২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বছরটা কেমন কাটল?

বছরটা কেমন কাটল? -

‘যায় দিন ভালো, আসে দিন কালো।’ কথাটা ব্যাপকভাবে চালু থাকলেও সদ্যবিগত ২০২০ সালের কথা ভাবলে এটা কি বলা যায়? কারণ, বিদায়ী বছরজুড়ে বিশ্বজুড়ে মহামারীর মহাতাণ্ডব দেখে অবশ্যই বলতে হয়, ‘যায় দিন মন্দ’। তাই নতুন বছরকে ‘কালো’ নয়, ‘ভালো’ দেখতে উদগ্রীব বিশ্বের মানুষ। এটা সবার ও প্রত্যেকের ঐকান্তিক কামনা। সব ক্ষমতার মালিক এবং বিশ্ব জগতের একক নিয়ন্তা, পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদের এ প্রত্যাশা পূরণ করেন। তাঁর ইচ্ছাই সবচেয়ে বড় বিষয়।

অপর দিকে, নতুন বছর মানেই নতুন আনন্দ নয়। এটা সবসময় নয় খুশির ব্যাপার। কারণ, ‘দিন দিন আয়ুহীন; হীনবল দিন দিন’ এ কথা শুধু আমার পরলোকবাসিনী মা-ই বারবার বলেননি, এটাই অনস্বীকার্য বাস্তবতা। আমরা সবাই প্রতিদিন এক পা করে কবরের দিকে আগাচ্ছি। ‘জন্মিলে মরিতে হবে; অমর কে কোথা কবে?’ এটা চিরসত্য হলেও মানুষ স্বর্গ চায়, কিন্তু মৃত্যু চায় না। আয়ু যতই হোক ‘শৈবালের নীড়’, সবার আশা থাকে দীর্ঘায়ু হওয়ার জন্য।

একজন লেখক বলেছেন, ‘বছরটি গেল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, প্রতীক্ষা আর মানসিক অশান্তির মধ্য দিয়ে। প্রতিনিয়ত ভীতি আর অনিশ্চয়তা জীবনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। মানুষ বাঁচে আশা নিয়ে। সবাই সুদিনের অপেক্ষায় রইলাম।’

কথাগুলো পুরো সত্যি। ২০২০ সালের মতো বছর না আসুক; এমন মহামারীর কবলে যেন আর না পড়ি- এটাই সবার চাওয়া। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর রহমত বা করুণার ব্যাপারে হতাশ হয়ো না।’ তাই তো কবির ভাষায়- ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি।’ কেবল মহান স্রষ্টার করুণাধারায় নিষিক্ত হোক পুরো জীবন, গোটা বিশ্ব। সেটাই চূড়ান্ত সার্থকতা।

২০২০ সালের শুরুতে কে ভেবেছিলেন যে, এ বছরটা বাংলাদেশসমেত গোটা বিশ্বের জন্য এতটা ভয়ানক, এত মর্মান্তিক এবং এত বেশি অভাবনীয় হয়ে উঠবে? ২০২০ সালে ব্যক্তিগতভাবে নিজে হারিয়েছি অনেক আপনজন ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে। মহামারীর ঠিক আগে ২২ ফেব্রুয়ারি এক ভাগ্নের আকস্মিক ইন্তেকাল দিয়ে এই ট্র্যাজেডির অশুভ সূচনা। বিশেষ করে, করোনাভাইরাসে আপন বোনসহ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়পরিজন ও বান্ধবজনের মৃত্যুর কথা ভোলা যায় না। শাশুড়ির আগে থেকেই ডায়াবেটিস ছিল। তিনিও করোনাকালে হাসপাতালে চিরবিদায় নিয়েছেন। আর দেশ-জাতি হারিয়েছে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে যাদের নানামুখী অবদানে আমরা ঋদ্ধ এবং যারা বেঁচে থাকলে তাদের সুকৃতি দিয়ে আমাদের আরো সমৃদ্ধ করতে পারতেন। বিশেষ করে আমাদের একই পেশা, অর্থাৎ সাংবাদিকতায় নিয়োজিত যারা প্রাণ দিলেন মহামারীতে, তাদের স্মৃতি প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াবে।

পয়লা ক’মাস তালিকা রাখছিলাম, কারা কারা প্রাণ হারালেন করোনায়, অর্থাৎ মোট কতজন প্রাণ দিলেন মহামারীতে। পরে আর মৃত্যুর সংখ্যা হিসাব করে কুলাতে পারিনি। আরেক সমস্যা ছিল, অনেকে কোভিড মহামারীতে মারা গেলেও তা প্রচার করা হয়নি। বলা হয়েছে, অন্যান্য রোগ, বড়জোর শ্বাসকষ্টের কথা। এ দিকে, কোভিড নেগেটিভ রিপোর্ট এলেও অনেককে অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে মৃত্যুর কাছে। দেখা যায়, দেশে-বিদেশে প্রায় সব পেশার বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। তারা অতীতে দায়িত্বপূর্ণ পদে ছিলেন অথবা মৃত্যুকালেও গুরুদায়িত্ব পালন করছিলেন। বড় পদের মানুষদের মৃত্যু পত্রপত্রিকায় বেশি ছাপা হয় স্বাভাবিকভাবেই। তবে সে কারণে বলা যায় না, ‘করোনায় কেবল ধনীরাই মরে’ কিংবা ‘এটা বড়লোকের ব্যাধি’। এসব বলে স্বাস্থ্যবিধি না মানা অথবা সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। এটা অনেকটা ‘অক্ষমের সান্ত্বনা, রবীন্দ্রনাথ নর্মাল স্কুল ফেল ছিলেন’ বলার মতো।

২০২০ সাল মহামারী তো লেগেই ছিল, অন্যান্য খবরও তেমন ভালো নয়। বছরের সর্বশেষ দিনে দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম- মহামারীর ছোবল রাজনীতিতে, স্কুলের বাইরে বছর পার, করোনার নতুন স্ট্রেইন শনাক্ত, ইত্যাদি।

২০২১ সালের সর্বপ্রথম দিবসের পত্রিকার শিরোনামগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য, নতুন বছরে নতুন আশা (কারণ আশাই বাঁচিয়ে রাখে মানুষকে), চ্যালেঞ্জ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের, মৃত্যুদণ্ডেও কমেনি পাশবিকতা, মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, মহামারীতে কূটনীতি স্থবির, কমে গেল বেশির ভাগ ব্যাংকের পরিচালন-মুনাফা, রাবি প্রশাসন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে বছরজুড়ে সমালোচনায়, নতুন বছরে লড়াই করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে, হতাশ ক্রীড়াবিদরা চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়, ৭০ হাজার প্রবাসী করোনায় আক্রান্ত, প্রভৃতি। তবুও ২০২০ সালকে বিদায় এবং নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে কক্সবাজার ও কুয়াকাটা সৈকতে মানুষের ভিড়। আর যে আশাবাদের কথা বলা হলো, সে আশা যেন ‘কুহকিনী’ হয়ে না যায়।

অপর দিকে, অপরাধের হার বেড়েছে সম্ভবত মহামারীর প্রাদুর্ভাবের চেয়েও বেশি। এসব অপরাধের বৈশিষ্ট্য ছিল বিকৃতি, পাশবিকতা এবং নিকটজনেরও নিষ্ঠুরতা। বাংলাদেশের একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বলেছেন, ‘এত ভয়াবহ মহামারী চলছে। কিন্তু আমরা কোনো শিক্ষা নেবো কি? সব আগের মতোই চলবে।’ চার পাশের বাস্তবতা এরই সাক্ষ্য দিচ্ছে এখন। মনে পড়ছে ইংরেজি একটি প্রবাদ, Wish for the best and be ready for the worst.


আরো সংবাদ



premium cement