২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

মহামারীর বিষণ্ণতা এবং সুরের অসুর হয়ে ওঠার কাহিনী

-

ঢাকার ধনীদের এলাকায় বসবাসরত এক দম্পতিকে আমি চিনি গত প্রায় এক যুগ ধরে। দেখতে শুনতে চৌকস এবং তাদের বয়সও পঞ্চাশের নিচে। বেশ সচ্ছল এবং সুস্থ সবল নিরোগ দেহের অধিকারী। স্বামী-স্ত্রীকে দেখলে যতটা সুখী বলে মনে হয়, তার চেয়েও যেন লোকজন তাদের সুখী ভাবে, এ জন্য তারা চেষ্টা তদবিরের কোনো ঘাটতি রাখে না। ফলে আমি তাদের একটি আদর্শ সুখী দম্পতি ভাবতাম। তাদের সব কিছুই ভালো লাগত, কেবল তাদের কর্মহীন জীবন ছাড়া। তারা কোনো কাজ করত না। স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি থেকে যে আয় আসত তা দিয়ে একবিংশ শতাব্দীর জমিদারির ভাবসাব নিয়ে দিন কাটাত। তারা ঘুমাত-খেত-আড্ডা দিত এবং দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াত। নিজেরা কোনো কাজ করত না বটে তবে তাদের সন্তানরা যেন রাজা-বাদশাহ-মন্ত্রী-এমপি হয় এমন স্বপ্নে বিভোর হয়ে কোমর দুলিয়ে অহঙ্কার করে বেড়াত।

গত বছর যখন করোনা এলো তখন তারা খুব ভয় পেয়ে গেল। ঘর থেকে কাজের লোক বের করে দিলো এবং দরজা বন্ধ করে দ্বীন-দুনিয়ার সব যোগাযোগ ছিন্ন করে করোনা প্রতিরোধে অগ্রগামী সৈনিক হওয়ার চেষ্টা করল। বাসার টুকটাক কাজ, রান্না-বাড়া ইত্যাদি করতে গিয়ে তারা এতটাই হয়রান হয়ে পড়ল যে, পুরো পৃথিবী তাদের কাছে জাহান্নাম মনে হতে থাকল। অন্য দিকে ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থের ওপর লভ্যাংশ কমে যাওয়া, বাড়িভাড়ার হার কমে যাওয়া, বিদেশে সন্তানদের খরচ বেড়ে যাওয়া এবং করোনাসংক্রান্ত ভয়ের চাপে তারা ভয়ঙ্করভাবে ওজন হারিয়ে ডায়াবেটিস রোগীতে পরিণত হলো। তারা নিজেরা কোথাও যেত না এবং কাউকে নিজেদের বাড়িতে ঢুকতে দিত না। ফলে একটি বদ্ধপুরীর বাসিন্দা হিসেবে কয়েক মাসের মধ্যে তারা নানা রকম ভৌতিক বৈশিষ্ট্যে আক্রান্ত হয়ে পড়ল। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া-সন্দেহ-অহেতুক পেরেশানির কারণে তাদের দীর্ঘ দিনের পারিবারিক বন্ধন এমনভাবে নড়বড়ে হয়ে গেল, যা পুনরায় মেরামত হয়তো সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোর মধ্যে একটি বিশেষ শ্রেণীর মানুষের মধ্যে উল্লিখিত সমস্যাগুলো যেমন দানা বাঁধছে তেমনি অতি ধনী, ধনী, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ছাড়াও প্রায় এক কোটি ছিন্নমূল পরিবারের মধ্যে করোনাজনিত বিষণ্ণতা, করোনা আক্রান্ত রোগীর দুর্ভোগ এবং মৃত্যুর চেয়েও বেশি মাত্রায় ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রাজধানীর বস্তি এলাকা, ফুটপাথ ছাড়াও সারা দেশের পথে-প্রান্তরে যেসব ছিন্নমূল মানুষ একাকী কিংবা সপরিবারে বাস করে তাদের জীবনযাত্রা এবং মানসিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য আপনি যদি সন্ধ্যা রাতে তাদের এলাকাগুলোতে যান তবে দেখতে পাবেন যে, তাদের মধ্যে এক ধরনের সুনসান নীরবতা কাজ করছে। এর আগে তারা যেভাবে গল্প করত, মোবাইলে সিনেমা দেখত, রান্না-বান্নার কাজে ব্যস্ত থাকত এবং টুকটাক ঝগড়া-ফ্যাসাদ করত তা আর ইদানীংকালে করছে না। একবুক হতাশা নিয়ে লোকগুলো কেমন যেন উদাসীনভাবে বসে থাকে এবং তারা যে বেঁচে আছে এবং আগামীতে বাঁচতে চায় এমন কোনো মানবিক অভিব্যক্তি তাদের মধ্যে লক্ষ করা যায় না। করোনার বিষণ্ণতা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে নবদম্পতি এবং স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের। যাদের জীবনে অর্থ সঙ্কট রয়েছে তারা একরকম সমস্যার কবলে পড়েছে এবং যাদের অর্থ সঙ্কট নেই তাদের অন্য সমস্যা। খেলাধুলা, চলাফেরা, সামাজিক মেলামেশা, বিয়েশাদি, উৎসব, পার্বণ ইত্যাদিতে ছন্দপতনের কারণে পুরো পারিবারিক ব্যবস্থা, সামাজিক সংহতি এবং জাতীয়তাবোধ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অলসতা বাড়ছে। ফলে মানুষের শরীরে নানাবিধ রোগবালাই দেখা দিচ্ছে। খাবারের প্রতি আগ্রহ, বেঁচে থাকার আকর্ষণ, প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব, উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং বিরূপ পরিস্থিতিতে টিকে থাকার ক্ষমতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।

মানুষের মধ্য থেকে দয়ামায়া-বিশ্বাস ভালোবাসা-স্নেহ মমতা যেভাবে কমছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে কমছে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ। মানুষের সুকুমারবৃত্তি ক্রমেই নিম্নগামী হচ্ছে এবং পশুত্বের ধারাগুলো প্রকট আকার ধারণ করছে। সুষ্ঠু ও পরিচ্ছন্ন চিন্তার পরিবর্তে অলীক কল্পনা, সন্দেহ, অবিশ্বাস, ক্রোধ, কাম এবং ভোগের লিপ্সায় তাড়িত হয়ে মোটামুটি ভালো মানুষগুলো ক্রমেই মন্দ মানুষের দলে নিজেদের নাম লেখাচ্ছে। অন্য দিকে মন্দ মানুষগুলো ইবলিশের গণ্ডি অতিক্রম করে ভূমিকে নরক বানানোর তা-বের রণবাদ্য বাজিয়ে পুরো পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং পরিস্থিতি সব প্রাণীকুলের জন্য অসহনীয় করে তুলছে।

করোনার বিষণ্ণতায় মানুষের দায়িত্ববোধ কমে গেছে এবং কাণ্ডজ্ঞান তলানিতে নেমেছে। তাদের দৃষ্টিশক্তি ভোতা হয়ে যাচ্ছে এবং কণ্ঠস্বরে যক্ষ্মা রোগীদের মতো সর্বদা রক্তাক্ত কফ আটকে থাকছে। ফলে চোখের সামনে তারা মশামাছি দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পরও নড়াচড়া করছে না এবং রক্তাক্ত কফ বের হয়ে আসবে এই ভয়ে উহ্ শব্দটি করছে না। মানুষের লজ্জা-শরম-হায়া বলতে যে জিনিসগুলো ছিল সেগুলো যে কোথায় গেল তা খোঁজার মতো লোকের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে কমে গেছে। মানুষের অভ্যন্তরীণ পরিচ্ছন্নতা, বাহ্যিক সৌন্দর্য এবং বিলাসী চালচলনের অভ্যাসে ছন্দপতন ঘটেছে। ফলে নাপিতের দোকান থেকে শুরু করে বস্ত্র ব্যবসায়ী, ফুল ব্যবসায়ী, প্রসাধন ব্যবসা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও মহামন্দা দেখা দিয়েছে। ঘামের গন্ধ, মুখের গন্ধ, জুতা-মোজার গন্ধ এবং বায়ুত্যাগের দুর্গন্ধে জনবহুল এলাকাগুলোতে এখন দাঁড়িয়ে থাকা রীতিমতো কষ্টকর।

মহামারীর বিষণ্ণতা নিয়ে আমাদের দেশে নির্ভরযোগ্য কোনো গবেষণাকর্ম চলছে না। কিন্তু উন্নত বিশ্ব এরই মধ্যে এই মহামারীর কারণে মানব সভ্যতার যে কত বড় ক্ষতি হতে যাচ্ছে তা নিয়ে একের পর এক গবেষণাকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। একের পর এক গবেষণা বললাম এ কারণে যে, বর্তমান মহামারীর ফলে যেসব অদ্ভুত ও আনকোরা সমস্যা দেখা দিচ্ছে তা এর আগের কোনো মহামারীতে দেখা যায়নি। যেমন এই মহামারীর কারণে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমছে। সুতরাং এটিকে মোকাবেলার জন্য আবার নতুন করে গবেষণা করতে হচ্ছে।

ইউরোপ আমেরিকায় করোনাপূর্বকালে বিস্ময়কর অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তির উত্থানের সাথে সাথে মানুষের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে নিদারুণ সব বিবর্তন শুরু হয়েছিল। পরিবারহীন জীবন, সমলিঙ্গের মধ্যে আইনত বিয়েশাদি, বিয়েবিহীন যৌনজীবন, মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণী অথবা প্লাস্টিকের পুতুলের সাথে শারীরিক সম্পর্ক, বোহেমিয়ান জীবনযাত্রা ইত্যাদির মাধ্যমে একশ্রেণির মানুষ তাদের দেশ-কাল সমাজের হাজার বছরের মানবিক ঐতিহ্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যে বিবর্তন চালু করেছিল তা করোনার ধাক্কায় আরো অধিক মাত্রায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এই শ্রেণীটির জন্য সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা রীতিমতো হুমকির মধ্যে পড়েছে। এদের বিকৃত মানসিকতা এখন পাগলামো এবং হিংস্রতায় রূপ নিয়েছে এবং তারা সভ্য সমাজের জন্য প্রকৃতির যে কোনো ভয়ঙ্কর প্রাণীর চেয়েও হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

পশ্চিমা দেশগুলোতে যে স্বাভাবিক পারিবারিক বন্ধন রয়েছে সেখানেও শুরু হয়েছ স্মরণকালের ভয়াবহ অরাজকতা। আত্মহত্যার সংখ্যা মারাত্মকভাবে বাড়ছে। পারিবারিক দায়িত্ববোধ কমছে এবং অনেক পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিয়েবিচ্ছেদ বাড়ছে এবং উঠতি বয়স্কের যুবক যুবতীরা ব্যাপক হারে পরিবার ত্যাগ করে যাচ্ছেতাই জীবন শুরু করেছে। গত কয়েক দশক ধরে জাতীয় জীবনে যেসব সততা, ন্যায়নিষ্ঠতা, নিয়মানুবর্তিতা এবং আইন মান্য করার রেকর্ড তৈরি হয়েছিল তা এখন ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে তৃতীয় বিশ্বের চেয়েও পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে।

ইউরোপ আমেরিকা বাদ দিয়ে এবার আমরা বাংলাদেশ নিয়ে কিছু আলোচনা করি। আপনি যদি বিগত কয়েক মাসের অপরাধের ধরন ও প্রকৃতি লক্ষ করেন তবে দেখবেন যে, অপরাধীরা যেভাবে বেপরোয়া মনোভাব নিয়ে নির্লজ্জের মতো অপরাধ করে বেড়াচ্ছে এবং নিজেদের কুকর্মের জন্য গর্ব অনুভব করতে শুরু করেছে তা কিন্তু করোনা পূর্বকালে এতটা খারাপ অবস্থায় ছিল না। রাষ্ট্রের দুর্নীতিবাজ কর্তাদের মধ্যে এক ধরনের বিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। আগে তারা অপকর্মের অধিক্ষেত্ররূপে নিরীহ জনগণকে ব্যবহার করত। কিন্তু করোনার কারণে জনগণের ঘুষ দেয়ার ক্ষমতা মারাত্মক হ্রাস পাওয়ায় দুর্নীতিবাজরা এখন এক পশু কর্তৃক অপর পশুর মাংস খাওয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। ফলে ঘুষের রাজ্যে এবং ঘুষ বাণিজ্যে এমন এক মাফিয়াতন্ত্র চালু হয়েছে যা এর আগে কেউ কল্পনা করেনি। বিষয়টি খোলাসা করার জন্য একটি উদাহরণ দিচ্ছি। বাংলাদেশের কোন কোন ক্ষেত্রে এবং কোন কোন পদ-পদবিতে ব্যাপক হারে ঘুষ লেনদেন হয়, অর্থ লোপাট হয় এবং চুরি-ডাকাতির উৎসব হয় তা মোটামুটি ওপেন সিক্রেট। অর্থাৎ গোপনীয় কিন্তু সবাই জানে। এসব পদ-পদবি পেতে বিপুল অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয় এবং সেই অর্থ সুদে আসলে শত গুণ অথবা ক্ষেত্রবিশেষে হাজার গুণ উসুল হয় তাও আমরা জানি। সেসব অর্থে কোথায় কিভাবে বাড়ি-গাড়ি ব্যাংক ব্যালেন্স এবং আনন্দ ফুর্তি হয় সেগুলোও কারো অজানা নয়। কিন্তু কেউ এদের টিকিটি স্পর্শ করতে পারেনি। কারণ মাফিয়াতন্ত্র এত সুনিপুণভাবে তাদের আওতাধীন দুর্বৃত্তদের আমৃত্যু রক্ষা করেছে যার কারণে পদ-পদবি হারানোর পরও ঘুষখোররা বিপদে পড়েনি। কিন্তু ঘুষবাণিজ্যের মাফিয়াতন্ত্রে আগের সেই সুদিন আর নেই। মহামারীর বিষণ্ণতায় অতীতের সুরেরা নব্য সুরদের কবলে পড়ে কিভাবে অসুরে পরিণত হচ্ছে তা আর্থিক খাতের দুর্নীতি নিয়ে যারা ঘাঁটাঘাঁটি করেন তারা কমবেশি জানেন।

গত কয়েক মাসে করোনা যেভাবে তাদের ট্রেন্ড পরিবর্তন করেছে তদ্রূপ বাংলাদেশের সব শ্রেণীর অপরাধীও নিজেদের ট্রেন্ড পরিবর্তন করে ফেলেছে। অপরাধের নতুন গডফাদার পুরনো গডফাদারকে লুণ্ঠন করার পর গড ভাই, গড বোন এবং গড সন্তানদের সম্পত্তি হরণের জন্য কোমরে গামছা বেঁধে মাঠে নেমেছে। ঘুষ দুর্নীতির মক্ষীরাজা এবং মক্ষীরানীরা নতুন পদে বসামাত্র পুরনো মক্ষীরাজা ও মক্ষীরানীদের সহায় সম্পত্তি, প্রেমিক-প্রেমিকা, ভোগ-বিলাসের রঙ্গশালা ইত্যাদি সব জায়গায় নিজেদের বিষাক্ত থাবা বসিয়ে সব কিছু লুটে নেয়ার যে তাণ্ডব শুরু করেছে তার ফলে ঘুষবাণিজ্যের মাফিয়াতন্ত্রের পুরনো সুরে নতুন নতুন অসুর পয়দা হয়ে যাচ্ছে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement