ধনীরা পালিয়ে যাক মঙ্গলে, পৃথিবী বাঁচুক
- মুজতাহিদ ফারুকী
- ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ২০:০৫
চলতি সপ্তাহেই বিজ্ঞান গবেষণায় বড় অগ্রগতি অর্জন করেছে মানবজাতি। সৌরজগতের অন্যতম গ্রহ মঙ্গলে মহাকাশযান নামিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা। যানটি সেখানে নানা রকম গবেষণা চালাবে দুই বছর ধরে। মূল লক্ষ্য, মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি না বা কখনো ছিল কি না, জানার চেষ্টা করা। মূল লক্ষ্যের পেছনেও আছে আরো বড় লক্ষ্য। সেটি হলো, ভবিষ্যতে এই লাল গ্রহে মানুষের বসতি গড়ে তোলা সম্ভব হবে কি না; আর হলে সেটা কিভাবে, ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে জানা বোঝার চেষ্টা করা। এ জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’ শত শত কোটি ডলার ব্যয় করছে এই খাতে। অর্থ জোগাচ্ছে সে দেশের সরকার। মঙ্গলে প্রথম যখন অভিযান চালানো হয় তখন তাতে ব্যয় হয়েছিল আড়াই শ’ কোটি ডলার। আর সর্বশেষ অভিযানে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০০ কোটি ডলার। ২০৩৩ সালে দেশটি মঙ্গলে মানুষবাহী নভোযান পাঠাতে চায়। সে জন্যও ব্যয় হবে বিপুল অর্থ।
গবেষণাকর্মে অর্থ ব্যয় নিয়ে কথা বলার কিছু নেই। মানুষ তার অস্তিত্বের শুরু থেকেই অজানার উদ্দেশ্যে ছুটে বেড়িয়েছে। অজানাকে জানার চেষ্টা করেছে; জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্গম এমনকি অগম্য জায়গায়ও ছুটে গেছে কোনো না কোনোভাবে। কলম্বাসের প্রায় পাঁচ শ’ বছর আগে মুসলিম অভিযাত্রীরা আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন; সেই চাপাপড়া ইতিহাসও এখন উন্মুক্ত হয়েছে। কাজেই মানুষের জানার অদম্য আগ্রহের কোনো শেষ ছিল না, কখনো শেষ হবেও না। এ ছাড়াও মঙ্গলে অভিযাত্রার আরো কারণ আছে। কিছু মানুষ বারবার বলে আসছেন, পৃথিবী নামের আমাদের এই গ্রহটি অতিরিক্ত মানুষের ভার আর বহন করতে পারছে না; এটি বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তন দিনে দিনে এটিকে উষ্ণতর করে তুলেছে এবং শিগগিরই এটি মানুষের বসবাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে পড়বে। তখন মানুষের অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে পড়বে। পৃথিবী মনুষ্যবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে এই কথাটা বলছেন দুই ধরনের মানুষ। একদল আছেন বিজ্ঞানী যারা এই কথা বলে বিশ্বের নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান যাতে তারা পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে এগিয়ে আসেন এবং অর্থের জোগান দেন। আরেকদল বিজ্ঞানী একই কথা বলেন ভিন্ন কারণে। তাদের যুক্তি হলো, যেহেতু পৃথিবী মানুষের ভার আর বহন করতে পারছে না, তাই মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এখন ভিন্ন আবাস খুঁজে নিতে হবে মানুষকে। তারা চাঁদে, মঙ্গলে, শুক্রে বা অন্য কোনো গ্রহে মানুষের নতুন আবাস গড়ার চিন্তাভাবনা করছেন। শুধু যে চিন্তা করছেন এমন নয়। কেউ কেউ রীতিমতো প্ল্যান প্রোগ্রাম করে মাঠে নেমেছেন। এমনই একজন হলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী ও উদ্যোক্তা এলন মাস্ক। তিনি ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। তিনি মঙ্গল গ্রহে মানববসতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি মহাপরিকল্পনা নিয়েছেন। এ জন্য যে ধরনের মহাকাশযান ও তার রকেট তৈরি করতে হবে, সে সম্পর্কিত চিন্তাভাবনাও তুলে ধরেন বিশ্ববাসীর সামনে। তিনি ১২২ মিটার দীর্ঘ ও ১২ মিটার প্রশস্ত একটি নভোযান এবং সেটিকে মহাশূন্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য সুবিশাল একটি বুস্টার রকেট তৈরি করবেন। মঙ্গলের বুকে একটি নগরী গড়ে তোলার জন্য তিনি প্রায় ১০০ কোটি টন সামগ্রী পৃথিবী থেকে মঙ্গলে নিয়ে যাবেন। মঙ্গলের কার্বন-ডাই অক্সাইডে তৈরি বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন তৈরি এবং বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি করতে এসব সামগ্রীর প্রয়োজন হবে। আর এটি তিনি করতে চান ২০২৪ সালের মধ্যে। তিনি ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে ১০ লাখ লোককে মঙ্গলে নিয়ে যেতে চান।
মাস্কের এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অকল্পনীয় পরিমাণে অর্থ দরকার। সেটি তিনি চান যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সাথে যৌথভাবে জোগান দিতে। এরও একটি ফর্মুলা তিনি হাজির করেছেন। বলছেন, যদি ১০ লাখ লোক মঙ্গল গ্রহে যেতে রাজি হন তাহলেই তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব। সেক্ষেত্রে প্রত্যেক মানুষকে ব্যয় করতে হবে ‘মাত্র’ দুই লাখ ডলার করে বাংলাদেশী মুদ্রায় যা প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকা।
মাস্ক একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিজ্ঞানী ও উদ্যোক্তা সন্দেহ নেই। কিন্তু তার এই পরিকল্পনা কতটা বাস্তবসম্মত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ এতে সরকারের অর্থ জোগানোর বিষয়ে সম্মতি দেবে কি না সেসব এখনো স্পষ্ট নয়। কারণ কেউই এখনো মাস্কের পরিকল্পনার বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা রাখেন না। পৃথিবীর মানুষকে মহাশূন্যে নিয়ে হিম মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হবে কি না সেটি নিশ্চিত করতে না পারলে সরকারি টাকা মাস্ক পাবেন না। এরপরও সমস্যা আছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রায় শতভাগ কার্বন-ডাই-অক্সাইডে গড়া বায়ুমণ্ডলের মধ্যে যদি তিনি মানুষের টিকে থাকার মতো পরিবেশ তৈরি করতে পারেন, তাহলে পৃথিবী কী দোষ করল? পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে এখনো প্রচুর অক্সিজেন আছে। মানুষই সেই অক্সিজেন কমে যাওয়ার জন্য দায়ী। কল-কারখানা, গাড়ি, সিএফসি গ্যাস, ফসল উৎপাদন ইত্যাদি যা কিছু পৃথিবীর পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী তার সবই করেছে একমাত্র মানুষ। এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো প্রজাতির প্রাণিকুলের ভূমিকা এতটাই নগণ্য যে, উল্লেখের মতো নয়। তাহলে মানুষ কেন নিজের হাতে তৈরি করা এই দূষণ থেকে পৃথিবীকে মুক্ত রাখার দায়িত্ব না নিয়ে পালিয়ে যাবে? এটি একটি নৈতিকতার প্রশ্নও বটে। প্রাণের উদ্ভব থেকে শুরু করে যে গ্রহটি মাতৃস্নেহে মানুষসহ সব প্রজাতিকে লালন-পালন করে এসেছে সেই বসুমতি আজ ‘বুড়িয়ে গেছে’ বলে তাকে ফেলে রেখে মানুষকে পালিয়ে যেতে হবে? ভিন্নগ্রহে আশ্রয় নিয়ে জননী বসুধাকে পরিত্যাগ করতে হবে, যেমন স্বার্থপর বিত্তবান মানুষরা বুড়ো বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর নামে চিরতরে ছেড়ে যায়? এতটা স্বার্থপর কী করে হতে পারে মানুষ?
এলন মাস্কের মতোই আরেক বিলিয়নিয়ার, মাইক্রোসফটের বিল গেটস কিন্তু পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন না। তিনি বলেছেন, পৃথিবী থেকে পালিয়ে যাওয়ার এই চিন্তাটাই লজ্জাকর। তিনি পৃথিবীকে কার্বনমুক্ত করতে যা যা করা দরকার সেটা করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। শিল্প-কারখানা, গাড়িসহ সবকিছু কার্বনমুক্ত করার প্রযুক্তি কিন্তু এখনই মানুষের করায়ত্ব। দরকার শুধু প্রায়োগিক দিক থেকে সেসব প্রযুক্তির আরো উন্নয়ন। সেটা করতে অর্থ লাগবে। কিন্তু মঙ্গলে যেতে যে পরিমাণ অর্থ দরকার তার তুলনায় এটি প্রায় কিছুই নয়। এরই মধ্যে কার্বন ফ্রি গাড়ি বড় বড় শহরের রাস্তায় নেমেছে। ব্লু গ্যাস দূষণমুক্ত কল-কারখানায় ব্যবহারের উপযুক্ততা অর্জন করতে যাচ্ছে। এ ছাড়া পৃথিবীতে কয়েক কোটি গাছ লাগালেও উপকার পাওয়া সম্ভব। সেই বিষয়টি তুলে ধরেছেন বিল গেটস। (দেখতে পারেন নিউ ইয়র্ক টাইমসে বিল গেটসের পডকাস্ট, সোয়ে)। গেটস বলেছেন, মঙ্গলে যাওয়ার চেয়ে এই পৃথিবীতেই আমাদের অনেক কিছু করার আছে।
আমরা অবশ্য বিষয়টি একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করতে পারি। ভেবে দেখুন, পৃথিবীর বায়ু বা পরিবেশ দূষণের জন্য, আরো স্পষ্ট করে বললে, পৃথিবীর উষ্ণায়নের জন্য যা কিছু দায়ী তার সবই বিত্তবান মানুষের আরাম-আয়েশ নিশ্চিত করার প্রয়োজনে সৃষ্ট। শিল্প-কারখানা, সমুদ্রগামী জাহাজ-উড়োজাহাজ-গাড়ি, তাপানুকূল ব্যবস্থা, রেফ্রিজারেশন এগুলো নিম্নবিত্ত মানুষের ভোগে লাগে না। লাগে বিত্তবানদের। আর অতি বিত্তবান মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে খুব কম। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সংখ্যায় কম হলেও বিশ্বের মোট সম্পদের প্রায় পুরোটাই বিত্তবানদের দখলে। অক্সফামের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের মোট সম্পদের অর্ধেকের মালিক হলো মোট জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশ ধনাঢ্য ব্যক্তি। মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ অর্থাৎ ৪৬০ কোটি সাধারণ মানুষের যে পরিমাণ সম্পদ আছে তার চেয়েও বেশি সম্পদের মালিক হলেন মাত্র দুই হাজার ১৫৩ জন শীর্ষ ধনী। এদের আরামের ব্যবস্থা করতে গিয়েই ৭০০ কোটি মানুষের বাসস্থান পৃথিবী আজ মরণাপন্ন। তাহলে এই লোকগুলোকে কি মঙ্গলে পাঠিয়ে দেয়া যায় না? এলন মাস্কের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ১০ লাখ লোককে পৌনে দুই কোটি টাকা করে দিতে হবে। তাহলেই তিনি মঙ্গলে একটি ‘নিরাপদ নগরী’ গড়ে তুলতে পারবেন। স্বাভাবিকভাবেই ধনাঢ্য না হলে এই পরিমাণ টাকা কারো পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। আমরা কি আশা করতে পারি, পৃথিবীর ওপর আস্থা হারানো ১০ লাখ অতিধনী মানুষ মাস্কের টিকিট নিয়ে মঙ্গলে পাড়ি জমাবে? আমরা ভাবি, শুধু ১০ লাখ নয়, অতি ধনী ওই এক শতাংশ মানুষ যারা পৃথিবীকে ‘বৈষম্যের আটলান্টিক’ বানিয়ে ফেলেছে তারা সবাই পালিয়ে যাক মঙ্গলে। এই সাত কোটির মতো মানুষ চলে গেলে একসাথে দু’টি বড় কাজ হবে। মঙ্গলে আবাস গড়ার মধ্য দিয়ে মানবজাতি স্পর্শ করবে অগ্রগতির সবচেয়ে বড় মাইলফলক। আর বয়োবৃদ্ধা বসুন্ধরা বেঁচে যাবে তার স্বার্থপর সন্তানের লুব্ধ-লোলুপ নানা কর্মকাণ্ডের দুঃসহ নিপীড়ন থেকে।
আয়েশি ধনীগুলো চলে যাওয়ার পর অবশিষ্ট যে মানুষগুলো পৃথিবীতে থাকবে তারা যদি দূষণকারী কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবী শীতল হয়ে আসবে; যেমনটা দেখা গেছে ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারীর সময়। লকডাউনে সবকিছু বন্ধ থাকায় বায়ুদূষণ কমে গিয়েছিল, আকাশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল, গাছপালা সতেজ হয়েছিল আর বন্যপ্রাণীরা স্বচ্ছন্দ বিচরণের জন্য ক্ষণিকের অবকাশ পেয়েছিল। এখন বিশ্বজুড়ে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকায় পরিবেশের দূষণ আবার শুরু হয়েছে। স্বার্থান্বেষী মানুষগুলোর পালিয়ে যাওয়ার অনুকূল আবহ দেখা দিচ্ছে।
আমাদের প্রার্থনা, এলন মাস্ক যেন বিশ্বের অতিধনী সব মানুষকে মঙ্গলে নিয়ে যেতে পারেন। তারাও বাঁচুন, পৃথিবীও বাঁচুক, আমরা যারা গরিব মানুষ, তারাও এই মাটির পৃথিবীটাকে মায়ের মমতায় বুকে জড়িয়ে একটু দম ছেড়ে বাঁচি!
সফল হোক নাসা ও মাস্কের মঙ্গল অভিযান।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা