নির্মাণশ্রমিকদের বঞ্চনা
- মুজতাহিদ ফারুকী
- ১৯ জানুয়ারি ২০২১, ২০:৫২, আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২১, ২০:৫৪
প্রতি বছর শ্রমিক দিবস অর্থাৎ ১ মে তারিখে বাংলাদেশের প্রতিটি প্রধান দৈনিকে প্রায় অভিন্ন একটি ছবি ছাপা হয়। সেটি একজন পুরুষ বা নারী শ্রমিকের ঘর্মাক্ত কলেবরে কঠিন শ্রম দেয়ার ছবি। হয়তো অনেক ইট নিয়ে নির্মাণাধীন ভবনের উপরের তলায় নিয়ে যাচ্ছেন, সড়ক নির্মাণকাজে সবল হাতে গাঁইতি চালাচ্ছে, অথবা কোনো নারীশ্রমিক কোলে স্তন্যপানরত সন্তান নিয়ে ইট ভেঙে চলেছেন- এমনই সব ছবি। প্রায়শ ছবিটি রঙিন এবং বিশেষ যত্নে তোলা। যেন শ্রমিকের শরীরের ঘামটুকু স্পষ্ট করে বোঝা যায়, যেন তার হাতের বা পায়ের বা পিঠের পেশি দর্শকের চোখে সহজে ধরা পড়ে। ছবিটি দেখেই যেন মানুষের মনে সমবেদনার একটি অভিঘাত সৃষ্টি হয়; যেন তিনি নিজের মনেই বলে ওঠেন, আহা, কী কষ্ট এদের! এটাই ‘ফ্যাশন’। অনেক পুরনো। কিন্তু চলছে আজো। সাথে থাকে একটি প্রতিবেদন যাতে শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে কিছুটা হা-হুতাশ, কিছুটা দয়ামায়া দেখানোর চেষ্টা থাকে। ওই একদিনই। সারা বছরে শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে কেউ আর কোনো উচ্চবাচ্য করে না। আমরা সাংবাদিকরা প্রতিটি বিষয়ে নিত্যনতুন ধারণা সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করলেও মে দিবসের ছবির ক্ষেত্রে নতুন কিছু যেন ভাবতে পারি না। একজন নির্মাণশ্রমিক মে দিবসে ছুটি পেয়ে স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে নিজের গাড়িতে করে কোথাও বেড়াতে গেছেন এবং সেই হাস্যোজ্জ্বল সুখী পারিবারিক ছবি ছেপে আমরা ক্যাপশন দিচ্ছি, ‘ছুটির দিনে আনন্দভ্রমণে জনৈক নির্মাণশ্রমিকের পরিবার।’ এমনটা কি বর্তমান বাংলাদেশে কল্পনা করাও সম্ভব?
এই পর্যন্ত লিখে, সত্যি বলছি, কল্পনাটি আমার নিজের কাছেও বড় বেশি অবাস্তব এবং বিদ্যুৎবিহীন মধ্য দুপুরে ঘামেভেজা ঘুমের ঘোরে দেখা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। কারণ, নির্মাণশ্রমিকদের জীবনের বর্তমান তিক্ত বাস্তবতা। দেশে নির্মাণশ্রমিক ৩৮ থেকে ৪০ লাখ। এর মধ্যে প্রবাসী শ্রমিকদের ধরলে সংখ্যাটা ৮০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। তারা চিরকাল বঞ্চিত। আছে মজুরি বৈষম্য। আছে শোষণের নানা কৌশল। তাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। অনেক সময়ই প্রাণ হাতে নিয়ে চরম ঝুঁকির মধ্যে তাদের কাজ করতে হয়। কিছু আইনকানুন খাতাপত্রে আছে বটে কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রয়োগ নেই বললেই চলে। প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে নির্মাণকাজে শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর সংবাদ থাকে। হয়তো নির্মাণাধীন কোনো স্থাপনার ছাদ ধসে পড়ে, হয়তো কোনো রকম সেফটি গার্ড ছাড়াই অনেক উঁচুতে ঝুলন্ত অবস্থায় কাজ করতে গিয়ে দড়ি ছিঁড়ে অথবা অসাবধানতার কারণে নিচে পড়ে যাওয়া, কিংবা নিচ থেকে মালামাল ওপরে তুলতে গিয়ে দড়ি ছিঁড়ে নিচে পড়ে অনেকেই প্রাণ হারাচ্ছেন। ভবন ভাঙতে গিয়ে দুর্ঘটনাক্রমে আগুন লেগে একসাথে অনেক শ্রমিকের মৃত্যুর খবর তো আমাদের স্মৃতি থেকে এখনো মুছে যায়নি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিআইএলএস) তথ্য মতে, গত ছয় বছরে রাজধানী ঢাকায় কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৬২০ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন ৫৭৮ জন। তাদের মধ্যে অনেকেই পঙ্গু জীবন-যাপন করছেন। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ৬১ জন, ২০১৬ সালে ৮৫ জন, ২০১৭ সালে ১৩৪ জন, ২০১৮ সালে ১৬১ জন, ২০১৯ সালে ১৩৪ জন এবং চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৪৫ জন নিহত হয়েছেন। দেখা গেছে, দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে। আর ২০০২ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত ১৯ বছরে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় এক হাজার ৭০৬ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এক পরিসংখ্যানে জানা যাচ্ছে, ঝুঁকিপূর্ণ এই পেশায় কাজ করতে গিয়ে যেসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটে তার মধ্যে ১৫ শতাংশ শ্রমিক মারা যান নির্মাণস্থলে উঁচু থেকে পড়ে, ৭-৮ শতাংশ মারা যান আগুনে পুড়ে ও চোখে আঘাত পেয়ে এবং প্রায় ৪০ শতাংশ দুর্ঘটনায় হাত-পা কেটে যাওয়া, আঙুল কেটে পড়ে যাওয়া বা এমন নানা ধরনের অঙ্গহানির শিকার হচ্ছেন। পরিবহন দুর্ঘটনার পরেই নির্মাণশ্রমিকদের মৃত্যুর হারই অধিক। শ্রম আইন অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব নিয়োগকারীর। আইনে শ্রমিকদের শ্রেণী বিভাগ এবং শিক্ষানবিসকাল ঠিক করার কথা বলা আছে, যাতে একজন শ্রমিক প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিয়ে নির্মাণকাজে অংশ নিতে পারেন। তা ছাড়া প্রতিটি স্থাপনা নির্মাণে ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক কাজের তালিকা তৈরি করে সেসব কাজে অভিজ্ঞ নির্মাণশ্রমিক নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এসব আইনের কোনোটিই পুরোপুরি মানা হয় না। আইন অনুযায়ী নির্মাণশ্রমিকদের মাথায় হেলমেট, পায়ে বুট বা শক্ত জুতো, নাকে-মুখে মাস্কসহ নানা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু বাংলাদেশে এমন প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর যারা শ্রমিকদের এসব সামগ্রী সরবরাহ করে থাকেন। নির্মাণকাজে প্রাথমিক চিকিৎসা-সরঞ্জাম রাখা এবং নিরাপত্তা সম্পর্কিত রেকর্ডবুক সংরক্ষণের কথাও বলা আছে আইনে। কিন্তু এসব করতে গেলে যে অর্থ ব্যয় হবে, সেটুকুও মালিকরা মুনাফার ঘরে যোগ করেন। ফলে ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে হয় শ্রমিকদের। নির্মাতা ও ঠিকাদাররা এসব আইন মেনে চলছেন কিনা তা দেখার জন্য দেশে কেউ নেই, এমন নয়। এসব বিষয় তদারকির কথা সরকারের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)। তাদের তেমন কোনো নজরদারি যে নেই, তা বিভিন্ন ঘটনায় প্রমাণিত। তদারকি সংস্থাগুলোর প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব আছে অথবা আইন মানতে সংশ্লিষ্টদের বাধ্য করার মতো আইনগত ক্ষমতা নেই, এমন ‘যুক্তি’ তারা দিয়ে থাকেন। কিন্তু এ সবই আসলে খোঁড়া অজুহাত ছাড়া কিছু নয়। একজন সরকারি কর্মচারী নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে চাইলে পুরো প্রশাসন ও পুলিশ তার পেছনে থাকার কথা। সেটা সবসময় হয়তো এ দেশে সম্ভব নয় নানা কারণে। রাজনৈতিক বা অন্য কোনো ক্ষমতার জোরে অনেকেই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখান এবং সেটাই আমাদের ‘জাতীয় সংস্কৃতি’ হয়ে উঠেছে। কিন্তু একটি দেশে বিদ্যমান আইন চিরকাল উপেক্ষিত হতে থাকবে এটা কোনোভাবেই হতে পারে না। এ জন্য আমরা প্রশাসনের উদাসীনতা আর দায়িত্ব পালনে অনীহাকেই দায়ী করতে চাই। প্রশাসন আন্তরিকভাবে চাইলে আইন বলবৎ করা কোনো কঠিন কাজ নয় বলেই আমাদের বিশ্বাস। তবে এজন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন আছে, তাতে সন্দেহ নেই।
সরকার ও প্রশাসনের কাছে নিজেদের সমস্যার কথা বলা এবং বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরার চেষ্টা করছেন নির্মাণশ্রমিকরা। ইমারত নির্মাণশ্রমিক ইউনিয়ন (ইনসাব) গত সোমবার রাজধানীতে ‘দাবি দিবস’ পালন করেছে। সেখানে মানববন্ধন ও সমাবেশে তারা নির্মাণশ্রমিকদের ১২ দফা দাবি পেশ করেন। দাবিগুলো হচ্ছে, শ্রমিকদের বাসস্থান, উপযুক্ত কর্মপরিবেশ, পেশাগত ও স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকের পরিবারকে ১৫ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ, নারীশ্রমিকদের সমান মজুরি, জেলা-উপজেলায় শ্রম আদালত স্থাপন, মাসে একবার শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের বোর্ড সভা করা, শিল্প স্বাস্থ্য কাউন্সিল গঠনে ইনসাবের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা, শ্রমিকদের নিরাপত্তা, ঋণ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের বিদেশে কর্ম-সংস্থানের সুযোগ করে দেয়া, ইত্যাদি।
দাবিগুলোর প্রতিটিই যৌক্তিক এবং ন্যায্য। এসব দাবি পূরণ না করার কোনো কারণ নেই। তবে সরকার আন্তরিক হলেই কেবল এগুলোর বাস্তবে রূপায়ণ সম্ভব। এগুলো হলেই অবহেলিত ও উপেক্ষিত নির্মাণশ্রমিকদের বঞ্চনার কিছুটা হলেও অবসান ঘটবে। শুরুতে যে স্বপ্নের কথা বলেছি, তেমনটা না হলেও তাদের কষ্টকর জীবনে কিছুটা স্বস্তির সুবাতাস বইবে, তাতে সন্দেহ নেই।
ফেসবুকে আমার প্রায় পাঁচ হাজার বন্ধুর মধ্যে অন্তত একজন আছেন যিনি নিজে নির্মাণশ্রমিক। খুবই দরিদ্র পরিবারের এই তরুণ উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। কলেজ বন্ধ থাকলে বা ছুটি থাকলে পেটের দায়ে এবং লেখাপড়ার খরচ চালাতে তিনি নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করে থাকেন। আমার নিজ জেলার একটি গ্রামের এই দরিদ্র ছেলেটি নির্মাণশ্রমিকের কাজ করে শুধু যে লেখাপড়া করছেন তা-ই না, নিজের বাড়িতে একটি পাঠাগারও প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেই পাঠাগার থেকে সে গ্রামের ছেলেমেয়েদের বই ধার দেন বিনামূল্যে। তার বয়সের অন্যরা যখন খেলাধুলা বা মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত, তখন তিনি সাইকেলে করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিজে বই বিলি করে আসেন। পাঠক সৃষ্টি করেন। এ এক বিরল দৃষ্টান্ত। কিন্তু এটা যে কত বড় একটি কাজ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
স্বপ্ন দেখি, আজকের এই নির্মাণশ্রমিক ছেলেটি একদিন অনেক বড় মানুষ হবেন, সফল হবেন এবং নিজের গাড়িতে করে বউবাচ্চা নিয়ে কক্সবাজারে বা কুয়াকাটায় অথবা বিদেশে কোথাও বেড়াতে যাবেন। হয়তো আমি তত দিন বেঁচে থাকব না; কিন্তু আমার মতো কোনো এক সাংবাদিক হয়তো পত্রিকায় তার ছবি ছেপে ক্যাপশন লিখবেন, ‘এক সময়ের নির্মাণশ্রমিক আজকের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব।’ সেই দিনের অপেক্ষায় থাকি সব সময়।
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা