২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হবে

গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হবে - ফাইল ছবি

বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আর ব্যক্তিগোষ্ঠী বা রিজিম কর্তৃক শাসিত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বহু বিষয়েই রয়েছে প্রভেদ আর পার্থক্য। বিশেষ করে গণতন্ত্র সাধারণের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার, জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত মানুষের সার্বজনীন মৌলিক মানবাধিকার, প্রশাসনের ভুলত্রুটি নিয়ে কথা বলার প্রতি সহিষ্ণুতা দেখানো। ‘রিজিম’ শাসিত দেশে প্রকৃতপক্ষে এসব অধিকার খর্ব করার অসংখ্য আইন ও শাস্তির ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। সেসব দেশের নাগরিকদের মূক আর বধির হয়ে জীবন কাটাতে হয়। অথচ এসব কালো আইনকে হাজারো রংচং মাখিয়ে তাকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার শত প্রচার প্রপাগান্ডা চালানো হয়ে থাকে।

তবে ‘শাক দিয়ে তো আর মাছ ঢাকা যায় না’। এসব দেশ থেকে কেউ বেরিয়ে আসতে পারলে গোষ্ঠীতন্ত্রের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে থাকে। তাদের কাছ থেকে সে দেশের প্রশাসনের অমানবিক সব কর্মকাণ্ডের বয়ান শোনা যায়। তাতে মানুষকে হতবিহ্বল হতে হয়। মুক্ত বিশ্বের জনগণ একে স্বর্গ-মর্ত্যরে সাথেই তুলনা করে।

গোষ্ঠীতন্ত্রের প্রভেদ নিয়ে আলোচনা আর চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ বস্তুত পণ্ডিতদের কাছ থেকেই আসার কথা। আমাদের মতো সাধারণের পক্ষে সে প্রভেদ নিয়ে আলোচনায় যেমন যোগ্যতার ঘাটতি আছে, আর সে অভিপ্রায়ও নেই। কেননা এমন তাত্ত্বিক আর গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে সাধারণের উৎসাহ আর আগ্রহ থাকার কথাও নয়। তবে বোদ্ধাসমাজ আর পাণ্ডিত্যের অধিকারীরা এ সম্পর্কিত বহু গবেষণা ও বিশ্লেষণধর্মী বইপুস্তক রচনা এবং পাঠ করে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেছেন, সন্দেহ নেই। আমাদের লেখার উদ্দেশ্য সাধারণ পাঠকের কাছে গোষ্ঠীতন্ত্রের কিছুটা ধারণা দেয়া ও চিন্তার জগতে ‘টোকা দেয়া’। কেননা এ সম্পর্কে সতর্ক থাকা দরকার। কেননা, বিশ্বের অনেক দেশেই বিভিন্ন রিজিমের উন্মেষ লক্ষ করা যাচ্ছে। এর হালের উদাহরণ, মিয়ানমার। তা ছাড়া গণতন্ত্র আর গোষ্ঠীতন্ত্রের মাঝামাঝি অবস্থায় আছে এমন নজির হিসেবে অনেক দেশের নাম উল্লেখ করা যায়। যা হোক, বিশ্বের অনেক দেশ থেকেই গণতন্ত্রমনা মানুষ বহু সংগ্রাম এবং ত্যাগ আর তিতিক্ষা স্বীকার করে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা তথা জনগণের স্বশাসনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। মানুষ বিচার বিবেচনা করে সৎ যোগ্য প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। আবার যখন সেই প্রতিনিধিরা মানুষের আস্থা হারিয়েছেন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সফল হতে পারেননি, তখন সেই জনগণ তাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়েছে। তারা জগদ্দল পাথরের মতো শাসন ক্ষমতায় খুঁটি গেড়ে বসে থাকতে পারেননি। এজন্য হাঙ্গামাও বাধাতে হয়নি। নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন স্বপক্ষে না আসায় স্বেচ্ছায় শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছেন তারা। এটাই গণতন্ত্রের চেতনা ও সৌন্দর্য। গোষ্ঠীতন্ত্রে এই শৈলীর অনুশীলনের কথা কল্পনারও অতীত। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে বহুকাল দেশ শাসন করাই এই গোষ্ঠীতন্ত্রের নীতি। আর এ জন্য নির্বাচনের একটা হাস্যকর মহড়া প্রদর্শিত হয় বটে। তবে সেখানে শাসক শ্রেণীর যোগ্যতা ও তাদের দায়িত্ব পালনের মূল্যায়ন করা আর তার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার বিবেচনা করে নিজেদের মত ও ভোট চর্চার কোনো অধিকার মানুষের থাকে না। তা ছাড়া রিজিমের প্রতিপক্ষ বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব চিন্তাও করা যায় না।

বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা করলে দেখা যাবে, দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হতে চলেছে। এই অর্ধশতাধিক কাল অতিবাহিত হওয়ার পর আজ পরিতাপের সাথে বলতে হয়, এখনো এখানে গণতন্ত্রের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো তার শিকড় মাটির গভীরে প্রোথিত করতে পারেনি। অথচ এ দেশের যে সংবিধান তাতে এটা স্পষ্ট করা আছে যে, এই জনপদ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। সংবিধানে গণতন্ত্রকে ফলপ্রসূ করার জন্য বহু সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের রূপরেখা সন্নিবেশিত করা হয়েছে। আগেই উল্লেখ করে এসেছি, দেশে গত ৫০ বছরেরও গণতন্ত্র নামক বৃক্ষের শিকড় মাটির গভীরে যেতে পারেনি। যে কোনো বৃক্ষ সতেজভাবে বেড়ে ওঠার জন্য নানা পরিচর্যার প্রয়োজন পড়ে। ঠিক তেমনি গণতন্ত্রের বিকাশ এবং একে অর্থবহ করার জন্যও রাজনীতিকদের নানা অনুশীলন অধ্যবসায় প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য, ভিন্নমতের অধিকারী সংগঠন থাকা আবশ্যক। এ জন্য রাজনীতিকদের পরমতসহিষ্ণতার দীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। সবাইকেই ভাবতে হয় দেশ সবার, কোনো গোষ্ঠীর কব্জায় তা আবদ্ধ থাকতে পারে না।

বাংলাদেশের স্থপতি ক্ষণজন্মা পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সুযোগ্য সহযোগীরা এই জনপদের মানুষকে দেশের মালিক করতে সংবিধানে সুব্যবস্থা করে গেছেন, যাতে জনগণের স্বীয় অভিপ্রায় আর অভিমতের ভিত্তিতে এই ভূখণ্ডের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হতে পারে। এর প্রক্রিয়া অবাধ স্বাধীন ভোটব্যবস্থার মাধ্যমে। তিনি জীবদ্দশায় তার অনুশীলন করে গেছেন।

এবার বাংলাদেশের সেই মহান স্থপতি ও ক্ষণজন্মা নেতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপিত হয়ে গেল বর্ণাঢ্য সব অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে তার স্মৃতিচারণ করে তার প্রতি সব ঋণ শোধ করা সম্ভব নয়। বরং যারা এর আয়োজন করেছেন বস্তুত তারাই এ জন্য ধন্য হয়েছেন। সেই মহান স্থপতির যে স্বপ্ন বাংলাদেশকে ঘিরে ছিল, সেটি ছিল নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা তথা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যার জন্য তিনি সেই পাকিস্তান আমলে বহু আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়েছেন এবং অকাতরে জেলজুলুম সহ্য করেছেন। আজ তার শতবর্ষ উদযাপনকালে তার প্রতি সর্বাধিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন করার উত্তম ব্যবস্থা হচ্ছে তার স্বপ্ন তথা জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা, যা কিনা সুষ্ঠু নির্বাচনব্যবস্থাকে মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর উদ্যোগ নেয়া। তার আদর্শের উত্তরসূরিদের ওপর এখন সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের সব দায় চলে এসেছে। এই দায়িত্বের হক আদায়ের জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ নেয়া হলেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের যথাযথ সম্মান শ্রদ্ধার আর তার আত্মত্যাগের যথার্থ মূল্যায়ন হবে।

আগেই এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ দেশের মহান স্থপতি ও তার সুযোগ্য সহযোগীরা সংবিধান রচনা করে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান ও রাষ্ট্রের অন্যান্য বিষয় সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য নানা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচন পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানকে নিরপেক্ষ শক্তিশালী আর যোগ্য করে তোলার ব্যবস্থা করে থাকে। গণতান্ত্রিক দেশের সবচেয়ে গুরুত্বের বিষয় হচ্ছে সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা। সেই চেতনারই প্রকাশ ঘটানো হয়েছে আমাদের সংবিধানে। বাংলাদেশের নির্বাচন সেভাবে সুষ্ঠু তথা জনগণের স্বাধীনভাবে ভোট দেয়ার অধিকার নিশ্চিত করার কথা। সে জন্য সেই প্রতিষ্ঠানকে প্রভূত ক্ষমতা দিয়ে রাখা হয়েছে। অথচ আজ বাস্তবে এই প্রতিষ্ঠানটি ক্ষমতা কর্তৃত্বে অধিকারীদের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তাদের কাজের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব অনুরাগ আর বিরাগের প্রতিফলন এতটা প্রকাশ্য যে, সাধারণ মানুষের কাছে সংস্থাটি আস্থাহীন হয়ে পড়েছে এবং কঠোর সমালোচনার মুখে তারা। আজ তাদের স্বাধীন বিবেক বোধ বিবেচনার কোনো আশ্বাস নেই; নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মহান স্থপতি এবং তাদের সহযোগীরা এমন নির্বাচন কমিশনের কথা ভাবেননি। আজ কমিশনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে তারা যে ভোট পরিচালনা করে যাচ্ছেন তার হালচাল দেখে মানুষ এতটাই হতাশ ও বিমর্ষ যে, তারা এখন ভোট কেন্দ্র্রেই যান না। অথচ একসময় দেশের মানুষ উৎসাহ আর উদ্দীপনার আমেজ নিয়ে ভোটে অংশ নিতেন। তারা স্বপ্নও ভাবতেন না যে, তাদের ভোট নিয়ে কোনো জালিয়াতি হবে। ১৯৭০ সালে মানুষ বঙ্গবন্ধু ও তার দলকে বিপুল ভোট দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু কোনো অনিয়ম তখনো হয়নি।

বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করার জন্য সংবিধান নির্বাচন পরিচালনাকারী সংস্থা তথা নির্বাচন কমিশনকে পুরোপুরি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আজকে তাদের ব্যর্থতার কারণে নির্বাচন প্রহসনের রূপ নিয়েছে। কমিশনের প্রধান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ তুলে ধরেছেন সম্মানিত বিশিষ্ট সব বুদ্ধিজীবী। কমিশনের প্রধান যে আইনি শক্তির অধিকারী তা তিনি প্রয়োগ করেছেন নীতিবহির্ভূত যত অপকর্মে।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সফল করে তোলার জন্য অন্যান্য সরকারি প্রশাসনসহ পুলিশ প্রশাসনও সর্বত্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকে তাদের দায়িত্ব পালন করে থাকে। তারা নানা উন্নত কর্মকৌশল প্রয়োগ করে দায়িত্বের আনজাম দেয়। আর ১০টি প্রতিষ্ঠানের মতো পুলিশ প্রশাসনও বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশকে মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে ভূমিকা রাখে। সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী সব দুষ্কর্মের হোতাদের কঠিনভাবে তারা দমন করে থাকেন। দায়িত্ব পালনকালে কোনো অপশক্তির প্রতি তারা এতটুকু অনুকম্পা প্রদর্শন করেন না। তাই মানুষের কাছে পুলিশ শ্রদ্ধা ভালোবাসা আর নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে পরিগণিত। অথচ বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের মানুষের কাছে পুলিশের ভাবমর্যাদা অত্যন্ত ম্লান এবং তারা অনির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিগণিত। বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে সবার যথেষ্ট ধারণা রয়েছে। তাই সে সম্পর্কে আর বেশি বলতে চাই না। এ লেখার প্রধান লক্ষ্য গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। সেখানে পুলিশের ভূমিকা এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পুলিশের দায়িত্ব পালন নিয়ে তুলনামূলক আলোচনাও আমরা বেশি করতে চাই না। শুধু এতটুকুই উল্লেখ করব, বিগত বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পুলিশের ভূমিকার সাথে ক্ষমতাসীনদের নেতা সমর্থকদের ভূমিকা যেন একাকার হয়ে গিয়েছিল। অথচ নির্বাচন কমিশনের নজরে এসব ছিল না তা নয়। কমিশন যেন দলীয় অবস্থানের সাথে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছিল।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার পুরো অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানও মানুষকে সেই বিধিবদ্ধ অধিকার ভোগ করার পূর্ণ সুযোগ দিয়ে রেখেছে। সেখানে কোনো বাধাবিপত্তি বা শক্তিধরদের কোনো হস্তক্ষেপ আদালতের ন্যায়ভিত্তিক সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষেত্রে পিছপা করতে পারে না। নারী-পুরুষ কারো ক্ষেত্রেই কোনো বৈষ্যমের নজির নেই। দেশের বিভিন্ন আইন বিধিবিধান এবং সংবিধানের সংরক্ষণ ও ব্যাখ্যার পুরো অধিকার আদালতকে দেয়া হয়েছে।

নাগরিকদের মৌলিক অধিকারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে আদালত তার সবটুকু ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় কোনো ব্যত্যয় ঘটলে সেখানেও আদালত কিছুমাত্র পিছপা হন না। সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠার দিকনির্দেশনা আদালতের কাছ থেকেই প্রশাসনের কাছে আসছে। তাদের দুর্বলতার দিকগুলো চিহ্নিত করে আদালত তা দিয়ে যাচ্ছেন। আজ বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ দুর্নীতির জন্য নিন্দিত হচ্ছে। আমরা লক্ষ করছি, প্রশাসনের আর ব্যক্তির যত অনিয়ম আর দুর্নীতি নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত কড়া নজর রাখছেন। আইনানুযায়ী সেসব ব্যক্তি আর প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তির বিধান করছেন। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে এর যত ত্রুটিবিচ্যুতি তার সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম আমাদের আদালতের। তাদের আদর্শের দ্বারা রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গপ্রতিষ্ঠান যদি অনুপ্রাণিত হতে পারত তবে বাংলাদেশের চেহারা অবশ্যই পাল্টে যেত। তবে একটু উল্লেখ করতে চাই। সরকারি সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বিচার কার্য সমাধা হয়। কিন্তু সেই সরকারি সংস্থার বিরুদ্ধে এমন কিছু অভিযোগ রয়েছে যে, সংস্থা কিছু ‘বিনিময়’ পেয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংমিশ্রণ ঘটিয়ে থাকে।

আজকে দেশের যে পরিবেশ পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে এ কথা কেউ হলফ করে বলতে পারবেন না যে, মানুষ তার সাংবিধানিক ও মানবাধিকার ভোগ আর নিজ মতপ্রকাশের পূর্ণ সুযোগ পেয়ে থাকে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, মানুষের ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ ও প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হওয়া। এ জন্য যেকোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার অধিকার এবং সেই সংগঠনের রাজনৈতিক লক্ষ্যের আলোকে যাবতীয় কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার সুযোগ সব নাগরিকেরই রয়েছে। জাতীয় ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীদের জন্য বাধাহীনভাবে প্রচার কার্য পরিচালনা এবং ভোট দেয়ার অধিকার থাকে। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি হচ্ছে ভিন্ন রাজনীতির কার্যক্রমে শরিক হওয়া এবং ভোট প্রদানের সুযোগ এতটা সঙ্কুচিত এবং প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে যা আমাদের সংবিধানের মূল চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক।

দেশে এখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এতটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ যে, জাতীয় মিডিয়ায় সরকারি দল ও তাদের প্রতিপক্ষ পরস্পর কেবল পাল্টাপাল্টি তর্ক-বিতর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু এমনটা রাজনীতি বা রাজনৈতিক দল কোনোটাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে সহায়তা দেবে না। ফলে দেশ রাজনীতিশূন্য হয়ে যেতে পারে। ফলে দেশে কোনো গোষ্ঠী বিশেষের শাসনের জন্য পথ খুলে দেয়া হতে পারে। অথচ যে রাজনীতির জন্য আমাদের বরেণ্য পূর্বসূরিরা বহু ত্যাগতিতিক্ষার বিনিময়ে দেশে রাজনীতির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার অপমৃত্যু ঘটলে তাদের আত্মা দুঃসহ বেদনায় দারুণ কষ্ট পাবে।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষ স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগ পুরোপুরি ভোগ করে। আর এ কথা স্মরণ রাখতে হবে, মতপ্রকাশের মাধ্যম বহুমাত্রিক। জনগণের এমন অধিকার যাতে সংরক্ষিত থাকে তার প্রটেকশনের জন্য রয়েছে নানা বিধিবিধান। তাছাড়া এ ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা থেকে রক্ষা পাওয়ার আশ্রয় হিসেবে আছেন আদালত। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বে এমন সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। সেখানে প্রশাসন যতটুকু অনুমোদন দেয় সেই গণ্ডির মধ্যে থেকেই মতামতের চর্চা করতে হয়। এর ফলে প্রকাশ ঘটে তথ্যের নানা বিকৃত রূপ।

অথচ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থেকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনও নানাভাবে উপকৃত হতে পারে। পত্রিকার সাংবাদিকরা দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে হাজারও সমস্যার চিত্র তুলে ধরেন। এতে সমস্যার বিষয়গুলো প্রশাসনের নজরে আসে। তৃতীয় বিশ্বের আমলা শ্রেণী এতটা বিচক্ষণ আর দক্ষ নয় এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে এমন নীতিনিষ্ঠ নয় যে, দেশের সব সমস্যা তাদের দৃষ্টিতে থাকে। তাই এসব সমস্যা ক্রমেই কঠিন রূপ ধারণ করে। আর মানুষের সীমাহীন জনভোগান্তির সৃষ্টি হয়। সংবাদপত্র মানুষের দুর্ভোগ তুলে এনে তা প্রশাসনের দৃষ্টিগোচর করে; যাতে এসব সমস্যা দূর করতে রাষ্ট্রযন্ত্র সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশেও সংবাদপত্র সেই ভূমিকাই রেখে যাচ্ছে। তাই সংবাদমাধ্যমকে কারো প্রতিপক্ষ ভাবা উচিত নয়।

বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ জাতিসঙ্ঘের বিশ্বজনীন অধিকার চ্যাপ্টারে স্বাক্ষর করেছে। সেখানে মানুষের বহুবিধ অধিকার সংরক্ষিত করার জন্য স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এসব অধিকারের মাঝে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশেও তাই সংবাদপত্রের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা নিশ্চিত করার যাবতীয় ব্যবস্থা আঞ্জাম দেয়া সরকারের উচিত। সেই সাথে এ কথাও আমরা দৃঢ়প্রত্যয়ের সাথে বলতে চাই যে, স্বাধীনতা ভোগ করার পাশাপাশি অবশ্যই দায়িত্বের কথা মনে রাখতে হবে যে, অসত্য তথা ঘৃণা বিদ্বেষ আর সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে দেয়ার অনৈতিক চর্চাও সংবাদপত্রকে বন্ধ করতে হবে। কোনো কোনো অনলাইন মাধ্যম এমন ভিত্তিহীন গুজব আর অশ্লীলতা ছড়াচ্ছে যা তরুণদের বিপথগামী করবে।

ndigantababor@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement