২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

করোনার দুঃসময়ে রমজান বয়ে আনুক কল্যাণ

করোনার দুঃসময়ে রমজান বয়ে আনুক কল্যাণ - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে ২৯ শাবান চাঁদ দেখা গেলে ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হবে পবিত্র মাহে রমজান। তবে গত বছরের মতো এবারো করোনা মহামারীর আতঙ্কের মধ্যেই শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজানের রোজা। মুসলিম বিশ্বজুড়ে প্রায় সব মুসলমান নর-নারী এই মাসে সিয়াম সাধনায় লিপ্ত হয়ে থাকেন। অফুরন্ত এক আনন্দধারায় তখন সিক্ত হয় সবার জীবন।

পবিত্র মাহে রমজানের পাশাপাশি বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ পয়লা বৈশাখের দিনটিও শুরু হচ্ছে ১৪ এপ্রিল। করোনা মহামারীর কারণে এবার নববর্ষের উৎসবও সেভাবে পালন করা যাবে না। তবে এ দেশের মানুষ আশা করে, বাংলা নববর্ষ এক শুভ বার্তা নিয়েই আসবে সবার মাঝে।

বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারীর ছোবল থামছেই না। বরং নতুন নতুন রূপ ধারণ করে আবির্ভূত হচ্ছে করোনাভাইরাস এবং একই সাথে সংক্রমণও ঘটিয়ে চলেছে অব্যাহত গতিতে। ফলে দিন দিন পৃথিবীর মানুষ আরো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। এক বছরের বেশি বা তেরো মাস ধরে পৃথিবী এক অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দুঃসময় আমাদের এই পৃথিবীর পিছু ছাড়ছে না। অতিক্ষুদ্র অদৃশ্য করোনাভাইরাস পৃথিবীর স্বাভাবিক কার্যক্রম থামিয়ে দিয়েছে। গোটা পৃথিবী এখন ভালো নেই।

এই দুঃসময়, এই রোগ-শোক, ভয় জ্বরা দূরে সরিয়ে রেখেই পবিত্র মাহে রমজানে সিয়াম সাধনায় রত হবে মুসলিম বিশ্ব। তবে মহামারীর কারণে চিকিৎসকদের পরামর্শে কিছু নিয়মকানুন ও স্বাস্থ্যবিধি মেনেই আমরা পালন করবো রমজানের ফরজ রোজা।

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রমজানের রোজা। শুধু আত্মশুদ্ধিই নয়, এ মাস আত্মসংযমেরও। মহান আল্লাহর মহিমা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বরকতময় মাস রমজান। এ মাস হলো রহমত (অনুগ্রহ), মাগফিরাত (ক্ষমা) ও নাজাতের (মুক্তি) মাস। ধৈর্য, ত্যাগ, তিতিক্ষা ও বরকতের এ মাসে নফল ইবাদতের মাধ্যমে অতিরিক্ত সওয়াব অর্জন করা যায়। আল্লাহ তায়ালার অপার রহমতে এ মাসে শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দিয়ে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়।


রমজান কুরআন নাজিলের মাস। হিজরি সনের নবম মাস এই রমজান। মহান আল্লাহ কুরআনুল কারিমে একমাত্র এই মাসের নাম উল্লেখ করে একে সম্মানিত করেছেন। রমজান মাসের শেষ দশকে রয়েছে পবিত্র লাইলাতুল কদর। এ মহান রাতের মর্যাদা হাজার মাসের চেয়েও বেশি।রমজানের রোজা রাখা প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেক মুসলিম নারী-পুরুষের জন্য ফরজ। সুবহে সাদিকের আগে সাহরি এবং সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করতে হয়। লাইলাতুল কদর তালাশ করার জন্য মসজিদে ইতিকাফ করা সুন্নাহ। আর ঈদের নামাজের আগেই ফিতরা আদায় করতে হয়।

রোজা কষ্টকর ইবাদত এবং রোজার মাধ্যমে শরীরে চাপ পড়ে বলে অনেকেই রোজা রাখতে ভয় পান বা রোজা রাখেন না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শরিয়তের বিধান অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া রোজা পরিত্যাগ করা সম্পূর্ণ অনুচিত এবং গুনাহের কাজ। সুস্থ ব্যক্তি তো বটেই, অনেক অসুস্থ ব্যক্তিও চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া রোজা ছেড়ে দেয়া উচিত নয়।

রমজান মাসে রোজা রাখা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি রোজার মাসটি পাবে, তারই কর্তব্য হচ্ছে রোজা রাখা।’ (সূরা বাকারা-১৮৫)
হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘রোজা আমার জন্য, আমি নিজে এর প্রতিদান দেবো।’ তেমনি দিনে রোজা শেষে রাতে তারাবিহ নামাজ আদায় করা রোজার অন্যতম নফল ইবাদত। মহানবী সা:-এর এটি সুন্নাত। মাহে রমজানকে আমরা খোশ আমদেদ জানাই। মহিমান্বিত এ মাসে রোজা পালন এবং বেশি বেশি নফল ইবাদতের মাধ্যমে আমরা আসুন- নিজের জন্য, দেশের জন্য এবং আমাদের পৃথিবীর জন্য দোয়া করি যাতে আমরা করোনাভাইরাস মহামারীর মতো কঠিন এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাই।

করোনায় মৃত্যুর মিছিল
প্রতি দিনই কোনো না কোনো দুঃসংবাদ আসছে। আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন প্রিয়জন। মহামারী এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করেছে যে, আপনজনকে দেখার সৌভাগ্যটুকু পর্যন্ত হচ্ছে না। গত কয়েক দিনে দীর্ঘ দিনের বেশ কয়েকজন সহকর্মী আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন স্বনামধন্য সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার এবং এনামুল হক। সামনে আরো কী দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে, কেউ তা বলতে পারছে না।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। এই দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণ ও মৃত্যুর রেকর্ড অতীত অর্থাৎ আগের বারো মাসের পরিসংখ্যানকে ছাড়িয়ে গেছে। শনিবার ১০ এপ্রিল ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত ৭৭ জন মারা গেছেন। তেরো মাস ধরে এক দিনে এত মানুষের মৃত্যু আর হয়নি। শনিবার দেশে সংক্রমণের ৫৭তম সপ্তাহ (৪-১০ এপ্রিল) শেষ হয়েছে। এ সপ্তাহে ৪৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে কখনো এক সপ্তাহে এত বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। দুই সপ্তাহজুড়ে পরিস্থিতি নাজুক থেকে আরো নাজুক হচ্ছে। করোনা সংক্রমণ ছয় থেকে সাথে হাজার করে হচ্ছে গড়ে। এই সংক্রমণে করোনাভাইরাসের দক্ষিণ আফ্রিকার ধরনটি (ভেরিয়েন্ট) বেশি সক্রিয়। আইসিডিডিআরবি ও আইইডিসিআর জানায়, করোনায় ৮১ শতাংশই এই নতুন ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ।
শুধু দেশেই নয়, বাংলাদেশের প্রবাসী নাগরিকরাও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। গত ১৩ মাসে শুধু সৌদি আরবেই এক হাজার ২২৮ জন বাংলাদেশী মারা গেছেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়, ২৩টি দেশে এ সময়ে দুই হাজার ৭২৯ জন বাংলাদেশী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ৪৪৫ জন এবং যুক্তরাজ্যে মারা গেছেন ৪১২ জন প্রবাসী বাংলাদেশী।


করোনা মহামারী বিশ্বের ২২১টি দেশে বিস্তার লাভ করেছে। বিশ্বের সাড়ে ১৩ কোটি মানুষ করোনায় হয়েছে আক্রান্ত। করোনায় মারা গেছে সাড়ে ২৯ লাখ মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রে সোয়া তিন কোটি মানুষ আক্রান্ত এবং পৌনে ছয় লাখ লোকের মৃত্যু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরই ব্রাজিলে মারা গেছে সাড়ে তিন লাখ, ভারতে এক লাখ ৬৮ হাজার, ফ্রান্সে ৯৮ হাজার, রাশিয়ায় এক লাখ দুই হাজার। বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যু হয়েছে শনিবার পর্যন্ত ৯ হাজার ৬৬১ জন।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ, কোনো কোনো দেশে তৃতীয় ঢেউয়ে মানুষ দিশেহারা। বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করেছে ১৪ এপ্রিল থেকে দুই সপ্তাহের জন্য কঠোর লকডাউন করা হবে। নতুন করে দেশে দেশে লকডাউন ও কারফিউ আরোপ করা হয়েছে। এর কবলে পড়েছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। ভারতে দেড় লাখ করে মানুষ প্রতিদিন করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা দেশটির ‘ধনী রাজ্য’ হিসেবে পরিচিত মহারাষ্ট্রে। আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া, ফ্রান্স, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যে লকডাউন বা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছে মানুষ। করোনার টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং সরবরাহের ঘাটতিতে টিকাদান কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার মধ্যে এই লকডাউনের খবর হলো। টিকা নিয়ে বিশ্বব্যাপী এক তেলেসমাতি কাণ্ড চলছে। টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে ধনী ও গরিব দেশগুলোর বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশ্বে যত টিকা সরবরাহ করা হয়েছে, তার বেশির ভাগই পেয়েছে উচ্চ আয়ের দেশগুলো। মাত্র ১ শতাংশেরও কম টিকা পেয়েছে গরিব দেশগুলো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ৭০ কোটি টিকার ডোজ সারা বিশ্বে সরবরাহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮৭ শতাংশের বেশি পেয়েছে উচ্চ আয় অথবা মধ্যম আয়ের দেশগুলো। বাকিরা পেয়েছে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ টিকা।


লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব


আরো সংবাদ



premium cement