২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মোদি আসছেন বাংলাদেশে

মোদি আসছেন বাংলাদেশে - ছবি : সংগৃহীত

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২৬ মার্চ দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসছেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন তিনি। এই সফর সামনে রেখে সাংবাদিকরা সরকার বিশেষ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনকে কিছু প্রশ্ন করেন। প্রশ্নগুলো ছিল বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট। যেমন- মোদির সফরে তিস্তা চুক্তি হবে কি না, সীমান্ত হত্যা বন্ধের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে কি না, ভারতের সাথে বাংলাদেশের যে বিশাল বাণিজ্যঘাটতি রয়েছে সেটি মীমাংসা হবে কি না এবং ভারতের নাগরিকত্ব আইন ও মুসলিমদের নিয়ে মোদি সরকার বাংলাদেশকে যে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে তা থেকে উত্তরণ হবে কি না ইত্যাদি।

এ প্রশ্নগুলো সাংবাদিক তথা বাংলাদেশের গণমাধ্যমের হলেও এ নিয়ে আমাদের নাগরিকদেরও অজস্র কৌতূহল রয়েছে। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী অনেকটা উত্তেজিত হয়ে গিয়ে সাংবাদিক তথা দেশের গণমাধ্যমের সমালোচনা মুখর হন। তিনি এমনভাবে বলেন যে, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্ন করাই ঠিক হয়নি এবং এগুলো এখন কোনো আলোচ্য বিষয় নয়।

সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘দেখুন ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ এবং তার নেতা হলেন নরেন্দ্র মোদি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আসছেন বাংলাদেশে, এটাই তো আনন্দের বিষয়, উৎসবের বিষয়।’ অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে আসছেন এতেই তো আমাদের ধন্য হওয়া উচিত। এর চেয়ে আর পাওয়া কী হতে পারে? পররাষ্ট্রমন্ত্রী এও বললেন, ‘তিস্তা চুক্তি তো ১০ বছর আগেই সই হয়ে গেছে, বাস্তবায়ন হয়নি। চুক্তির পাতায় পাতায় সই রয়েছে। কী কারণে যে বাস্তবায়ন হয়নি, সেটিও ভারত আমাদের জানিয়েছে। আপনি-আমি-আমরা সবাই জানি।’

ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্টসহ ভারতের প্রায় সব চাহিদাই পূরণ করেছে বাংলাদেশ। এই সে দিনও গত ৯ মার্চ সীমান্তবর্তী ফেনী নদীর উপর একটি সেতুর উদ্বোধন করা হয়েছে। সেতুটি বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোকে সরাসরি যুক্ত করেছে। ভারতের এই রাজ্যগুলো সেতু দিয়ে সহজে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে পণ্য আনা নেয়া করতে পারবে। বিশেষ করে ত্রিপুরার মানুষের জন্য বিরাট সুবিধা হয়েছে। আর পাঁচ বছর আগেই ভারতের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুবিধা কার্যকর করে দিয়েছে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ কী পেয়েছে কিংবা পাচ্ছে সে প্রশ্ন তো উঠতেই পারে। দেখা যাচ্ছে ভারতের পক্ষ থেকে এ নিয়ে কিছু বলা না হলেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিব্রত হচ্ছেন! তিনি ধরেই নিয়েছেন সাংবাদিকরা বাংলাদেশের স্বার্থ নিয়ে যেসব প্রশ্ন করছেন এতে ভারতের গোসসা হতে পারে। আর সে জন্যই হয়তো তার মুখ থেকে বের হয়েছে প্রধানমন্ত্রী মোদির বাংলাদেশে আসা নিয়েই আমাদের খুশি থাকা উচিত। তিনি এটাও বলেছেন, করোনা মহামারীর এ সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একমাত্র বাংলাদেশেই আসছেন। আর কোথাও যাননি। অর্থাৎ এটা নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী তাহলে মোদির আসা নিয়েই কি আমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত? মনে হয়, না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে আসছেন, আমরা তাকে স্বাগত জানাই। তিনি আমাদের অতিথি। তবে আমাদের নিয়েও তো তাকে ভাবতে হবে। তিনি প্রতিবেশী ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ভারতের সাথে বাংলাদেশের যে সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলো সমাধানের প্রধান ব্যক্তি তো তিনি। বাংলাদেশে তিনি আসায় আমরা একটা সুযোগ পেয়েছি। এই সুযোগ কি আমরা কাজে লাগাব না? তার সামনে যদি আমরা আমাদের সমস্যাগুলো তুলে ধরতে পারি এবং এর একটা সমাধান আসে তাহলে ক্ষতি কী?

এটা তো ঠিক ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কে প্রত্যাশার ক্ষেত্রে দীর্ঘ দিনের হতাশা রয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তিস্তা চুক্তি ১০ বছর আগেই সই হয়েছে। এটা কি ঠিক? ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন তিস্তা চুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি চুক্তির শর্ত ও বিষয়বস্তু নিয়ে দ্বিমত এবং বিরোধিতা করায় চুক্তিটি আর হয়নি। এটাই আমরা জানি, বাংলাদেশের মানুষ জানে। গোপনে কিছু সই হয়েছে কি না তা আমরা জানি না। এখন যদি বলা হয় চুক্তি হয়ে গেছে তাহলে কী হলো? সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন, এ ব্যাপারে স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘তিস্তা নদীর পানি নিয়ে কিন্তু আমরা মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে তা হবে। কারণ বেশ কয়েক বছর ধরে একাধিক প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছিলেন এবং চুক্তি সই হওয়ার কাছাকাছিও গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। এটা এখন অনেকটা কোল্ডস্টোরেজে চলে গেছে। যেটা একটা হতাশার কারণ।’

মোদির সফর নিয়ে কয়েক দিন আগে ঢাকা ঘুরে গেলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তার বক্তব্য ছিল তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে ভারত সরকার আগের অবস্থানেই আছে। অর্থাৎ চুক্তি যে হয়নি সেটিই সত্য। সেটিই নতুন করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নজরে আনতে হবে যাতে তার অফিস বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নেয় এবং তিস্তার একটা সমাধান হয়। কারণ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষি ও মৎস্য উৎপাদনে তিস্তার সাথে বিরাট জনগোষ্ঠী জড়িত। তিস্তা অববাহিকায় পাঁচ হাজার ৪২৭টি গ্রামের মানুষ তাদের জীবিকার জন্য এই নদীর ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় এবং বাংলাদেশ পানি না পাওয়ায় মানুষের জীবিকা বন্ধের উপক্রম হয়েছে।

সীমান্ত হত্যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় উদ্বেগের কারণ। ভারতের সাথে বাংলাদেশের প্রায় চার হাজার কিলোমিটারের সীমান্ত রয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত যোগাযোগ বেশ কয়েক মাস বন্ধ থাকলেও সীমান্ত হত্যার মতো ঘটনা কমেনি। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিস কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী ২০০০-২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কমপক্ষে ১,১৮৫ বাংলাদেশীকে গুলি বা নির্যাতন করে হত্যা করেছে ভারতীয় বিএসএফ। গত ২০২০ সালের ১১ মাসে বিএসএফ কর্তৃক সীমান্তে প্রাণ হারিয়েছেন ৪১ জন বাংলাদেশী। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক নীনা গোস্বামীর মতে, একটি প্রশিক্ষিত বাহিনী হিসেবে বিএসএফ চাইলেই এমনভাবে গুলি করতে পারে যাতে ওই ব্যক্তি মারা না যায়। কিন্তু তারা এমনভাবে গুলি করে যাতে নিরস্ত্র মানুষটির মৃত্যু ঘটে। তাই নরেন্দ্র মোদির সফরে যদি সীমান্ত হত্যার বিষয়টি তার নজরে আনা যায় এবং তার একটা সুরাহা হয় তাহলে ক্ষতি কী?

ভারতের নাগরিকত্ব আইন এবং মুসলিমদের নিয়ে বিজেপির রাজনীতি বাংলাদেশে বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব এবং এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো ব্যক্তিরাও প্রকাশ্যে বক্তব্য রাখছেন, অবৈধ অভিবাসী যারা আছে, তাদের ভারত থেকে বের করে দেয়া হবে এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে নানান নেতিবাচক ও আপত্তিকর বক্তব্য দেয়া হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক উসকানি দেয়া হচ্ছে। এটা নতুন উদ্বেগের তৈরি হয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলছেন, তাদের ডিকশনারিতে হতাশা বলে কোনো শব্দ নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভারতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের হতাশা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী যতই বলছেন, আসুন মোদির সফরে আনন্দ করি, কিন্তু বিশাল হতাশার মাঝে সেই আনন্দ বাংলাদেশের জনগণ কতটা করতে পারবে সেটিই দেখার বিষয়।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক,
জাতীয় প্রেস ক্লাব


আরো সংবাদ



premium cement