২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

স্বাধীনতা আন্দোলন ও কিছু কথা

স্বাধীনতা আন্দোলন ও কিছু কথা - ফাইল ছবি

 

 


পৃথিবীর এই অঞ্চলের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে মওলানা ভাসানী অবিস্মরণীয় পিতৃপুরুষের নাম। ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলমুক্তি তথা ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনত সংগ্রামে যারা ছিলেন শীর্ষস্থানীয়, তিনি তাদের একজন। পরবর্তীকালে পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ’ (হামজা আলাভী : ১৯৭২) বিরোধী স্বাধীনতার আন্দোলনে তিনিই ছিলেন উৎসমূল। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই এই অনিবার্য সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তিনিই প্রথম রাজনৈতিক দল সংগঠিত করেন। যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে ১৯৫৪ সালে তিনি গণবিরোধী শক্তিকে পর্যুদস্ত করেন। তিনিই সেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা যিনি পশ্চিমাদের উদ্দেশে সর্বপ্রথম উচ্চারণ করেছিলেন ‘আসসালামু আলাইকুম’, কথিত ‘নিউক্লিয়াস’ (মহিউদ্দিন : ২০২১) এর অনেক আগে। তাই সঙ্গতভাবেই তাকে বলা যায় বাংলাদেশের স্বার্থক স্বপ্নদ্রষ্টা। স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের চেয়ে স্বাধিকার আন্দোলনকে তিনি অগ্রাধিকার দেন। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালে নির্বাচন বর্জন করে স্বাধিকার আন্দোলনকে বেগবান করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে জাতীয় নেতৃত্বকে স্বাধীনতার পথে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেন। এই জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে দিয়েছেন যথার্থ সম্মান। তাই মওলানা ভাসানী আমাদের পিতৃপুরুষদের একজন। বলা যায়, পিতামহ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে কালরাত্রির পর অগত্যা তিনি সীমান্ত অতিক্রম করেন। সেখানে ৯ মাস ধরে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পর নাগরিক স্বাধীনতা অর্জনের পথে নিরন্তর সংগ্রাম করেন।

মওলানা উপাধিধারীরা ধর্মীয় নেতা হিসেবেই সমধিক বরেণ্য। সেক্ষেত্রে মওলানা ভাসানী একটি উজ্জ্বল স্বকীয় সত্তা। তিনি ধর্মীয় নেতা ছিলেন এবং সেই সাথে ছিলেন জননন্দিত রাজনৈতিক নেতা। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার মেহনতি মানুষের মুক্তির দিশারিদের সাথে উচ্চারিত হয় তার নাম। ধর্মের চেতনা বিশেষত খ্রিষ্টধর্মের মূল দর্শনের আলোকে গোটা লাতিন আমেরিকা এবং এশিয়ার দক্ষিণ দক্ষিণ-পূর্বাংশে স্বাধীনতা ধর্মতত্ত্ব (লিবারেশন থিওলজি) এবং বিপ্লবী ধর্মতত্ত্বের (রেভোল্যুশনারি রিলিজিওন) বিকাশ ঘটে। খ্রিষ্টধর্মীয় নেতারা বাইবেলে কথিত স্বাধীন মানবসত্তার আলোকে ঔপনিবেশিক তথা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকা পালন করেন। মওলানা ভাসানী এই উপমহাদেশে এবং বাংলাদেশে তার স্বধর্ম ইসলামের আলোকে খ্রিষ্টধর্মতাত্ত্বিকদের মতোই স্বাধীনতার ও মানবতার পক্ষে বিপ্লবী ভূমিকা পালন করেন। অনেক পশ্চিমা সমাজতাত্ত্বিক মওলানা ভাসানীকে স্বাধীনতা ধর্মতত্ত্ব ও বিপ্লবী দর্শনের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন।

খ্রিষ্টধর্মবেত্তাদের সাথে তুলনীয় হলেও মওলানা ভাসানীর আদর্শ ও আন্দোলন ছিল স্বকীয় ধারায় মহিমান্বিত। তিনি মুক্তি ও মানবতার আবেদনকে খ্রিষ্টধর্ম থেকে ধার করেননি। এটি ছিল ইসলামেরই মর্মকথা। তাই দেখা যায়, ইসলামের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় বিশেষত ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ইসলামী ধর্মতাত্ত্বিকরা ‘জেহাদ’ করেছেন। এ ক্ষেত্রে আফ্রিকার উত্তরাঞ্চলে উমর মুখতার ছিলেন এক বিপ্লবী মুজাহিদ। আলজেরিয়ায় আবদুল কাদের। সুদানে আল মেহেদী। আরব জাহানে আবদুল ওয়াহাব। মধ্য এশিয়া তথা আফগানিস্তানে জামাল উদ্দিন আফগানি। এই উপমহাদেশও সে ধারায় ধন্য। মাওলানা মোহাম্মদ আলী, মাওলানা শওকত আলী সে ধারার বিপ্লবী পুরুষ। এই বাংলাদেশে হাজী শরীয়তউল্লাহ, হাজী নিসার আলী তিতুমীর ও ফকির মজনু শাহ সে ধারারই পথিক। মওলানা ভাসানী ছিলেন একই ধারার সর্বশেষ যোদ্ধা। যিনি একই সাথে স্বাধীনতা ও মানবিকতার জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লড়াই করে গেছেন। কুরআন ও হাদিস ব্যাখ্যা করে তিনি জনগণকে আন্দোলনে উজ্জীবিত করতেন। ইসলামকে তিনি সমাজতন্ত্রের প্রতিরূপ বলে বিশ্বাস করতেন। তার সমাজতন্ত্র মার্কসবাদ নয়, গরিব দুঃখী মানুষের মুক্তি। মার্কসবাদী তথা বামধারার লোকেরা তাকে ভালোবাসতেন। তার মাধ্যমে তাদের আন্দোলন এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। তাই তার আন্দোলন হয়ে দাঁড়ায় মার্কসবাদ থেকে ভিন্ন কিছু। আবার প্রচলিত আলেম-ওলামাদের রাজনীতি থেকে স্বতন্ত্র। সে আন্দোলন পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতায় স্বকীয় সত্তায় দেদীপ্যমান।

শুধু ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য নয়, উপমহাদেশে ক্ষমতাশ্রয়ী রাজনীতির বিপরীতে চিরবিরোধী রাজনীতির উজ্জ্বল উদাহরণ তিনি। একমাত্র মহাত্মা গান্ধীই তার অগ্রজ প্রতীয়মান হতে পারেন- অন্য কেউ নয়। বাংলাদেশের রাজনীতির ৫০ বছরে মওলানা ভাসানীর চিরবিরোধী চিরবিদ্রোহী রাজনীতির দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। অত্যাচারিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে তিনি বরিত হয়েছেন ‘মজলুম জননেতা’ হিসেবে। পাকিস্তান আমলে ‘বিপ্লবী ধারার রাজনীতিবিদ হিসেবে অভিহিত হয়েছেন ‘রেড মওলানা হিসেবে’। (নুরুল কবীর : ২০১২) ১৯৬৯ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাকে বলেছে, ‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’ বা সন্ত্রাস-সহিংসতার অবতার। (মেসবাহ কামাল-১৯৯২ : ১৪২-৪৩)

মওলানা ভাসানীর প্রতিবাদী চরিত্র আজন্ম লালিত। জমিদারের অত্যাচার, আসামে বাঙালি খেদাও তথা লাইন প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে জননেতা হয়েছেন। পাকিস্তানের ইতিহাসে তিনিই পূর্ব বাংলার প্রথম ব্যক্তি যিনি কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে উচ্চকিত হয়েছেন। প্রাদেশিক পরিষদের সাময়িক সদস্য হিসেবে ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘আমরা সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের গোলাম কি না?’ পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরে রাজনীতি যখন প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের হাতে, যখন সবাই কেন্দ্রীয় সরকার ও তাদের এতদ্দেশীয় তাঁবেদারদের ভয়ে ভীত, তখন তিনিই সেই অকুতোভয় নেতা যিনি পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল সংগঠনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন রোজ গার্ডেনে জন্ম লাভ করে আজকের আওয়ামী লীগের পূর্বসূরি আওয়ামী মুসলিম লীগ। সভাপতিত্ব করেন মওলানা ভাসানী। নবগঠিত বিরোধী দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মেধাবী নেতা শামসুল হক (পরবর্তীকালে নিরুদ্দেশ)। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। খাজা-গজাদের নিয়ন্ত্রিত সামন্তবাদী অসাধারণ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গঠিত হয় সাধারণের দল আওয়ামী লীগ। পরদিন ২৪ জুন আরমানিটোলা ময়দানে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিরোধী জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এখানেও সভাপতিত্ব করেন মওলানা ভাসানী। ভাষা আন্দোলনের সূচনার নেতৃত্ব তার। ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয় তারই সভাপতিত্বে। এ সময় ১৬ মাস কারাবরণ করেন তিনি। ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠনে শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর সাথে সমদায়িত্ব পালন করেন মওলানা ভাসানী। ১৯৫৭ সালের ৫-৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানকে লক্ষ্য করে ঘোষণা করলেন ‘আসসালামু আলাইকুম’ অর্থাৎ বিদায়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন পর্যায়ে মওলানা ভাসানী একই ধরনের উচ্চারণ করেছেন। সেই সময়ে মওলানা ভাসানী পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সামরিক জোটে যোগদানের ক্ষেত্রে প্রবল বিরোধিতা করেন। সোহরাওয়ার্দী বলেন, ‘পূর্ব বাংলার ৯৮ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হয়েছে। মার্কিন জোটের ব্যাপারে মওলানা ভাসানী নির্দেশিত মুসলিম জোটের বিপক্ষে বলেছিলেন ‘জিরো প্লাস জিরো ইকুয়াল টু জিরো’। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল অংশ নিয়ে মওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ গঠন করেন। ন্যাপের মস্কো বনাম পিকিং বিভাজন ঘটলে তিনি পিকিংপন্থীদের নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৪ সালে আইয়ুবের সামরিক শাসনের পর রাজনীতির সূচনা হলে মওলানা ভাসানী অন্যান্য নেতার সাথে দলীয় রাজনীতির বদলে গণতন্ত্রের সংগ্রামকে প্রাধান্য দেন। এভাবে গঠিত হয় কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি-কপ। ১৯৬৯ সালে মওলানা ভাসানী বায়তুল মোকাররমে প্রথম মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে গণ-আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুববিরোধী গণ-আন্দোলনে অনন্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাস ঘটে। এতে লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। উপদ্রুত এলাকা সফর শেষে ২৩ নভেম্বর পল্টন ময়দানে পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে ‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন’ বললেন। তখন কবি শামসুর রাহমান লিখলেন-
‘বল্লমের মতো ঝলসে ওঠে তাঁর হাত বারবার
অতি দ্রুত স্ফীত হয়, স্ফীত হয় মৌলানার সফেদ পাঞ্জাবি
যেন তিনি ধবধবে একটি পাঞ্জাবি দিয়ে সব
বিধ্বস্ত বে আব্রু লাশ কী ব্যাকুল ঢেকে দিতে চান।’

১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর আবারো স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের ঘোষণা দেন। ১৮ জানুয়ারি ১৯৭১ সালে রংপুরের জনসভায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার কথা পুনরায় উল্লেখ করে মওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুকে প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দেন। মওলানার ভাষণে তখন ন্যাপ নেতারা স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের পতাকা তৈরি করেন। এখানে লক্ষণীয় যে, যখন বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা বলছেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দিয়েছেন তখন মওলানা ভাসানী স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের কথা বলছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ এবং স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে তত্ত্বগত বিভেদ রয়েছে। মওলানা ভাসানী তার ঘোষণার মাধ্যমে ১৯৪০ সালে গৃহীত লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক স্বতন্ত্র রাষ্ট্রেরই প্রতিধ্বনি করছিলেন। স্মরণীয় যে, আবুল মনসুর আহমেদ বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ‘এন্ড অব দ্য বিট্রেয়াল অ্যান্ড রেস্টোরেশন অব লাহোর রেজ্যুলেশন’ অর্থাৎ বিশ্বাসঘাতকতার শেষ এবং লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়ন বলে বর্ণনা করেছেন। মওলানা ভাসানীর স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান ধারণায় অবিভক্ত বাংলার অপর অংশের আদর্শিক ও ভাষাগত সংশ্লিষ্টতা ছিল না। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের ধারণা একান্তভাবেই ১৯৪৭ সালে অর্জিত স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের ভৌগোলিক ও ধর্মীয় পরিচয় বিধৃত ছিল। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, পরবর্তীকালে শহীদ জিয়াউর রহমান যে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করেন তার সাথে মওলানা ভাসানী ঘোষিত স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের আত্মিক, তাত্ত্বিক ও ভৌগোলিক মিল রয়েছে। মওলানা ভাসানীর অনেক অনুসারী স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ভারতের দিল্লি, দেরাদুন ও কলকাতায় অবস্থান করেন। মুক্তিযুদ্ধকে সর্বদলীয়ভাবে উপস্থাপনের চেষ্টায় তাকে সভাপতি করে ন্যাপ মুজাফফর, সিপিবি ইত্যাদি দল সমন্বয়ে স্বাধীন বাংলা সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়। এ সময়ে মওলানা ভাসানী পৃথিবীর বিভিন্ন নেতানেত্রীকে মুক্তিযুদ্ধ সমর্থনের আহ্বান জানিয়ে চিঠি লিখেন। এদের মধ্যে রয়েছেন চীনের চেয়ারম্যান মাও জে দুং, সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগর্নি ও জাতিসঙ্ঘের সহাসচিব উ থান্ট প্রমুখ। মওলানা ভাসানীর ভারতে থাকাকালীন সময়কে অনেকে ‘অন্তরীণ অবস্থা’ বলে বর্ণনা করেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও মওলানা ভাসানী দেশে ফিরেন বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ২২ জানুয়ারি, ১৯৭২।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তিনি তার সেই চিরায়ত বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাকিস্তান আমলে বামধারার রাজনীতিকরা তার সাথী হলেও স্বাধীনতার পর তারা নিজ নিজ রাজনৈতিক দল গঠন করেন। মওলানা ভাসানী একরকম নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। একান্ত অনুসারীরা তাকে ঘিরে থাকেন। এ সময় তিনি আরো গভীরভাবে ইসলামী ধ্যান-ধারণাপুষ্ট রাজনীতির কথা বলেন। তিনি হুকুমতে রব্বানিয়া ও রবুবিয়তের দর্শন প্রচার করেন। ইসলামী সমাজতন্ত্রের পক্ষে জনমত গঠন করেন। তবে মওলানা ভাসানীর রাজনীতি ও ধর্ম দর্শনে স্বাতন্ত্র্য ছিল। সম্প্রতি সম্পাদিত একটি গবেষণাকর্মের নির্যাসে বলা হয়, ‘মওলানা ভাসানী এ দেশের একমাত্র রাজনীতিক যথার্থভাবে ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছিলেন। তার ধর্মবিশ্বাস ছিল রাজনীতির অন্যতম উপাদান, যদিও তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করতেন না। এ জন্যই তার ধর্ম কখনো রাজনীতিকে কলঙ্কিত করেনি। আবার তার রাজনীতিও ধর্ম পালনে অন্তরায় সৃষ্টি করেনি। তিনি ধর্মের বিপ্লবী আদর্শকে রাজনীতিতে প্রয়োগ করেছেন সাফল্যের সাথে। তিনি ছিলেন একই সাথে ধর্মতাত্ত্বিক ও বিপ্লবী রাজনীতিক। তিনি ধার্মিক ছিলেন সাম্প্রদায়িক না হয়ে। বিপ্লবী ছিলেন ধর্মকে বিসর্জন না দিয়ে। পীর হয়েও তিনি ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে প্রগতিশীল রাজনীতির নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ধর্মীয় মূল্যবোধকে রাজনীতিতে প্রয়োগের পক্ষপাতী ছিলেন। এটাই ছিল তার রাজনীতির মূলমন্ত্র।’ (মো: ফোরকান মিয়া-২০১৪ : ৫)

যেকোনো জাতির মুক্তিসংগ্রাম একটি সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রয়াস। আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশ জাতির রাষ্ট্র অতিক্রম করেছে অনেক নদীর বাঁক। এসব বাঁক পরিবর্তনে একেকটি পর্যায়ে একেক ধরনের নেতৃত্ব হয়ে উঠেছে অনিবার্য। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে যারা শীর্ষ নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন- শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, খাজা নাজিমুদ্দিন, মওলানা আকরম খাঁ ও আল্লামা আবুল হাশেম প্রমুখ। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর জাতীয় নির্বাচন এবং অবশেষে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এদেশের সাধারণ মানুষ ও জাতীয় নেতৃত্ব মূল্যবান ভূমিকা পালন করেছে। এই ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় কারো নেতৃত্বই অস্বীকার করার মতো নয়। ডান-বাম ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ সব নেতৃত্ব আমাদের স্বাধীনতার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছে।

আমরা যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি তখন অতীত ও বর্তমানের সব সত্য ও সব সত্তাকে নিয়ে আমাদের আগুয়ান হতে হবে। সব মুক্তিকামী জাতির ইতিহাসে একক নেতৃত্বের কথা যেমন আছে, তেমনি আছে সম্মিলিত নেতৃত্বের কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজনের বদলে জাতীয় রাষ্ট্র সৃষ্টির কৃতিত্ব দেয়া হয় সম্মিলিতভাবে বেশ কয়েকজনকে। তারা বলে, ফাদারস ফিগারস বা পিতৃতুল্য ব্যক্তিত্ব।

আমাদের ইতিহাসে বাংলাদেশ জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবার শীর্ষে রয়েছেন।

বাংলাদেশ জাতির অভ্যুদয় এবং বঙ্গবন্ধুর অনন্য অবদানের আগে ও পরে যেসব নেতৃত্ব পাহাড় কেটে কেটে আমাদের জন্য সমতল স্বাধীনতার সোপান নির্মাণ করেছেন তারা সবাই স্মরণীয় ও বরণীয়। তাই স্বাধীনতার এই ৫০ বছর পূর্তিতে আর সবার সাথে মওলানা ভাসানীকে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম। ‘যুগ যুগ জিও তুমি, মওলানা ভাসানী’।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement