বায়ুদূষণ, শ্রেণিবৈষম্য ও গণতন্ত্রের স্বপ্ন
- মাসুদ মজুমদার
- ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ২০:৫৬
ঢাকা মহানগরী সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছে বিশেষভাবে বায়ুদূষণের জন্য। তাবৎ বিশ্বের মধ্যে ঢাকা হচ্ছে বায়ুদূষণের দিক থেকে এক নম্বর। তাই স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ কাকডাকা ভোরে রমনা পার্কে একটু সবুজের ছোঁয়া নিতে যান। আশা থাকে, ঢাকা শহরে বৃক্ষ নিধনের যে মহোৎসব চলছে, সেখানে রমনা এলাকাটা অনেকটা সবুজ। কারণ রমনা পার্কে এখনো যথেষ্ট গাছপালা রয়েছে। তাই ঢাকা মহানগরীর মধ্যে এলাকাটা এখনো বেশি অক্সিজেন সরবরাহ করে। বৃষ্টিপাতও রমনা এলাকায় একটু বেশি। গরমকালে যখন পার্কের চার ধার দিয়ে যাতায়াত করে মানুষ, তখন অনেকটা ঠাণ্ডা অনুভব করে। অভিজ্ঞতা দিয়েই বিষয়টি উপলব্ধি করেছি। আবার শীতকালে যখন পার্কের চার ধারে যাতায়াত করবেন, দেখবেন একটু বেশি মাত্রা ঠাণ্ডা অনুভব করছেন। এটা এক ধরনের পরীক্ষিত বিষয়।
ঢাকায় বায়ুদূষণের বিষয়টি নিয়ে পরিবেশবাদীরা সোচ্চার, কিন্তু সরকার এবং মেয়রদ্বয় কথার ফুলঝুরি ছাড়া তেমন কার্যকর কিছুই করছেন না, ঢাকায় উন্নয়নের ছোঁয়া আছে; কিন্তু পরিবেশ রক্ষায় বাস্তবে কার্যকর কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না। কারণ একটাই, আমরা বলি বেশি, করি কম। ফলে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি ঘটছে না।
প্রথম যখন ঢাকায় এসে ট্রেনে ফুলবাড়িয়ায় নামতাম, তখন সেগুনবাগিচায় এক নিকট আত্মীয়ের বাসায় উঠতাম। মনে পড়ে, তখন সেগুনবাগিচায় অনেক গাছ ছিল, তারপর সেসব বড় করই গাছ একসময় উজাড় হয়ে গেল; জিপিওর সামনে ছিল অনেক বড় বড় গাছ; একই অবস্থা ছিল দিলকুশা রোডের। অপর পাড়ে ছিল গর্ভনর হাউজ। এখন সেটাই বঙ্গভবন। প্রেসিডেন্টের নিবাস। সেখানেও ছিল বড় বড় গাছ-গাছালি। তাই এলাকাটি ছিল সবুজবেষ্টিত। বঙ্গভবন যখন হয়, তখনো বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে দেয়াল ঘেঁষে মিষ্টি আলুর চাষ করেছিলেন। নিজ হাতে অবসর সময়ে সেই গাছে নিড়ানি দিতেন, একজন বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিক যিনি তখনো একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক, তার সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে নেতা তার কাঁধে হাত দিয়ে সামান্য চাপ দিয়ে বলেছিলেন- দেখ্, যুদ্ধ করে একটা দেশ অন্য একটি দেশকে স্বাধীন করেছে। তারা কি এমনিতেই দেশ ছেড়ে চলে যায়? আমি ইন্দিরা গান্ধীকে বললাম, ‘আপনার সেনাবাহিনী দ্রুত ফিরিয়ে নিন। অন্যথায় আমার জনগণ আপনার সৈনিকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। বল, আমি বেঁচে পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্তি না পেয়ে দেশে আসলে এই দেশ থেকে তোরা ভারতীয় সৈন্য হটাতে পারতিস?’ এসব কথা যখন বলছিলেন তখন বঙ্গবন্ধুর হাতে ছিল নিড়ানি, পরনে ছিল একটি চেক লুঙ্গি। বঙ্গবন্ধু ঠিকই বলেছিলেন, তিনি না এলে, ভারতীয় সৈন্যরা লুটপাট থামিয়ে ফেরত যেত না, তখনো ভারত ২৫ মার্চ ইস্টার্ন কমান্ড ডে পালন করে, আমরা করি কালরাত্রি। প্রসঙ্গটা উঠল বঙ্গভবনের প্রসঙ্গ এসে যাওয়ার কারণে। বয়োজ্যেষ্ঠ সেই সাংবাদিক এখনো জীবিত এবং একটি বাংলা দৈনিকের সম্পাদক। আল্লাহ তাকে আরো হায়াত দিন। সম্প্রতি তার স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেছেন, আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন।
দিলকুশা এলাকায় এত গাছ ছিল যা দেখার মতো। আজ আর সেই গাছ নেই। ডিআইটি ভবনের চার পাশ ছিল গাছ-গাছালিতে ঘেরা। আজ আর সে অবস্থা দেখাই যায় না।
প্রসঙ্গটা ঢাকার গাছ-গাছালি নিয়ে উঠেছিল, বঙ্গভবন ছিল গাছপালা বেষ্টিত। সেই বঙ্গভবনে বেশ ক’বার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। শেষবার যাই মরহুম গিয়াস কামাল চৌধুরীর সাথে। কিংবদন্তিতুল্য এই সাংবাদিক আর আমাদের মাঝে নেই। লাট ভবন থেকে গভর্নর হাউজ, তারপর বঙ্গভবন। অনেক পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে বঙ্গভবনে। একসময় এত প্রটোকল ছিল না। গভর্নর হাউজের সামনে ছিল টঙ্গীর মুড়ির টিন মার্কা বাসস্ট্যান্ড, বঙ্গভবনের দেয়ালকে পেছনে রেখে একসময় ছিল গণমূত্রালয়, রাস্তাটি ছিল খোলা। এখন অনেক পরিবর্তন, রাস্তার একদিক বন্ধ, তা ছাড়া বঙ্গভবনের প্রটোকলও অনেক কড়া। এত গাছ-গাছালি ছিল যে, সেখানে বঙ্গভবন হলেও বানরের উৎপাত ছিল গাছে গাছে। আজ আর ওসব এলাকায় প্রায়ই যাওয়া হয় না। একসময় পঁচিশের কালরাত্রিতে আশ্রয় নিয়েছিলাম দিলকুশা রোডে অবস্থিত সিমেন্স অফিসে, আমার এক জেঠাতো ভাই সেই অফিসে কাজ করতেন। পরদিন কারফিউ শিথিল হলে সুদূর ফেনীর উদ্দেশে হেঁটে রওনা হয়ে যাই। এসেছিলাম মার্চের শুরুতে। মার্চের ৭ তারিখ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে ফেনী ফিরে যাই। আবার এসে ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে আটকা পড়ি। তারপর বাড়ি ফিরে উত্তর দিকে উঁচু ভিটায় এক ব্যান্ডের রেডিওতে শুনি মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা। প্রথমে নিজের নামে দিলেও শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ঘোষণাটা দিয়েছিলেন। যে অর্থে জিয়া ভক্তরা তাকে স্বাধীনতার ঘোষক বলেন, সেই অর্থে কথাটা ষোলআনা সঠিক। তার সেই ঘোষণা মানুষকে হতবিহ্বল অবস্থা থেকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রত্যক্ষ প্রেরণা যুগিয়েছিল। পরে চাটগাঁর কালুরঘাট থেকে সেই ঘোষণা দেয়া হলেও সেটাই করের হাট হয়ে ফেনীর শুভপুরের রাস্তাধরে ভারতে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হিসেবে দেশ ও জাতির উদ্দীপনার একমাত্র কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। আর ছিল দু’টি কণ্ঠ, বিবিসি খ্যাত আতাউস সামাদ ও ভয়েস অব আমেরিকা খ্যাত ইকবাল বাহার চৌধুরীর।
শুরু করেছিলাম রমনা পার্ক নিয়ে। তারপর ঢাকার গাছ-গাছালি, তারপর লাট ভবন থেকে গভর্নর হাউজ ও বঙ্গভবন পর্যন্ত। বাস্তবতা ছিল ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে। গত সপ্তাহে রমনায় হাঁটছিলাম। হঠাৎ কানে এলো দু’জন প্রাতঃভ্রমণকারীর কণ্ঠ। তারা বলছিলেন, কোভিড-১৯ অনেক কিছু নিয়েছে। কি দিয়েছে সেই হিসাব পরে হবে। তবে এই সুযোগে দেশে দুটো শ্রেণী স্পষ্ট হয়েছে। একটা শ্রেণী দুর্নীতি করে আঙুল ফুলে কলাগাছ। আর একটা শ্রেণী নিঃস্ব হয়ে গেছে। আমার আজকের প্রসঙ্গ শ্রেণী বিভক্ত সমাজের অবস্থা নিয়ে। তাই ভূমিকায় কথার পিঠে নানা কথা চলে এলো। গত লেখায়ও বলেছি; কলাম লেখকদের বদাভ্যাসও বলতে পারেন। তারা ধান ভানতে শিবের গীত গায়। এটাই কলাম লেখকদের স্বাধীনতা।
বর্তমানে দেশে কার্যত শ্রেণী হিসাবে দু’টি শ্রেণীরই অস্তিত্ব চোখে পড়ে। একটি উচ্চবিত্ত, অন্যটি নিম্নবিত্ত। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দ্রুত যেন বিলুপ্তি ঘটছে। জানি না, মাও-লেনিনের সেই শ্রেণী সংগ্রামের দিকেই দেশ ছুটছে কি না। শাসক শ্রেণী মানে ধনিক শ্রেণী, ক্ষমতা মানে ধনিক শ্রেণীর মানুষ, তারাই ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছেন। এর বাইরে আছেন নিম্নবিত্ত, এরা যেন শাসিত হওয়ার জন্যই জন্ম নিয়েছেন। সমাজে সব সময় শ্রেণিবৈষম্য ছিল, কিন্তু এখনকার মতো এতটা উৎকটভাবে আগে কখনো চোখে পড়ত না। এক সময় ‘২২ পরিবার’ নিয়ে নানা কথা ছিল। অথচ তারাই ছিলেন দেশে শিল্প কারখানার মালিক। লক্ষ শ্রমিক তাদের কল কারখানায় শ্রম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
স্বাধীনতার পর সব কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত করার পর শুরু হলো আমাদের পাটশিল্পের ধস, চাপ পড়ল অসম প্রতিযোগিতার মুখে। চামড়া তো এখন ‘বোঝা’, অথচ পাট, চা, চামড়া ছিল আমাদের প্রধান রফতানি পণ্য। এখন পোশাক শিল্প দাঁড়াল বটে; কিন্তু মালিক শ্রমিক ব্যবধান পর্বততুল্য। মানবসম্পদ খাতে রেমিট্যান্স আসছে। শ্রমিক শোষণ বাড়ল হাজার গুণ।
মানবপাচার এখন অনেক ঝুঁকিতে রয়েছে। দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিক কর্মচারীর ঘামের পয়সায় আনা রেমিট্যান্স স্ফীত হচ্ছে। তার চেয়ে ঢের বেশি হচ্ছে শোষণ। এখানেও আদম ব্যাপারি আর শ্রমজীবী মানুষের কোনো তুলনাই চলে না। তার ওপর রয়েছে, সাগরপথে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে কত মানুষই না সর্বস্ব হারাচ্ছেন। জিম্মি হচ্ছেন তার চেয়ে বেশি। মৃত্যুর তো কোনো হিসাবই নেই। আদম ব্যাপারি এক এমপি এখন কুয়েত কারাগারে সাজা ভোগ করছেন। তার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকায় কেনা এমপিগিরি কোথায় গিয়ে ঠেকে সেটা তো পরের প্রশ্ন। দেশের এমপি বিদেশে মানবপাচারের জন্য অপরাধী সাব্যস্ত হলে দেশের ইজ্জত থাকে কোথায়? সারা বিশ্বে এ ধরনের কোনো নজির এর আগে কেউ কি শুনেছে? নিশ্চয়ই শোনেনি। এই এমপি স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন। তাকে আওয়ামী লীগ কিনে নিয়েছিল। এমন কি তার স্ত্রীও কেনা এমপি। এভাবেই ‘মনোনয়ন বাণিজ্য’ করা কতটা সততার পরিচায়ক? এ প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রীকে করে কোনো লাভ হবে না, কারণ খোদ তার কাছেও এর কোনো সদোত্তর নেই। দেশে পর্বততুল্য শ্রেণিবৈষম্য কি এভাবে সৃষ্টি হয়নি?
যাদের ঘর নেই তাদের ঘর দেয়া হচ্ছে। এটা দেশে একটি শুভ কাজের আলামত। অপর দিকে এরও তো প্রমাণ পাওয়া যায় দেশে অনেক মানুষ গৃহহীন ছিল, আছে। এটাই শ্রেণিবৈষম্যের বড় প্রমাণ। এখন সময় এসেছে, শুমারি করে বের করতে হবে কত লোক গৃহহীন অবস্থায় আছে। আর কী পরিমাণ মানুষ অট্টালিকায় বসবাস করে। এক শ্রেণীর মানুষ টাকা বিদেশে পাচার করেও দেশে বসে ভালো মানুষ সেজে ছড়ি ঘোরাচ্ছে। আর বিপুলসংখ্যক মানুষ শোষিত হয়ে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। এটা কোনো ভালো দেশের উপমা হতে পারে না। সুশাসনের তিল পরিমাণও যে দেশে অবশিষ্ট নেই, এটা তার উৎকৃষ্ট নমুনা।
যে দেশে গণতন্ত্র নেই, সে দেশে সুশাসন থাকবে কী করে? গণতন্ত্র না থাকলে দেশে আইনের শাসন কিভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব? কিভাবে বিচার বিভাগ, স্বাধীন থাকতে পারে? কিভাবে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জনগণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন? জবাবদিহিতার লেশমাত্র খুঁজে পাওয়া কিভাবে সম্ভব?
দেশে ‘চাটার দল’ এত বেশি যে, সব কিছু খেয়ে দেশটাকে ফোকলা বানিয়ে দিচ্ছে। অনেকেই বলেন, প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত সৎ ও নিষ্ঠাবান। মানলাম; কথাটা বিশ্বাসও করলাম। বঙ্গবন্ধু চাটার দলের গল্প শুনিয়েছিলেন। বাস্তবে গল্প নয়, তিক্ত সত্যই তিনি উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বিদেশের কাছে মান-সম্মান বিক্রি করে হাত পেতে আনি, আর ‘আমার লোকেরা’ তা খেয়ে ফেলে। কম্বল নিয়েও তিনি একটি তিক্ত সত্য কথা উচ্চারণ করেছিলেন। বর্তমান অবস্থায় টেকনিক পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু দুর্নীতির শ্রেণী চরিত্র একই রয়ে গেছে। মনোনয়ন বাণিজ্যের প্রশ্ন তুলে বিরোধী দলকে দূষে রাজনীতি জমজমাট করা যায়; কিন্তু বাস্তবতা কি সরকার ও সরকারি দল আড়াল করতে পারে?
দুর্নীতির লাগাম ধরে টানার হিম্মত কারো নেই। কারণ সারা অঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেবেন কোথা? বাস্তবে সৈয়দ মুস্তফা আলীর সেই বিখ্যাত সংলাপ, কুইনিন জ্বর সারাবে কিন্তু কুইনিন সারাবে কে? এই উপমা এখন আমাদের দেশের সব মানুষের চরিত্রের অংশ হয়ে গেছে। সরকার নিজেও জানে ভোটের নামে যা কিছু হচ্ছে তা একতরফা। বিরোধী দলের মুরোদের প্রশ্ন তুলে সান্ত্বনা পেতে পারেন কিন্তু আত্মগ্লানি মুক্ত হওয়ার মতো কোনো পথই খোলা রাখেননি। আপনারাই গাছের মগডালে উঠেছেন, আপনারাই মইটা সরিয়ে নিয়েছেন। এখন লাফ দিয়েও নামার পথও খোলা রাখার কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। আমরা জানি না, শ্রেণিবৈষম্য কমানোর কোনো ধন্বন্তরি আপনারা জানেন কি না। তবে আমাদের কাছে পথ সহজ এবং তা খোলা আছে। দেশে প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রের চাষাবাদ শুরু করে দিন। জবাবদিহিতা তাতেই নিশ্চিত হয়ে যাবে। বৈষম্য কমে আসবে। দুর্নীতির লাগাম ধরে টান দেয়ার প্রয়োজন পড়বে না।
গণতান্ত্রিক পরিবেশে মানুষ নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ পেলে ‘লোম বাছতে কম্বল উজাড়’ করতে হবে না। শুধু জবাবদিহিতার বিষয়টি নিশ্চিত করুন, নিজেরা নজির হয়ে যান। দেশ শনৈ শনৈ উন্নয়নের পথে চলবে। বর্তমানে উন্নয়ন আছে, তবে তা টেকসই কি না কেউ নিশ্চিত নয়। দেশে রডের পরিবর্তে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ‘উন্নয়ন’ হলে তা টেকসই হবে কিভাবে? বিরোধী দল ধোয়া তুলসী পাতা নয়। কিন্তু তাদের এখন দায়ী করে সান্ত্বনা পেতে পারেন; সব সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। হাফেজ্জি হুজুর ‘তওবার রাজনীতি’র কথা বলে অনেকের হাসির পাত্র হয়েছিলেন। কিন্তু তার কথার সারমর্ম কেউ বুঝতে পারেননি, কিংবা বুঝতে চেষ্টা করেননি। এখন আমাদের শাসকদের প্রকৃত অর্থে তওবার রাজনীতির মাজেজা বুঝতে হবে। ‘তওবা’র অর্থ ফিরে আসা; ভুলের স্বীকৃতি দেয়া, আর ভুল না করার প্রতিশ্রুতি দেয়া। বর্তমান শাসকরা অনেক দূর ভুলপথে হেঁটে ফেলেছেন। এবার তওবা করে অকপটে ভুলের স্বীকৃতি দিন, আর ভুল না করার প্রতিশ্রুতি দিন। রাজা ঠিক তো প্রজারা আপনাতেই ঠিক হয়ে যেতে বাধ্য।
বাংলাদেশে যেসব জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন হচ্ছে এর কোনোটি বাস্তবে নির্বাচন নয়। নির্বাচন কমিশন এক ধরনের ঠুটো জগন্নাথ, কোনো সততা নেই তাদের আচরণে ও কথাবার্তায়। এটা একজনের দোষ নয়। কমিশনার মাহবুব তালুকদার ভিন্ন সুরে কথা বলছেন বিবেকের তাড়নায়। তিনি পদত্যাগ করেন না কেন? হয়তো তার নিজস্ব কোনো ভাবনা রয়েছে। তিনি হয়তো ভেবেছেন, হোক না তিনি একা; তবুও তো সত্য উচ্চারণের একটা দৃষ্টান্ত অন্তত থাকুক। এর মাধ্যমে ব্যক্তি মাহবুব তালুকদার বাহবা পেতে পারেন। তবে এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের যে প্রাতিষ্ঠানিকতা সেটা দাঁড়াবে না। সঠিক নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিকতা জরুরি। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতাবলে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে হবে। মার্কিন নির্বাচনব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিকতায় পূর্ণ আস্থাশীল থাকার কারণে ট্রাম্পের এত পাগলামির পরও মার্কিন জনগণ নির্বাচন কমিশনের ওপর একচুল পরিমাণও আস্থা হারায়নি। ভারতের নির্বাচনব্যবস্থাও মোটামুটি প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে। কারণ তারা সংবিধানের অনুসরণে সামান্যতমও ছাড় দেন না বা এখনো দিচ্ছেন না। যদি কখনো এর ব্যত্যয় ঘটে যায়, তাহলে ভারত ইউনিয়ন কোনোভাবেই টিকে থাকবে না।
আরো উন্নত বিশ্বের কিছু দেশের উদাহরণ দেয়া সম্ভব, তারা নির্বাচন ব্যবস্থার কোনো ম্যানিপুলেশন হতে দিচ্ছে না। ইরানের ভোট ব্যবস্থাও স্বচ্ছ। নির্বাচন কারা করতে পারবে কিংবা পারবে না সে জন্য সাংবিধানিক একটি ব্যবস্থা রয়েছে। অনেক মানুষ সেটা নিয়ে হয়তো ভিন্নমত দিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু ইরানের শত্রুরাও নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন না।
আমাদের অবস্থা একেবারেই উল্টো। কাগজ-কলমে ও সংবিধানে সব ঠিকঠাক আছে; কিন্তু দলীয় রাজনীতির স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু থাকার কারণে কোনো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানই প্রাতিষ্ঠানিকতা পাচ্ছে না। কারণ স্বৈরতন্ত্রে স্বেচ্ছাতন্ত্র চালু হয়, তাই দলীয় লোকজন ছাড়া কোথাও কোনো কাজ হয় না। এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে শ্রেণিবৈষম্য কোনো দিন দূর হবে না। সেবা কিনতে হবে, বিচার পাবেন না। দলতন্ত্র এমন এক ব্যবস্থা যিনি দেশের নির্বাহী প্রধান হন তার অঙ্গুলির হেলনে সব কিছু চলে। তিনি মানুষ। আর আমরা তার পেছনের অংশও দেখতে পাই না। একজন কিভাবে সব কিছু সামাল দেবেন? এতে সব রক্ত মাথায় উঠে একসময় তিনি হয়তো অপঘাতে বিদায় নিতে বাধ্য।
সীমাহীন দুর্নীতি দেশে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বাড়াবে। শুধু শ্রেণিবৈষম্য বাড়বে না। একে একে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, এমনকি বেসরকারি খাতও তখন বেপরোয়া হয়ে উঠতে বাধ্য। তাই খাদে পড়ে যাওয়া সংবিধানকে টেনে তুলুন। তা ষোলো আনা অনুসরণ করুন। দেখবেন, ধীরে ধীরে সব কিছু ঠিক হয়ে যাচ্ছে। যা কিছু সমস্যা বাকি থাকবে তা মানবিক দুর্বলতার একটা সীমাহীনতা মাত্র।
আসুন, অক্ষরে অক্ষরে সবাই সংবিধান অনুসরণ করি। আন্তরিকভাবে তওবা করে তারপর করণীয় নির্ধারণ করি। দেশের ও দশের কথা ভাবি। ক্ষমতা আল্লাহ তায়ালাই দেন, আবার কেড়েও নেন। আমরা শাসক ও শাসিত কেউ এর ঊর্ধ্বে নই। এই কলামের নাম ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’। তাই নানা প্রসঙ্গ আলোচনায় উঠে আসে। প্রথমত, বায়ুদূষণ ঠেকান, শ্রেণিবৈষম্য কমান, গণতন্ত্রের চাষবাস শুরু করুন, নির্বাচন ব্যবস্থাকে মানে তুলুন। দেশের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে চলতে দিন, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করুন। সর্বোপরি জনগণকে মর্যাদা দিন, তাদের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিন, প্রয়োজনে আগাম নির্বাচন দিয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করুন। জনগণের স্বাধীনভাবে দেয়া রায় মেনে নিতে প্রতিশ্রুতি দিন। নিশ্চয়ই দেশ আবার গণতন্ত্রের সুবাতাস দেখে আশাবাদী হয়ে উঠবে। ‘কল্যাণ রাষ্ট্রে’র ধারণাও বাস্তবতা পাবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা