের পাশাপাশি দক্ষ সংগঠকও প্রয়োজন। বাংলাদেশে ব্যক্তি উদ্যোগেই দাবাড়–রা গ্র্যান্ড মাস্টার হয়েছেন। এখন পর্যন্ত আমরা মাত্র পাঁচজন গ্র্যান্ড মাস্টার পেয়েছি নিয়াজ, জিয়া, রিফাত, রাকিব ও রাজীব। অথচ ভারতে এখন দাবায় গ্র্যান্ড মাস্টারের সংখ্যা ৬০ জন। এ হতাশা বাংলাদেশ কাটিয়ে উঠুক, এটাই সবার কামনা। নিয়াজ মোরশেদের বিশ্বকাপে খেলা নিয়ে আমরা আবার স্বপ্ন দেখছি।

মজার খেলা দাবা

দাবা আসলেই মজার খেলা। এখানে আছে বুদ্ধির মারপ্যাঁচ। কবি হাসান হাফিজের ছড়ায় চোখ রাখলেই চেনা যাবে দাবা খেলা। ছড়ার কয়েকটি লাইন :

‘কেমন খেলা দাবা?
বুদ্ধির খেইল, বুঝলে বাবা!
সারাক্ষণই চিন্তা, ভাবা-
কৌশলী হও বিজয় পাবা।

আছেন রাজা মন্ত্রী ঘোড়া
হাতি এবং নৌকা বোড়ে
পরীক্ষা হোক নেশার ঘোরে
করেই ফ্যালো কিস্তিমাত
প্রতিপক্ষের মাথায় হাত!

বোর্ডের পর বসাও ঘুঁটি
এ ঘর থেকে ওই ঘরে যাও
ঝোপ বুঝিয়া কোপ মারো হে
ফান্দে ফেলে রাজাকে’।

ষোলটি করে ঘুঁটি দ্বারা ৬৪ বর্গক্ষেত্রের একটি বোর্ডে দু’জন খেলোয়াড়ের খেলা দাবা। ঘুঁটির মধ্যে আছে একটি রাজা, একটি মন্ত্রী, দু’টি ঘোড়া, দু’টি হাতি, দু’টি নৌকা ও আটটি বোড়ে (সৈন্য)। এ খেলা ভারতবর্ষে প্রথম প্রচলিত ছিল। সেখান থেকে পারস্য এবং মুসলমানদের মাধ্যমে ইউরোপে যায়। ভারতীয় পাশা খেলার সঙ্গে এর মিল আছে। দাবা মূলত রাজার খেলা। রাজায় রাজায় যুদ্ধের খেলা। রাজাকে বন্দী করাই হলো দাবা খেলার মূল বিষয়। খেলতে খেলতে যে দলের রাজা কিস্তির ফাঁদে আটকা পড়ে বা বন্দী হয়ে যায় সেই রাজার দল পরাজিত হয়। দাবার এই ৬৪ ঘরেই নিয়াজ মোরশেদ কাটিয়ে দিয়েছেন তার জীবনের অনেকটা সময় রাজা, মন্ত্রী, ঘোড়া, হাতি ও সৈন্য নিয়ে। তার ৫৫ বছর বয়সে এবার বিশ্বকাপে কিভাবে তিনি কিস্তিমাত করেন সেটাই দেখার বিষয়।

বাংলাদেশে এক সময় ফুটবল ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয় খেলা। কাজী সালাউদ্দিনের খেলা দেখতে মাঠ উপচে পড়ত দর্শকে। এখন ক্রিকেট নিয়েই সব জায়গায় মাতামাতি। সাকিব, মাশরাফি, মুশফিক, তানিমরা এখন দর্শকদের নয়নমণি। নিয়াজ মোরশেদের পর দাবা মাস্টার রাণী হামিদ ছিলেন বাংলাদেশের দাবার রাণী।
চ্যানেল বিজয়ী ব্রজেন দাস সাঁতারের এক কিংবদন্তি। তার পথ ধরেই সাঁতরে সাফ গেমছে পাঁচ-পাঁচটি সোনার পদক জয় করে বাংলাদেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছেন কৃতী সাঁতারু মোশাররফ।
নিয়াজ মোরশেদের হাত ধরে দাবায় বিশ্বকাপটা যদি ঘরে আসে সেটা বাড়তি আনন্দই দেবে আমাদের।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাতীয় প্রেস ক্লাব


আরো সংবাদ



premium cement