২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
আল-কুরআনে অর্থনীতি : ১৩

ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামো

-

‘তারা এমন লোক, যাদেরকে আমরা যদি জমিনে ক্ষমতা দান করি, তবে তারা সালাম কায়েম করবে, জাকাত দেবে, যাবতীয় ভালো কাজের হুকুম দেবে এবং যাবতীয় অন্যায় কাজে নিষেধ করবে। আর সব বিষয়ের চূড়ান্ত পরিণাম আল্লাহর হাতে।’ (সূরা হজ্জ-৪১)

সূরা হজ্জের ষষ্ঠ রুকু শুরু হয়েছে এর ৩৯ নং আয়াত থেকে। রুকুর শুরুতে কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এটি ছিল মদিনায় হিজরতের পর কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সর্বপ্রথম অনুমতি। বলা হয়েছে, ‘যারা নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বহিষ্কৃত হয়েছে এবং যাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে, তাদেরকে যুদ্ধ করার অনুমতি দেয়া হলো।’ তারপর যুদ্ধসংক্রান্ত আল্লাহর একটি মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে, ‘যদি আল্লাহ এক দল অন্য দলের প্রতিরোধের ব্যবস্থা না করতেন তা হলে মসজিদ, গির্জা, উপাসনালয় সবই চুরমার করে দেয়া হতো।’ যুদ্ধ সংঘটনের এই কারণেই পূর্ববর্তী নবী ও উম্মতকে কাফিরদের মোকাবেলা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। এরূপ না করা হলে কোনো মাজহাব ও ধর্মেরই অস্তিত্ব থাকত না। ইতোমধ্যে হিজরতের পর নবী করিম সা:-এর নেতৃত্বে মদিনা সনদের মাধ্যমে কার্যত মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। এই ভিত্তিকে আরো সংহত এবং যত দূর সম্ভব বিস্তৃত করার সুযোগ দানের জন্য প্রয়োজনে যুদ্ধ করার অনুমতিও দেয়া হলো। এখন ইসলামী রাষ্ট্রের কী দায়িত্ব হবে, তার ওপর আলোকপাত করা প্রয়োজন। তাই দেখা যাচ্ছে, ৪১ নং আয়াতে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদি দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

তাফসিরবিদদের আলোচনা
মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ:) লিখেছেন, আগেই বলা হয়েছে, এই আয়াত মদিনায় হিজরতের অব্যবহিত পরে তখন অবতীর্ণ হয়, যখন মুসলমানদের কোথাও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাদের সম্পর্কে আগেই বলে দিলেন যে, তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভ করলে তা ধর্মের উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদনে ব্যবহার করবে। এ কারণে হজরত ওসমান রা: বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালার এই ইরশাদ কর্ম অস্তিত্ব লাভ করার আগেই কর্মীদের জন্য এই নিশ্চিত সংবাদ দুনিয়াতে বাস্তব রূপ লাভ করেছে।’ খোলাফায়ে রাশেদিন ও মুহাজিররা এ আয়াতের বিশুদ্ধ প্রতিচ্ছবি ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁদেরকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রদান করলেন এবং কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণীর অনুরূপ তাদের কর্ম ও স্ফীতি বিশ^বাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন, তারা তাদের ক্ষমতা এ কাজেই ব্যবহার করে থাকে। জাকাতের ব্যবস্থা সুদৃঢ় করে, সৎ কাজের প্রবর্তন করে এবং মন্দ কাজের পথ রুদ্ধ করে দেয়। এ কারণেই আলেমরা বলেন, এই আয়াত সাক্ষ্য দেয়, খোলাফায়ে রাশেদিন সবাই এই সুসংবাদের যোগ্য পাত্র ছিলেন এবং তাঁদের আগমনে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল তা সত্য, সঠিক, আল্লাহর ইচ্ছা, সন্তুষ্টি ও আগমন সংবাদের অনুরূপ ছিল। (রুহুল মাআনি)

এ হচ্ছে আলোচ্য আয়াতের শানে নুজুলভিত্তিক দিক। কিন্তু বলা বাহুল্য, কুরআনের ভাষা ব্যাপক হলে কোনো বিশেষ ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং নির্দেশও ব্যাপক হয়ে যায়, এ কারণেই তাফসিরবিদ দাহহক বলেন, এ আয়াতে তাদের জন্যই নির্দেশ রয়েছে, যাদের আল্লাহ তায়ালা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন করে থাকেন। ক্ষমতাসীন থাকাকালে তাদের এমন সব কাজ আঞ্জাম দেয়া উচিত, যেগুলো খোলাফায়ে রাশেদিন তাদের জামানায় আনজাম দিয়েছিলেন। (কুরতুবি) (মুফতি শফি (রহ:) তাফসিরে মাআরেফুল কুরআন, ষষ্ঠ খণ্ড, সূরা হজ্জের তাফসির অংশ থেকে)

মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী এ আয়াতের তাফসিরে লিখেছেন, তাঁর (আল্লাহর) সাহায্য ও অনুগ্রহ লাভের অধিকারী লোকের গুণাবলি এই যে, তাদেরকে দুনিয়ায় শাসনক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দান করা হলে তাদের ব্যক্তিগত চরিত্র আল্লাহদ্রোহিতা ও নাফরমানি এবং অহঙ্কার ও গৌরবের পরিবর্তে এমন হবে যে, তারা সালাত কায়েম করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, তাদের ধন-সম্পদ বিলাসিতা, জাঁকজমক ও নফসের দাসত্বের কাজে ব্যয় হওয়ার পরিবর্তে জাকাত দানে ব্যয় হবে, তাদের সরকার যাবতীয় ন্যায় কাজকে দমন করার পরিবর্তে তার বিকাশ ও উৎকর্য সাধনে নিয়োজিত হবে। তাদের ক্ষমতা অন্যায় ও পাপকে বিস্তার করার পরিবর্তে তা দমন করার কাজে ব্যবহৃত হবে। বস্তুত এই একটি বাক্যে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার লক্ষ্য এবং তারা কর্মধারা ও কর্মচারীদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মূল কথা বলে দেয়া হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র মূলত কী ধরনের রাষ্ট্র, তা কেউ বুঝতে চাইলে এই একটি আয়াত হতেই বুঝতে পারেন। (তাফহিমুল কুরআন, সূরা হজ্জের ৮৫ নং টীকা)

অর্থনৈতিক তাৎপর্য
ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামো সম্পর্কে এ আয়াতে মূলনীতি এবং দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে জাকাত কায়েম করা। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আগেই করা হয়েছে। অন্য দিকে এ আয়াতে মারুফের প্রতিষ্ঠা ও মুনকারকে নির্মূল করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মারুফ বা সুনীতি এবং মুনকার বা দুর্নীতি শব্দ দু’টির ব্যাপক নৈতিক সামাজিক, আন্তর্জাতিক ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে আমরু বিল মারুফের সঠিক প্রয়োগের অর্থ হবে সর্ববিধ উপায়ে সুবিচারমূলক অর্থনীতি গড়ে তোলা এবং নাহি আনিল মুনকারের তাৎপর্য অর্থনৈতিক অবিচারের সব উপায় ও পন্থা বন্ধ করা। অর্থনৈতিক সুবিচার কায়েম ও জুলুমের অবসানের জন্য রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় সব আইন তৈরি করতে পারে এবং তার প্রয়োজনীয় আইনগত ক্ষমতা কুরআনের এ আয়াতে ইসলামী সরকারকে প্রদান করা হয়েছে। অবশ্য কী ধরনের পন্থা ও উপায়ে জুলুম চিহ্নিত করা হবে তা নির্ভর করবে ইসলামী রাষ্ট্রের পার্লামেন্টের ওপর। এ ক্ষমতা প্রয়োগ করে ইসলামী সরকার সব ধরনের মুনাফাখোরি, মজুদদারি, কার্টেল, মনোপলি ইত্যাদি বন্ধ করে দিতে পারে।

প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় শরিয়াহ ও ইসলামী আইনের লক্ষ্য সম্পর্কে ইমাম ইবনুল কাইয়্যেমের মতামত উল্লেখ করা হলো- আল্লাহ তায়ালার সব নবী পাঠানো ও কিতাব নাজিল করার উদ্দেশ্য ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা, যা গোটা সৃষ্টির মূলনীতি। আল্লাহর নাজিল করা প্রতিটি বিষয় এ কথা প্রমাণ করে যে, এসবের সত্যিকার উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্য ও ইনসাফ এবং ভারসাম্যপূর্ণ জীবন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা।

আমরা তাই ন্যায়সঙ্গত সরকারি নীতি ও আইনকে শরিয়তের অংশ মনে করি; শরিয়তের বরখেলাফ হওয়া মনে করি না। এসবকে ‘রাজনৈতিক নীতি’ বলা কেবল পরিভাষার ব্যাপার। আসলে এগুলো শরিয়তেরই অংশ। তবে শর্ত এই যে, এগুলোকে ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। (ইলাম আল মুআক্কিন, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩০৯-১১)

ইবনুল কাইয়্যেমের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘ইসলামের উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবনের প্রতিটি বিভাগে ইনসাফ কায়েম করা।’ আলোচ্য আয়াতে অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইনসাফ কায়েম করার বিষয়টি ইসলামী সরকারের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করা হয়েছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে কিভাবে ইনসাফকে বাস্তবায়ন করা হবে, তা বিস্তৃত নীতি ও পদ্ধতি উদ্ভাবনের ব্যাপার। এই বিস্তৃত নীতিমালার পরিধি হিসেবে বলে দেয়া হচ্ছে- যাবতীয় সৎ, সাবলীল ও উত্তম পদ্ধতি ও কর্মগুলো সর্বোত্তম পন্থায় প্রতিষ্ঠা করা এবং সর্বপ্রকার না-হক অসৎ, বাতিল ও বে-ইনসাফি, জুলুম, অপচয় ইত্যাদি উৎখাত ও বর্জন করা। অর্থনীতির ক্ষেত্রে মারুফ প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হিসেবে জাকাতের উল্লেখ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

এ আয়াতে ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণাও নিহিত রয়েছে বলা যায়। একটি কল্যাণরাষ্ট্র সংগঠনে শুধু অর্থনৈতিক নীতি যথেষ্ট নয়। এ জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের আনুকূল্য। সালাত কায়েমের কথা বলে এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার


আরো সংবাদ



premium cement