২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মিতব্যয়িতা কৃপণতা নয়

-

মিতব্যয়িতা ও মিতব্যয় উভয়ই বিশেষ্য। মিতব্যয়িতা অর্থ প্রয়োজন মতো অথবা হিসাব করে ব্যয় করা। আবার পরিমিত ব্যয় বা আয় বুঝে ব্যয় করার স্বভাবও মিতব্যয়িতা। মিতব্যয়িতার বিপরীত শব্দ অমিতব্যয়িতা। একজন ব্যক্তি অপব্যয়ের মাধ্যমে যখন অর্থ ব্যয় করে তখন তাকে অমিতব্যয়ী বলা হয় অন্য দিকে অতিমিতব্যয়িতা কৃপণতা বা কার্পণ্যের সমার্থক। একজন কৃপণ ব্যক্তি সবসময় প্রয়োজনমতো অর্থ ব্যয় হতে নিজেকে দূরে রাখে। মিতব্যয়িতা একটি গুণ। মিতব্যয়ী ব্যক্তিকে সবাই পছন্দ করে। মিতব্যয়ী ব্যক্তি দেশ ও সমাজের জন্য ভালো ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত। জীবনে চলার পথে মিতব্যয়ী ব্যক্তিকে খুব কমই অর্থসঙ্কটের মুখাপেক্ষী হতে হয়। মিতব্যয়ী ব্যক্তির ব্যক্তি ও সংসার জীবন সচরাচর সুখময় হয়ে থাকে। অমিতব্যয়ী ব্যক্তি অর্থসঙ্কটে পড়লে অনেকটা দিশেহারা হয়ে যায়। এ সময় একজন অমিতব্যয়ী ব্যক্তিকে মূল্যবান সহায়সম্পদ বিক্রি করতে কোনোরূপ দ্বিধান্বিত হতে দেখা যায় না। অমিতব্যয়ী ব্যক্তির অপরিণামদর্শিতার কারণে জীবনের সূচনালগ্নে সচ্ছল ছিলেন এরূপ ব্যক্তিকে মাঝ বয়সে বা বার্ধক্যে উপনীত হলে অর্থসঙ্কটে দুঃখ-দুর্দশায় নিপতিত হতে দেখা যায়।
অর্থ ব্যয় বিষয়ে মানুষের মধ্যে তিন ধরনের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। এর একটি হলো মিতব্যয়িতা এবং অপর দু’টি অপব্যয়িতা ও কৃপণতা। ইসলাম ধর্মে অপব্যয়িতা ও কৃপণতাকে নিরুৎসাহিত করে মিতব্যয়িতাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। ইসলাম ধর্ম মতে, মিতব্যয়িতা একটি উত্তম কাজ। মিতব্যয়ী ব্যক্তিকে বলা হয় মধ্যমপন্থী। ইসলাম ধর্ম মতে কৃপণতা ও অপব্যয়িতা নিন্দনীয় কাজ।

ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে এমন অনেক সচ্ছল ব্যক্তি দেখা যায় যাদের মিতব্যয়িতার কারণে অনেকে কৃপণ হিসেবে আখ্যা দেয়ার প্রয়াস নেন। দ্বীপ রাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের ত্রিশোর্ধ্ব বয়স নয়, এমন একজন ধনাঢ্য ব্যক্তির নাম অ্যাডাম খো। এ ব্যক্তিকে ব্যবসায়িক কাজে প্রায়ই বিমানযোগে বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করতে হয়। তার মতো ব্যক্তির আর্থিক অবস্থান, সঙ্গতি ও সামাজিক মর্যাদা বিবেচনায় নেয়া হলে এরূপ ব্যক্তির বিমানের বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণ করার কথা। কিন্তু ব্যক্তিটি বিমানে ভ্রমণকালীন সবসময় ইকোনমি ক্লাসের যাত্রী হিসেবে যাতায়াত করেন। এত ধনী হওয়া সত্ত্বেও ইকোনমি ক্লাসে যাত্রার কারণে তাকে যখন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়; প্রতিবারই তার উত্তর- ‘ইকোনমি ক্লাসে ভ্রমণের কারণেই আমি এখনো এ বয়সে সিঙ্গাপুরের বিশিষ্ট ধনীদের অন্যতম।’ অ্যাডাম খো প্রায়ই তার বন্ধুমহলে আলাপচারিতায় বলেন, ‘বিলাসিতার কোনো শেষ নেই। বিলাসিতা কখনো একজন ব্যক্তির তৃপ্তি শেষ করতে পারে না। যেমন আপনি একটি দামি ব্র্যান্ডের শার্ট কিনলেন, কেনা ও পরা অবধি আপনার আনন্দ। এরপর কিন্তু আপনার অপর একটি ব্র্যান্ডের দামি শার্ট পছন্দ হবে, আপনি সেটিও কিনলেন এবং পরলেন, তার পর আরেকটা- তার পর আরেকটা- এটি আসলে কখনো নিঃশেষ হয় না এমন একটি প্রবণতা।’

সুখ সবসময় তৃপ্তির মধ্যে নিহিত। বিলাসিতার আসলে কোনো শেষ নেই। কোনো বিলাসিতাই একজন অতৃপ্ত ব্যক্তির তৃপ্তি শেষ করতে পারে না। একজন মিতব্যয়ী ব্যক্তি অল্পতেই তুষ্ট। এ তুষ্টির মধ্যেই তার জীবনের অন্তর্নিহিত সুখের গুড় রহস্য। অ্যাডাম খো তৃপ্তি বা সুখকে যে আঙ্গিকে দেখেন তা বিবেচনায় নেয়া হলে তার আর্থিক সঙ্গতি সত্ত্বেও বিমানের ইকোনমি ক্লাসের ভ্রমণকে কৃপণতারূপে আখ্যা দেয়ার সুযোগ নেই।

অন্য দিকে কৃপণতা কী, সে সম্পর্কে একটি গল্পের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করতে পারি আমরা। এক ব্যক্তি তার দূরসম্পর্কীয় এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। দীর্ঘ আলাপচারিতার পর গৃহকর্তা তাকে বললেন, আজ ঘরে তোমার কাকীমা নেই। তোমার কাকীমা চিনি যে কোথায় রেখে গেছেন; তা তো আমি জানি না, তা না হলে আমি নিজেই তোমাকে চা বানিয়ে খাওয়াতে পারতাম। ওই ব্যক্তি যখন বললেন তিনি ডায়াবেটিসের রোগী, চিনি ছাড়া চা খান, তখন ভদ্রলোক বললেনÑ ঘরে চা পাতাও নেই। দোকান হতে চা পাতা আনতে গেলে যে সময় লাগবে সে সময় পর্যন্ত তো তুমি থাকবে না। তাই পরেরবার আসলে চা না খেয়ে কিন্তু যেতে পারবে না। এখানে চা না খাওয়ানোর বিষয়টিই কৃপণতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। একটি দেশ ও সমাজে এরূপ কৃপণ ব্যক্তির যত বেশি আধিক্য পরিলক্ষিত হবে সে দেশ ও সমাজ তত বেশি আন্তরিকতাবিহীন।

বিগত শতকের ৫০ দশকের আগে সৌদি আরব ধনী দেশ ছিল না। সে সময় সৌদি আরব থেকে দরিদ্র জনমানুষ জীবিকার তাগিদে অর্থ উপার্জনের জন্য বিভিন্ন দূর মুসলিম দেশে পাড়ি দিত। আমাদের এ দেশ তখন প্রথমত ব্রিটিশ এবং অতঃপর পাকিস্তানের শাসনাধীন ছিল। আমাদের এ দেশের সাধারণ জনমানুষ বিশেষত গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত জনমানুষ সুদূর অতীত হতে ধর্মপরায়ণ। সৌদি আরবের নাগরিকরা পুণ্যভূমি মক্কার ছোঁয়ায় বেড়ে ওঠায় এ দেশের মানুষ আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও পরম মমতায় তাদের আপ্যায়িত করত। সাথে সাথে বিদায় বেলায় হাতে কিছু অর্থ গুঁজে দিত। যদিও এখন আর তেলের বদৌলতে আর্থিক অবস্থার চরম উন্নতির কারণে তাদের আর আগেকার মতো উপলক্ষ নিয়ে আমাদের দেশে আসার আবশ্যকতা দেখা দেয় না। বরং আমাদের দেশ থেকে জীবিকার সন্ধানে হতদরিদ্র মানুষজন ভাগ্যোন্নয়নের আশায় সে দেশের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়। সে দেশের মানুষের জীবনযাপন প্রণালী বর্তমানে বিলাসীতায় পরিপূর্ণ। তারা নিত্য আহারের পর যা উচ্ছিষ্ট থাকে, তা দিয়ে পৃথিবীর লক্ষ দুর্ভিক্ষপীড়িতদের দুই বেলা অন্নের সংস্থান সম্ভব। কিন্তু তাদের অনেকেই আজ বোধশক্তিবিহীন। সহজ অর্থের আতিশয্যে মিতব্যয়িতা ও অমিতব্যয়িতার ফারাক বুঝতে অক্ষম।

মানুষের জীবন-জীবিকার জন্য অর্থ অপরিহার্য। মানুষ ভবিষ্যতে সুখ ও নির্বিঘ্নে জীবনযাপনে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ সঞ্চয় করে। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করে বৈধ ও হালাল পন্থায় যারা অর্থ উপার্জন করে আল্লাহর কাছে তাদের ইবাদত কবুল হয়। কুরআনে অপব্যয় ও কার্পণ্য পরিহার করে মিতব্যয়ী হতে মুমিনদের আহ্বান জানানো হয়েছে। পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লাহ ঘোষণা করেন- ‘আর তোমরা খাবে ও পান করবে, কিন্তু অপচয় করবে না; নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’

অপরাপর প্রধান ধর্মমতেও মিতব্যয়িতা প্রাধান্য দিয়ে অমিতব্যয়িতা ও কার্পণ্য বর্জনের কথা বলা হয়েছে। তাই ধর্মবিশ্বাস নির্বিভেদে অর্থ ও সম্পদের অপচয় না করে প্রত্যেক মানুষের মিতব্যয়ী হওয়া কর্তব্য।
অন্যান্য দিবসের মতো সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিকভাবে মিতব্যয়িতা দিবস পালিত হয়। এ দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য হলো- ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির কল্যাণে মিতব্যয়ী হওয়ার প্রতি আত্মসচেতনাবোধ সৃষ্টি করা। ১৯২৪ সালে মিলানে অনুষ্ঠিত বিশ্বের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রথম বিশ্ব কংগ্রেসে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দিবসটি পালন শুরু হয়। সেই থেকে বিভিন্ন দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটি পালন করে আসছে। আমাদের দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ জাতীয় সঞ্চয় পরিদফতর প্রতি বছর দিবসটি আড়ম্বরতার সাথে পালন করে থাকে।

অপচয় পরিহারপূর্বক মিতব্যয়ী হওয়ার অর্থ কৃপণতা নয়। ইসলাম ধর্মে মিতব্যয়িতাকে গুরুত্ব দিয়ে উৎসাহিত করা হলেও কৃপণতাকে তিরস্কার করা হয়েছে। এ বিষয়ে সূরা বনি ইসরাইলে আল্লাহ পাক বলেন- ‘তুমি বদ্ধমুষ্টি হওয়া থেকে বিরত থাকো এবং একেবারে মুক্তহস্তও হয়ে যেয়ো না; যদি তা হও তবে তুমি তিরস্কৃত ও অনুতপ্ত (নিঃস্ব) হয়ে পড়বে।’ মিতব্যয়িতা একজন মানুষকে সফলতা এনে দেয়।
অমিতব্যয়িতার স্বভাব একবার গড়ে উঠলে তা থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়। অমিতব্যয়িতা পাপের কাজ ও মিতব্যয়িতার পরিপন্থী। মিতব্যয়িতা মানুষকে অন্যায় পথে যাওয়া হতে রোধ করে, অন্য দিকে অমিতব্যয়িতা মানুষকে অন্যায় পথে চলতে ও অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনে উৎসাহ জোগায়। পরিবারের ভরণপোষণের জন্য যে পরিমাণ ব্যয় প্রয়োজন সে পরিমাণ ব্যয় করে অবশিষ্টাংশ সঞ্চয় করাই মিতব্যয়িতা। অনেকে মিতব্যয়িতাকে কৃপণতার সাথে তুলনা করে থাকেন। কৃপণতা হলো প্রয়োজনের সময় খরচ না করা, অন্য দিকে মিতব্যয়িতা হলো প্রয়োজন যতটুকু ততটুকু ব্যয় করা।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

E-mail: iktederahmed@yahoo.com

 


আরো সংবাদ



premium cement