২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ইতিহাসের শিক্ষা আমলে নিন

ইতিহাসের শিক্ষা আমলে নিন - নয়া দিগন্ত

বিচার বিভাগের স্থবিরতা ও দক্ষতার অভাবে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি, তা আমরা যেন অতিক্রম করতে পারছি না। অথচ বিচারবহির্ভূত হত্যা থামছে না। প্রথম বিচারহীন হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার পরপরই। জাসদ, সর্বহারা ও বিভিন্ন চরমপন্থীকে বিচারের আওতায় না এনেই হত্যা করা হয়েছে। সিরাজ সিকদার হত্যা নিয়ে অনেকেই কথা বলেন, কিন্তু জাসদের ৩০ হাজার ক্যাডার হত্যার কথা এখন কেউ উচ্চারণ করেন না। তার পরও বিচারবহির্ভূত হত্যা থেমে থাকেনি। এর কারণ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ এর প্রকৃত কারণ খতিয়ে দেখার কারণ চিহ্নিত করছেন না। কেউ ভাবেন, এটি আমাদের বিকৃত মানসিকতার ফসল। কারো ভাবনায়, নিছক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার একটা অপকৌশল। তাৎক্ষণিক এর সুফল মিললেও শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্টরা কেউ রেহাই পাবেন না। আখেরাতে তো নয়ই।

এখন বলা হচ্ছে, বেগম খালেদা জিয়া ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নাম দিয়ে যে অপকর্মটি শুরু করেছিলেন, তার সেই র‌্যাব এখন শুধু দুর্বিনীত হয়ে ওঠেনি; কয়েক গুণ বেশি মাত্রায় গুম, খুন ও হত্যা করে চলেছে। এখন অতীত ম্লান হয়ে গেছে। যখন অপারেশন ক্লিনহার্ট শুরু করা হয়েছিল তখন অনেকেই বাহবা দিয়েছিলেন। আমরা কিন্তু বাহবা দিতে পারিনি। সেদিনও বলেছিলাম, এর পরিণতি ভালো হবে না। যারা এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তারাও এর শিকার। আমাদের বক্তব্য ছিল সহজ : পৃথিবীর কোনো সংবিধান, ধর্ম, মানবাধিকার ও আইন বিচারবহির্ভূত হত্যাকে সমর্থন করে না। আল্লাহ মানুষকে ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি’ বলে অভিহিত করেছেন। একজন মানুষকে বিনাবিচারে হত্যা করাকে সমগ্র মানবজাতিকে হত্যার শামিল বলা হয়েছে। ইসলামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকে কোনোভাবেই বৈধতা দেয়া হয় না। অন্য সব ধর্মও বিচারবহির্ভূত হত্যাকে মহাপাপ বলেছে। জনগণ মনে করে, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার ও বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে যেসব গল্প শোনানো হয়, সবই হত্যা ও বিচারবহির্ভূত হত্যা। বিচারবহির্ভূত হত্যাকে বৈধতা দেয়ার অপকৌশল জনগণ বোঝে। যে দেশে পুলিশ ইয়াবা, মাদক ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের গল্প শোনায় ও সাজায়, তার কোনো কিছুই জনগণের বিশ্বাসযোগ্য হয় না।

আমরা স্বল্প স্মৃতির মানুষ, যখন একটা চাঞ্চল্যকর হত্যার ঘটনা ঘটে তখন আমরা সরব হই। আবার সময়ের ব্যবধানে ভুলে যাই। এটাই মানুষের সীমাবদ্ধতা। অব: মেজর সিনহা হত্যা নিয়ে কত তোলপাড় হলো, এরই মধ্যে আমরা ভুলে গেছি। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। একই ভাবে চৌধুরী আলম, ইলিয়াস আলীরা কোথায় আছেন আমরা কেউ জানি না, সাগর-রুনি হত্যার কোনো বিচার হলো না। বছরের পর বছর তাদের হত্যার তদন্ত প্রতিবেদনটি পর্যন্ত দেয়া সম্ভব হয়নি। এ জন্য প্রায় ৮০ বারের মতো সময় নেয়া হয়েছে। তার পরও তদন্ত শেষ হয় না। এটি বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। এটি যেন মর্মান্তিক প্রহসন।

মানুষের জীবন নিয়ে এভাবে হেঁয়ালি ও তামাশা হলেও জনগণ ঠিক বার্তাটিই পায়; কিন্তু সরকার ভাবে জনগণ আহাম্মক। ঠিক একই পদ্ধতিতে আরো অসংখ্য হত্যা খুন গুম নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে কিন্তু জবাব দেবেন কে? জবাবদিহিতার এ অভাবের শেষ কখন হবে, কেউ জানে না। তবে সব কিছুর শেষ আছে। এর পরিণতিও অপেক্ষমাণ। এ ধ্রুব সত্যটি সরকার ভুলে থাকতে পারে; কিন্তু জনগণ কিছুই ভোলে না।

বিনাবিচারে মানুষ হত্যা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার আরশকেও স্পর্শ করে। তাই মানুষের আদালত সব কিছু এড়াতে পারে; কিন্তু সৃষ্টিকর্তার বিচার এড়ানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই শাসক চক্রকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার দায়বোধ থেকে আমরা বারবার লিখছি। এটি আমরা মনে করি, আমাদের দায়বোধ। এ দায়মুক্তির জন্য আমাদের যেটুকু সামর্থ্য আছে সেটুকু করাই কর্তব্য বলে বিবেচনা করি। তা ছাড়া জন্ম মৃত্যুর ফয়সালা জমিনে হয় না, আসমানেই হয়। এ কথা সব কর্তৃপক্ষের স্মরণে থাকা জরুরি।

একজন বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদের বক্তব্য শুনছিলাম, যিনি সরকারি ঘরানার লোক হিসেবে পরিচিত। তার উদ্বেগ, এ সমাজটা পচে গেছে। রাজনীতি পচে গেছে। তাই কসমেটিক উন্নয়নের আড়ালে যে নিষ্ঠুর সত্যটি লুকিয়ে আছে সেটিই একসময় পুরো সমাজটাকে গ্রাস করবে। তিনি সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে দিচ্ছেন- পরিণতি নিয়ে ভাবুন, নয়তো প্রকৃতি প্রতিশোধ নেবে এবং সেই সময় অনেক দূরে নয়। ক্ষমতাসীন বিষয়টি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়; একসময় দেখা যাবে সব শেষ। একটা সত্য উদ্ভাবন করা ভালো। সিনহা হত্যার পর সমাজ যখন ফুঁসে উঠল, তখন থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যা প্রকাশ্যে হচ্ছে না, কিন্তু এটাই শেষ ঘটনা- এ নিশ্চয়তা কে দেবেন?

উন্নয়ন যে হচ্ছে না তা কিন্তু নয়; তবে মানবিক বোধ ও নীতি নৈতিকতার যে ধস নেমেছে, এটি রোধ করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা আইয়ুব খানের ‘উন্নয়নের দশক’ দেখেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইয়ুব টিকে থাকতে পারেননি। ইয়াহিয়া খানও টিকে থাকতে পারেননি।

‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়ে মনে হয়েছে- তিনি সত্য আড়াল করতে চাননি, স্বাধীনতার পর তার আত্মগ্লানি মাখা বক্তব্যগুলো এখনো কানে বাজে। দুর্ভাগ্য তার রাজনৈতিক জীবন থেকে কেউ শিক্ষা নিচ্ছে না। তার ভাস্কর্য নিয়ে আলোচনা হয়, তার জীবনের একটা দিক নিয়ে ভাবা হয়, প্রচার করা হয়; অথচ খণ্ডিত জীবনী চর্চা কোনো ধরনের সততা হতে পারে না।

আজ সোহরাওয়ার্দী নিয়ে কোনো আলোচনা নেই, শেরেবাংলার বিষয়টি তোলা হয় না, ভাসানী উপেক্ষিত। ‘স্বাধীনতার চেতনা’র কথা বলা হয় অথচ স্বাধীনতার পুরো ইতিহাস নিয়ে ভাবা হয় না। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে জেনেছি, ইতিহাসে যার যতটুকু প্রাপ্য তাকে ততটুকু পাইয়ে দিতে হয়, নয়তো ইতিহাস ক্ষমা করে না। শাসকদের ফরমায়েশি ইতিহাস চর্চা ক্ষমতার চেয়ার পাল্টে গেলে আর টিকে থাকে না; ইতিহাসের সবটুকু সত্য আবার সামনে এসে দাঁড়ায়। ইতিহাসের এই শিক্ষা কোনো শাসক মানতে চান না। এ সত্যটুকু ক্ষমতার দম্ভে অস্বীকার করা যায়; কিন্তু ইতিহাস চেপে রাখার মতো বিষয় নয়।

আজ শাসকশ্রেণী ও ক্ষমতাবানদের স্মরণ করিয়ে দেয়ার দায়বোধ থেকে বলছি, সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ান, নয়তো শেষ রক্ষা হবে না।

শুরু করেছিলাম বিচারবহির্ভূত হত্যা, খুন, গুম ও নানা ধরনের প্রহসন নিয়ে, অথচ এখনো নির্বাচন নিয়ে প্রসহন চলছে, বিচার নিয়ে বেশি কথা না বলাই উত্তম। কারণ বিচার বিভাগ দু’ধারী করাতের মতো। পক্ষে হলে কোনো কথা নেই, বিপক্ষে নয় শুধু সত্য উচ্চারণ করলেই জবাই হয়ে যেতে হবে। তাই বিচারের নামে যত অবিচারই হোক, মানুষকে বোবা হয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। দুর্নীতির সর্বগ্রাসী রূপ দেখেও জনগণের টুঁ শব্দ করার কোনো সুযোগ নেই। চুন থেকে নুন খসলেই আর রক্ষা নেই। অথচ দুর্নীতির যে প্লাবন চলছে তা রোধ করার কোনো উদ্যোগ নেই। জিরো টলারেন্স বক্তব্যের ভাষা। কথার কথা। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। সমস্যা হচ্ছে ‘সারা অঙ্গে ব্যথা ঔষধ দেবো কোথায়’।

শেষ করার আগে আরো একবার স্মরণ করিয়ে দেবো, সময় থাকতে নিজেদের দৈত্য নিজেরা থামান, অন্যথায় প্রকৃতির নিয়তি শেষ রক্ষা হতে দেবে না। অতীতে অনেক জাঁদরেল শাসক, রাজা-বাদশাহ শেষ পরিণতি ঠেকাতে পারেননি। জনগণ হয়তো আজ অক্ষম রাস্তায় নামতে সাহস পায় না, শেষ পর্যন্ত ছাত্র-জনতার অপ্রতিরোধ্য জোয়ার ঠেকানো সম্ভব হবে না। ইতিহাসের এই শিক্ষাটুকু এবার অন্তত ভেবে দেখুন।

masud2151@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement