২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
আল কুরআনের অর্থনীতি : ১৪

অভাবগ্রস্তদের দুঃখ দূর করা

-

এবং আল্লাহর ভালবাসার মিসকিন, ইয়াতিম ও কয়েদিকে যারা খাওয়ায় আর তাদেরকে বলে- “কেবল আল্লাহর জন্যই তোমাদেরকে খাওয়াচ্ছি এবং তোমাদের নিকট হতে কোনো প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা চাই না।” (সূরা দাহর ৮-৯)।

তাফসিরকারদের আলোচনা : মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী এ দুটি আয়াতের তাফসিরে লিখেছেন :
মূলের শব্দ হলো (আলা-হুব্বিহি) বহুসংখ্যক তাফসিরকার এর তাৎপর্য করেছেন। খাবারের প্রতি তাদের মনের আকর্ষণ, লোভ এবং নিজেদের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তারা এই লোকদের খাওয়ায়। ইবনে আব্বাস ও মুজাহিদ বলেন, দরিদ্র লোকদিগকে খাওয়ানোর আগ্রহ ও উৎসাহে তারা এ কাজ করে থাকে। আর হজরত ফুজাইল ইবন আয়াজ ও আবূ মাসুদ দারানী বলেন, ‘তারা আল্লাহর ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এরূপ করে।’ আমাদের দৃষ্টিতে, এটাই ঠিক। এর পরবর্তী বাক্য ‘আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তোমাদের খাওয়াই’-এ কথা সমর্থন করে। (তাফহিমুল কুরআন, সূরা দাহর, টীকা ১১) তিনি আরো লিখেছেন, আলোচ্য আয়াতে ‘কয়েদি বলতে যেকোনো বন্দীকেই বোঝায়, সে কাফির হোক কিংবা মুসলমান, যুদ্ধবন্দী হোক কিংবা কোনো অপরাধের কারণে বন্দী। (প্রাগুক্ত, টীকা নং ১২)

মুফতি মুহাম্মদ শফী (রহ:) লিখেছেন : উপরে বর্ণিত সৎ লোকদের গুণাবলির মধ্যে এটাও অন্যতম গুণ যে, তারা নিঃস্ব, ইয়াতিম ও বন্দীদের খাদ্য দান করেন। আয়াতে শব্দটির অর্থ ‘মা’আলা’ অর্থাৎ সত্ত্বেও। মর্মকথা হল, তারা নিঃস্বার্থে খাদ্য দান করে থাকেন, যদিও এ খাদ্যে তাদের আসক্তি ও ভালোবাসা আছে। শুধু তাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার প্রদান করেন- এমন নয়। দরিদ্র ও ইয়াতিমদের খাওয়ানো সওয়াবের কাজ এবং ইবাদত বলে প্রকাশ্যেই বোঝা যায়। বন্দীদের ব্যাপারে এমন কাজও ইবাদত। কেননা, বন্দী- সে মুসলিম হোক বা কাফির- তাকে সাহায্য করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যদি কেউ ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য করে তাও সওয়াব হবে। কেননা ইসলামের প্রাথমিক যুগে বন্দীদের খাওয়ানো ও সংরক্ষণ করার কাজ সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে বণ্টন করা হতো। যেমন ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের বন্দীদের সাথে এ রূপ করা হয়েছে। (প্রাগুক্ত, পৃ ৬৩৮)

আর্থ সামাজিক তাৎপর্য : সূরা দাহরের শুরুতে বলা হয়েছে যে, মানুষ তার জীবনের শুরুতে কিছুই ছিল না এবং ক্রমে সে শ্রবণ ও দৃষ্টিসম্পন্ন মানবে পরিণত হয়। আল্লাহ তাকে পথ প্রদর্শন করেছেন; তার মন চাইলে শোকরগুজার বান্দা হিসেবে আল্লাহর পথে চলতে পারে অথবা অকৃতজ্ঞ কাফির হতে পারে। তারপর কাফিরদের শাস্তি এবং সৎকর্মশীলদের গুণাবলীর পর্যায়ে আলোচ্য আয়াত দুটিতে কেবল আল্লাহর ভালোবাসা ও সন্তুষ্টির জন্য মিসকিন, ইয়াতিম ও কয়েদিদের খাওয়াতে বলা হয়েছে।

ইয়াতিম ও মিসকিনদের প্রতি খেয়াল রাখা এবং তাদের অভাব-দারিদ্র্য ও অসুবিধা দূর করার কথা কুরআনের বহু স্থানে বলা হয়েছে। কয়েদিদের কথাও আয়াতে বিশেষভাবে বলা হয়েছে। কুরআনে যে অথনৈতিক নীতিমালা পাওয়া যায় তার অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে, অভাবগ্রস্ত জনসমষ্টির অভাব ও দুঃখ দূর করা। এ প্রসঙ্গে সূরা কাসাসে একটি ব্যাপক নীতি বর্ণিত হয়েছে- আমি ইচ্ছা করলাম যে, যারা দুনিয়াতে নির্যাতিত তাদের প্রতি মেহরবানি করব, তাদের নেতৃত্ব দান করব, তাদেরকে দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠিত করব এবং তাদেরকে উত্তরাধিকারী বানাব (সূরা কাসাস : ৫)।

আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা কার্যকর করা প্রত্যেক মুমিনের দায়িত্ব। সূরা দাহরের এ আয়াতদ্বয়েও ওই মূলনীতির ব্যাখ্যা রয়েছে। এই নীতি কার্যকর করা ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এ দুটি আয়াতে ইসলামের ন্যায়নীতির একটি দিক পাওয়া যায়। মুসলমানদের ব্যয় আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার কারণে হতে হবে। ব্যয়ের অন্যান্য লক্ষ্য যেমন, সেগুলোর ওপরে থাকতে হবে আল্লাহর জন্য ভালোবাসা। অর্থাৎ, যাতে আল্লাহর মর্জি নেই, এমন কাজে ব্যয় করা যাবে না। তেমনিভাবে ইসলামী সমাজে ব্যক্তি ও সরকারকে এমন অনেক ব্যয় করতে হবে, যা আপাতঃদৃষ্টিতে লাভজনক নয়, কিন্তু যা করা মানবকল্যাণের দাবি।

বস্তুত ইসলামী অর্থনীতির মূল বৈশিষ্ট্য এই যে- এটা এমন একটি Comprehensive, যেখানে অর্থনীতির যাবতীয় বিষয় অর্থনৈতিকভাবে সুসমন্বিত করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ার উৎপাদন প্রক্রিয়া (Production Process) এর সাথে যারা প্রাকৃতিক ও সামাজিক কারণে সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছেন, তাদের আবার এ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত করার জন্য বিভিন্ন পন্থা গৃহীত হয়েছে। দান-সাদকা, জাকাত ইত্যাদির মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদেরকে সক্ষম করে তোলার প্রচেষ্টা চালানো হয়। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে এ বিষয়ে নানাভাবে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। আলোচ্য আয়াতদ্বয়েও একইভাবে তা করা হয়েছে। সুতরাং, এ আয়াতদ্বয়ের বাহ্যিক রূপ আধ্যাত্মিক হলেও সমষ্টির দিক দিয়ে এগুলো অবশ্যই অর্থনৈতিকভাবে তাৎপর্যবহ। (এই সিরিজটি সমাপ্ত হলো)

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার।


আরো সংবাদ



premium cement