ফিনল্যান্ডে মুসলমানদের জীবন-জীবিকা
- ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন
- ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ২০:০৪
পূর্ব ইউরোপের অন্যতম রাজনৈতিক স্থিতিশীল ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ দেশ ফিনল্যান্ড। এ দেশে ক্রমে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজারে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগ অভিবাসী হলেও ‘ভূমিপুত্র’দের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। ১৮৭০ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে তাতার মুসলিম জনগোষ্ঠী প্রথম সৈনিক ও ব্যবসায়ী হিসেবে ফিনল্যান্ডে আগমন করেছিল।
পরবর্তীতে উত্তর আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া ও সাবেক যুগোস্লাভিয়া থেকে মুসলমানরা এখানে এসে আলাদা কমিউনিটি গড়ে তোলেন। সংখ্যায় কম হলেও মুসলমানদের শিকড় এ দেশের গভীরে প্রোথিত। মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনাচার, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, সামাজিক বন্ধন ও ধর্মীয় ঐতিহ্যে মুগ্ধ হয়ে স্থানীয় বহু লোক ইসলাম কবুল করেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সাম্প্রতিককালে প্রতি বছরে ইসলাম গ্রহণকারীর সংখ্যা গড়ে এক হাজার, যাদের মধ্যে মহিলার সংখ্যা বেশি। পরে তারা মুসলমান ছেলেদের বিয়ে করে সংসার পাতেন।
মসজিদকেন্দ্রিক দাওয়াতি তৎপরতা পরিচালিত হয় ফিনল্যান্ডে। বড় বড় মসজিদের সাথে পাঠাগার, কমিউনিটি হল, পবিত্র কুরআন শিক্ষাকেন্দ্র সংযুক্ত। আল-ঈমান মসজিদ ও দাওয়াহ সেন্টারে মহিলাদের নামাজ আদায়ের জন্য পৃথক ব্যবস্থা রয়েছে। এদেশের ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিক্ষা-দীক্ষা, সামাজিক সৌহার্দ্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সৃষ্টিতে মুসলমানদের অবদান রয়েছে ব্যাপক। কিছু অসুবিধা সত্ত্বেও ফিনল্যান্ডের শ্রমবাজারে মুসলমান শ্রমিকদের প্রবেশাধিকার স্বীকৃত।
ফিনল্যান্ড একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সংসদীয় গণতন্ত্র এ দেশের সুস্থ রাজনীতির মূল চাবিকাঠি। এর পশ্চিমে রয়েছে সুইডেন, উত্তরে নরওয়ে, পূর্বে রাশিয়া ও দক্ষিণে এস্তোনিয়া। ফিনল্যান্ডকে বলা হয় ‘হ্রদের দেশ’।
ছোট বড় প্রায় এক লাখ ৮৭ হাজার ৮৮৮টি হ্রদ নিয়ে ফিনল্যান্ড গঠিত। দেশের ৮৬ শতাংশ ভূ-ভাগ বনভূমি দিয়ে আচ্ছাদিত। জীববৈচিত্র্যের দিক দিয়েও ফিনল্যান্ডের অবস্থান বেশ উঁচুতে। হুপার হাঁসসহ ২৪৮ প্রজাতির পাখি রয়েছে এখানে। প্রায় ৫৪ লাখ জনঅধ্যুষিত ভূখণ্ডটি আয়তনের দিক দিয়ে ইউরোপ মহাদেশে অষ্টম। হেলসিংকি এর রাজধানী। ট্যামপেরে, টুর্কু, অউলু, জাইভাসকিলা, লাহতি ও কুউপি ফিনল্যান্ডের উল্লেখযোগ্য শহর। ৩৩৬টি পৌরসভা নিয়ে স্থানীয় সরকার গঠিত। কৃষিনির্ভরশীল হলেও এ দেশ ধীরে ধীরে শিল্পায়নের পথে ধাবিত হচ্ছে। বিশ্বের ধনী দেশগুলোর মধ্যে ফিনল্যান্ড অন্যতম।
জনগণের মাথাপিছু আয় ৪৯ হাজার ৩৪৯ মার্কিন ডলার। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের বিবেচনায় এ দেশ ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম ও ব্রিটেনের সাথে তুলনীয়। ১২ থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত ফিনল্যান্ড ছিল সুইডেনশাসিত। ১৮০৯ থেকে ১৯১৭ পর্যন্ত এ দেশ ছিল রাশিয়ার অধীনে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। অবশেষে ১৯১৭ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। বৈশ্বিক আর্থ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের মেলবন্ধনরূপে ফিনল্যান্ডের ভূমিকা ব্যাপক। সাম্প্রতিক সময়ে ফিনল্যান্ড পৃথিবীর অন্যতম শান্তিপূর্ণ ও বাসযোগ্য দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
ফিনিস ও সুইডিশ হচ্ছে সরকারি ভাষা। জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ ফিনিশ ভাষায় কথা বলে। ৬৩ শতাংশ ইংরেজি ভাষা জানে ও বুঝে। মাধ্যমিক পর্যায়ের সব স্কুলে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক। শিক্ষার সুষ্ঠু ও অনুকূল পরিবেশ রয়েছে এ দেশে। হরতাল, ভাঙচুর, ক্লাসবর্জন, ছাত্ররাজনীতি, চাঁদাবাজি, ভর্তিবাণিজ্য এদেশে অকল্পনীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৬। ১৮২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয় এর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন। ফিনল্যান্ডের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নের জন্য শিক্ষার্থীদের বেতন দিতে হয় না।
বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ধর্মচর্চা, ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণ ও ধর্মপ্রচারের ক্ষেত্রে এ দেশে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। প্রতিটি মানুষ আইনের চোখে সমান। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৪২ লাখ মানুষ লুথেরান গির্জার অনুসারী খ্রিষ্টান। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এভানজেলিক্যাল লুথেরান গির্জা এখানে অবস্থিত।
এ দেশে শতকরা ২০ ভাগ মানুষের কোনো ধর্মীয় পরিচয় নেই। ধর্মচর্চা অব্যাহত রাখার স্বার্থে মুসলমানরা ফিনল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার নির্মাণ করেন। বিভিন্ন মুসলিম গ্রুপের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠায় গঠিত হয় ‘ফেডারেশন অব ইসলামিক অর্গানাইজেশন্স ইন ফিনল্যান্ড’। সোমালি, আরবি, আলবেনি, কুর্দি, বসনীয়, তুর্কি ও ফার্সি ভাষাভাষী মুসলিম জনগোষ্ঠী এখানে ইংরেজি ও ফিনিশীয় ভাষায় কথা বলেন।
অবশ্য মসজিদে ধর্মীয় আলোচনা আরবিতে পরিচালিত হয়ে থাকে। ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হেলসিংকি ইসলামিক সেন্টার সর্ববৃহৎ সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠন, যার সদস্য সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। ইসলামিক সোসাইটি অব ফিনল্যান্ড আরব বংশোদ্ভূত মুসলমানদের পরিচালিত সংগঠন। ১৯৮৭ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ফিনিশ ইসলামিক অ্যাসোসিয়েশন এ দেশের সবচেয়ে পুরনো সংগঠন। ১৯৫৫ সালে এর যাত্রা শুরু, সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭০০। এ সংগঠনের ব্যবস্থাপনায় হেলসিংকি, ট্যামপেরে, টুর্কু, অউলু, জাইভাসকিলা, লাহতি প্রভৃতি অঞ্চলে রয়েছে বহু মসজিদ। হিজাব পরিধানের ক্ষেত্রে সরকারিভাবে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। হেলসিংকির বিদ্যালয়ে, রাস্তা-ঘাটে ও শপিংমলে ইসলামী পোশাক পরা মেয়েদের অবাধ বিচরণ লক্ষ করার মতো। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় হালাল খাদ্যের দোকান গড়ে উঠেছে।
ফিনল্যান্ড সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পেলেও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুরো দমে বহাল রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ ও কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক চমৎকার। ফিনল্যান্ডের বিভিন্ন পৌর নগরীর মসজিদে কর্মরত ৫০ জন ইমামকে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে পড়ালেখার সুযোগ দেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে ইসলামিক সোসাইটি অব ফিনল্যান্ড। ইমামরা নিজ নিজ দেশে স্বীয় কারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণ শেষে এ দেশে আসার কারণে ফিনিশ সোসাইটির সাথে অনেকে খাপ খাইয়ে নিতে অসুবিধার সম্মুখীন হন। সোসাইটি মনে করে, ফিনল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিলে ইমামদের চিন্তা-চেতনা ও সামাজিক আচরণে এক ধরনের সামঞ্জস্যপূর্ণ ঐক্য গড়ে উঠবে। ফিনল্যান্ডের কোথাও কোনো মাদরাসা নেই। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তাদের সন্তান-সন্ততিদেরকে পারিবারিক পরিসরে অথবা মসজিদকেন্দ্রিক প্রয়োজনীয় ধর্মশিক্ষা দিয়ে থাকেন। স্কুল পর্যায়েও ধর্মশিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। অঞ্চল বিশেষে যদি মুসলমান শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় তা হলে সরকারি অনুমতিক্রমে স্থানীয় বিদ্যালয়ে নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায়।
১১টি ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের ধর্মশিক্ষার জন্য সরকার অনুমোদিত পৃথক সিলেবাস রয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইসলামে নবদীক্ষিত ফিনিশ মেয়েরা শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকায় ইসলাম ধর্ম শিক্ষা প্রদান সহজতর হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সরকারি স্কুলে ইসলাম ধর্ম শিক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে পাঠ্যবই বের করে প্রতি বছর। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২১টি সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্প, সেমিনার, কর্মশালা, মিডিয়া প্রশিক্ষণ, আইন, আন্তঃধর্মীয় সংলাপের আয়োজন করে থাকে, যাতে মুসলমানদের নিজস্ব শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির আবহ তৈরি এবং অন্যান্য ধর্মের সাথে সহমর্মিতাসুলভ আচরণ বৃদ্ধি পায়। প্রতি বছর এ খাতে সরকারি অনুদান বরাদ্দের পরিমাণ ৬০ থেকে ৮০ হাজার ইউরো। হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রয়েছে আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ। এ বিভাগ থেকে কোর্স শেষে শিক্ষার্থীদের স্ন্নাতক, মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয়।
মিডিয়ার বৈরী প্রচারণা যে নেই, এমন নয়। ‘ইসলাম-আতঙ্ক’ ছড়ানোর প্রয়াসও লক্ষ্যণীয়। কিন্তু সত্যের জয় অবধারিত। নাইন-ইলেভেনের পর থেকে ফিনল্যান্ডের সাধারণ জনগণের মাঝে ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। বহু মানুষ ইসলামিক সেন্টারগুলোর সাথে যোগাযোগ করে লাইব্রেরি থেকে ধর্মীয় গ্রন্থ সংগ্রহ করছেন। আরবি টেক্সটসহ ফিনিশ ভাষায় রচিত পবিত্র কুরআনের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। সারা বিশ্বের মুসলমানদের দায়িত্ব হচ্ছে ফিনল্যান্ডে মুবাল্লিগ, শিক্ষক ও ধর্মীয় স্কলার পাঠিয়ে ইসলামের অগ্রযাত্রাকে সুনিশ্চিত করা। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরোপে মুসলমানদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে চলেছে। বহু ইউরোপীয় দেশে ইসলাম এখন দ্বিতীয় ধর্ম।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা