কার মনে কী আছে কে জানে
- মুজতাহিদ ফারুকী
- ১৬ মার্চ ২০২১, ২১:০৪
অনেক সময় খুব সাধারণ মানুষেরও কল্পনাশক্তির নমুনা দেখে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। সেই কল্পনার কতটা বাস্তব সত্য আর কতটা অলীক সে প্রশ্ন তোলার দরকার মনে করি না। কারণ মানুষ তো কত কিছুই বলে! রাজনীতি, অর্থনীতি, দেশ শাসন, সংস্কৃতির অঙ্গন বা রুপালি জগতের তারকাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে মানুষের মঙ্গল অভিযান পর্যন্ত কোনো বিষয়ই তো মানুষের আগ্রহের বাইরে নয়। সাংবাদিকরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘটনার পেছনের খবর বের করেন, সাধারণ মানুষও সেসব পড়ে এবং পারস্পরিক জল্পনা-কল্পনা ও কানাঘুষা থেকে একেকটি বিষয়ে নিজেদের ধারণা তৈরি করে নেয়। আর সেই ধারণা প্রকাশের ক্ষেত্রেও তারা প্রায়ই কোনো রাখঢাক করে না, কপটতার আশ্রয় নেয় না। অনেক সময় তাদের এসব ধারণা এতটাই বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয় যে, সেটি সত্য-মিথ্যা যা-ই হোক, মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে। যেমন আমার ক্ষেত্রে ঘটেছে গত রোববার।
একটি লোকাল বাসে চড়ে গন্তব্যে যাচ্ছিলাম। খুব বেশি ভিড় নেই। সিট পুরো হয়ে দু-চারজন দাঁড়িয়ে আছেন মাথার ওপরের রড ধরে। বাসটি গদাইলস্করি চালে কিছুক্ষণ চলছে, আবার কোথাও যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই। পাবলিক মাঝে মধ্যে রুষ্ট হয়ে চিৎকার করছে, ‘ওই ড্রাইভার, আর কত? যাও না ক্যান! বাস তো ভরা।’ ড্রাইভার কোনো উচ্চবাচ্য করছেন না। কিন্তু যথারীতি গা ছাড়া স্টাইলে নিজের মর্জিমতো কাজ করে চলেছেন।
এ সময় আমার ডান দিকের একটি সিটে বসে এক তরুণ মোবাইলে ব্রাউজিং করছিল। তার কানে ইয়ারফোন। একনজরে মনে হলো, ছেলেটি কলেজ স্টুডেন্ট বা ইউনিভার্সিটির শুরুর দিকের ছাত্র হতে পারে। একবিংশ শতকের প্রথম দশক থেকে এমন দৃশ্য পথচলতি গাড়ির পরিচিত অনুষঙ্গ। মানুষ যাত্রাপথের সময়টুকু স্মার্টফোনে যোগাযোগ বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করে। এ তরুণটি কিছুক্ষণ খুব দ্রুত কিছু লিখল। সম্ভবত মেসেঞ্জারে। তার পর কিছুটা সময় ফেসবুক বা কোনো সামাজিক মাধ্যমে নজর বুলাল। একসময় মনে হলো, কোনো একটি গণমাধ্যমের সাইটে ঢুকে খবর দেখছে। বাসের মধ্যে কাউকে নিউজফিড ব্রাউজ করতে দেখেছি এমন ঘটনা অনেকটা বিরল। বিশেষ করে তরুণদের ক্ষেত্রে। নিউজ দেখেন বেশির ভাগ বয়স্ক লোকেরা, যাদের বয়স সাধারণত ৪০ বা তারও বেশি। আমি নিজে যানবাহনে কখনো মোবাইলে ইন্টারনেট ডেটা ইউজ করি না। বাসায়, অফিসে, ক্লাবে এমনকি গ্রামের বাড়িতে সব জায়গায় আমার ওয়াইফাই সক্রিয় থাকে, সেখানেই নেটে ঢুকি। আর যানবাহনে সফরের সময়টুকু ব্যয় করি মোবাইলের নোটবুকে নিজের কোনো লেখা সম্পাদনা করে, সেভ করে রাখা কোনো লেখা পাঠ করে বা মুড থাকলে নতুন কিছু লেখার চেষ্টায়। এ মুহূর্তে আমার মোবাইল পকেটে। পাশের সিটের ছেলেটিকে মোবাইলে সক্রিয় দেখে জানালার বাইরের দৃশ্য দেখতে থাকি। রাস্তার চলমান গাড়িঘোড়া, ফুটপাথে হাঁটতে থাকা বা দণ্ডায়মান নারী-পুরুষ, সন্নিহিত দোকানপাটের সাইনবোর্ড, ভেতরের সাজসজ্জা- এসব দেখি। একসময় পাশের ছেলেটি হঠাৎ আপন মনেই মৃদু স্বরে বলে ওঠে, ‘আহারে, দেশে আবার করোনায় মৃত্যু বেড়ে গেল।’ ওর কথা শুনে পাশের একজন যাত্রী আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তার মন্তব্য, ‘বাড়ব না, দেহেন তো এই বাসে কয়জন মাস্ক পরছে? কেউ কোনো নিয়মকানুন মানতাছে? গাদাগাদি কইরা আমরা বইসা আছি। ঠেলাঠেলি কইরা বাসে উঠতাছি। কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানে?’
ভদ্রলোকের কথা শুনে যাত্রীরা পুরো বাসে নজর ঘুরিয়ে, পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে একটি চকিত সমীক্ষা সেরে নেন। দেখা যায়, অনেকেরই মুখে মাস্ক নেই। যাদের আছে তাদেরও বেশ কয়েকজনের মাস্ক থুঁতনিতে বা গলায় ঝুলছে। বক্তা লোকটি আবারো বলেন, ‘এত দিন যে মৃত্যু কম ছিল, এই তো বেশি! ইউরোপ-আমেরিকার মতো বাংলাদেশের করোনাভাইরাস তেমন ভয়ঙ্কর না। তাইলে তো লাখ লাখ মানুষ মরত।’ কেউ কেউ তার কথায় মাথা ঝুঁকে সায় দেন। মোবাইলে খবর দেখা ছেলেটি একটু উদ্বেগ নিয়ে বলে, ‘না, এখন তো ব্রিটিশ ভাইরাস চইলা আসছে। মনে হয়, আরো বাড়বে। খবরে লেখছে, আগের দিন মরছে ১৩ জন। আইজ মরল ২৬ জন। একদিনে দ্বিগুণ!’
আমার মনে হচ্ছিল, করোনাভাইরাস নিয়ে আলোচনাটি এবার জমে উঠবে। কারণ যানবাহনে কেউ একজন একবার যেকোনো প্রসঙ্গ তুললেই নানা জন স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অভিমত প্রকাশ করতে থাকেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকার কী করেছে, তার কতটা ভালো, কতটা খারাপ, কেন ভালো বা খারাপ- এ বিষয়ে মানুষ কী করছে ইত্যাদি বিষয় সামনে চলে আসে। মনে হলো করোনার বাড়বাড়ন্তি নিয়েও এমন আলোচনা শুরু হতে যাচ্ছে।
কিন্তু দেখা গেল, আলোচনা সে দিকে গেল না। আমার সামনের দিকের সিট থেকে এক যাত্রী হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসির কারণ বোঝা গেল না বলে সবাই ঘুরে তাকালেন তার দিকে। ছোটখাটো চেহারার মাঝবয়সী লোকটি। পরনের জামাকাপড় জৌলুসহীন কিন্তু পরিপাটি। হতে পারে কোনো সরকারি-বেসরকারি অফিসের চাকুরে কিংবা ছোটখাটো ব্যবসায়ী। বড় ব্যবসায়ী হলে লোকাল বাসে উঠতেন না। মানুষের চেহারা দেখে তার পেশা বোঝার মতো প্রখর বুদ্ধির মানুষ অবশ্য আমি নই। সেই চেষ্টাও করছি না। লোকটি মাথা ঘুরিয়ে আলোচনারত সহযাত্রীদের দিকে তাকান। তার পর হাসতে হাসতেই বলেন, ‘এই যে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে বললেন না, এইটা কোনো ব্যাপার না। এইটা হইলো সরকারের হিসাবের খেলা।’
কেউ কোনো মন্তব্য করে না। তবে তাদের তাকানোর ভঙ্গি দেখে বোঝা যায়, লোকটি এরপর কী বলেন শোনার অপেক্ষায় সবাই। সরকারের কোন খেলার কথা বলতে চাইছেন লোকটি? বোঝার চেষ্টা করছে যেন সবাই। লোকটি হাসতে হাসতেই আবার বলেন, ‘এইটা হইলো স্কুল-কলেজ-ইনভার্সিটি না খোলার বুদ্ধি। সহজ হিসাব। বলা তো যায় না, যদি উল্টাপাল্টা কিছু শুরু হয়! করোনার প্রকোপ কমছিল, আর সবাই স্কুল-কলেজ খোলার জন্য পাগল হয়া উঠছিল। এখন সেইটা আর সম্ভব না। করোনা বাইড়া গেছে, হা হা হা!’
লোকটি চুপ করে যান। তার কথাটা কে কিভাবে বুঝল জানি না। কিন্তু খেয়াল করে দেখি, একজন যাত্রীও এ বিষয়ে রা কাড়ে না। সবাই মুখ ঘুরিয়ে নিজের সিটে নিশ্চুপ বসে থাকেন যেন বাসে কোনো আলোচনা হচ্ছিল না। সবাই যে যার গন্তব্যে কখন পৌঁছাবেন সেই চিন্তায় ব্যস্ত। আমার মনে হয়, ঘটনার পেছনের কারণ অনুমানের মৌলিকতার দিক থেকে এটি এক বিশিষ্ট পর্যবেক্ষণ। তখনই ওই শুরুর কথাটি আমার মস্তিষ্কে টুপ করে উদিত হয় যে, মানুষের কল্পনাশক্তি সত্যিই বিস্ময়কর। করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার তথ্য প্রকাশের পেছনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আরো কিছু দিন বন্ধ রাখার সরকারি মতলব থাকতে পারে এমনটি ভাবতেও তো কল্পনাশক্তির যথেষ্ট দূরগামিতা দরকার। সেটি কারো কারো আছে।
পরে অফিসে এসে নেটে ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখি, করোনার সংক্রমণ সত্যিই ভয়াবহ, অন্তত গণমাধ্যমের খবরে যতটা জানা যাচ্ছে। পেছনের খবর জানার উপায় নেই। সরকারের ‘মনের খবর’ জানার মতো অলৌকিক ক্ষমতা আমার নেই। এটি কোনো কোনো পুলিশের থাকলেও থাকতে পারে। যেমন- ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলার ঘটনা তদন্তকারী কর্মকর্তা জানতে পেরেছিলেন, হামলাকারীদের ‘মনের খবর’। তিনি তদন্ত করে বের করেন, “হামলাকারীরা ‘মনে করেছিল’, ২০১৮ সালের ৪ আগস্ট রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদকের বাসায় নৈশভোজে ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। সে জন্যই তার গাড়িতে হামলা করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা।” ষড়যন্ত্র হলে প্রতিরোধের অধিকার তো সব নাগরিকেরই! সে কথা থাক। যা বলছিলাম সে প্রসঙ্গে ফিরে যাই।
গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, গত রোববার সকাল ৮টা থেকে সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে দেশে মারা গেছে ২৬ জন। এ সময় নতুন করে এক হাজার ৭৭৩ জন সংক্রমিত হয়েছে। শনিবার শনাক্ত হয়েছিল এক হাজার ১৪ জন। এ পরিস্থিতিকে কোনো কোনো চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ ‘হতভম্বকর’ বলেও বর্ণনা করেছেন।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রথম ধরা পড়ে। আমাদের দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ প্রথম করোনায় এক ব্যক্তি মারা যান। তার পর থেকে করোনায় মৃত্যু, আক্রান্ত ইত্যাদি নিয়ে সরকারি তরফে রাখঢাক কম করা হয়নি। করোনার ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুযোগ কেড়ে নেয়া হলো। সরকার যে তথ্য, যতটা প্রকাশ করতে চায় কেবল সেটুকুই সাংবাদিকদের জানানো হয়েছে। এখন করোনার প্রকোপ আবার বাড়ছে বলে সরকারই জানাচ্ছে। কে জানে, কার মনে কী আছে?
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা