২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

রকেট গতিতে আকাশ ফুঁড়ে মহাকাশে

-

বাংলাদেশের চালের দামকে আমার কাছে জাতীয় কবির ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় বর্ণিত বীরের মতো মনে হয়। চালের মূল্য যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তারা তাদের সাহস-শক্তি এবং অবাধ্যতার তালিম কাজী নজরুল ইসলামের এই কবিতা থেকে সংগ্রহ করেছেন কি না তা বলতে পারব না। কিন্তু তাদের ভাবসাব দেখলে মনে হয় তারা কবিতার মতো করে চীন উন্নত মম শির, অর্থাৎ সর্বাবস্থায় মাথা উঁচু করে রাখতে অভ্যস্থ। তারা কোনো অবস্থায়ই রাষ্ট্রের কোনো কর্তৃপক্ষ, জনগণ, আল্লাহ, খোদা, ভগবান, কারো কাছেই বিবেকের তাগিদে বা ন্যায়নীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে মাথানত করবেন এবং চালের মূল্য কমাবেন এমন পরিস্থিতি স্বপ্নেও কল্পনা করেন না। তারা বরফে ঢাকা সুউচ্চ পর্বতমালা ছাড়িয়ে আকাশ-বাতাস পেরিয়ে মহাকাশের পথে ঘূর্ণায়মান বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটকে পাশ কাটিয়ে দুঃসাহস নিয়ে যে দুরন্ত গতিতে ছুটছেন, তাতে বাংলাদেশের ১৭ কোটি ভাতখেকো মানুষের মনে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে।

চালের বাজারে যে আগুন লেগেছে তা ইতঃপূর্বে কোনোকালে হয়নি। অতীতকালের দুর্ভিক্ষগুলোতে বড় সমস্যা ছিল টাকা ও চালের জোগানের মধ্যে সমন্বয়হীনতা। অর্থাৎ সারা দেশে চাহিদার চেয়ে চালের জোগান কম ছিল। ফলে চালের মূল্য খুব বেড়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, দেশের বেশির ভাগ লোকের কাছে চাল কেনার অর্থকড়ি ছিল না। ফলে দুর্ভিক্ষকবলিত দেশে চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি, লুটপাট প্রভৃতির উপলক্ষ ছিল চাল। লোকজন চালের জন্য ডাকাতি ও খুন খারাবির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েছিল। চালের বিনিময়ে নারী ইজ্জত বিক্রি করত, শিশু বিক্রি হতো এবং চালের অভাবে শতসহস্র মানুষের বিভীষিকাময় মৃত্যুর মতো দৃশ্য রচনা করে অনেকে দুর্ভিক্ষকে ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব দিত।

অতীতকালে যত সব দুর্ভিক্ষ হয়েছে সেগুলোর নেপথ্যে সাধারণত দু’টি কারণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করত। প্রথমটি হলো- অসৎ রাজনীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অশ্রদ্ধা, অভক্তি এবং ঘৃণা, মন্দ লোকের শাসন, অযোগ্যদের বিচারিক ক্ষমতা, নিষ্ঠুর ও বিবেকহীন সরকারি কর্তাদের ঘুষ-দুর্নীতি, দমন-পীড়ন, অত্যচার এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন দলমত গোষ্ঠীর গণবিরোধী মনোভাব। দ্বিতীয় কারণ হলো- বন্যা, মহামারী, খরা, শস্যহানি, যুদ্ধ, নেতিবাচক বৈশ্বিক পরিস্থিতি প্রভৃতি। অতীতকালে যেসব ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছে সেগুলোর নেপথ্যে কখনো বা উল্লিখিত একটি কারণ ছিল। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই সাথে দু’টি কারণই দায়ী ছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, উল্লিখিত দু’টি কারণ যখন যুগপৎভাবে কোনো দেশ-কাল-রাষ্ট্রে দৃশ্যমান হয় তখন সেখানকার দুর্ভিক্ষের হৃদয়বিদারক দৃশ্য প্রকৃতির সবচেয়ে হিংস্র ও বিষাক্ত জন্তু জানোয়ার ও কীটপতঙ্গদেরকে অশ্রুসিক্ত করে- কিন্তু আফসোস। দুর্ভিক্ষের হোতা জাহান্নামের কীটরা তখন মানুষের লাশের সারির ওপর নিজেদের আনন্দ ফুর্তির রঙ্গমঞ্চ তৈরি করে উত্তাল নৃত্যগীত শুরু করে দেয়।

এবারের চালের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির সাথে অতীতের চালের মূল্যবৃদ্ধি অথবা অতীতকালে দুর্ভিক্ষ-পূর্ব সময়ে সমাজ-সংসার-রাষ্ট্রে যে রসায়ন ঘটে সেগুলোর কোনো মিল দেখতে পাচ্ছি না। ২০২১ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে ‘মধ্যবিত্তের চাল’ হিসেবে পরিচিত নাজির শাইল চালের মূল্য প্রতি কেজি ৮০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। এই চালের সমগোত্রীয় অন্যান্য চাল, মোটা চাল, পোলাওয়ের চাল, সুগন্ধি কাটারিভোগ অথবা আমদানিকৃত বাসমতি চালের দামও আকাশছোঁয়ার চেষ্টা করছে। বাজার সংশ্লিষ্ট লোকজন হঠাৎ করে চালের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে চালের জোগান, সিন্ডিকেটের কারসাজি, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ফসলহানি প্রভৃতি কারণকে মাত্র ২৫ শতাংশ দায়ী করছেন। তারা মূল্যবৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করছেন মূল্যস্ফীতিকে। অর্থাৎ টাকার মান কমে যাওয়াকে।

অর্থনীতির ছাত্র-শিক্ষক এবং বোদ্ধারা বলে থাকেন, সমাজ-সংসারের হাজারো কুকর্মের সাথে যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যোগ হয় তা হলে মুদ্রাস্ফীতি বা মূল্যস্ফীতি লাগামহীন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের বর্তমানকাল যেভাবে যাচ্ছে তাতে আমাদের কারো সাধ্য নেই সঠিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অর্থনীতির মূল্যায়ন করা। আমরা কেউ জানি না, গত ছয় মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কত টাকা নতুন করে ছাপিয়েছে এবং কিভাবে তা বাজারে ছেড়েছে। অথবা সরকারের যে বিশাল ব্যয়, সেগুলো কিভাবে মেটানো হচ্ছে। গত এক বছরের রাজস্ব আদায়, বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক সাহায্যের যে অবস্থা তাতে সরকারের উচিত ছিল, তাদের আবশ্যিক ব্যয়গুলো কম করে হলেও অর্ধেকে নামিয়ে আনা। কিন্তু তারা সেটি করেননি। ফলে এ কথা বুঝতে খুব বেশি পাণ্ডিত্যের দরকার নেই যে, সরকার নতুন টাকা ছেপে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে, যা আপাত দৃষ্টিতে বেকুব লোকদের কাছে সরকারের মুখরক্ষা করেছে বটে, কিন্তু শেষাবধি সরকারকে অবশ্যই সেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে, যা অতীতকালের সরকারগুলো দেশ-বিদেশে করেছিল এবং পরিণামে মহা সর্বনাশের অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে পড়েছিল।

গত এক বছরে আমাদের অর্থনীতি, বাজার ব্যবস্থা, সামাজিক ভোগ এবং জাতীয় উৎপাদনের হিসাব-নিকাশে যে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়েছে তা গত একশ’ বছরের ইতিহাসে হয়নি। দেশের প্রাইভেট সেক্টরে কত লোক চাকরিচ্যুত হয়েছে, তার সঠিক হিসাব আমরা জানি না। এসব লোক কী করছে, কিভাবে চলছে, কী খাচ্ছে তাও আমরা জানি না। অনুমাননির্ভর কথাবার্তা দ্বারা যা শোনা যায় তা হলো- কমপক্ষে এক কোটি লোক চাকরিচ্যুত হয়েছে এবং এক কোটি লোকের বেতন অর্ধেকে নেমে এসেছে। সুতরাং এই দুই কোটি মানুষের সাথে যদি গড়ে চারজন করে লোক থাকে, তা হলে আট কোটি লোক বর্তমান মহামারীতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের কারণে পুরো বাজারব্যবস্থা অস্থির হয়ে পড়েছে এবং অর্থনীতির অশনি সঙ্কেত বলতে যা বোঝায় তার সব উপকরণ দেশের আকাশে-বাতাসে কাল নাগিনীর বিষাক্ত ছোবলের মতো ফোঁস ফোঁস করছে আঘাত হানার জন্য।

উল্লিখিত ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের বিপরীতে, সুবিধাভোগী লোকের সংখ্যা কমেছে। কিন্তু সুযোগ ও সুবিধা নির্দিষ্ট বলয়ে ঘুরপাক খাওয়ায় সমাজে অতি ধনী ও অলস টাকার পরিমাণ বাড়ছে। সরকারি অফিসে কর্মরত প্রায় ২০ লাখ লোক, বিদেশে কর্মরত ৮০ লাখ লোক এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আরো প্রায় ৫০ লাখ, অর্থাৎ সাকুল্যে দেড় কোট লোকের আয় রোজগারে আপাত সমস্যা নেই। কিন্তু মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। অধিকন্তু ক্ষতিগ্রস্ত দুই কোটি মানুষ এবং ক্ষতিবিহীন দেড় কোটি মানুষের একত্রে বসবাস-চলাফেরা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে দীর্ঘকাল থাকতে পারে না। ফলে হাটবাজার, অফিস-আদালতে হাল আমলে যেসব সমস্যা দেখা যাচ্ছে তা অনাগত দিনে ভয়ঙ্কর রূপ লাভ করবে।

বর্তমানে চাল-ডাল-চিনি-লবণের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম যেভাবে বাড়ছে এবং দাম বাড়ার তালিকা যেভাবে দীর্ঘতর হচ্ছে তাতে সামনের দিনে আমরা আমাদের চলমান সমস্যাগুলোর সাথে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, টাকার মূল্যমান কমে যাওয়া এবং বিপরীতে, ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থায় ধস নামার মতো বিপর্যয় মোকাবেলা করতে গিয়ে কী যে বিপদের মধ্যে পড়ব তা কল্পনাও করতে পারছি না। যারা দেশ চালাচ্ছেন- তাদের কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, সারা দেশে দুধ আর মধুর নহর বইছে। পুকুর ভরা মাছ; নদী-সমুদ্রের অফুরান মৎস্যসম্পদ এবং গোয়ালের গরুর সংখ্যা এত বেশি হয়ে পড়েছে যে, হাটে-মাঠে-ঘাটে বিনামূল্যের গবাদিপশু বেওয়ারিশ অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আমাদের দেশে খুচরা পর্যায়ে বিক্রির ক্ষেত্রে যে অভিনব ব্যবসায় পদ্ধতি চালু হয়েছিল তাও ইদানীং মুখ থুবড়ে পড়েছে। অনলাইনে কেনাবেচা, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বাহারি ভোগ্যপণ্য শহরে এনে বিক্রি, আবহমান বাংলার ঐতিহ্য সরিষার তেল, ঢেঁকিছাটা চাল, আখ-খেজুর-তালের গুড়, পাহাড়ি এলাকার কৃষিপণ্য ও ফলফলাদি প্রভৃতি ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য করোনা পূর্বকালে যে বিশাল ক্রেতা-বিক্রেতা গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল তা বর্তমান সঙ্কটের চাপে লাটে উঠেছে।

গত ১০ বছরে দেশে কোনো বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি, অধিকন্তু গার্মেন্টসসহ মাঝারি ও ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প বন্ধ হয়ে গেছে, যার সংখ্যা হাজার দশেকের কম নয়। পাড়া-মহল্লার দোকানপাট, স্কুল-কলেজ-মাদরাসা, ফুটপাথের দোকান, ভ্রাম্যমাণ দোকানপাট প্রভৃতি বন্ধ হওয়ার সংখ্যাও লক্ষাধিক হবে। গত এক বছরে কোনো ব্যাংক নতুন করে ব্যক্তি খাতে ব্যবসায়-বাণিজ্যের জন্য ঋণ বিতরণ করেনি। ফলে পুরো আর্থিক সেক্টরের অভ্যন্তরে একধরনের রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় কিছু দিনের জন্য যখন শেয়ার বাজার স্বাভাবিক হলো, তখন মানুষ পাগলের মতো ছুটে গেল সেখানে বিনিয়োগের জন্য। কিন্তু দুর্ভাগা বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কারসাজির কবলে পড়ে চলমান দুর্যোগের মধ্যে আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকলেন।

দেশের চলমান রাজনৈতিক স্থবিরতা, ক্ষমতাসীনদের হেঁয়ালিপনা, প্রশাসনে দুর্নীতিবাজদের দাপট এবং সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গা ছাড়া ভাব, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের গৃহে অবস্থান এবং তৎসংক্রান্ত পারিবারিক ও মানসিক সমস্যা, করোনার কারণে বেশির ভাগ সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে সীমিত চিকিৎসায় আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্য ও জাতীয় মানসিক অবস্থায় দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া, প্রেম-বিয়ে-দাম্পত্যে নিত্যনতুন সমস্যা এবং সন্তান উৎপাদন ও নর-নারীর পারস্পরিক আকর্ষণে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। ফলে পুরো সমাজ ব্যবস্থায় যে বোবা কান্না বিরাজ করছে, তার ওপর সরকারের উন্নয়নের ঢাক-ঢোল-আনন্দ ফুর্তি এবং নৃত্যগীতের ধ্বনির কারণে সত্য বলা, সত্য অনুধাবন করা এবং সত্য দৃশ্য অবলোকন করার মানবিক শক্তি রহিত হয়ে গেছে।

উল্লিখিত অবস্থার মধ্যে বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। সারা দুনিয়াতে করোনা নতুন করে যেভাবে আক্রমণ শুরু করেছে তা কিয়দংশও যদি বাংলাদেশে শুরু হয়ে যায় তবে যে পরিণতি ও পরিস্থিতি আমাদেরকে ভোগ করতে হবে তা কল্পনা করলে গা শিউরে ওঠে। আমাদের অতীতকালের ’৭৬-এর দুর্ভিক্ষ বাংলা ১১৭৬ সনে ঘটেছিল এবং সেই জামানায় এক কোটি লোক অর্থাৎ বৃহত্তর বঙ্গের এক-তৃতীয়াংশ লোক মারা পড়েছিল। তামাম দুনিয়ার ইতিহাসবিদরা বাংলার সেই মহাদুর্ভিক্ষের জন্য ব্রিটিশদের কুশাসন-অপরাজনীতি-দুর্নীতি ও অত্যাচারকে কারণ বলে বর্ণনা করে গেছেন। কাজেই বারবার দুর্ভিক্ষের কবলে পড়া ভূখণ্ডে যখন চালের দাম আকাশচুম্বী হয় এবং ধীরে ধীরে তা আকাশ পেরিয়ে মহাকাশের পানে ছুটে চলার ইঙ্গিত দেয়, তখন মনে পড়ে যায়- এই বঙ্গে এক দিন ১১৭৬ সনে মীরজাফরের পরিবার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছত্রছায়ায় দেশের শাসন চালনার নামে পুরো দেশকে ‘দারুল হাবিয়া’য় পরিণতি করেছিল।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement