আর যেন আগুন না লাগে
- মীযানুল করীম
- ২৭ মার্চ ২০২১, ২০:১৯
গত সোমবার ২২ মার্চ রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে শরণকালের ভয়াবহতম অগ্নিকাণ্ডে ১৫ জনের মতো প্রাণ হারানোর পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি নজিরবিহীন। একই দিন রাজধানীর উপকণ্ঠেও কয়েকটি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে কোনো কোনো ঘটনা ছিল অভূতপূর্ব ও রহস্যময়। চরম নির্যাতনে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য (সাবেক আরাকান স্টেট) থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান উদ্বাস্তু হিসেবে বছরের পর বছর কাটাচ্ছে কক্সবাজার জেলার উখিয়া-টেকনাফ এলাকায়। উখিয়ার বিশাল বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরেই রহস্যজনক আগুনের ঘটনা ঘটেছে এবার। আসল কারণটা গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জানা যায়নি। মৃতের সম্ভাব্য সংখ্যা ৩০ জন পর্যন্ত বলা হচ্ছে কোনো কোনো মহল থেকে।
একটি জাতীয় দৈনিকের খবর মাফিক, বালুখালী উদ্বাস্তু শিবিরের নজিরবিহীন আগুনে সোমবার বেলা ৩টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ১০ সহস্রাধিক ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তাছাড়া, সংলগ্ন হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের কমপক্ষে ৩০০ ঘরবাড়ি পুড়ে যায়। এই অগ্নিকাণ্ডে ৪৫ হাজার রোহিঙ্গাসহ অর্ধ লাখ মানুষ হারিয়েছে সর্বস্ব। সহায় সম্বলহারা রোহিঙ্গারা সড়কে, পাহাড়ে, এমনকি বনজঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে কোনোমতে বেঁচে আছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন কেন, কে বা কারা লাগাল? অর্থাৎ এই মারাত্মক অগ্নিকাণ্ডের কারণ কী? ‘নানা মুনির নানা মত’। এক দিকে রোহিঙ্গারাই পরস্পরকে দোষ দিচ্ছে। আবার কোনো কোনো পত্রিকায় ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ প্রকাশ পাচ্ছে। কেউ বলছে, উগ্রবাদী গোষ্ঠী এই সন্ত্রাসী ঘটনার হোতা। কারো মতে, একটি পরিবারের মধ্যে চরম কোন্দলজনিত ঘটনাও হতে পারে এটা। অভিযোগ রয়েছে, রোহিঙ্গাদের একটি উগ্র সংগঠনের মধ্যে বর্তমানে বিরোধ চরমে। সোমবার সকালে একটি রোহিঙ্গা পরিবারের মধ্যে প্রচণ্ড বিরোধও উল্লেখ করার মতো ঘটনা। তদুপরি রোহিঙ্গাদের অনেকের ঘরে ছিল জ্বালানি গ্যাসের সিলিন্ডার। এর সাথে এক প্রকার বিস্ফোরক দ্রব্য যোগ হয়ে আগুন ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করেছিল। কিছু দূর থেকে অনেকে দেখেছেন, উদ্বাস্তু শিবিরে কয়েকটি জায়গায় একই সময়ে হঠাৎ আগুন ধরে যায়। এর রহস্য উদঘাটন দরকার। জানা যায়, তখন কারো কারো নাকে বিস্ফোরকের গন্ধ লেগেছে, যা গ্যাসের নয়। এমনকি, আগুনের ফুলকি অনেক দূর থেকে ক্যাম্পের একেক স্থানে ছুট আসছিল।
অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে স্বাভাবিকভাবেই দুঃখ-বেদনা, আহাজারি ইত্যাদি থাকে। বালুখালীতে এর সাথে যোগ হয়েছে অনেকের ক্ষোভ। এ ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা নয়, ‘পরিকল্পিত’ ও ‘নাশকতা’ বলছে অনেকে। অবশ্য সঙ্গত কারণেই সাধারণ শরণার্থীরা খুলে বলতে চায় না। জানা গেছে, ক্যাম্পে যারা অন্যায় দাপট দেখায় এবং যারা ‘শক্তিশালী,’ তাদের প্রতিই সন্দেহের আঙুল। ওরা নাকি সংঘবদ্ধভাবে বারবার চেষ্টা করেছে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির। এমনকি তাদের ব্যাপারে খুন, হামলা, অপহরণ, ছিনতাই, মুক্তিপণ আদায়, নারী নির্যাতন, মাদক কারবার প্রভৃতির অভিযোগ রয়েছে। উদ্বাস্তুদের একাংশের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার নানা খবর দেশের মিডিয়া প্রচার করেছে সম্প্রতি।
বালুখালী ক্যাম্পে আগুন লেগেছিল বেলা ৩টায়। পুরো নিভেছে রাত ১টার দিকে। আবার কারো কারো মতে, আগুন আসলে লাগে বিকেল ৪টায়। রাত সাড়ে ৯টার সময় আগুন প্রায় নির্বাপিত হয়ে যায়। একটি পত্রিকার ভাষ্য, ‘সোমবার বেলা ৩টা। কক্সাবাজার শহর থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শিবির। সেখানকার একটি ঘরে হঠাৎ আগুন লাগে। দ্রুত সেই আগুন ছড়াতে থাকে। রাত পৌনে ১০টায় স্থানীয় মানুষ, বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এ সময়ের মধ্যে পাঁচটি উদ্বাস্তু শিবির পুড়ে ছাই। ১১ জনের লাশ পাওয়া গেলেও শ চারেক মানুষ রয়েছে নিখোঁজ।’
কেউ কেউ বলছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কিংবা ভাসান চরে তাদের স্থানান্তরকে বাধা দিতে ‘এজেন্ট’রা এটা ঘটিয়েছে। এর মধ্যে সরকার সমর্থক একটি পত্রিকার ‘খবর’- মুজিববর্ষ উদযাপনকালে বিশেষ কোনো মতলবে এ ধরনের নাশকতা হতে পারে। কোনো কোনো পত্রিকা বলেছে, শরণার্থীদের মাঝে মিয়ানমার সরকারের কিছু দালাল লুকিয়ে থাকতে পারে। স্থানীয় একজন ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ‘খবর যা পেয়েছি, মনে হয় এটা পরিকল্পিত ঘটনা। এক সাথে কয়েক স্থানে আগুন লাগায় সহজে তা নেভানো যায়নি।’ এ চেয়ারম্যানের অভিযোগ, স্থানীয় যাদের ঘর বা দোকান ভস্মীভূত হয়েছে, তারা সাহায্য পাননি। ফায়ার সার্ভিস জানায়, ‘শিবিরের ঘরগুলো গায়ে গা লাগানো এবং কয়েকটি পাহাড়ের ঢালে এর অবস্থান। তাই আগুন নেভাতে সময় লেগেছে অনেক। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তে এসব বিষয়ে প্রকৃত ব্যাপার জানা যাবে বলে আশা করা যায়।’
দেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পত্রিকায় লিখেছেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আগুন বাইরেও ছড়াবে’ শিরোনামে নিবন্ধ। চলমান অগ্নিদুর্যোগ নীতিমালা ও কৌশল আরো কার্যকর ও সঠিক করার বিষয়ে তিনি জানান, এ সম্পর্কে গত ২১ ডিসেম্বর সংশ্লিষ্ট চূড়ান্ত সভায় বিশেজ্ঞরা ২৯টি পরামর্শ দিয়েছেন। তিনটি পর্যায়ে দুর্যোগ মোকাবেলার একটি ছকও তৈরি করা হয়।
নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, (রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের) ক্যাম্পগুলোতে আগুন লাগলে কী কী কারণে নেভানো খুবই কষ্টসাধ্য হবে, তার একটা তালিকাও বিশেষজ্ঞরা দেন। স্যাটেলাইট ফায়ার স্টেশন তখনো কার্যকর না থাকা, অগ্নিনির্বাপক গাড়ি ঢুকতে না পারা, স্যাটেলাইট ফায়ার স্টেশনে যন্ত্রপাতি সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষিত কর্মী না থাকা, ফায়ার এক্সটিংগুইশার ও অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহারোপযোগী না থাকা, প্রতিদিন নিয়মিত দাহ্য পদার্থ পরীক্ষা না করা, নির্বাপণকর্মী চাকুরে না থাকা, নতুন সরঞ্জাম থাকলেও নির্বাপণকর্মী প্রশিক্ষিত না রাখা, পানির স্বল্পতা, নির্বাপণ দক্ষতার ছক না থাকা, আগুন বাগে আনার জন্য গমন-বহির্গমনের সবচেয়ে মোক্ষম পথগুলোতে কোনো মানচিত্র না থাকা, ইত্যাদি। ২৯টি পরামর্শের বাস্তবায়ন এবং বিশেষজ্ঞদের চেষ্টায় অগ্রগতি কতদূর কী হয়েছে, এখন হয়তো সাংবাদিকেরা এবং এনজিওসহ সাধারণ নাগরিকরা সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নামবেন।’
অথঃতদন্ত কাহিনী
তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে রোহিঙ্গা শিবিরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপারে। তারা এ ঘটনার প্রকৃত কারণ উদঘাটন এবং আবার যাতে এ ধরনের অঘন না ঘটে, সে জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ বা করণীয় পেশ করবেন।
আমাদের দেশে গতানুগতিকভাবে তদন্তের একটা প্রথা বিদ্যমান যা কার্যত অর্থহীন। এ নিয়ে যেসব কথা রসিকতা করে বলা হয়ে থাকে, তার কিছুটা উল্লেখ করা হলো- বাংলাদেশে ঘটনা-দুর্ঘটনার শেষ নেই, তাই সীমা নেই তদন্ত কমিটি গঠনের। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তদন্ত প্রতিবেদনে কী আছে, তা আর শেষাবধি জানা যায় না। এ জন্য অনেকের মতে, তদন্তের বিষয়ে গাফিলতি তদন্তের প্রয়োজনে নতুন করে তদন্ত হওয়া উচিত। এ জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে আবার তদন্ত কমিটি গঠন করা দরকার।’ কিন্তু কথা হলো, সে কমিটিও যদি ‘ফেল মারে’! অর্থাৎ তদন্ত কেন হলো না অথবা, কেন তদন্তের নামে কোনোমতে দায়সারা হলো তার জবাব যদি পরেও খোঁজা না হয়? তখন আসলে কী করতে হবে, তা এখনই ভাবতে হবে সবাইকে।
তদন্তসংক্রান্ত সমস্যার মধ্যে রয়েছে- তদন্তের বিষয় ও আওতা সঠিকভাবে নির্ধারণ না করা (Terms of Referesnce-এর অসম্পূর্ণতা), তদন্তের আশ্বাস বা অঙ্গীকার সত্ত্বে¡ও শেষ পর্যন্ত তদন্ত না করা (হয়তো থলের বিড়াল বের হয়ে যাবে, এই ভয়ে), তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও তারা তদন্তের দায়িত্ব পালন না করা, এ কমিটি কাজ করার পরও প্রতিবেদন না দেয়া, তদন্তের প্রতিবেদন দেয়া হলেও তা গোপন রাখা, প্রতিবেদনে উল্লিখিত সুপারিশ কার্যকর না করা, প্রভৃতি। যা হোক, ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ ওঠা’র শঙ্কায় এ দেশে কত তদন্তকে যে ধামাচাপা দেয়া হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। ফলে মূল সঙ্কট রয়ে যাচ্ছে। আর একই অন্যায়, অনিয়ম, দুর্ঘটনা কিংবা দুর্ভোগ ঘটছে বারবার।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা