নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর
- সৈয়দ আবদাল আহমদ
- ২৮ মার্চ ২০২১, ২১:২৫
বাংলাদেশে দু’দিনের সফর শেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দিল্লি ফিরে গেছেন। বিদেশী মেহমান বিশেষ করে বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশে আগমনে জনগণের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আনন্দ-উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হবে, এটিই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশে নরেন্দ্র মোদির আগমনে বিশেষ একটি মহল খুশি হলেও বেশির ভাগ জনগণের মধ্যে তা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। তার এই সফর ঘিরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের সাথে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রলীগ ক্যাডারদের সংঘর্ষ হয়েছে। পুলিশের গুলিতে ১১টি তাজা প্রাণ অকালে ঝরে গেছে। মোদির এই সফরটি বিতর্কিত সফর হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ, ভারত সম্পর্কে তা নতুন করে তিক্ততার জন্ম দিয়েছে।
কূটনৈতিক দিক থেকেও নরেন্দ্র মোদির এই সফর ব্যর্থতার একটি নজির হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের মিডিয়া লিখতে পারল না, মোদি এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। বরং লিখতে হবে, মোদি এসে বাংলাদেশে রক্ত ঝরালেন! হতাশা বাড়িয়ে দিলেন! তিস্তার পানির ব্যাপারে চুপ রইলেন। সীমান্ত হত্যা বন্ধ হবে কিনা সেই নিশ্চয়তাও আমরা পাইনি।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মোদি
২৬ মার্চ, ২০২১ ছিল আমাদের মহান স্বাধীনতার ৫০তম পূর্তির দিন অর্থাৎ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ ৫০ বছর পার করল। ১৭ মার্চ, ২০২১ ছিল বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। এবারের এই মার্চ মাস আমাদের জন্য খুবই আনন্দের এবং গৌরবের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই আনন্দ আমরা উপভোগ করতে পারিনি। ক্ষমতাসীনরা সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠান সর্বজনীন করতে পারেনি। আওয়ামী লীগের বাইরে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তেমন কোনো দল ও ব্যক্তিবর্গকে দাওয়াত করা হয়নি। অন্য দল ও সংগঠনকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানমালা নিজ নিজ উদ্যোগে পালন করতেও দেয়া হয়নি।
আমন্ত্রিত অতিথি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নিরাপত্তার অজুহাতে রাজধানী ঢাকায় জারি হয়েছিল অঘোষিত কারফিউ। মানুষ ২৫ ও ২৬ মার্চ ঘরের বাইরে খুব একটা বের হতে পারেননি। ঘরে তারা ছিলেন এক প্রকার বন্দী।
নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানানো দোষের কিছু নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী ভারতের অবদান রয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ছাড়াও এটি বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনেরও ৫০ বছর পূর্তির বছর। সে হিসেবেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী আসতেই পারেন। তবে এটাও চিন্তা করা উচিত ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং নরেন্দ্র মোদি এক জিনিস নয়। মোদিকে নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। তিনি মুসলিমবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত। মুসলিমদের নির্বিচারে হত্যার জন্য তাকে বলা হয় ‘গুজরাটের কসাই’। ২০০২ সালে গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য তাকে দায়ী করা হয়। তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘মোদির হাত গুজরাটের রক্তে লাল হয়ে আছে।’ (প্রথম আলো)
তাছাড়া বাংলাদেশের স্বার্থের ব্যাপারে তিনি ইতিবাচক নন। তার দল বিজেপি থেকে প্রায়ই বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য দেয়া হয়। বিজেপি এর আগেও ক্ষমতায় ছিল। অটল বিহারি বাজপেয়িও বাংলাদেশ সফর করেছেন। তার সময় কোনো বিক্ষোভ হয়নি। কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকাকালে প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং দু’দুবার ঢাকায় এসেছেন। সে সময়ও কোনো বিক্ষোভ হয়নি। বরং জনগণের মধ্যে ব্যাপক উচ্ছ্বাস ছিল। মোদি বলেই বিক্ষোভ হয়েছে। অনেকেই বলেছেন, আমাদের মহান স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানটাই ম্লান করে দেয়া হয়েছে। বিতর্কিত করে দেয়া হয়েছে। ভারতের অনেক মহান নেতা আছেন। প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গ আছেন। তাদের কাউকেও তো আনা যেত।
বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আসার কয়েক দিন আগ থেকেই বিক্ষোভ হচ্ছে। শুধু ইসলামপন্থীরাই নয়, অর্থাৎ হেফাজতে ইসলামই নয়, বামপন্থী অনেক সংগঠনও বিক্ষোভ করেছে। এসব বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণভাবেই হচ্ছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীনরাই এই বিক্ষোভকে সহিংস করে তোলে। মোদির বিতর্কিত ভূমিকার জন্য নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ হতেই পারে। এই প্রতিবাদ হিংস্রপন্থায় দমন করতে হবে? দেখা যায়, নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে যেখানেই বিক্ষোভ হয়েছে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পুলিশ। না, শুধু পুলিশই নয়, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগও ঝাঁপিয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ঢাকায় ছাত্রলীগ পুলিশের সাথে বিক্ষোভ দমনে ঝাঁপিয়ে পড়ায় পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ, গুলি এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এর পরিণতিতে ১১ জন নিরীহ মানুষ নিমর্ম হত্যার শিকার হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা তাদের বক্তব্যে বলেছেন, নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের স্বার্থ, সম্মানের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন, কথা বলেছেন। তিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। সেজন্যই তাদের প্রতিবাদ। এমন একজনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কেন করা যাবে না? আমাদের স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তীর সময়ে কেন মুখে তালা দিয়ে রাখতে হবে?
আশাহত বাংলাদেশ
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হয়ে এসেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বাংলাদেশের জনগণের মনে একটা আশা জন্মেছিল যে, হয়তো এবার আমাদের একটা বিহিত হবে। অর্থাৎ তিস্তার পানির ব্যাপারে অন্তত সুনির্দিষ্ট একটা ঘোষণা আমরা পাবো। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি নরেন্দ্র মোদির নজরেও আনলেন। বললেন, তিস্তার পানির অভাবে আমাদের জনগণ কষ্ট করছে। কিন্তু মুখে কুলুপ এঁটে রইলেন নরেন্দ্র মোদি। একগাল মুচকি হাসি দিয়ে শুধু আশ্বাস দিলেন এ ব্যাপারে আমাদের অঙ্গীকার আছে। কি সেই অঙ্গীকার খোলাসা করলেন না।
প্রধানমন্ত্রী সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যার বিষয়টিও তুললেন। কিন্তু নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি যে, সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা পুরোপুরি বন্ধ হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভারত সক্রিয় ভূমিকা রাখুক, সেটাও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদির সামনে তুলে ধরেন। নরেন্দ্র মোদি শুধু বললেন, এ ব্যাপারে ভারত সহযোগিতা করবে। এতটুকুই। এ সফরে অবশ্য বাংলাদেশ ১০টি ঘোষণা পেয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, চিলাহাটি-হলদিবাড়ি পথে মিতালী এক্সপ্রেস চালু, দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে বঙ্গবন্ধু চেয়ার চালু, ৬ ডিসেম্বর ‘মৈত্রী দিবস’ পালন ইত্যাদি।
নরেন্দ্র মোদি সফরকালে ওড়াকান্দির ঠাকুরবাড়ি এবং সাতক্ষীরার যশোরেশ্বরী কালীমন্দিরে পূজা নিতে যান যা নিয়ে খোদ ভারতেই বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে চলমান নির্বাচন প্রভাবিত করার জন্যই মোদি ওই দুই মন্দিরে পূজো দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধান সভা নির্বাচনে মতুয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের প্রভাব রয়েছে কিছু আসনে। নরেন্দ্র মোদি সেটা কাজে লাগাতেই সেখানে গেছেন। এ ব্যাপারে সাংবাদিকরা ভারতের পররাষ্ট্র সচিবকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সফরের সময় ওড়াকান্দির ঠাকুরবাড়ি ও সাতক্ষীরার মন্দিরে যাওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি শিলাইদহের কুঠিবাড়িও পরিদর্শন করতে চেয়েছিলেন। এবারের সফরে অন্তত দু’টি জায়গায় যেতে পেরে তিনি খুশি। তাই এ সফরকে সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা ঠিক হবে না।
প্রতিবেশীর কাছে বাংলাদেশের প্রত্যাশা
ভারতের কাছে বাংলাদেশের বড় প্রত্যাশা এখন চারটি। তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের ন্যায্য সমাধান, সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধ, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভারতের সক্রিয় সহযোগিতা এবং নেপাল ও ভুটানে যাতায়াতের সুবিধা সৃষ্টি করে দেয়া। প্রাপ্তির বিষয় উঠলেই ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দেয়ার ব্যাপারে বড় সহযোগিতা দিয়েছে। এর চেয়ে প্রাপ্তি আর কী হতে পারে? অবশ্য আমরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতায় ভারতের এই অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করি। তারা আমাদের এক কোটি শরণার্থীকেও আশ্রয় দিয়েছে। তবে এটাও তো ঠিক বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় ভারতেরও কম লাভ হয়নি! বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ে ভারত কি অস্বস্তিতে থাকত না? প্রতিবেশী পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ কি ভারতের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসেনি? তাছাড়া ভারতের অর্থনীতিতেও বাংলাদেশ বিরাট ভূমিকা পালন করছে। ভারতের রেমিট্যান্স আয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চতুর্থতম। প্রায় ৩৩ থেকে ৩৫ হাজার কোটি রুপি বৈধ পথে রেমিট্যান্স ভারত আয় করছে বাংলাদেশ থেকে। দুই লাখ ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। এর মধ্যে ভারতীয়দের সংখ্যাই বেশি। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ১৫ থেকে ১৬ লাখ লোক ভারতে সিকিৎসা ও ভ্রমণে যায়। ওখান থেকে বিশাল অঙ্কের টাকা ভারত আয় করছে। পশ্চিমবঙ্গের নিউ মার্কেটে প্রতিদিনের বিক্রির অর্ধেকটাই আসে বাংলাদেশী নাগরিকদের পণ্য কেনা থেকে। বর্তমান করোনাকালে কলকাতা নিউ মার্কেটে বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে। এর কারণ বাংলাদেশীরা নেই। বাংলাদেশ ভারতের অন্যতম পণ্যের বাজার। এসব কারণেও তো ভারতকে বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ দেখানো উচিত। আমরা চাই দু’দেশের সুসম্পর্ক, সেটা শুধু একমুখী হলে তো চলবে না!
লেখক : সাংবাদিক; সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাতীয় প্রেস ক্লাব
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা