জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তী
- সৈয়দ আবদাল আহমদ
- ১১ জানুয়ারি ২০২১, ২০:১৬
‘শ্যামলা বরণ বাংলা মায়ের
রূপ দেখে যা, আয় রে আয় ...’
কবি নজরুলের এই দেশের গানে আমাদের প্রিয় প্রাঙ্গণ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে খুঁজে পাই। দেশমাতা আর বিশ্ববিদ্যালয় একাকার যেন এ গানের বর্ণনায়। সবুজে শ্যামলে, পাখির কলরবে অপরূপ এ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাণের ক্যাম্পাস আমার!
১২ জানুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছর পূর্তি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এ ঘটনা খুব আনন্দের, তেমনি গৌরবের। এই শুভ মুহূর্তে তোমাকে অভিবাদন, প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। শুভ হোক তোমার জন্মদিন।
করোনাভাইরাস মহামারী ক্যাম্পাসে ৫০ বছর পূর্তির আনন্দ অনুষ্ঠান থামিয়ে দিয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সগর্ব পথচলা থামবে না, এগিয়েই যাবে জাহাঙ্গীরনগর।
১৯৭১, মহান মুক্তিযুদ্ধের বছর। সংগ্রাম ও বিজয়ের গৌরবোজ্জ্বল এ বছরে রোপিত হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নামক চারাটি, আজ সেটিই পরিণত হয়েছে বিরাট মহীরুহে।
আগামী ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি তথা সুবর্ণজয়ন্তী। জন্মভূমির স্বাধীনতার এই বর্ণিল মুহূর্তের প্রাক্কালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েরও প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তী। এ এক অনন্য ঘটনা, ইতিহাসেরই সাক্ষী।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছর নিঃসন্দেহে এক উজ্জ্বল সময়। এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা বিস্তারে পালন করেছে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তেমনি রাজনীতি ও সমাজ-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও অতুলনীয় ভূমিকা রেখেছে । অসংখ্য শিক্ষার্থী এখান থেকে ডিগ্রি অর্জন করে আলোকিত হয়েছেন। আলো ছড়িয়ে চলেছেন দেশ-বিদেশেও। আপন আলোয় উদ্ভাসিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আলোকিত করতে থাকবে আমাদের বর্তমান ও অনাগত কালের উত্তরসূরিদেরকেও।
১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর এবং এ প্রতিষ্ঠানের চ্যান্সেলর রিয়ার এডমিরাল এসএম আহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ফলে এ দিনটিই বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’ অধ্যাদেশ ১৯৭০ সালে জারি হয়েছিল। তখন প্রখ্যাত রসায়নবিদ অধ্যাপক মফিজউদ্দিন আহমদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি এবং ড. সুরত আলী খান প্রকল্প পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।
অর্থনীতি, ভূগোল, গণিত ও পরিসংখ্যান এই চারটি বিভাগে ১৫০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। ফলে প্রথম ব্যাচে ভর্তি হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অনেকে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’, নামে নতুন আইন ১৯৭৩ প্রণীত হয়। সে আইনেই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
জাহাঙ্গীরনগর দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। শুরুতে একে সম্পূর্ণ গবেষণামূলক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার চিন্তা ছিল। ঢাকার অদূরে সাভারে প্রায় ৭০০ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এর ক্যাম্পাস। এর উত্তরে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, উত্তর-পূর্বে সাভার সেনানিবাস, পূর্বে সাভার ডেইরি ফার্ম এবং দক্ষিণে বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র অবস্থিত, যার জায়গাটিও একসময় বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছিল। প্রায় সমতল, বিস্তীর্ণ এলাকার মাঝে মাঝে উঁচু নিচু সামান্য ঢাল, সবুজের সমারোহ এবং ছোট-বড় অসংখ্য জলাশয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে করেছে মনোমুগ্ধকর। লেক ও জলাশয়ে পরিযায়ী পাখির আগমনে ক্যাম্পাস হয়ে ওঠে কলকাকলীমুখর। প্রখ্যাত স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যান করেন। একে ভিত্তি ধরেই পরবর্তীতে স্থপতি রবিউল হুসাইন এর সৌন্দর্যবর্ধনে কাজ করেছেন।
অপরূপ সৌন্দর্যের ক্যাম্পাস
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য বৈশিষ্ট্য এর সুন্দর ক্যাম্পাস। লেক-জলাশয় ও সবুজে ঘেরা মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি লাল ইটের নানা স্থাপত্য শৈলীতে মুগ্ধ হতে হয়। ক্যাম্পাসে যে কেউ ঘুরে এলে তাকে বলতে ইচ্ছে করবে ‘সৌন্দর্যে অপরূপা তুমি, জাহাঙ্গীরনগর’।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে পুরনো কলাভবন, আল বেরুনী হল ও প্রশাসনিক ভবন গড়ে ওঠে। এরপর হয় মীর মশারফ হোসেন হল। উপর থেকে এ হলকে দেখলে মনে হবে সবুজ বনের মাঝে এক প্রজাপতি উড়ে যাচ্ছে। লাল সিরামিক ইটে প্রজাপতির আদলেই হলটি নির্মাণ করা হয়েছে স্থপতি মাজহারুল ইসলামের নকশায়। বর্তমানে এ ধরনের সুন্দর সুন্দর ১৬টি হল আছে। এর মধ্যে আটটি ছাত্র ও আটটি ছাত্রী হল। আরো ছয়টি হল নির্মাণাধীন। প্রতিষ্ঠাকালে দেড় শ’ ছাত্রছাত্রী এবং চারটি বিভাগ নিয়ে যে ক্যাম্পাসের শুরু, সেখানে এখন ছয়টি অনুষদের অধীনে ৩৫টি বিভাগে প্রায় ১৮ হাজার ছাত্রছাত্রী। আছে দুই হাজারের বেশি পিএইচডি শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি ড. ফারজানা ইসলাম। দেশের প্রথম নারী ভিসি। আছে ইনস্টিটিউট, ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র, বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র। দেশের উচ্চতম শহীদ মিনার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নতুন কলাভবনের সামনে নির্মিত হয়েছে স্থপতি রবিউল হুসাইনের তত্ত্বাবধানে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক হিসেবে ৫২ ফুট ব্যাস ও ৭১ ফুট উচ্চতায় তৈরি করা এটি। শহীদ মিনারের আটটি সিঁড়ি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আটটি তাৎপর্যপূর্ণ বছর তথা ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯ ১৯৭০ ও ১৯৭১ সালকে তুলে ধরছে। আর তিনটি স্তম্ভ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি, মাটি ও মানুষ এবং গণতন্ত্র ও মুক্তি তথা স্বাধীনতাকে তুলে ধরছে। ক্যাম্পাসে শোভা পাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য ‘সংশপ্তক’। এই ভাস্কর্যে এক পা ও এক হাত হারিয়েও এক সংশপ্তক মুক্তিযোদ্ধা বিজয়ের হাতিয়ার তুলে ধরেছেন। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সামনে শিল্পী জাহানারা পারভীনের অমর একুশে ভাস্কর্যও খুব সুন্দর। প্রধান ফটক, প্রান্তিক গেট, মসজিদ, আর বিভিন্ন সরণিও দেখার মতো। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মুক্তমঞ্চ’ একটি আকর্ষণীয় স্থাপত্য। গ্রিক অ্যাম্ফিথিয়েটারের আদলে তৈরী এই মুক্তমঞ্চ নাট্যাচার্য সেলিম আল-দীনের নামে নামকরণ করা হয়েছে। ক্যাম্পাসের অতিথি পাখি বাড়তি আনন্দের সৃষ্টি করেছে। এটি পাখির পর্যটকদের পছন্দের জায়গা। প্রজাপতি পার্কও ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। আরো আছে ব্যায়ামাগার, ক্যাফেটেরিয়া, চিকিৎসাকেন্দ্র, সুইমিং পুল, খেলার মাঠ, গ্রন্থাগার এবং বিভিন্ন অ্যাকাডেমিক ও আবাসিক ভবন। সব কিছু মিলিয়ে শিল্পীর তুলিতে আঁকা যেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র
সংস্কৃতি চর্চার এক উর্বর ভূমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীদের কাছে ‘সাংস্কৃতিক রাজধানী’। মূলত নাট্যচার্য সেলিম আল-দীনকে ঘিরেই সংস্কৃতির জোয়ার আসে এ ক্যাম্পাসে। গ্রাম থিয়েটার আন্দোলনের সূত্রপাত হয় এখান থেকে। ১৯৮০ সালে মুক্তমঞ্চে মঞ্চস্থ শকুন্তলা নাটক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সেলিম আল-দীন এখান থেকেই তার জনপ্রিয় নাটকগুলো দেশবাসীকে উপহার দিয়েছিলেন। দর্শকনন্দিত অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি, শহীদুজ্জামান সেলিমসহ বেশ কয়েকজন জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি করেছে। অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়, কবি মোহাম্মদ রফিক, অধ্যাপক আফসার আহমদ প্রমুখ সৃজনশীল শিক্ষকও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।
বাংলাদেশের হারিয়ে যেতে বসা ঐতিহ্যবাহী লোকজ সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ঐতিহ্যবাহী পুতুল নাচ এবং যাত্রাপালাকে নতুন করে তুলে ধরেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি, ক্যাম্পাসে প্রতি বছর ‘হিম উৎসব’ আয়োজন করে সাপ খেলা, লাঠি খেলা, গাজীর গান, পটের গান, পালাগান, গম্ভীরা, ঘাটুগান, আদিবাসী নাচ, মনিপুরী নৃত্য, সঙ, বাউল সন্ধ্যা, কাওয়ালী, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, গান ও কবিতা চর্চা ক্যাম্পাসকে মাতিয়ে রাখছে। তেমনি পাখি মেলা, প্রজাপতি মেলা, পুতুল নাট্য দেখতেও পর্যটকরা ভিড় করে থাকেন এখানে।
খেলাধুলায়ও অনন্য ভূমিকা রাখছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা এবং মুশফিকুর রহিম এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই কৃতী ছাত্র। তেমনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রছাত্রী আজ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
হৃদয়ের একূল ওকূল দু’কূল ভেসে যায়
স্মৃতিময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাসের মধুঝরা দিনগুলো পেরিয়ে এসেছি প্রায় তিন যুগ আগে। সেই নানা রঙের দিনগুলো আমার জীবনের সোনালি অধ্যায়। কত অজস্র স্মৃতির কথা মনে পড়ছে আজ! মণিমাণিক্যের মতোই এসব স্মৃতি জ্বল জ্বল করছে।
জীবনের শ্রেষ্ঠকাল ছাত্রজীবন। আর ছাত্রজীবনের বর্ণাঢ্য সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকাল। যৌবনকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পদার্পণ ঘটে, তখন মনের আবেগ, অনুভূতি থাকে স্বচ্ছ ঝরনা ধারার মতো। এমন বর্ণালী সময়, এমন আনন্দময় মুহূর্তগুলো জীবনে আর কখনোই ফিরে আসবে না যখন ভাবছি, তখন মনের ভেতরটা হু হু করে উঠছে।
মনে পড়ে, হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ থেকে ‘গ্রিন অ্যারো’ বা ‘উল্কা’ ট্রেনে করে ঢাকায় এসেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য। ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করে চলে গিয়েছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বৃন্দাবন কলেজে আমার সিনিয়র বাদল সেখানে রসায়নে পড়ছেন। ভাগ্নের ক্লাসমেট হিসেবে আমাকে মামা ডাকতেন। মীর মশারফ হোসেন হলের আবাসিক ছাত্র। তার কাছে গিয়েই উঠি। কারণ ঢাকা কিংবা আশপাশে তখন থাকার মতো আমার পরিচিত কেউ ছিল না। আশ্চর্য! জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকেই এক অন্যরকম অনুভূতি বোধ করলাম। আমার মন খুশি, খুশি। কেমন যেন আনন্দের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। প্রথম দেখাতেই প্রাণবন্ত ক্যাম্পাস আমাকে আপন করে নেয়। ওর প্রেমে পড়ে যাই। বিশ্ববিদ্যালয় এতটাই আকর্ষণ করেছিল যে, তখনই সিদ্ধান্ত নেই জাহাঙ্গীরনগর ছাড়া আর কোথাও পড়ব না। বাস্তবে ঘটলও তাই। অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতেও যাইনি। জাহাঙ্গীরনগরে রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে আবেদন করি। মনে আছে, হলে বাদলের সিটে অবস্থান করে রসায়ন বিষয়ে রাত-দিন এমনভাবে পড়েছি যাতে অবশ্যই ভর্তি হওয়া যায়। অবশেষে ১৯৮০-৮১ শিক্ষাবর্ষে সুযোগ পেয়ে যাই রসায়ন বিভাগে। এরপর আমার প্রাণপ্রিয় ক্যাম্পাস জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। কত আড্ডা, কত কথা, কত স্মৃতি!
সাংবাদিকতার পোকাটা মাথায় করে হবিগঞ্জের বৃন্দাবন সরকারি কলেজ থেকেই নিয়ে এসেছিলাম। ফলে রসায়ন পড়ার পাশাপাশি ক্যাম্পাসে সাংবাদিকতাও করেছি। প্রথমে ছোটখাটো পত্রিকায়। পরে ভিসি জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর কল্যাণে দৈনিক বাংলায়। তিনি তার বন্ধু কবি শামসুর রাহমানের কাছে পাঠিয়েছিলেন। রাহমান ভাই আমাকে দৈনিক বাংলায় নিয়ে নেন। ক্যাম্পাসে সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ফিরোজ ভাই, কিরণ ভাই, কাওসার, মহিউদ্দিন, সালাম আনোয়ারসহ আরো কয়েকজন তরুণ। এদের অনেকে এখন বড় বড় প্রতিষ্ঠানের দিকপাল। এই তরুণদের নিয়ে ক্যাম্পাস আলোড়িত করতে থাকি। আমাদের সাংবাদিকতার কর্মচাঞ্চল্য ভিসি জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীকে আকৃষ্ট করে। তিনি পুরনো কলাভবন ও পুরনো রসায়ন বিভাগের মাঝখানে অবস্থিত, ভবনের একটি কক্ষ সাংবাদিক সমিতির জন্য বরাদ্দ দেন। চেয়ার টেবিলসহ ফার্নিচারের ব্যবস্থা করেন। খরচের জন্য বার্ষিক ১০ হাজার টাকার বাজেট বরাদ্দও দেন। চলতে থাকে আমাদের ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা।
বিশাল ক্যাম্পাসে মাত্র ১০টি বিভাগে দুই-আড়াই হাজার ছাত্রছাত্রী। হলের সংখ্যাও ছিল মাত্র তিনটি। শিক্ষার্থীরা সবাই একে অন্যকে চেনে। নিরিবিলি অন্যরকম এক ক্যাম্পাস। সন্ধ্যার পর শিয়ালের হুক্কা হুয়া ও ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের মজাই ছিল আলাদা। বিশ্ববিদ্যালয়ে খবর হওয়ার মতো বিষয়ের প্রচুর অভাব ছিল। তাই আমরা খবর সৃষ্টির জন্য সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা আয়োজনের জন্য বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের এবং ছাত্র ও অন্য সংগঠনগুলোর কর্তাব্যক্তিদের উৎসাহিত করতাম।
একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গবেষণার প্রতি আমার চোখে পড়ে। বিশেষ করে ভূগোল বিভাগে। এ বিভাগে তখন ছিলেন অধ্যাপক এমআই চৌধুরীর মতো উপমহাদেশের প্রখ্যাত ভূগোল বিজ্ঞানী। ছিলেন প্রফেসর আ. ফ. ম কামালউদ্দিন, প্রফেসর ড. মওদুদ ইলাহী, প্রফেসর মেসবাহ উস সালেহীন, ড. সুভাষ চন্দ্রসহ আরো অনেকে। তাদের ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের চমৎকার সব গবেষণা।
সেন্টমার্টিন, বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে ফারাক্কার প্রতিক্রিয়া, বাংলাদেশের বনাঞ্চল, সুন্দরবন, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শহরে মানুষের অভিবাসন ইত্যাদি নিয়ে দৈনিক বাংলায় প্রথম পাতায় লিড, সেকেন্ড লিড, ডাবল কলাম, সিঙ্গেল কলাম রিপোর্ট ছাপা হয়েছে আমার। তেমনি রসায়ন বিভাগ থেকে প্রফেসর সৈয়দ শফিউল্লাহ স্যারের গঙ্গা দূষণ, গ্রিন হাউজ গ্যাস ও জলবায়ু এবং অধ্যাপক মেজবাহউদ্দীন আহমদের করলা নিয়ে গবেষণা ও পলিথিন ব্যাগ নিয়ে সাক্ষাৎকারভিত্তিক রিপোর্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আখলাকুর রহমান, অধ্যাপক আমীরুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক মুস্তাহিদুর রহমান, অধ্যাপক এম কবির, অধ্যাপক এম এ রকীব, অধ্যাপক সেলিম আলদীন, কবি মোহাম্মদ রফিক দৈনিক বাংলায় আমার অসংখ্য আলোচিত খবরের উৎস ছিলেন।
আমাদের সময় মীর মশারফ হোসেন হলের প্রভোস্ট ছিলেন সুসাহিত্যিক সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়। বিকেল বেলায় তিনি আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে ক্যাম্পাসে হাঁটতেন। মহৎপ্রাণ একজন শিক্ষক ছিলেন। হলে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে হকিস্টিক নিয়ে সংঘর্ষ বাধলে তিনি ‘বাবারে সোনারে’ ডেকে তাদের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে সংঘর্ষ থামিয়ে দিতেন। হলে আমার ২৫৮/বি কক্ষটি ছিল একটি আদর্শ কফি পান কেন্দ্র। তবে এ কফি আসল কফি নয়। মল্টোভাকে কফি হিসেবে চালিয়ে দিতাম। কারণ এর রঙ এবং স্বাদ অনেকটা কফির মতো। জাকসু ও ছাত্র সংগঠনের নেতারা, বড় ভাইয়েরা এখানে এসে বিনা পয়সায় কফি খেয়ে যেতেন। প্রথম দিকে কিছু দিন হলের ডাইনিংয়ে খেয়েছি। পরে মেস করে খেয়েছি।
আমাদের মেসের খুব নামডাক ছিল। মেসে সদস্য হতে হলে দরখাস্ত করতে হতো। ভিসি অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীও এ মেসে একদিন ডিনার করেছেন। মেসের বাবুর্চি মান্নান পরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের বাবুর্চি হয় এবং ক্লাবের প্রধান বাবুর্চি হয়ে অবসরে গেছে। সাংবাদিক সমিতির পক্ষ থেকে আমরা বার্ষিক বনভোজনের আয়োজন করতাম। এমনি এক বনভোজন ছিল আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর বাগান বাড়িতে। সেখানে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্টারদের নিমন্ত্রণ করি। বনভোজনে এসেছিলেন দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর আ ফ ম কামাল উদ্দিন ও প্রফেসর আবদুল মান্নান। মান্নান স্যার এতটাই খুশি হন যে, তিনি পরদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসিতে তার বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টারদের জন্য অফিস বরাদ্দ করে দেন। এ বনভোজনে সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদও এসেছিলেন। তিনি সম্ভবত তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাখি সম্পর্কে এখন কে না জানে? আশির দশকে প্রথম দৈনিক বাংলায় ‘নিথর ক্যাম্পাসে শীতের পাখি’ শিরোনামে আমার লেখা ফিচার ছাপা হয়েছিল। তেমনি ‘সবুজে ঘেরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’ ফিচারও অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তখন।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটি আনন্দঘন অনুষ্ঠান ছিল হলে বার্ষিক ভোজ বা ফিস্টের আয়োজন। ভিসি এসে ফিস্ট উদ্বোধন করতেন। ওই খাবারটা মনে হতো যেন অমৃত। খাবারের আগে প্রধান অতিথির বক্তৃতা হতো। মনে আছে, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী স্যারের বক্তৃতা সবাইকে মুগ্ধ করত। প্রান্তিক গেট, ডেইরি ফার্ম গেট, মুক্তমঞ্চ আর খেলার মাঠের ঘাসে বসে আনন্দ আড্ডার কথা খুব মনে পড়ছে। ১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারির মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন এবং আর্মিরা এসে হল ঘেরাও করে আমাদের মাঠে নিয়ে বসিয়ে রাখার কষ্টের স্মৃতিও ভোলার নয়। আমাদের সময়ে প্রথম দিকে ‘র্যাগ ডে’ পালন করা হতো, রঙ খেলা চলত। আমরা এটি বদলে দেই।
বিষয়ভিত্তিক ‘সমাপনী দিবস’ পালন শুরু হয়। যেমন আমাদের দশম ব্যাচের সমাপনীর বিষয় ছিল ‘নেবো না যৌতুক বউ’। সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আমাদের যৌতুক না নেয়ার শপথ করিয়েছিলেন। যতটুকু জানি, আমাদের ব্যাচের বন্ধুরা বিয়েতে কেউই যৌতুক নেননি। আজ মনে পড়ছে মহৎপ্রাণ অনেক শিক্ষকের কথা। সৈয়দ আলী আহসান, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর মতো পণ্ডিত ব্যক্তিরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন। ক্যাম্পাসে এমন উপভোগ্য সুন্দর দিনই কাটিয়েছি আমরা। রসায়নের ছাত্র হলেও সাংবাদিকতাই ছিল ধ্যান-জ্ঞান। ফলে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকেই বেছে নেই।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক,
সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা