৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫ পৌষ ১৪৩১, ২৭ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

চীন-ভারত নয়, নেপালের নিজে বাঁচা

-

নেপালের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কে পি ওলি (খাড়গা প্রসাদ ওলি) অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী হয়েও সম্ভবত আগামী মাসের মধ্যে আর ক্ষমতায় থাকতে পারছেন না। নেপালের পার্লামেন্টের আয়ুকাল আরো ১৮ মাস থাকা সত্ত্বেও গত ২০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী ওলি সংসদ ভেঙে দিয়ে আগামী এপ্রিল-মে মাসে নতুন নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেছিলেন। তার এ সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতিও অনুমোদন দিয়েছিল। কিন্তু তাতে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ও দলের প্রতিনিধিরা সুপ্রিম কোর্টে নালিশ দিয়েছিলেন। এমন মোট ১৩টি মামলার নিষ্পত্তি করে কোর্ট তার রায় দিয়েছেন ২২ ফেব্রুয়ারি। তা হলো, প্রধানমন্ত্রী ওলির ‘সংসদ ভেঙে দেয়া’ ছিল অবৈধ। তাই ১৩ ওয়ার্কিং ডে-এর মধ্যে সংসদ পুনরুজ্জীবিত করে বসাতে হবে।

এতে এখন নতুন পরিস্থিতিতে ওলির অপসারণ মানে- সংসদে তার ইমপিচমেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে গেল। কারণ ওলির দল আগেই তার বিরুদ্ধে গিয়ে দলের সভাপতির পদ থেকে তাকে অপসারিত করে রেখেছে।

গ্লোবাল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব
গ্লোবাল নেতৃত্ব- এ বিষয়টি এমনিতেই দুনিয়াতে সবসময় হাজির ছিল এমন ফেনোমেনা নয়; ফলে সেই ‘গ্লোবাল নেতৃত্বের মধ্যে আবার কোনো ‘পালাবদল’ আসা- এটাও বারবার ঘটে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে, ‘গ্লোবাল’ বলে বা ‘দুনিয়াজুড়ে’ কোনো একক বা দু’টি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাব বা অর্থনৈতিক প্রভাব ছিল না। তাও রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক প্রভাব এ দুটোর মধ্যে অর্থনৈতিক প্রভাব সবসময় আগে আসে। আর তাকে ফলো করে রাজনৈতিক প্রভাবও হাজির হয়ে থাকে।

যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫) আগে দুনিয়াতে ‘গ্লোবাল নেতৃত্ব’ বলে কিছু ছিল না। যদিও কলোনি দখল করতে চায় এমন ছোট-বড় মাতবর গোটা পাঁচেক ইউরোপীয় রাষ্ট্র ছিল যাদের মধ্যে শেষবিচারে প্রধান দুই রাষ্ট্র ছিল ব্রিটিশ ও ফরাসি দখলদার রাষ্ট্র। আর আমরা তখন ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া কলোনি হিসাবে ছিলাম, প্রায় ২০০ বছর। কিন্তু তবুও সে সময়ের ব্রিটিশরা গ্লোবাল নেতা বা লিডার কিনা তা বলার কোনো চল ছিল না।

দুনিয়াতে এমন কলোনি সাম্রাজ্যের মালিক-রাষ্ট্রের ধারণার অবসান ও বিলুপ্তি ঘটেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভেতর দিয়ে, যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ১৯৪১ সালে। অর্থাৎ ‘দুনিয়াতে রাষ্ট্রগুলোর কেউ কাউকে অধীনস্থ ও কলোনি দখল করে আর রাখতে পারবে না।’ মানে, কলোনি অধীনস্থতার সম্পর্ক দুনিয়া থেকে লোপ পাবে- এই নীতিগত দিক তৈরি হয়েছিল। আর তাতেই এই ভিত্তিতে জোট, মানে পক্ষ-বিপক্ষ দুটো রাষ্ট্রজোট তৈরি হয়েছিল। কলোনি দখল অবৈধ- এ নীতির ভিত্তিতে যারা পক্ষজোট, আমেরিকার নেতৃত্বে তারাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয় লাভ করেছিল। আর তা থেকেই আমেরিকা গ্লোবাল নেতৃত্বের আসন নিয়ে নিয়েছিল।

তবে বিশ্বযুদ্ধে বিজয়লাভের সাথে আমেরিকার হাতে গ্লোবাল নেতৃত্ব এসে পড়ার পেছনে মূল কারণ ছিল আমেরিকান বিপুল বিনিয়োগ সক্ষমতা। কিন্তু সেই বিনিয়োগের সুযোগ হাতে পেতে আগে আমেরিকাকে আরো দুটো বড় খরচের দায় নিতে হয়েছিল। এক. নিজ পক্ষজোটের সবাইকে যুদ্ধের খরচ বা ব্যয়ভার জোগানো; আর দ্বিতীয়ত, যুদ্ধের পর, ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ-বিপক্ষ সব রাষ্ট্রকেই ত্রাণ, পুনর্বাসন ও ভেঙে যাওয়া অবকাঠামোগুলো আবার গড়ে দেয়া ইত্যাদিতে বিনিয়োগ। সবচেয়ে বড় কথা, এসব খরচ আমেরিকা কিভাবে ফেরত পাবে কিংবা তা ফেরত নাও পেতে পারে, সেটি উহ্য রেখেই আমেরিকা এই বিপুল খরচ করেছিল যা পরে কমবেশি উসুল হয় অবশ্যই। কিন্তু তাতেই আমেরিকার ‘সবচেয়ে বড় পাওনা’ দুনিয়ার গ্লোবাল নেতৃত্ব হাতে চলে আসা। আর সেই থেকে দুনিয়ায় ‘গ্লোবাল নেতৃত্ব’ ধারণাটা প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়।

আরেক দিক থেকে দেখলে, গ্লোবাল নেতৃত্ব কথাটার তাৎপর্য কী? একেবারে ‘রুট’ হিসেবে বললে এটি সোজাসাপ্টা এক গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম। আর ক্যাপিটালিজমের ভেতরে যে স্বভাবটা সবসময় সুপ্ত থাকে এবং উপযুক্ত পরিবেশ পেলে যা ব্যাপ্তি লাভ করে ছেয়ে বসে। এতে ছোট ছোট পকেট বা ছোট-বড় আঞ্চলিক ক্যাপিটালিজমের উদ্যোগ ও ফেনোমেনাগুলো পরস্পর যুক্ত হয়ে পড়ে; এক গ্লোবাল ক্যালিটালিজমের রূপ ধারণ করে বিকশিত হয়ে উঠতে চায়।

এ কারণে ‘কলোনি শাসন অবৈধ’ হয়ে যাওয়ার ভিত্তিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার জয়লাভ কথাটার ব্যবহারিক মানে হয়ে যায়, যুদ্ধ শেষে কলোনিমুক্ত শ-দেড়েকের বেশি স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়ায় তার বিনিয়োগ-ক্রেতা। কিন্তু এসব রাষ্ট্র স্বাধীন-মুক্ত হলেও এত দিন কলোনি দখলে থাকায় উদ্বৃত্ত-সম্পদ সব কলোনি মালিকের দেশ লুটে নিয়ে যাওয়ায় অর্থনৈতিকভাবে এরা একেবারে ফোকলা। এ অবস্থা থেকে আবার বেঁচে ওঠার ক্ষেত্রে প্রধান প্রয়োজন ছিল বাইরের বিনিয়োগ, যেটা হতে পারে লুট হয়ে যাওয়া সারপ্লাসের সবচেয়ে ভালো বিকল্প। এরই স্টোর বা সাপ্লায়ার হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল আমেরিকা। কাজেই প্রথম গ্লোবাল নেতৃত্বে ‘আমেরিকা’ কথাটার তাৎপর্য হয়ে উঠেছিল যে, কলোনিমুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর আমেরিকান নেতৃত্ব গ্লোবাল সিস্টেম থেকে বিনিয়োগের পুঁজি-পণ্য নেয়া ও সম্পর্কে জড়ানো। তবে কথা পরিষ্কার রাখা ভালো। কলোনি-উত্তরকালে আমেরিকান নেতৃত্বের এই গ্লোবাল অর্থনৈতিক সিস্টেমের সাথে সম্পর্কিত হয়ে যাওয়া- এ সম্পর্কটাও আগেকার কলোনি দখল হয়ে থাকা সম্পর্কের চেয়ে ভালো হলেও এটাও অসম; এক অসম বিনিময় সম্পর্ক। কিন্তু অবশ্যই এটি তুলনামূলক অর্থে বেশি ভালো, ‘মন্দের মধ্যে ভালো’।

কিন্তু সমস্যা দেয়া দিয়েছিল অন্যখানে। কলোনিমুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে এবার আমরা কি ‘কথিত সমাজতন্ত্রী’ হবো নাকি গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের অংশ হবো? পরেরটা অসম হলেও তুলনামূলক ভালো বলে এই অসম বিনিময় সম্পর্কে প্রবেশ করতে পারব। সেই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এটিই হয়ে পড়েছিল দীর্ঘ চার দশকের ‘সমাজতন্ত্রী’ হওয়া না হওয়ার দ্বন্দ্ব। পরে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন আর চীন ষাটের দশক থেকেই ‘কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ক্যাপিটালিজম’- এভাবে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের সাথে যুক্ত হওয়ার পথ নেয়ায় আমাদের মতো রাষ্ট্রের জন্য পথ বেছে নেয়া সহজ হয়ে যায়। আমরা সবাই এখন আমেরিকান নেতৃত্বের গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের অংশ- আমরা এটি পছন্দ করি আর নাই করি। আর এটি অসম বিনিময় সম্পর্কের হওয়া সত্ত্বেও ‘মন্দের ভালো’ বলে। অর্থাৎ কলোনি-উত্তরকালে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম এই সিস্টেমের অংশ হয়ে ওঠার পথটাই অন্তত আপাতত টিকে যায়, প্রধান ধারা হয়ে যায়। তবে ইন্টারেস্টিং দিকটা হচ্ছে, সমাজতন্ত্রী ব্যবস্থার রাষ্ট্রগুলো ভেঙে পড়ার ক্ষেত্রে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকাই নেই। তারা নিজ গুণ বা দোষেই ভেঙে পড়ে অকার্যকর হয়েছে। এর মূল কারণ সম্ভবত সবারই টিকে থাকা, এই সারভাইবাল কোনো রকমে নিশ্চিত করা ছিল একেবারেই মুখ্যবিষয়। আর সবার চেয়ে বড় কথা- সমাজতন্ত্রীদের ঘাটতিও ছিল। যেমন- গ্লোবাল বাণিজ্য বা দুনিয়াজুড়ে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটা লেনদেন বিনিময় ব্যবস্থা হাজির থাকা আদৌ এসেনশিয়াল কি না এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে মৌলিকভাবে এখনো একেবারেই বেখবর হয়ে আছে সমাজতন্ত্রীরা।

এ দিকে এই শতকে এসে আমেরিকান গ্লোবাল নেতৃত্ব এরই মধ্যে চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে ও ঢলে পড়েছে। আগামী ঐতিহাসিকরা সম্ভবত মূলত এর দুটো কারণ উল্লেখ করবেন। এক. আফগানিস্তান আমেরিকার সাথে যে তুলনায় অযোগ্য ও তুচ্ছ বলতে পারে অনেকেই। কিন্তু আমেরিকার পতনের অন্যতম ‘হিরো’ এই আফগানিস্তান। সে একটাই কাজ করেছে। তা হলো, আমেরিকাকে সে এমনই ‘নেভার এন্ডিং’ এক অনন্তযুদ্ধে ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, যুদ্ধের খরচ জোগানোর সামর্থ্য গ্লোবাল নেতা আমেরিকার নেই। মনে রাখতে হবে, ২০০৮ সালের যেটা ‘গ্লোবাল মহামন্দা’ দেখা দিয়েছিল সেটা ১৯৩০ সালের প্রথমটার পরে দ্বিতীয়। ২০০৮ সালের মহামন্দার মূল কারণ কিন্তু যুদ্ধের খরচ বইতে গিয়ে ফেল করা আমেরিকান অর্থনীতি।

এ ছাড়া আমেরিকান গ্লোবাল নেতৃত্ব ইতোমধ্যে চ্যালেঞ্জ হওয়ার দ্বিতীয় কারণ, চীনের উত্থান; ‘কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে এক ক্যাপিটালিজমের’ চীন- এর কাছে আমেরিকার গ্লোবাল নেতৃত্ব হারানো। চীনের নেতা হিসাবে উত্থান, এটাকেই ‘গ্লোবাল নেতৃত্বে পালাবদল’ বলা হচ্ছে। নেপালসহ আমাদের মতো রাষ্ট্র বিশেষত যাদে দক্ষিণ এশিয়ায় চীন ও ভারতকে সাথে নিয়ে বসবাস, তাদের জন্য এই ‘পালাবদল’ এক কঠিন পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতি ঠিক কী প্রকৃতির, অভিমুখ কী, সম্ভাবনা কী, নেতিবাচক দিক কী ইত্যাদি সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার ধারণা থাকা খুবই জরুরি। যারা এটি ঠিকঠাক বোঝাবুঝি-মূল্যায়নে সফল হবেন, কেবল তারাই টিকে যাবেন। আর বাকিরা এ পালাবদলের সাথে সাথে টিকতে না পেরে এর ধাক্কায় হারিয়ে যাবে। আবার এ পরিস্থিতিতে চীন নিজেই নিজের যোগ্যতা বা ঘাটতি অথবা ইতি ও নেতি দিক সবটা বোঝে- এর সবই সত্যি নয়। সবচেয়ে বড় কথা চীন বড়জোর গ্লোবাল অর্থনৈতিক দিকের নেতা হতে পারে। আর ঠিক ততটাই গ্লোবাল রাজনৈতিক নেতা, আমেরিকার তুল্য, এ ক্ষেত্রে চীন এখনো অযোগ্য। চীনের বিরাট দুর্বলতা হলো, ‘মাস পাবলিক’ মানে আম-জনগণের সাথে উপস্থিত চীনা-রাষ্ট্রের সম্পর্ক এখনো একেবারেই ‘রাজনৈতিক সম্পর্ক’ নয়। কমিউনিস্ট পার্টির চোখে- মানুষ মানে, এখনো অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসা-বাসস্থান ইত্যাদি বৈষয়িক চাহিদার একটা ‘ডিব্বা’ মাত্র। তার কাছে রাজনৈতিকতা, স্পিরিচুয়ালিটি অনেক অনেক দূরের জিনিস। কাজেই এই চীন দুনিয়াকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিবে কিভাবে?

সুনির্দিষ্ট করে নেপাল
একটু পেছনে ফিরি ও সুনির্দিষ্ট করি নেপালকে ঘিরে। নেপাল নিয়ে অনেক হিস্টোরিয়ান গর্ব করে থাকেন যে, নেপাল কখন কলোনি শাসনে যায়নি। এ ক্ষেত্রে সমতুল্যভাবে আমরা বলতে পারি, ব্রিটিশ-ইন্ডিয়াতেও ৫৫০টার বেশি প্রিন্সলি স্টেট (করদরাজ্য) ছিল যারা কঠিন কিছু শর্তসাপেক্ষে ‘স্বাধীন’ রাজা ছিল বলে দাবি করে থাকে। নেপালও প্রায় সে রকম। ওই ধরনের চুক্তিতে যা থাকে তা হলো, রাজা যা রাজস্ব সংগ্রহ করবেন এর একটা অংশ ব্রিটিশদের দিয়ে যেতে হবে রেগুলার। আর ব্রিটিশরা ছাড়া অন্য কোনো বিদেশী শক্তির সাথে সম্পর্ক করতে এমনকি বাণিজ্যিক সম্পর্কও স্থাপন করতে পারবে না। বাইরে থেকে অস্ত্রও কিনতে পারবে না। তাদের প্রশাসন ব্রিটিশদের হাতে নয় রাজার হাতে পরিচালিত হবে; তবে ব্রিটিশদের থেকে তাদের ট্রেনিং বা অন্যান্য সহায়তা পেতে পারবে। নেপালের ক্ষেত্রে আরো যা ‘বিশেষ ছিল’ তা হলো, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের সময় তারা ব্রিটিশদের সহায়তা করেছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে নেপালি গোর্খা সৈন্য দিয়ে সহায়তা করায় বাড়তি কিছু ছাড় পেয়েছিল। যেমন ভূমি ছাড় (মাধেসি অঞ্চল ফিরে পাওয়া), বাইরের দেশ থেকে অস্ত্র কেনা ইত্যাদিসহ ১৯১৫ সালের সুগৌলি চুক্তি, ১৯৬০ সালের চুক্তিতে তরাই অঞ্চল ফেরত পাওয়া, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধ করায় সর্বশেষ ১৯২৩ সালের আরো ছাড় দেয়া এক চুক্তি। আর এ চুক্তিতে লেখা ছিল যে, এটা ১৯৫০ সালে আবার রিভিউ হবে। আর তত দিনে স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরু এবার নেপালের সাথে ১৯৫০ সালের চুক্তি করেছিলেন। সেটিরই মূল কথা হলো, ভারতের অর্থনীতি ও ব্যবসার অধীনে থেকে একটা নেপালি অর্থনীতি গড়ে উঠবে। যেমন ভারতের অনুমতি ছাড়া এবং ভারতীয় ব্যবসায়ীর মাধ্যমে ছাড়া নেপালের বিদ্যুৎ বিদেশে (যেমন বাংলাদেশে) নেপাল বিক্রি করতে পারবে না। আর নেহরু এ ধরনের চুক্তির ড্রাফটটা পেয়েছিলেন ব্রিটিশ আমলের ১৯২৩ সালের চুক্তি থেকে। এটা হলো ‘কলোনিমুক্ত নেপালের’ নমুনা। তাই স্বভাবতই নিজেদের প্রটেকশনের জন্য নেপালের রাজশাসকেরা এই নেহরু বা ভারত-অনুরক্ত এক নেপালি রাজতন্ত্র গড়তে খুবই আগ্রহী হয়েছিলেন। আর এটাই ছিল নেপালে ১৯৯৬ সাল থেকে শুরু হওয়া মাওবাদী সশস্ত্র আন্দোলনের মূল কারণ যেখানে অন্যান্যের সাথে প্রধান দুই দাবি- রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে নেপালকে ‘রিপাবলিক’ ঘোষণা আর এই ১৯৫০ সালের চুক্তি বাতিল (রিভিউ)।

নেপালে রাজতন্ত্র উৎখাত করে ক্ষমতা দখলের মধ্যে ২০০৭ সালেই অন্তর্বর্তী সরকার গঠন সম্পন্ন হয়েছিল। পরে এর সপক্ষে আনুষ্ঠানিক রেজুলেশন হয়েছিল নেপালের প্রথম কনস্টুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পরে। সেই অ্যাসেম্বলিতে ২০০৯ সালে। আর রিপাবলিক নেপালের কনস্টিটিউশন রচনা সম্পন্ন হয়েছিল ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে। কিন্তু এতে সবচেয়ে অখুশি এবং প্রকাশ্যে বিরোধিতা ও অসহযোগিতা শুরু করেছিল ভারত। এমনকি ল্যান্ডলকড যে নেপাল ভারতের ওপর দিয়ে ছাড়া কিছু আমদানি করতে পারে না, দীর্ঘ ছয় মাস ভারতের ওপর দিয়ে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে অবরোধ করে রেখেছিল তাকে। নেপালে ব্যবহার্য রান্নার গ্যাস সিলিন্ডারসহ সব ধরনের জ্বালানি ভারত সরবরাহে চুক্তিবদ্ধ থাকলেও তা বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। আর এতেই সারা নেপালের সব শ্রেণীর মানুষই নিজ নিজ স্বার্থে ও কারণে প্রবলভাবে অ্যান্টি-ইন্ডিয়ান হয়ে উঠেছিল। কোনো রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক বক্তব্যে আকৃষ্ট হওয়ার চেয়েও নিজ নিজ বৈষয়িক ও সারভাইভালের স্বার্থে।

চীন নেপালের রাজনৈতিক আসরে এই প্রথম প্রবেশ করেছিল তখনই, এই ২০১৫ সালে। কারণ ল্যান্ডলকড নেপালের জনগণ নিজ দেশের বাইরে যেতে ভারতের ভূমি পেরোনোর বিকল্প খুঁজছিল। ভারত নেপালের পুরো দক্ষিণাংশজুড়েই। আর পুরো উত্তরাংশজুড়ে চীন-সীমান্ত হলেও তা আরো পাহাড়ি উচ্চতায় দুর্গম বলে কখনো একে বিকল্প বলে ভাবা হয়নি। কিন্তু একালে চীনা উত্থানের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ হেভি-ডিউটির রেল ব্যবস্থা রয়েছে যেটা সমুদ্রবন্দরের সাথে যুক্ত এমন উন্নত। কিন্তু নেপাল সীমান্তের সবচেয়ে কাছাকাছি চীনের এমন রেলপথটাও নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে দিয়ে গেছে। তাই চীন সম্প্রতি এই ১০০ কিলোমি রেলপথ এক্সটেন্ড করে নেপালকে বহির্বিশ্বের সাথে কানেক্ট করে দিয়েছে।

কিন্তু সারা নেপাল অ্যান্টি-ইন্ডিয়ান হয়ে ফুঁসে ওঠার সেই কালেই কোয়ালিশন সরকার হওয়ায় ওলির কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসেন। সেই পপুলার সেন্টিমেন্টকে জনগণের পক্ষে সফল ব্যবহার করেন ওলি, একজন মাস পপুলার লিডারের যা করা উচিত সেভাবে। মূলত ওলি বা তার দল নামকাওয়াস্তেই শুধু কমিউনিস্ট, কাজে নয়। রাজতন্ত্রী নেপালের যুগে রাজ-সরকারের মন্ত্রী থাকার লোভে রাজার মন জুগিয়ে নেপালে মূল দল হয়ে কাজ করত এমন প্রথম চামচা ছিল নেপালি কংগ্রেস দল, আর পরেরটা হলো ওলির কমিউনিস্ট দল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওলি পপুলিজম বোঝেন বলেইসেসব পিছনে ফেলে ২০১৫ সালে পপুলার নেতা হয়ে যান। তিনি মাওবাদী দলের নেতা পুষ্প কমল দাহালের (সশস্ত্র দল থাকার সময় তার নিকনেম ছিল ‘প্রচণ্ড’) চেয়েও পপুলার। তাই ইতোমধ্যে ভারত যতই নেপালের চোখে অনিষ্টকারী হয়ে উঠেছিল, চীনা সরকারের সাথে দুই কমিউনিস্ট দলেরই ঘনিষ্ঠতা ও ওয়ার্কিং রিলেশন ততই ঘন হতে থাকে। এমনকি ট্রাডিশনাল নেপাল কংগ্রেস দলও তখন ভারত থেকে দূরত্ব মেনটেন করত। এ দিকে ২০১৭ সালের নভেম্বরের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসছিল। তাই ব্যক্তিগতভাবে চীনা নেতারা পরামর্শ দিয়েছিলেন ওলি ও দাহালের দুই কমিউনিস্ট পার্টিকে একদল হয়ে নির্বাচন করতে। নির্বাচনী ফলাফল খারাপ হয়নি। তারা দু-তৃতীয়াংশ আসল লাভ করে ভারত বা নেপালি কংগ্রেসকে আরো ক্ষুদ্র বানিয়ে ফেলেছিল।

সমস্যার গোড়া ওলি
কিন্তু সমস্যার গোড়াটা ছিল অন্যখানে। প্রথমত, মাওবাদী দাহালের দলের আজন্ম দুর্বলতা বা খারাপ কপাল হলো- এক. ২০০৯ সালের নির্বাচন ছাড়া আর কখনোই পপুলার ভোটের বেলায় দাহালের দল ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। সবসময় তৃতীয় স্থানে থেকে গেছে। অথচ ভারতের চরম বিরোধিতা অসহযোগিতা সত্ত্বেও দাহাল-ওলির দল, নেপালি কংগ্রেস ও নিজ দলকে একসাথে রেখে পরিস্থিতি মোকাবেলার অর্থে মুখ্য ভূমিকাটা পালন করে গেছিল। প্রচন্ড দল বা রাজনীতির ভালো সংগঠক, কিন্তু পাবলিক হ্যান্ডলিংয়ে যেন ততটা নন। দ্বিতীয়ত, ওলি ব্যক্তিত্ব হিসেবে একটা ফিউডাল লর্ডের মতো। তার কাছে দল মানেই, তিনিই এতে একমাত্র ইচ্ছাদাতা, হুকুমদাতা। কিন্তু তার বড় গুণ হলো, পপুলার মাস হ্যান্ডলিং ভালো বুঝেন ও পারেন।

সব মিলিয়ে ২০১৭ নির্বাচনের দুই বছরের মধ্যে যা দাঁড়ালো তা হলো, ওলি আরো দুর্দমনীয়, একক নিজ হুকুমে চলা, কোনো ফোরামের সিদ্ধান্ত বা কারো কথা না শুনে চলা ব্যক্তিতে পরিণত হলেন। ওদিকে কমিউনিস্ট দুই দল মিলেমিশে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন বলে ওলির পক্ষের দলের সবার সাথে মিলে মিলিত দলের কমিটি গড়তে দাহাল খুবই সফল ব্যক্তিত্ব, কিন্তু ওলির দলের লোকেরাই ওলির প্রশ্নে দাহালের সাথে দাঁড়িয়ে যায়। আগে ওলির সাথে যারা ছিলেন যেমন মাধব চন্দ্র নেপালসহ সবাই থাকলেন দাহালের পক্ষে। আর এটাই একপর্যায়ে ওলিকেই দল থেকে বহিষ্কার করে দেয়। এই বহিষ্কার ঘটেছে মাত্র তিন মাস আগে, অর্থাৎ ওলির সাথে মিলিত দলের সবার বিরোধ প্রকাশ পাওয়ারও প্রায় দু’বছর পরে।

কিন্তু কেন এত সময় লাগল? এটাই চীনা অনুরোধের ‘ঢেঁকি গেলা’; চীনের অতিরিক্ত জড়িয়ে যাওয়া যা অযাচিত পর্যায়ের। এতে বড় ভুলের এক নম্বর হলো, একধরনের ‘কমিউনিস্ট ভাই ভাই’ খুঁজে বের করে চীনের সাথে সম্পর্ক গড়া ও রাখার চেষ্টা। ‘চীন’ বলে যাকে আমরা দেখছি সে হলো হবু গ্লোবাল নেতা যার স্বার্থ অনেক জটিল ও আলাদা। তা ‘নট নেসেসারিলি’ নেপালের কোনো দল বা নেপালের স্বার্থের সাথে পুরোপুরি মিলবে অথবা মিল থাকাটা জরুরি। আর শেষ বিচারে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিটি দেশের মধ্যে ভারত ও চীনের যে প্রবল স্বার্থ- লড়াই তাতে এ দু’জনের যাকেই বেশি ভালো লাগুক না কেন শেষ বিচারে নিজ রাষ্ট্রস্বার্থই সব কিছুর ঊর্ধ্বে রাখতেই হতো। এটা থাকেনি। আর তা বজায় রাখলে চাইলে নেপালকে চীন, ভারত ও আমেরিকা থেকে একটা সম-দূরত্ব অবশ্যই বজায় রাখতে হবে। তবেই একমাত্র নিজ রাষ্ট্রস্বার্থ বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হতে পারে। দ্বিতীয়ত, এখান থেকেই আসে নিজ দেশের দলগুলো চীন, ভারত বা আমেরিকা এই তিন দেশের একেকটার প্রতিনিধি বা দালাল হয়ে যেতে পারে না। এটা বন্ধ করতে হবে। দেশের দলমাত্রই সবাইকে একমাত্র নিজ রাষ্ট্রস্বার্থের রক্ষকই হতে হবে।

অথচ গত দুই বছরে চীন বারবার ভেতরে হাত ঢুকিয়েছে যদিও এক কম্বোডিয়া ছাড়া কোথায় চীন এমন করেনি। দাহালের উচিত ছিল এটা খোলাখুলি বুঝিয়েই চীনকে নিবৃত্ত রাখা এবং এ কাজে সফল হওয়া। আবার চীনের অনুমান যে, ওলিকে বহিষ্কার করে দিলে তিনি নেপাল কংগ্রেস ও ভারতের সাথে মিলে পাল্টা সরকার গঠনসহ বিরাট কিছু করে ফেলতে পারেন- এ অনুমানও এত দিনে ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে। চীন-ভারত নয়, আগে নেপালকে নিজে বাঁচতে হবে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement