খিলাফতের অর্থনৈতিক তাৎপর্য
- শাহ্ আব্দুল হান্নান
- ২৪ ডিসেম্বর ২০২০, ২১:২১
‘অতঃপর আমরা তাদের পর পৃথিবীতে তোমাদেরকে স্থলাভিষিক্ত করেছি, তোমরা কী প্রকার আচরণ করো তা দেখার জন্য।’ (সূরা ইউনুস : ১৪)
খলিফা এ আয়াতে ‘খালায়েফ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর একবচন হচ্ছে খলিফা। এটি কুরআন মাজিদে ব্যবহৃত একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ। খলিফা শব্দের তাৎপর্য বর্ণনা প্রসঙ্গে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী লিখেছেন : খলিফা তাকে বলা হয় যে অন্য কারো মালিকানায় তারই প্রদত্ত ক্ষমতা এখতিয়ার ব্যবহার করে। খলিফা কখনো মালিক হতে পারে না। প্রকৃত মালিকের ইচ্ছা ও কামনা অনুসরণ করা তার কর্তব্য।
এমতাবস্থায় সে যদি নিজে মালিক হওয়ার দাবি করে বসে এবং মালিক প্রদত্ত ক্ষমতা খামখেয়ালিভাবে ব্যবহার করতে শুরু করে কিংবা প্রকৃত মালিককে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে মালিক মনে করে, তারই ইচ্ছা-বাসনা অনুসরণ এবং তারই আদর্শ পালন করতে শুরু করে দেয়, তবে তা হবে বিশ্বাসঘাতকতামূলক পদক্ষেপ।
তাফসিরকারদের মতামত
এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ শফী লিখেছেন, ‘পূর্ববর্তী জাতি সম্প্রদায়ের ধ্বংস করার পর আমি তোমাদেরকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছি এবং পৃথিবীর খিলাফত তথা প্রতিনিধিত্ব তোমাদের হাতে অর্পণ করেছি। কিন্তু তাই বলে এ কথা মনে করো না যে, পৃথিবীতে খিলাফত কেবল ভোগ-বিলাসের জন্যই তোমাদের হাতে অর্পণ করা হয়েছে; বরং এই মর্যাদা ও সম্মানদানের আসল উদ্দেশ্য হলো, তোমাদের পরীক্ষা নেয়া। তোমরা কি অতীতের উম্মতদের ইতিহাস থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে নিজেদের অবস্থা সংশোধন করো, না রাষ্ট্র ও ধন-দৌলতের নেশায় উন্মত্ত হয়ে পড়, তা দেখা। এতে প্রতীয়মান হয়ে গেল যে, পৃথিবীর সাম্রাজ্য ও প্রভাব-প্রতিপত্তি কোনো অহঙ্কারের বিষয় নয় বরং একটি ভারী বোঝা, যাতে রয়েছে বহু দায়-দায়িত্ব।
আয়াতের সাধারণ অর্থনৈতিক তাৎপর্য
সূরা ইউনুসের ১১-১৩ নং আয়াতে আল্লাহকে অমান্যকারীদের পরিণতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর ১৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা পূর্ববর্তীদের পরিবর্তে নতুন লোকদের পৃথিবীতে দায়িত্ব দিয়েছেন,যাতে তিনি তাদের আচরণ লক্ষ করতে পারেন।
এ আয়াতে মানুষের আচরণের গুরুত্ব উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষের আচরণের ভালো-মন্দের জন্যই আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে এক জাতির পর অন্য জাতির উত্থান ঘটান, অর্থাৎ মানুষের আচরণ ইতিহাসে বিভিন্ন জাতির উত্থান-পতনের বড় কারণ। কুরআনের অন্যান্য আয়াতে মানুষের ঈমান বা সঠিক বিশ^াসকেও জাতির কল্যাণ-অকল্যাণের কারণ বলা হয়েছে। সূরা আসরে আল্লাহ পাক উল্লেখ করছেন, ‘সময়ের সাক্ষ্য। মানুষ সব সময় ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তারা ছাড়া, যারা ঈমান এনেছে, ভালো কাজ করেছে; একে-অপরকে সত্যের পথে এবং ধৈর্যধারণের ব্যাপারে সহযোগিতা করেছে।’
খিলাফতের অর্থনৈতিক বিষয়ে প্রথম বলা হচ্ছে যে, মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহর খলিফা। রাব্বুল আলামিনের অন্যতম অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ সব জীবের প্রতিপালক। তাই রাব্বুল আলামিনের প্রতিনিধি হিসেবে প্রত্যেক মানুষকে অন্য সব মানুষ ও জীবের জীবিকা ও প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব পালন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে কুরআন পাকের নিম্নোক্ত আয়াতগুলোর উল্লেখ করা যায়। সব প্রাণীর রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহর (সূরা হুদ : ৬)
আমার ইচ্ছা যে, দুনিয়াতে যারা বিস্তৃত তাদের ওপর মেহেরবানি করব এবং তাদেরকে দুনিয়াতে ইমাম বানাব, দুনিয়াতে তাদের আমার উত্তরাধিকারী এবং পৃথিবীতে তাদের ক্ষমতা দান করব। (সূরা কাসাস : ৫)
আল্লাহর পক্ষ থেকে আল্লাহর দেয়া সম্পদ থেকে আমার রিজিক পাওয়ার সুযোগ করে দেয়া বান্দার দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ দায়িত্ব বিশেষ করে মুসলিম সরকারের আরো বেশি। কেননা তারা গোটা জাতির পক্ষ থেকেও দায়িত্বপ্রাপ্ত। তেমনিভাবে নির্যাতিত জনগণের নির্যাতন দূর করাও খলিফা হিসেবে সবার এবং বিশেষ করে সরকারের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।
এ কথাও উল্লেখযোগ্য যে, খিলাফতের নীতিই প্রধান গুরুত্বের দাবিদার। তাতে কোনো পরিবর্তন হবে না। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে বা জনগণের মতামতের ভিত্তিতে কাজ করতে গেলে অবস্থাবিশেষে পরিবর্তন করা যেতে পারে, যদি তাতে শরিয়াহর কোনো প্রমাণিত নীতির লঙ্ঘন না হয়।
এ আয়াতে যে খিলাফতের কথা বলা হয়েছে, তাতে অর্থনৈতিক খিলাফতের সাথে সাথে রাজনৈতিক খিলাফতের নীতিও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। খিলাফতের অর্থনৈতিক নীতি হচ্ছে- দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত জনগণের সম্মতিতে গ্রহণ করতে হবে। জাতির অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত হতে জনগণকে বাদ দেয়া যাবে না। এ যুগে তা করার সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে, স্বাধীনভাবে নির্বাচিত পার্লামেন্টের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। স্বাধীন পত্রপত্রিকাও এ ব্যাপারে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে এ আয়াতের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রয়েছে। আল্লাহ পাক মানুষের আচরণ লক্ষ করেন। এ আচরণের মধ্যে নিশ্চয়ই অর্থনৈতিক আচরণও অন্তর্ভুক্ত। মানুষের অর্থনৈতিক আচরণের জন্য সে আল্লাহর কাছে দায়ী। মানুষকে তার অর্থনৈতিক আচরণের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। মুসলিম সরকার যেভাবে আল্লাহর নিকট দায়ী, মুসলিম শাসকগণ সম্পর্কেও একই কথা। তাই মানুষ যদি আল্লাহর অনুগত হয়, তাহলে সে অবশ্যই অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইসলামী নিয়ম-নীতি অনুসরণ করবে। কোনো অর্থনৈতিক জুলুম করবে না; বরং অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করবে। মানুষের অর্থনৈতিক আচরণের জন্য জবাবদিহি করা ইসলামের বৈশিষ্ট্য, যা এ আয়াতের দ্বারা প্রমাণিত হয়।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা