২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

‘জিহাদ’ শব্দের ব্যবহার ও অপব্যবহার

‘জিহাদ’ শব্দের ব্যবহার ও অপব্যবহার -

বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি ইসলামের বিরুদ্ধে কোনো কোনো মহলের পক্ষ থেকে মর্যাদা হানিকর বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করতে। এর মধ্যে আছে উগ্র (fanatic), মৌলবাদী (fundamentalist)সহ বিশেষ কিছু শব্দ। ইসলাম ও মুসলমানদের অপবাদ দেয়ার জন্য সম্প্রতি আরো একটি নতুন শব্দ উদ্ভাবন করা হয়েছে। এটি হচ্ছে, তথাকথিত শব্দ জিহাদিস্ট (jihadist)। জিহাদিস্ট বা জিহাদপন্থী শব্দটি আরবি ‘মুজাহিদুন’ শব্দটিকে ইংরেজিতে বিকৃতভাবে রূপান্তরিত করে সন্ত্রাসী (terrorist) বোঝাতে ব্যবহার করা হচ্ছে। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লেখক, সংবাদপত্র ও বিশ্লেষক বিশেষ করে যারা ইসলামবিদ্বেষী, তারা এই ‘জিহাদিস্ট’ শব্দকে বেশ জোরেশোরেই ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। এটা তারা ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে বোঝানোর জন্যই ব্যবহার করছেন। প্রকৃতপক্ষে কোনোভাবেই সন্ত্রাস জিহাদের কোনো অনুবাদ নয়। jihadist হচ্ছে জিহাদ শব্দের প্রকৃত ব্যবহারের বিপরীতে একটি কটূক্তিপূর্ণ ব্যবহার।

‘জিহাদ’ ইসলামে ব্যবহৃত একটি সামগ্রিক শব্দ। এর মানে হলো প্রচেষ্টা বা struggle করা। যখন জিহাদ শব্দটি ‘ফি সাবিলিল্লাহ’ বা আল্লাহর পথের সাথে যুক্ত হয়ে ব্যবহৃত হয়, তখন এর অর্থ হয় ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম; আত্মসংশোধন ও সমাজ সংশোধনের জন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম; মুসলিম ভূখণ্ড ও সমাজ রক্ষার জন্য সংগ্রাম।

কোনো কোনো সময় এটা মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামও। ইসলামের অতীতের কোনো স্কলারই সন্ত্রাসী তৈরি বা সাধারণ নাগরিক হত্যা, নারী ও শিশু হত্যার মতো বিষয়ের সাথে জিহাদ শব্দটিকে সমার্থক বলে বিবেচনা করেননি। এই পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর আমেরিকান ফিকাহ কাউন্সিলের সভাপতি ড. মুজাম্মিল এইচ সিদ্দিকীর গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা তুলে ধরা হলো।

‘জিহাদ’ ইসলামের সবচেয়ে বেশি ভুল বোঝাবুঝি ও অপব্যবহারগত একটি বিষয়। কিছু মুসলমানও আছেন, যারা নিজেদের স্বার্থে জিহাদের অপব্যাখ্যা করে থাকেন। অনেক অমুসলিম এতে ভুল বুঝে থাকেন। কিছু অমুসলিম আছেন যারা ইসলাম ও মুসলমানদের দোষী করতে এর অপব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। জিহাদ মানে পবিত্র বা ধর্মযুদ্ধ (Holy war) বোঝায় না। জিহাদ বলতে বোঝায় সংগ্রাম বা লড়াই। কুরআনে যুদ্ধের জন্য যে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তা হলো হরব (Harb) বা কিতাল (Qital)। জিহাদ বলতে বোঝায় ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্তরে আন্তরিক ও সচেতন সংগ্রাম। এটা সমাজে ভালো কিছু করার এবং সমাজ থেকে অন্যায়, নির্যাতন, মন্দকে দূর করার সংগ্রাম। এই সংগ্রাম আধ্যাত্মিক এবং একই সাথে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনাচারের বিরুদ্ধে। জিহাদ হলো ভালো কিছু করার জন্য কঠিন পরিশ্রম করা। কুরআনে এই শব্দ বিভিন্নভাবে ৩৩ বার ব্যবহার করা হয়েছে। এটা মাঝে মধ্যে অন্য কিছু ধারণার সাথে যেমন- বিশ্বাস, অনুশোচনা, সঠিক চুক্তি ও অভিবাসনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে।

জিহাদ হলো কারো বিশ্বাস এবং কারো মানবাধিকার রক্ষা করা। জিহাদ প্রায় ক্ষেত্রেই যুদ্ধ নয়, যুদিও যুদ্ধের জন্য এই পরিভাষা ব্যবহৃত হতে পারে। ইসলাম শান্তির ধর্ম। কিন্তু এর মানে এই নয় যে,ইসলাম শোষণকে সমর্থন করে। উত্তেজনা ও বিবাদ দূর করতে কারো সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা থাকা উচিত, ইসলাম এটাও শিক্ষা দেয়। ইসলাম দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতহীনভাবে সমাজে পরিবর্তন ও সংস্কারের ব্যাপারে উৎসাহ দেয়।

প্রকৃতপক্ষে ইসলাম শান্তিপূর্ণ উপায়ে এবং যতটুকু সম্ভব শক্তি প্রয়োগ ছাড়াই, অন্যায়কে দূর করার কথা বলে। ইসলামের ইতিহাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে আজকের সময় পর্যন্ত বেশির ভাগ সময়ই মুসলমানরা শোষণ-নির্যাতন প্রতিরোধ এবং শান্তিপূর্ণভাবে ও দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত ছাড়াই স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে। ইসলাম যুদ্ধেরও সঠিক নৈতিকতার শিক্ষা দেয়। ইসলামে যুদ্ধ অনুমোদিত কিন্তু তা তখনই প্রযোজ্য হবে, যখন সব ধরনের শান্তিপূর্ণ উদ্যোগ যেমন সংলাপ, মধ্যস্থতা এবং চুক্তিগুলো ব্যর্থ হয়ে যায়। এটা একেবারে শেষ ব্যবস্থা। তাই এটাকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে যাওয়া উচিত। জোর করে জনগণকে পরিবর্তন করা, জনগণকে অধীনস্থ করা, ভূখণ্ড দখল করা কিংবা সম্পদ বা নিজ গৌরবকে তুলে ধরা জিহাদের উদ্দেশ্য নয়। মূলত জিহাদের উদ্দেশ্যে হলো- জীবন, সম্পত্তি ও ভূমি রক্ষা, অন্যায় ও নির্যাতন থেকে নিজের সম্মান ও স্বাধীনতা রক্ষা করা, অন্যকে রক্ষা করা।

আমাদের এ ব্যাপারে জোর দিতে হবে যে, নির্দোষ জনগণের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস সেটি নির্যাতন, নিপীড়ন কিংবা আত্মঘাতী হামলা যেকোনো উপায়ে হোক না কেন, কোনো অবস্থাতেই ইসলাম অনুমোদন করে না। ইসলাম শোষিত মানুষকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করতে উৎসাহিত করে থাকে। ইসলাম শোষিতদের সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য আদেশ দেয়। কিন্তু ইসলাম কোনো অবস্থাতেই নিরীহ, নিরস্ত্র ও নির্দোষ জনগণের ওপর সন্ত্রাসকে সমর্থন বা অনুমোদন করে না। এটা ইসলামের শিক্ষার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। কিছু লোক আছে যারা সন্ত্রাসকে স্বীকৃতি দিতে বা সন্ত্রাসের পক্ষে বলতে নিজেদের মনগড়া যুক্তিকে ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু এর কোনো যুক্তি নেই। (দেখুন : www.islamonline.net)

আমরা এই পরিপ্রেক্ষিতে সচেতন সব লেখক, স্কলারকে জিহাদের বিষয়টি স্পষ্ট করে তুলে ধরতে বলি। সেই সাথে সবাইকে জিহাদের প্রকৃত অর্থের বিপরীতে, অসম্মানজনক জিহাদিস্ট শব্দ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাই। একই সাথে বিষয়টি ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার, সংস্থা ও এজেন্সিগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার


আরো সংবাদ



premium cement