স্মৃতিপটে আ: মতিন খসরু
- তৈমূর আলম খন্দকার
- ২৩ এপ্রিল ২০২১, ২০:৫৬
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন হয়ে গেল ১০-১১ মার্চ ২০২১। আবদুল মতিন খসরু সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন অনেক ভোটে। সুপ্রিম কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন বিল্ডিংয়ে আমাদের দু’জনের কিউবিকল চেম্বার পাশাপাশি। এক্সটেনশন বিল্ডিংয়ে আমার রুম নম্বর ৩০০৪। আর খসরু ভাই বসতেন ৩০০৫ নম্বর রুমে। নির্বাচনের দিন দেখা হয়েছিল। পরে শুনলাম, তিনি অসুস্থ, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ১৩ এপ্রিল ২০২১ তারিখে শুনলাম তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়েছে। ১৪ এপ্রিল প্রথম রমজান অপরাহ্ণে টেলিভিশনে দেখলাম তিনি আর নেই। চারদিক তার মৃত্যু সংবাদের ফোন ও খুদে বার্তা আসতে লাগল। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে কলম নিয়ে বসলাম।
আমরা দু’জন দুই মেরুর রাজনীতিতে অবস্থান করলেও খসরু ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর। ১৯৭৮ সালে একই বছর তিনি এবং আমি আইন পেশায় ‘বাংলাদেশ বার কাউন্সিল’ থেকে সনদ লাভ করি। এ জে মোহাম্মদ আলী (সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি), পি সি গুজ প্রমুখ আইনজীবী একই তারিখে আমরা বার কাউন্সিলের সনদ লাভ করি। মতিন খসরু ভাই কুমিল্লা জেলা বার এবং আমি নারায়ণগঞ্জ মহকুমা আইনজীবী সমিতির সদস্য হয়ে পেশায় নিযুক্ত হই। সে সময় তার সাথে আমার তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না যেমনটি পরবর্তী সময়ে ঘটেছিল।
আমি শ্রমিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় নারায়ণগঞ্জের ওই সময়ের জাহাজ-শ্রমিক, ঘাট-শ্রমিক সংগঠনের বড় নেতা আবদুল আউয়াল আমাকে কুমিল্লা সেশন আদালতে বিচারাধীন একটি মামলায় জামিন শুনানি করার জন্য নিয়ে যান। আউয়াল ভাইয়ের সাথে ছিলাম আমি ও আমার ক্লার্ক মোবারক হোসেন। সেদিন কুমিল্লায় আধাবেলা হরতাল চলছিল। মেঘনা ও দাউদকান্দি ব্রিজ তখনও তৈরি হয়নি। তাই সময়মতো কোর্টে হাজির হওয়ার জন্য আগের দিনই আমরা কুমিল্লায় গিয়ে হোটেলে অবস্থান করি। হরতালের কারণে কোর্ট দেরিতে বসায় আমাকে খসরু ভাইয়ের বাড়িতে নেয়া হলো। তিনিই ওই সংশ্লিষ্ট মামলার মূল আইনজীবী। বাড়িটি কোর্টের পাশেই। বাড়ির নিচের তলায় তার চেম্বার। চা আনালেন। আমাকে এক কাপ দিয়ে তিনি একই সাথে দু’কাপ চা পান করলেন। বললেন, ‘আমি একসাথে দু’কাপ চা পান করি’। মামলাটি ছিল অত্যন্ত জটিল, কুমিল্লা জেলাধীন বাঞ্ছারামপুরের এক গ্রামের লোক পার্শ্ববর্তী গ্রামে প্রবেশ করে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়, একটি শিশু আগুনে পুড়ে মারা যায়। দীর্ঘ শুনানি শেষে মামলার আসামিদের জামিন হয়েছিল। ট্রায়াল করার জন্য আরো কয়েকবার কুমিল্লা কোর্টে গিয়েছি। তখন থেকেই খসরু ভাইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা শুরু। এটা ছিল তার মৃত্যু পর্যন্ত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চাঞ্চল্যকর নিদারাবাদ হত্যাকাণ্ডের যে জজ সাহেব (এম এ ওহাব) আসামি তাজুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়েছিলেন তার কোর্টেই সংশ্লিষ্ট মামলাটি ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া তখনো কুমিল্লা জেলাধীন একটি মহকুমা।
দিনক্ষণ স্মরণে আসে না, তবে যতটুকু মনে পড়ে, সম্ভবত ২০০২-০৩ সাল হবে। খসরু ভাইয়ের মা এবং আমার বাবা একই সময়ে দীর্ঘদিন ঢাকা বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি প্রতি রাতেই তার মাকে দেখতে যেতেন, আমি দেখতে যেতাম আমার বাবাকে। বারডেম হাসপাতালে অনেক দিন দীর্ঘসময় ধরে তার সাথে আমার আলোচনা হয়েছে এবং রাজনীতিতে আমাদের দুই মেরুতে অবস্থান হওয়া সত্ত্বেও হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশ ও সহনশীলতা নিয়ে মাধুর্যপূর্ণ আলোচনা হতো।
পাঁচ বছর একটানা বিআরটিসির চেয়ারম্যান থাকার পর ২০০৬ সালে নভেম্বরে ওয়ান-ইলেভেনের অবৈধ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আমার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে দেয়। আমি পুরনো আইন পেশায় চলে আসি। ৩৩ নং তোপখানা রোডের মেহেরবা প্লাজায় চতুর্থ তলায় একটি চেম্বার নেয়া হলো। সেখানে দেখলাম আমার চেম্বারের মুখামুখি বিপরীত চেম্বারে বসেই খসরু ভাই ওকালতি করেন। দীর্ঘ সময় ধরে তার চেম্বারে বিভিন্ন আলাপচারিতা হতো। ১৮ এপ্রিল ২০০৭ ওয়ান-ইলেভেন সরকার কর্তৃক আমি গ্রেফতার হওয়ার পর পরিবারের পক্ষ থেকে ভাড়া নেয়া চেম্বারটি ছেড়ে দেয়া হয়। তিনি তখন চেম্বার পরিবর্তন করে মাহাতাব টাওয়ারে চলে যান। উল্লেখ্য, নারায়ণগঞ্জ রূপগঞ্জের প্রায় এক হাজার লোককে বিআরটিসিতে চাকরি দেয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে প্রায় ২৬ মাস কারাভোগ করি। হাইকোর্ট ও অ্যাপিলেট ডিভিশনের রায়ে ওই মামলা থেকে অব্যাহতি পাই।
২০০১ সালের নভেম্বরে বিআরটিসির চেয়ারম্যান পদে যোগদানের আগে সাবেক মন্ত্রী নিতাই রায় চৌধুরী, সাবেক বিচারপতি (অব:) বজলুর রহমান তালুকদার এবং আমি সুপ্রিম কোর্ট বারের মূল ভবনের ২০৫ নম্বর রুমে বসতাম। বিআরটিসির চেয়ারম্যান হওয়ায় আমার নামে বরাদ্দকৃত কিউবিকলটি অন্য আইনজীবীর নামে বরাদ্দ হয়ে যায়। জেল থেকে মুক্ত হয়ে আবারো আইন পেশায় ফিরে এলে সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনের এক্সটেনশন বিল্ডিংয়ে আমার নামে রুম বরাদ্দ করা হয় যার নম্বর ৩০০৪। ওই রুমে ঢুকেই জানতে পারলাম পাশের ৩০০৫ নম্বর রুমটি আ: মতিন খসরুর নামে বরাদ্দ এবং তিনি নিয়মিত সেখানেই বসেন। পাশাপাশি রুম হওয়ায় বিভিন্ন সময়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে, তার অমায়িক ও বন্ধুসুলভ ব্যবহারে অনেকের মতো আমারও তার প্রতি অনেক মুগ্ধতা ছিল। ২০২১-২২ বর্ষের জন্য সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি পদে নমিনেশন পেপার দাখিল করার আগেই হঠাৎ করে তিনি আমার রুমে এসে বললেন ‘ভোট তো দিতে পারবেন না, তবে দোয়া তো করতে পারবেন।’ এসব লোকের জন্য মন থেকেই দোয়া আসে, রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা আসুক বা না আসুক।
আমার দ্বিতীয় মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে সাত-আট হাজার মেহমান দাওয়াতের প্রস্তুতি ছিল, কিন্তু জাতীয় সংসদ ভবনের মাঠ ছাড়া অন্য কোনো সুবিধাজনক স্থান পাওয়া যাচ্ছিল না। উল্লেখ্য, আমার বড় মেয়ের (ব্যারিস্টার মার-ই-য়াম খন্দকার) বিয়ের সংবর্ধনা সেখানেই হয়েছিল। বর-কনে দুইজনই লন্ডনে লেখাপড়া করে বলে ছয় মাস আগেই বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। সংসদ ভবনের মাঠটি পার্লামেন্ট ক্লাবের নিয়ন্ত্রণে। সংসদ সদস্যদের সুপারিশ নিয়ে মাঠটি ব্যবহারের জন্য তিনবার সংসদের পার্লামেন্ট ক্লাবে দরখাস্ত করি, কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় বারবারই বিবাহোত্তর সংবর্ধনার জন্য সংশ্লিষ্ট কমিটি কর্তৃক আমার আবেদনটি নামঞ্জুর হয়। যেহেতু আমি ও আমার পরিবার বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত সেহেতু আমার আবেদন মঞ্জুর হয়নি বলে জানতে পারি। পার্লামেন্ট মাঠ ব্যবহারের অনুমতি না নিয়ে কার্ড ছাপানো যাচ্ছে না। উপায়ান্তর না দেখে আমি পার্লামেন্ট ক্লাবের সেক্রেটারি বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন তাজ এমপির সাথে দেখা করি। তিনি আমাকে বললেন, আপনি নিজে দরখাস্তকারী না হয়ে সরকারদলীয় কোনো এমপি আবেদনকারী হিসেবে স্বাক্ষর করলে বর্ণিত কারণে পার্লামেন্ট মাঠ ব্যবহারের জন্য আপনি অনুমতি পাবেন। ক্যাপ্টেন তাজকে শ্রদ্ধা জানাই পরামর্শ দেয়ার জন্য। তার পরামর্শ মোতাবেক আমি আ: মতিন খসরু ভাইকে সমস্যাটির কথা জানালে তিনি বললেন, ‘তাড়াতাড়ি আবেদন ফরমটি নিয়ে আসেন, আগামীকাল আমি ওমরাহ হজে চলে যাবো।’ তিনি সুপ্রিম কোর্টের পুরনো ভবনের ১৬ নং কোর্টে শুনানিতে অংশ নেয়ার জন্য বসেছিলেন। দরখাস্তটি সামনে নেয়ামাত্রই সুপারিশ নয়, আবেদনকারী হিসেবে স্বাক্ষর করলেন এবং মাঠ ব্যবহারের অনুমতি পাওয়া গেল। উল্লেখ্য, দরখাস্তে লিখা ছিল- ‘আমার ভাতিজির বিবাহোত্তর সংবর্ধনার জন্য পার্লামেন্ট মাঠ ব্যবহারের অনুমতি প্রার্থনা।’ খসরু ভাইয়ের বদন্যতায় ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬ মাঠটি ব্যবহার করার অনুমতি পাই।
আমি বিএনপির রাজনীতির সাথে জোরালোভাবে জড়িত জেনেও আ: মতিন খসরু দরখাস্তে আবেদনকারী হিসেবে স্বাক্ষর করে আমার পরিবার ও আপনজনদের কাছে আমার মুখরক্ষা করেছেন। তার এই সহানুভূতি আমার পরিবার চিরদিন মনে রাখবে। আমার মেয়েকে নিজের ভাতিজি উল্লেখ করে আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করেছেন।
বর্তমানে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রেও রাজনীতিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ উঠে গেছে। কেউ কাউকে সহ্যই করতে চায় না। প্রতিপক্ষ রাজনীতিবিদ দেখলেই উপকার বা সহানুভূতি দেখানো তো দূরের কথা, সহ্য করতে চায় না, শত্রু বলে মনে করে, তবে ব্যতিক্রম তো কিছু আছে, নতুবা সমাজ টিকে থাকত না।
নিজ নিজ রাজনৈতিক অবস্থানে দৃঢ় থেকেও প্রতিপক্ষের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব বজায় রাখা যায় আ: মতিন খসরু ভাই ছিলেন এর অন্যতম দৃষ্টান্ত। একজন রাজনীতিবিদ প্রতিপক্ষ রাজনীতিককে কেন বৈরী বা শত্রু মনে করবে? আগে তো এ সংস্কৃতি ছিল না। বর্তমানে চলমান বিদ্বেষমূলক সংস্কৃতি, প্রতিশোধ গ্রহণমূলক রাজনীতি, পরস্পর পরস্পরকে ল্যাং মারার সংস্কৃতি কি দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে? আ: মতিন খসরুর কাছ থেকে আমাদের এ বিষয়ে শিক্ষা নেয়ার আছে।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা