২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

রোহিঙ্গারা সময়ের দাবার ঘুঁটি

রোহিঙ্গারা সময়ের দাবার ঘুঁটি - ছবি : সংগৃহীত

মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান ‘নগদ ঘটনা’। সবার দৃষ্টি আরেকবার মিয়ানমারের দিকে পড়ল। সত্য হলো ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর কয়েক বছর পরই অর্থাৎ ১৯৬২ সাল থেকে সামরিক জান্তার সাথে সহাবস্থান শুরু করে মিয়ানমারের জনগণ। মিয়ানমারের স্বাধীনতার ইতিহাসও পাকিস্তান-ভারত বিভক্তির মতো ছিল না। ব্রিটিশরা কম-বেশি ১৩টি নৃ-গোষ্ঠীকে আলাদা ১৩টি জোন বা প্রদেশে বিভক্ত করেছিল। ব্রিটিশরা বলেছিল তোমরা অঙ্গরাজ্য হতে পারো, আবার স্বাধীন দেশ হিসেবে থাকতে পারো, আবার স্বায়ত্তশাসনের মতো অবস্থান নিতে পারো। সেই দেশটি বাস্তবে ১৩ জন জেনারেলের অধীনে এক হয়েও থাকতে পারো। শেষ পর্যন্ত ১৩ জন জেনারেল স্বাধীন মিয়ানমারের মানুষের দণ্ডমুণ্ডের মালিক-মোক্তার হয়ে দাঁড়ান। এখন ১৩ জন জেনারেল ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করেন। তাদের স্ত্রীরা নিয়ন্ত্রণ করেন তাবৎ ব্যবসা-বাণিজ্য। মিয়ানমারে রয়েছে অনেক নৃ-গোষ্ঠী, এরা অস্ত্রধারী। এমতাবস্থায় মিয়ানমারে সামরিক শাসনই কপালের লিখন।

মিয়ানমারে মাঝখানে গণতন্ত্রের মানসকন্যা সেজে ক্ষমতায় শরিক হয়েছিলেন অং সান সু চি। তিনি বাস্তবে ক্ষমতাশালী কোনো দিন হতে পারেননি। সেটি ছিল সামরিকতন্ত্রের সাথে বোঝাপড়া করে চলা। মিয়ানমারের মানুষ বা জনগণ কখনো গণতন্ত্রের স্বাদ পায়নি। দীর্ঘ দিন অন্তরীণ থেকে সু চি ও তার দলকে টেনে এনে নির্বাচনের মহড়া করে ক্ষমতার শেয়ার করা হলো। বিশ্ববাসী ভাবল, সু চি বুঝি সত্যিকারের গণতন্ত্রের মানসকন্যা হয়ে ক্ষমতা চর্চা করছেন। বাস্তবে সেটি কখনো ছিল না। তাই মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান নতুন কিছু নয়, এটাকে বড় জোর বলা যাবে জেনারেলদের একধরনের ‘করুণা’।

তবে এটা সত্যি কথা, সু চি এবং তার দল গণতন্ত্র চায়, পশ্চিমা বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে চলতে চান। এসবই ছিল জেনারেলদের সাজানো ও পাতানো খেলা। ‘মিয়ানমার’ নতুন নামকরণের আগে এর নাম ছিল ‘বার্মা’। আমাদের দেশের প্রচুর লোক রেঙ্গুন যেত, চাকরি করত। ‘বার্মিজ লুঙ্গি’ ছিল অনেক নাম করা। আমাদের দেশের সাধারণ লোক যারা রেঙ্গুন গিয়ে নানা ধরনের নিম্নমানের কাজ করত তাদের বলা হতো ‘রেঙ্গুনের ডামিশ’। মনে পড়ে, এক জেঠাতো ভাই রেঙ্গুনে রুটির দোকানে কাজ করত, আরো এক ভাই রেঙ্গুন থাকত, পরে রেঙ্গুন থেকে ফিরে চট্টগ্রামে এসে নাসিরাবাদ এলাকায় হোটেল ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছিল। সম্ভবত সেটি ছিল আরেকজনের সাথে শেয়ার ব্যবসা। সেই হোটেলে এক রাত কাটিয়েছিলাম।

মিয়ানমার আমাদের পড়শি রাষ্ট্র। নাফ নদী বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নাফ নদী গিয়ে টেকনাফ দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। মিয়ানমারের সাথে আমাদের সম্পর্ক ভালোই যাচ্ছিল, যদিও মিয়ানমার বারকয়েক উসকানিমূলক আচরণ করেছে। বাংলাদেশ অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে আচরণ করেছে। দেশটির সাথে সম্পর্ক নষ্ট করতে চায়নি। যখন প্রথম রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে জোর করে ঠেলে দেয়া হলো তখনো বাংলাদেশ ধৈর্যের সাথে দু’দেশের সম্পর্কের স্বার্থে সংযম প্রদর্শন করেছে। বাংলাদেশ বাধ্য হয়ে রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে সাহায্য করলেও বারবার দেনদরবার করে বলেছে, ‘তোমরা রোহিঙ্গাদের ফেরত নাও।’ এ নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বসম্প্রদায়ের সহযোগিতা কামনা করে আসছে। ভূ-কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ জানে, শত্রুতা করে রোহিঙ্গাদের কোনোভাবেই ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না। ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। মিয়ানমার দ্বিতীয় পড়শি। বাংলাদেশ জানে, ভারত বক্তব্য বিবৃতিতে সান্ত্বনা দেবে, কার্যত মিয়ানমারকে বাধ্য করতে সচেষ্ট হবে না। কারণ ভারত ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ বলে কথা! তাই মান রক্ষার জন্য বিবৃতি দেয়; কিন্তু মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো অবস্থান নেয় না, নেবে না। ভারতের অনেক স্বার্থ জড়িয়ে আছে মিয়ানমারের সাথে। একই অবস্থা চীনের। বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্ব প্রদর্শন করে, প্রচুর বিনিয়োগও করে; কিন্তু মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করতে যাবে না। কারণ তাদের সাথে মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অনেক বেশি জোরদার। চীন বাংলাদেশের কাছে যা চেয়েও পায়নি, মিয়ানমার তা চীনকে দিয়ে দিয়েছে। তাই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘের ঐক্যের আহ্বান বাস্তবে কোনো সুফল আনবে না। কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ পশ্চিমা বিশ্ব মানবাধিকার প্রশ্নে এবং নীতিগত কারণে মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে। ভূকৌশলগত কারণে সেই আহ্বান বাস্তবে সুফল বয়ে আনবে না। চীন অর্থনৈতিক পরাশক্তি; এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ ভালো করেই জানে। তাই তারাও সংযমের সীমা অতিক্রম করতে যাবেন না। পুতিনের রাশিয়াও প্রকারান্তরে চীনের দিকে ঝুঁকে থাকবে। ধর্ম এখানে একটা বড় ফ্যাক্টর হয়ে আছে। রোহিঙ্গারা মুসলমান। পশ্চিমের রয়েছে ইসলামোফোবিয়া। সৌদি আরব একসময় রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বেশ আগ্রহ দেখিয়েছে। ফুয়াদ আল খতিব যখন সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ছিলেন এ দেশে, তখন তিনি বাংলাদেশকে প্রচুর সাহায্য করেছেন। ‘রাবেতা’র মাধ্যমে হাসপাতাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নজিরবিহীন অবদান রেখেছিলেন। বর্তমানে রোহিঙ্গাদের নিয়ে সৌদি আরব বিব্রত। উম্মাহপ্রীতি প্রদর্শন করতে গিয়ে তারা নিজেরাই এমন বিব্রত। দেশটি বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশী পাসপোর্ট ইস্যু করতে। মিয়ানমার বৌদ্ধ রাষ্ট্র। তাই বৌদ্ধ রাষ্ট্রগুলো মিয়ানমারকে সমর্থন জোগাবেই। রোহিঙ্গাদের অনেকেই মন্দ স্বভাবের। হয়তো নির্যাতন-নিপীড়ন তাদের বাধ্য করেছে একটু রুক্ষ স্বভাবের হতে। সৌদি আরবে স্বচক্ষে দেখে এসেছি, রোহিঙ্গাদের মধ্যে ব্যতিক্রম ছাড়া অবশিষ্টরা উম্মাহ’র সদস্য হয়েও সিম্প্যাথি পাচ্ছে না। বরং রোহিঙ্গারা সৌদি আরবে ‘মন্দ’ লোকের উপমা হয়ে আছে। পশ্চিমা বিশ্বে রোহিঙ্গারা আদরণীয় হচ্ছে না, ধর্মীয় কারণে আবার তাদের স্বভাবের জন্য। কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশে থাকার মতো মানুষ নেই, অথচ রোহিঙ্গারা ঠাঁই পাচ্ছে না। তার পরও বাংলাদেশের ভারসাম্যমূলক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। রাশিয়ার ভেটো পাওয়ার চীনের পক্ষেই থাকবে। তাই জাতিসঙ্ঘ কার্যকর কিছু করতে পারবে না যদিও আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার কোনো বিকল্প নেই। মার্চে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোদি আসবেন ঢাকায়। তখন রোহিঙ্গা ইস্যু নিশ্চয় উঠবে। ভারত আশাবাদের বাণী শোনাবে, কিন্তু বাস্তবায়নের ব্যাপারে চাণক্য নীতির ফলে ‘উত্তরে বললে দক্ষিণে যাবে।’ এটাই ভারতের ব্যাপারে আমাদের দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা। তারা বন্ধুত্বের ভাব প্রদর্শন করে সব আদায় করে, দেয়ার বেলায় মুলা ঝুলিয়ে রাখারই স্বভাব। এই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের ষোলো আনা রয়েছে। তাই বাংলাদেশও তাদের বন্ধুত্বকে আমলে নিয়েও ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে চাইছে না।

তা ছাড়া মিয়ানমার, ভারত ও চীন জঙ্গিবাদী উপদ্রুত এলাকা। শান্তিবাহিনীর কাণ্ডকীর্তি জানি। ‘উলফার’ নাম শুনেছি। বাস্তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর স্বাধীনতার লড়াই আমাদের সামনে নেই। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

কফি আনান কমিশন যে ফর্মুলা দিয়েছিলেন, সেটি ছিল সর্বজন সমর্থিত। সব দেশ সেই ফর্মুলা সমর্থন করেছিল। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারও সেই কমিশনকে অস্বীকার করেনি। বরং বাংলাদেশ আশাবাদী ছিল, সেই কমিশন অনুযায়ী একটা উপসংহারে পৌঁছা যাবে। মিয়ানমারও সেই সত্যটি অস্বীকার করেনি। অথচ কফি আনান কমিশনের প্রতি অবজ্ঞা করে মিয়ানমার আবার অসংখ্য রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে। এখন সর্বসাকুল্যে কম-বেশি ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। প্রতিদিন তারা সংখ্যায় বাড়ছে। কারণ তাদের জন্মহার অনেক বেশি। এর বাইরে তারা জড়িয়ে পড়েছে নানা অপরাধের সাথে। তার ওপর পরিবেশ বিপর্যয় তো এক কঠিন বাস্তবতা। এখন রোহিঙ্গারা ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ পড়েছে উভয় সঙ্কটে। এক দিকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে, অন্য দিকে ভাসানচরে তাদের আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। অথচ বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত আইন হচ্ছে, কোনো মানুষ রাষ্ট্রহীন থাকতে পারবে না। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের দেশ নয়। মিয়ানমার তাদের গ্রহণ করছে না- এ অবস্থায় জাতিসঙ্ঘের ঐক্যের ডাক, সু চির কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার আহ্বান বাস্তবে কোনো সমাধান নয়। নিরাপত্তা পরিষদের নিন্দা প্রস্তাব যখন পাস হচ্ছে তখন সু চির বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হচ্ছে। তার সহযোদ্ধা এমনকি ডান হাত হিসেবে খ্যাত একজন রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অধিকাংশ এমপিও গ্রেফতার এড়াতে পারেননি।

মিয়ানমার কার্যত রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দিতেই নারাজ। তারা বারবার বলার চেষ্টা করছে, তারা মিয়ানমারের লোক নয়। বাংলাদেশ থেকে তারা মিয়ানমারে গেছে। ইতোমধ্যে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বসতিতে নতুন স্থাপনা নির্মাণ করেছে। তা চীনকে ইজারা দিয়েছে। তাই বিষয়টি মিয়ানমার-বাংলাদেশ ইস্যু হয়ে থাকেনি। এটা হয়েছে বিশ্ব ভূরাজনীতির একটি ইস্যু। বঙ্গোপসাগরও কার আধিপত্যে থাকবে সেটিও এখন বিরাট প্রশ্ন। বাস্তবে রোহিঙ্গারা শুধু রাষ্ট্রহীন মানুষই নয়, তারা বিশ্ব রাজনীতির উপাত্ত হয়ে গেছে।

তবে কিছু আশার বাণীও শোনা যাচ্ছে। যতদুর স্মরণে পড়ে মিয়ানমারের উত্থান্ট জাতিসঙ্ঘের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সম্ভবত ষাটের দশকে, সম্ভবত সেই সময়ে নে উইন ছিলেন ক্ষমতায়, আর সু চি ছিলেন বন্দী অবস্থায়। এখন সু চি বলছেন তার দলের পক্ষে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখার জন্য। অপর দিকে সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে মিয়ানমারে বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়েছে। তারই ফলাফল হিসেবে সম্ভবত ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সামরিক জান্তা তাদের অভ্যুত্থানের যুক্তি খাড়া করে এই বলেছে যে, নির্বাচন দ্বন্দ্বের জের হিসেবে তারা সামরিক অভ্যুত্থান করতে বাধ্য হয়েছে। তাদের মতে, ভুয়া ভোটার রয়েছে অনেক। অপর দিকে বিশ্বের অনেক দেশ সু চির মুক্তির দাবি অব্যাহত রেখেছে। একই সাথে সে দেশে সামরিক শাসনের অবসান চাচ্ছে। জাতিসঙ্ঘসহ অপরাপর সংস্থাও সু চির মুক্তি দাবি করে চলেছে। বাস্তবে সু চির আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় তার দল নানা রঙের পতাকা হাতে বিক্ষোভ করেছে। তুরস্কও বলেছে রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান, তাদের মিয়ানমারে পুনর্বাসন করা। এ দাবি মানবিক বিশ্ব ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবির সমান্তরাল; তবে এই দাবি আরো জোরদার করতে হবে।

টেলিনর জানিয়েছে, পাঁচ কোটি ৩০ লাখ মিয়ানমারবাসী টেলিফোন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সামাজিক সব যোগাযোগমাধ্যমের ওপর সামরিক শাসক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। অপর দিকে মিয়ানমার দূতের মাধ্যমে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশকে বলেছে, সামরিক শাসনে তাদের সম্পর্কের পরিবর্তন হবে না। বাস্তবতা কী হবে সেটি ভবিষ্যৎই বলে দেবে। তবে বিশ্ব পরিস্থিতি এখন সামরিকতন্ত্রের সপক্ষে নেই। সামরিক বাহিনী নেপথ্যে থেকেও ‘গণতন্ত্রের আলখাল্লা’ পরে দেশ চালায়। পাকিস্তানও এর একটি উপমা হতে পারে। আফ্রিকায়ও অনেক দেশের অবস্থা একই ধরনের। মিসর চার বছর পর আলজাজিরার এক সাংবাদিককে মুক্তি দিয়েছে। অপর দিকে আলজাজিরার একটি প্রতিবেদন নিয়ে আমাদের সরকার বিব্রত। তার অনেক কারণ। বিশেষ করে সামরিক বাহিনী নিয়ে মন্তব্য থাকায় বাংলাদেশের পক্ষে এর সত্যতা মেনে নেয়া কষ্টকর। অপর দিকে চ্যানেলটির বিশ্বস্ততা নিয়ে এখন পর্যন্ত কেউ তেমন কোনো প্রশ্ন তোলেনি। আমরা মিসর প্রসঙ্গ তুলেছিলাম। দেশটি কার্যত সামরিক আশ্রয়ে পরিচালিত হয়। মুরসির যে করুণ পরিণতি তা কি সামরিক বাহিনীর জন্য হয়নি? এখনো মিসর সামরিক আশ্রিত পথে শাসিত হচ্ছে।

আমাদের মূল প্রসঙ্গ রোহিঙ্গা ইস্যু ও মিয়ানমার। একটা কথা বলে শেষ করা প্রয়োজন, কোনো না কোনোভাবে একসময় মিয়ানমার কিছু লোককে গ্রহণ করতে পারে। তবে ‘দিল্লি হনুজ দূর অস্ত’। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিয়মিত হ্যামারিং করে যেতেই হবে। রোহিঙ্গা নিছক আওয়ামী লীগের সমস্যা নয়, বাংলাদেশের সমস্যা। তাই বাংলাদেশকে শত উসকানির মুখেও বিশ্বজুড়ে দূতিয়ালি অব্যাহত রাখতে হবে। ভারত-চীনকে একটি কথা বারবার বুঝতে হবে। ভারতের সেভেন সিস্টার রয়েছে। তারা অস্ত্র হাতে দিল্লির সাথে যুদ্ধ করে চলেছে। বাংলাদেশ ঠাঁই না দিলে তারা অন্য পথ ধরবে। অপর দিকে মিয়ানমারকেও চার দিকের ভিন্ন ভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর হুমকি মোকাবেলা করে চলতে হচ্ছে। নৃ-জাতিগোষ্ঠী কখনো অস্ত্র ছাড়ে না। হয় নিঃশেষ হয়ে যায়, অন্যথায় একসময় বিজয় পায়। আমাদের পার্বত্য ইস্যু এর জ্বলন্ত প্রমাণ। একসময় সন্তু লারমাকে বশে আনতে চুক্তি করতে হয়েছে। তাই বলে পার্বত্য এলাকা এখনো শান্ত হয়নি। সেখানে হানাহানি চলছে। সবাইকে বাঙালি হয়ে যাওয়ার কথা বলে একসময় সমস্যাটার সূচনা করেছিলেন বলে মনে করা হয়।

পৃথিবীজুড়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো কেউ অস্ত্র সমর্পণ করে না। হয় নিঃশেষ হয়ে যায় নয়তো তারা সময়মতো মাথা তুলে দাঁড়ায়। বসনিয়া-চেচনিয়াই কি তার প্রমাণ নয়? তাই কাশ্মির কাশ্মিরিদের হবেই। সেটি সময়ের প্রশ্ন। ভারতকে একসময় ছাড় দিতেই হবে। পাকিস্তানও ছাড় না দিয়ে কোনো উপায় নেই। প্রয়োজনে আরো ‘কারগিল যুদ্ধ’ হবে। কিন্তু কাশ্মির কাশ্মিরিদেরই হবে। আমাদের ভাষা নিয়ে পাকিস্তানিরা কত বাহানার আশ্রয় নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ভাষার পথ ধরে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এখন বাংলাদেশকে নিয়ে আর কেউ উপেক্ষার ভাষায় কথা বলার সাহসও দেখাতে চেষ্টা করে না। তাই রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীও একসময় মাথা তুলে দাঁড়াবে, সেটি সময়ের প্রশ্ন। তাই আমরা আশাবাদী, কোনো শাসক ও মানচিত্র দীর্ঘ দিন এক থাকে না। সময় বদলায়; লাওস, কম্বোডিয়া, তিমুর কি এখন বাস্তবতা নয়? কুর্দিরা একসময় অবশ্যই মাথা তুলে দাঁড়াবে যদিও বর্তমানে তারা ‘বিদ্রোহী’ হিসেবে খ্যাতি পাচ্ছে। একসময় আসবে তারা আর বিদ্রোহী হয়ে থাকবে না; হয় অস্তিত্ব নিঃশেষ হয়ে যাবে নয়তো মাথা তুলে দাঁড়াবে। ভারতে যত রাজ্য ততটাই বিদ্রোহী দল-উপদল রয়েছে। একসময়ের নকশালবাদীরা নিঃশেষ হয়ে গেছে। সময়ের ব্যবধানে তারা খোলস পাল্টে ভিন্ন নামে ভিন্ন চেহারায় আবার জেগে উঠবে। বাহাদুর শাহ জাফর শেষ মুঘল সম্রাট। তাকে রেঙ্গুনে কবর দেয়া হয়েছে। সেই মুঘল সাম্রাজ্য এখন কয়েকটি দেশে বিভক্ত। তাই রেঙ্গুন গেলে অনেকেই বাহাদুর শাহ জাফরের কবর জিয়ারত করে আসে। অন্তত দেখে আসে।

রোহিঙ্গারা শেষ কোন ধরনের পরিণতির জন্য অপেক্ষা করছে, তা একমাত্র স্রষ্টাই জানেন। আমরা মানবিক কারণে তাদের প্রতি সাহায্যের হাত প্রসারিত করে দিয়েছি। ভাগ-বিভাজনের বিশ্ব-মানচিত্র কখন কোথায় পাল্টায়, বলা কঠিন। ‘দাদা’ খ্যাত সিরাজুল আলম খান আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায় মানচিত্র পাল্টানোর কথা লিখেছেন। তাই ভবিষ্যৎ নিয়ে শেষ কথা কে কখন বলতে পারে? সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছার বাইরে কিছুই হওয়ার নয়, এই বিশ্বাস আমাদের ঈমানের অঙ্গ। তাই রোহিঙ্গাদের নিয়ে শেষ কথা মিয়ানমারও বলতে পারে না, বাংলাদেশও বলতে পারে না।

masud2151@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement