২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
আল কুরআনে অর্থনীতি : ১১

সম্পদ বণ্টন সম্পর্কিত আল্লাহর নীতি

-

আল্লাহ যাকে চান রিজিকের প্রাচুর্য দান করেন আর যাকে চান পরিমিত পরিমাণ রিজিক দেন। এ লোকেরা দুনিয়ার জীবনে আনন্দে নিমগ্ন হয়ে থাকে; অথচ দুনিয়ার জীবন পরকালের তুলনায় সামান্য সামগ্রী ছাড়া কিছুই নয়। (সূরা রা’দ : ২৬)
শব্দের অর্থ : ‘রিজিক’ শব্দের ব্যাপক অর্থ সূরা বাকারার ৩ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

তাফসিরভিত্তিক আলোচনা : মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী এ আয়াতের তাফসিরে লিখেছেন- এ আয়াতের পটভূমি এই যে, মুসার কাফিররাও সাধারণ মূর্খদের ন্যায় আকিদা ও আমলের ভালো-মন্দ দেখার পরিবর্তে ধনী ও দরিদ্র হওয়ার দৃষ্টিতে মানুষের মূল্য ও মর্যাদা নির্ধারিত করত। তাদের ধারণা ছিল, যে লোক দুনিয়ার আরাম-আয়েশের দ্রব্যসামগ্রীর অধিকারী, সে লোক বুঝি আল্লাহরও প্রিয়, কার্যত সে যতই পথভ্রষ্ট ও অনাচারী হোক না কেন। পক্ষান্তরে, যার অবস্থা দীন-দরিদ্র সে আল্লাহরও অপ্রিয়, অভিশপ্ত লোক, তার আমাল, আখলাক, যতই উন্নত ও পবিত্র হোক না কেন। এ কারণেই তারা কুরাইশ সম্প্রদায়কে নবী করিম সা:-এর সাহাবিদের তুলনায় অনেক মর্যাদাবান ও সম্মানী মনে করত। তারা বলত, এই দেখো না, আল্লাহ কাদের সাথে রয়েছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ সাবধান করে দিয়েছেন। বলেছেন, রিজিকের কম বেশি হওয়া তো আল্লাহর অপর এক নিয়মের অধীন। অপর দিক দিয়ে অসংখ্য রকমের বিবেচনার ভিত্তিতে আল্লাহ তায়ালা কাউকে বেশি, কাউকে কম দান করেন। কিন্তু মানুষের অভ্যন্তরীণ নৈতিক মানদণ্ডের জন্য এটা কোনো মানদণ্ড নয়। মানুষের মধ্যে মর্যাদার পার্থক্যকরণের আসল ভিত্তি এবং সৌভাগ্যবান ও দুর্ভাগা হওয়ার আসল মাপকাঠি হচ্ছে, চিন্তা ও কর্মের সঠিক পন্থা কে গ্রহণ করেছে; কে উত্তম গুণাবলির অধিকারী হয়েছে আর কে খারাপ গুণাবলির। কিন্তু অজ্ঞ-মূর্খ লোকেরা এ ভিত্তি ও মাপকাঠি বাদ দিয়ে কাকে ধন-সম্পদ বেশি দেয়া হয়েছে আর কাকে কম- তারই ভিত্তিতে বিচার করে থাকে।

আল্লামা শাব্বীর আহমদ উসমানী লিখেছেন, পৃথিবীতে বেশি সম্পদ ও অর্থ হওয়া ভালো ভাগ্য বা মন্দ ভাগ্যের ব্যাপার নির্ধারণ করে না। এটা সবসময় সত্য নয় যে, যাদের বেশি ধন-সম্পদ আছে তারা আল্লাহর অধিক প্রিয়। আল্লাহর অনেক প্রিয় বান্দা দারিদ্র্যে জীবন কাটান, অন্য দিকে অনেক অপরাধী লোক আরাম-আয়েশে দুনিয়ায় থাকে। এটিই আখিরাত সংঘটন করার কারণ। সুনিশ্চিতভাবে আরেকটি জগত আছে যেখানে ভালো-মন্দ কাজের ফল পাওয়া যাবে। সংক্ষেপে, পৃথিবীর অভাব বা প্রাচুর্য গ্রহণ বর্জনের মানদণ্ড হতে পারে না।

আর্থসামাজিক তাৎপর্য : সূরা রা‘দ রাসূলুল্লাহ সা:-এর মক্কী জীবনের শেষপর্যায়ে অবতীর্ণ হয়। এই সূরায় নানাভাবে তাওহিদ, পরকাল ও নবুওয়াত-রিসালাতের সত্যতার প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। এই সূরার তৃতীয় রুকুতে সৎ ও মন্দ লোকদের গুণাবলি আলোচনা করা হয়েছে। সৎ লোকদের গুণাবলি পর্যায়ে বলা হয়েছে- তারা আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পূরণ করে, আল্লাহ যেসব সম্পর্ক বহাল বলেছেন তা বহাল রাখে, ধৈর্য ধারণ করে, নামাজ কায়েম করে, আল্লাহর দেয়া রিজিক থেকে প্রকাশ্য ও গোপনে খরচ করে এবং অন্যায়কে ন্যায় দ্বারা প্রতিরোধ করে। এসব লোকের জন্য রয়েছে পরকালে বিশেষ পুরস্কার। সৎ লোক দুনিয়াতে পুরস্কার পেতে পারে আবার না-ও পেতে পারে। আল্লাহর নানা নিয়মে তা ঘটতে পারে। যেমন আল্লাহ পাক সূরা বাকারায় বলেছেন, আমি তোমাদেরকে ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষতি দ্বারা পরীক্ষা করব। তুমি শুভ সংবাদ দাও ধৈর্যশীলদেরকে। (সূরা বাকারা : ১৫৫)

দুনিয়াতে কোনো সৎ লোকের কম ধন-সম্পদ হওয়া আল্লাহর কাছে তার অপ্রিয় হওয়ার লক্ষণ নয়। তেমনিভাবে কারো বেশি ধন-সম্পদ হওয়া আল্লাহর কাছে তার প্রিয় হওয়ার লক্ষণ নয়- যেমন মক্কার কাফিররা বিশ্বাস করত। আজকালও পাশ্চাত্যের উন্নত জৌলুশে প্রভাবিত লোকেরা এ ধারণা বিশ্বাস ও প্রচার করে থাকে। এ বিশ্বাস ও যুক্তির অসারতা ঘোষণা করেই আল্লাহ পাক বলছেন, তিনি যাকে ইচ্ছা রিজিকের প্রাচুর্য দান করেন আর যাকে ইচ্ছা রিজিক কম দেন। এসব ঘটে থাকে আল্লাহর পরিকল্পনা ও নৈতিক আইনের অধীনে।

অবশ্য এখানে এ কথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, রিজিক অর্জন ও ধন বণ্টন সম্পর্কিত আল্লাহর আইনের অন্যান্য দিকও রয়েছে। যেমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার রিজিকের জন্য চেষ্টা করতে হবে। (সূরা জুমু’আ : ১০; সূরা নিসা : ৩২; সূরা হাশর : ৭) তেমনিভাবে অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিকে সমাজ ও রাষ্ট্র দেখাশুনা করবে এবং তার অভাব দূর করবে। (সূরা তওবা : ৬০)

আলোচ্য আয়াতে ধন বণ্টন সম্পর্কিত আল্লাহর একটি মৌলিক নীতি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইসলামের ধন বণ্টননীতি সম্পর্কিত অন্যান্য শিক্ষার সাথে সাথে এ আয়াতের বক্তব্যকেও ইসলামী অর্থ ও সমাজনীতিবিদদের মনে রাখতে হবে।

অর্থাৎ এ আয়াত থেকে এ কথা মোটেই বোঝায় না যে, সম্পদে মানুষের হিস্যার বিষয়টি আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করে থাকেন বলে তাকে সম্পদ অর্জনের জন্য কোনো চেষ্টা তদবির করতে হবে না। কেননা এখানে উল্লিখিত বিষয়টি হলো, প্রাকৃতিক ও নৈতিক পরিকল্পনার অন্তর্গত আর সম্পদ অর্জনের জন্য চেষ্টা করা সাধারণ নীতিমালার অন্তর্গত। এ দুয়ের সমন্বয়েই ইসলামী জীবন দর্শন পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে এবং এতেই ইসলামের সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য নিহিত।

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার


আরো সংবাদ



premium cement