অভিবাসী মন
- আমীর হামযা
- ২৮ ডিসেম্বর ২০২০, ২০:৫৮, আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২০, ২১:৩৬
এক দেশ থেকে অন্য দেশে অভিবাসনের প্রক্রিয়াটা বোধ করি আদিকাল থেকেই চলছে; না হলে ১৪৯২ সালে যখন আমেরিকা আবিষ্কার করে কলম্বাস সেখানে মনুষ্য-বসতি পেতেন না। ধারণা করা মোটেই অযৌক্তিক নয় যে, বেরিং প্রণালী- যেটা আমেরিকা ও রাশিয়াকে বিযুক্ত করেছে, তা একসময় বেরিং যোজক তথা জলভাগের পরিবর্তে স্থলভাগ ছিল এবং ওটার ওপর দিয়েই নূহের (আ:) সন্তানরা এশিয়া থেকে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়ে থাকবেন।
প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে বর্তমান জমানাতেও পার্থিব জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আকাক্সক্ষা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করছে। দুনিয়ার জিন্দেগিতে সুখের বাসনায় সব বাধা তুচ্ছ করে, কোনো কিছুতে দমে না গিয়ে অভিবাসনে প্রত্যাশী হয় মানুষ। সব কষ্ট উপেক্ষা করে পৌঁছাতে চায় কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। জাতিসঙ্ঘের পরিসংখ্যান মতে, বিশ্বের মোট লোকসংখ্যার চার শতাংশই অভিবাসী। আমেরিকানদের তো বলাই হয় ‘আ নেশন অব ইমিগ্র্যান্টস’ তথা অভিবাসীদের জাতি; কেননা ওখানে সবাই ইমিগ্র্যান্টস ও তাদের বংশধর, কেউ আগে ওখানে পৌঁছেছেন আর কেউ পরে, তফাত শুধু এটুকুই।
অভিবাসন আর অভিবাসী পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। অভিবাসন হচ্ছে সেসব লোকের চলাচল, যারা বসবাসের উদ্দেশ্যে ভিন দেশে গমন করেন। সেই তারাই যখন কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছান, তাদের বলা হয় অভিবাসী।
অর্থাৎ বর্তমানে অভিবাসী তারাই, দেশের বাইরে নতুন ঠিকানায় থিতু হন যারা। তবে দেশ ছাড়ার ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে শরণার্থী বা আশ্রয়প্রার্থী নামেও ডাকা হয় প্রবাসীদের। জোরপূর্বক বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে নয়, স্বেচ্ছায় ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে যারা স্থায়ীভাবে বিদেশে পাড়ি জমান তারা প্রবাসী। শরণার্থী বলা হয় তাদের, যারা যুদ্ধ, গণহত্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এড়াতে দেশান্তরী হন। এটি সম্পূর্ণ অন্যরকম এক পরিস্থিতি। যে মুহূর্তে কাউকে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়, তখন তার নির্দিষ্ট কিছু অধিকারও স্বীকার করে নেয়া হয়। তারা এমন বাস্তবতার শিকার, যা তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। দেশ ছাড়ার সব ক’টি প্রকারের মিশ্রণ হতে পারে একজন আশ্রয়প্রার্থীর ক্ষেত্রে। তার বিশেষত্ব হলো, তিনি নিজ দেশ বাদে অন্য দেশে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুরক্ষায় আবেদন করেন। আজকাল আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যেও আসল-নকল শ্রেণী বিন্যাসের একটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়। ক্ষেত্রবিশেষে এটি যৌক্তিক হলেও তাদের আশ্রয় চাওয়ার বিষয়টি কিন্তু অস্বীকার করা যায় না। মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী হলো সাম্প্রতিক সময়ে এর বড় উদাহরণ। জাতিসঙ্ঘের হিসাবে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ৯ লাখ ৩২ হাজার। শরণার্থী আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ দ্বিতীয়।
সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিবাসনবিষয়ক কেন্দ্রের শিক্ষক শার্লট টাইলরের মতে, অভিবাসী যথেষ্ট নিরাপদ একটি পরিভাষা। এমন নয় যে, এটি ভবিষ্যতেও নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ রাজনৈতিক অভিবাসনের ক্ষেত্রে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়। অনেকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কারণে ভিন দেশে দেশান্তরি হয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন। মানে, কোনো ব্যক্তি যখন বিশেষ কোনো শাসনাবস্থা থেকে দূরে যেতে চান, তখন এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। একটি দেশে ক্রমাগত অভিবাসীদের আগমন হতে থাকলে মিডিয়ায় যখন সেই বিষয়ে খবরে বা লেখায় ‘ঢল’, ‘জোয়ার’ বা ‘বন্যা’র মতো শব্দ ব্যবহার করা হয়, তখন অভিবাসীদের সাথে ‘অমানবিক’ আচরণ করা হয়, বলে মনে করেন টাইলর। এরকম শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে অভিবাসীদের ‘পণ্য’ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় বলেও মনে করেন তিনি।
কিন্তু যে কারণেই হোক, স্বদেশ বা আপনজন ছেড়ে অন্যত্র কেন গমন করে মানুষ? মোটা দাগে বলা যায়, অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মনস্তত্ত্বে গাঁথা থাকে উন্নত জীবন বা কর্মসংস্থানের খোঁজে স্থান পরিবর্তনের প্রত্যাশা। তাদের একটিই স্বপ্ন থাকে, উন্নত ও নিরাপদ দেশের নাগরিক হওয়া। দূর থেকে দেশটির প্রাচুর্যের কথা শুনে কিংবা পর্যটক হিসেবে বেড়াতে গিয়ে বাইরের চাকচিক্য দেখে বিমোহিত হয়ে অভিবাসনপ্রয়াসী হন তারা। সেই তারা ঝুঁকি বা অর্থ ব্যয়ের তোয়াক্কা করেন না। নিজের এবং পরিবারের ভবিষ্যৎ সুরক্ষাই থাকে একমাত্র বাসনা। আপনজনের সাহচর্য ছেড়ে, পরিচিতমণ্ডল পেছনে ফেলে শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে বা ভাগ্যের অন্বেষণে সাগর-মরু-জঙ্গল পাড়ি দিতে কার্পণ্য করে না তারা। এই যে সবাইকে ছেড়ে যাওয়া, এখানে বৈষয়িক উন্নতিই মুখ্য। দেখা যাচ্ছে, নাড়ির টান উপেক্ষা করতে না পারলে জীবনে কাক্সিক্ষত উন্নতি অধরাই থাকে। তাই তা বিপুলসংখ্যক মানুষ অভিবাসনপ্রত্যাশী।
২০১৯ সালে প্রকাশিত জাতিসঙ্ঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগের অভিবাসন প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বর্তমান বিশ্বে অভিবাসীর সংখ্যা ২৭ কোটি ২০ লাখ। অভিবাসী হওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে ভারতীয়রা। তবে আমরা বাংলাদেশীরাও কম নই। বিশ্বে আমাদের অবস্থান ষষ্ঠ। বাংলাদেশের ৭৮ লাখ মানুষ পৃথিবীর নানা দেশে বাস করছেন। তাদের বেশির ভাগই জীবিকার তাগিদে শ্রমিক হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থায়ীভাবে অভিবাসন নিয়েছেন। আবার কেউ উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়ার মতো ধনী দেশে স্থায়ী অভিবাসী হয়েছেন। তিন দশকের ব্যবধানে বাংলাদেশী অভিবাসীর সংখ্যা ৪০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এভাবেই বছরের পর বছর এ দেশের লাখ লাখ মানুষ জীবিকার তাগিদে ও ভালো থাকার আকাক্সক্ষায় দেশান্তরী হয়েছেন। জাতিসঙ্ঘের তথ্যমতে, অভিবাসী হওয়ার জন্য সবচেয়ে পছন্দের পাঁচটি গন্তব্য হলো যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, সৌদি আরব, রাশিয়া ও যুক্তরাজ্য। এর মধ্যে সৌদি আরবে শ্রমিক অভিবাসীই বেশি। অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা সংস্থা রামরুর গবেষণা বলছে, ঝুঁকির কথা জেনে-বুঝেই যেতে আগ্রহী হচ্ছেন ৯১ শতাংশ বাংলাদেশী।
বাংলাদেশের তরুণরা স্বদেশে পছন্দমতো কাজ না পেয়ে শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যাচ্ছেন। দেশে অল্প বয়সে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। জাতিসঙ্ঘ বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশী অভিবাসীদের গড় বয়স ৩০ বছর। ৯ বছর আগে অর্থাৎ ২০১০ সালে বাংলাদেশী অভিবাসীদের গড় বয়স ছিল ৩৪ বছরের বেশি। বিশ্ব সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, নব্বইয়ের দশকে বছরে গড়ে আট লাখের মতো বাংলাদেশী কাজের জন্য বিদেশে যেতেন। এখন বেড়ে ২১ লাখে উন্নীত হয়েছে। বিদেশে যত বাংলাদেশী অভিবাসী আছেন, তাদের দুই-তৃতীয়াংশের বয়স ২০ থেকে ৬৪ বছর। তারা কর্মক্ষম। কমবেশি সবাই দেশে প্রবাসী আয় পাঠিয়ে থাকেন। দেশের উৎপাদন খাতে কর্মসংস্থান কমে যাওয়ায় শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। বিদেশে গিয়ে সেই তারাই প্রবাসী আয় পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করছেন। যেসব পরিবার থেকে তরুণরা বিদেশে যাচ্ছেন, সেসব পরিবার দারিদ্র্যসীমার উপরে পৌঁছে যাচ্ছে। তারা প্রবাসী আয় না পাঠালে হয়তো ওই সব পরিবারের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হতো না।
ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান অধিদফতর ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, গত আট বছরে বেআইনিভাবে ইউরোপে গেছেন এক লাখ ৩০ হাজারের বেশি বাংলাদেশী। ১৯৭৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চিত্র বলছে, বাংলাদেশের শ্রমবাজারের ৮০ শতাংশের বেশি মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর মিলিয়ে ১৫ শতাংশের মতো। অবশিষ্ট বাজার নানা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। একক দেশ হিসেবে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়া বড় বাজার।
অভিবাসীদের বেলায় দেখা যাচ্ছে, পার্থিব জীবনের সাফল্য বা চাবিকাঠি নিহিত রয়েছে সাধারণত অভিবাসনপ্রত্যাশায়। তবে স্মরণে রাখা প্রয়োজন, প্রার্থিব জীবন ক্ষণস্থায়ী। পৃথিবীর যশ-খ্যাতি-প্রতিপত্তি শুধুই মরীচিকা। আল কুরআনে বলা হয়েছে,‘পার্থিব জীবন খেলতামাশা, জাঁকজমক, পরস্পর অহঙ্কার প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা, ধনসম্পদ ও সন্তানসন্তুতি বাড়ানোর চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।’ (সূরা-৫৭, আয়াত-২০)। ঐশী গ্রন্থের ভাষ্যমতে, পরকালীন জীবনের সাফল্যই মহাসাফল্য। এটি অর্জন করতেও অভিবাসী মন থাকা অত্যাবশ্যক। কারণ, পৃথিবীর উন্নতিকে উপেক্ষা করার দৃঢ় মানসিকতা চাই। আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি এদের কিছু লোককে ভোগ বিলাসের যে উপকরণ দিয়েছি, তার প্রতি তুমি কখনো তোমার দু’চোখ তুলে তাকাবে না ( সূরা ১৫, আয়াত ৮৮)।
লক্ষণীয় বিষয়, বৈষয়িক উন্নতির জন্য হেন কাজ নেই, যা আমরা করি না। পরকালীন সাফল্য পেতেও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা জরুরি বৈকি। এর জন্য যে চলাচল, তা হতে হয় ঐশী জ্ঞানের আলোকে। এটি অর্জন করতে হয় প্রতিনিয়ত কুরআন চর্চায়। ঐশী জ্ঞানের সাথে থাকতে হয় বোঝাপড়া। তবেই আশা করা যায় পরিশুদ্ধ মানবজীবন। পরকালে বাস উপযোগী বনভূমি পাওয়ার পথিক হতে কষ্টসহিষ্ণুতার বিকল্প নেই। পরকালীন সাফল্য সম্পর্কে আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘এটাই মহাসাফল্য। এই সাফল্য পেতে হলে তো সাধকের মতো সাধনা করা দরকার।’ (সূরা-৩৭, আয়াত-৬০-৬১)। ভাবা প্রয়োজন, তাৎক্ষণিক চাওয়া-পাওয়ার পৃথিবীর এই ক্ষণস্থায়ী জিন্দেগির সাফল্যের পরিবর্তে জান্নাতে অভিবাসনপ্রত্যাশী হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। এতেই লুকিয়ে রয়েছে মানবজীবনের প্রকৃত সার্থকতা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা