০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

মিডিয়ার ‘কাঙালপনা’

আহমদ ছফা - ছবি সংগৃহীত

সংবাদপত্র সমাজের দর্পণ। এতে প্রতিফলিত হয় সমকালীন জনভাবনা। অন্য অর্থে, সংবাদমাধ্যমে নিজ ভূখণ্ডের চলমান ইতিহাস অক্ষরে চিত্রায়িত হয়। যে জন্য মিডিয়ার থাকতে হয় প্রখর মাত্রাজ্ঞান বা পরিমিতিবোধ। অবশ্য এটি নির্ভর করে সংবাদকর্মীদের মানসিকতা, জানাশোনার পরিধি ও রুচিবোধের ওপর। যেহেতু গণমাধ্যমের মূল চালিকাশক্তি সংবাদকর্মী; তাই তাদের হতে হয় প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত ও তীক্ষ্ণ ধীশক্তি সম্পন্ন। নিজের সমাজ, ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে থাকতে হয় পূর্ণমাত্রায় ওয়াকিবহাল। এর ব্যত্যয় ঘটলে দেখা দেয় বিপত্তি। তখন সাধারণের স্বার্থ সংরক্ষণের অঙ্গীকার হয় গৌণ; গোষ্ঠীবিশেষের স্বার্থ রক্ষাই হয়ে ওঠে ধানজ্ঞান। আদর্শহীন মিডিয়া আপন সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে বিজাতীয় সংস্কৃতি বাজারজাত করতে কসুর করে না। ক্ষেত্রবিশেষে পুলকিত বোধ করে। লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে নগ্ন প্রতিযোগিতায় নামে। অনেকসময় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ গণমাধ্যম সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা হারায়। হয় দেউলিয়া। নিজের সমাজের দিকে না তাকিয়ে কর্তব্য নির্ধারণ করে। ঠিক সেই সময় সাংবাদিকতার নামে যে কাণ্ডকারখানা সংঘটিত হয়; তা ‘কাঙালপনা’ ছাড়া কিছু নয়।

কয়েক দশক ধরে মূলধারার কিছু বাদে বেশির ভাগ পত্রিকার কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। এর একটি টাটকা নমুনা দিন তেইশ আগে পত্রিকার পাঠক পরখের সুযোগ পেলেন। ভারতীয় বিশিষ্ট অভিনেতা সৌমিত্রের মৃত্যু সংবাদ ঢাকার প্রায় সব পত্রিকা যেভাবে ছেপেছে; তা আমাদের মিডিয়ার মনোজতত্ত্ব ও মানসিকতা উপলব্ধিতে সহায়ক হয়েছে। বিশ্বে স্নায়ুযুদ্ধকালে ঢাকার রাজনীতিতে একটা কথা চালু ছিল, ‘মস্কো কিংবা পিকিংয়ে (বর্তমান নাম বেইজিং) বৃষ্টি হলে ঢাকায় বসে অনেকে ছাতা ধরতেন’। এতে নাকি মানসিক আরাম বোধ করতেন তারা!

১৫ নভেম্বর কলকাতায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সৌমিত্র। কাকতালীয় কিনা জানি না, সাবেক এক মস্কোপন্থীর সম্পাদিত পত্রিকাতেই সৌমিত্রকে নিয়ে প্রথম পাতায় ঢাউস ছবিসহ দীর্ঘ সংবাদগল্প ছাপা হয়েছে। এতেও মন না ভরলে শেষের পাতায় ছবিসহ তিন কলাম আরেকটি বাক্সবন্দী ফিচার ছাপা হয়। ভেতরে বিনোদনের পাতার কথা নাইবা বললাম। ৮৫ বছরের দীর্ঘ আয়ু পেয়েছিলেন সৌমিত্র। ঢাকাই পত্রিকায় সেই মৃত্যু সংবাদই শুধু নয়, প্রায় সব নামী-দামি কাগজে পরের কয়েক দিন চলে সৌমিত্র কীর্তন ও বন্দনা। যা মাতমের সাথে তুলনীয়। আমরা দ্বিধাহীন মনেই স্বীকার করি, নিঃসন্দেহে সৌমিত্র ছিলেন অত্যন্ত শক্তিমান অভিনেতা। তার অভিনয়শৈলী ছিল ঈর্ষণীয়। আধুনিক বাংলা চলচ্চিত্রে তার অবদান অতুলনীয়। জীবদ্দশাতেই হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তিসম। তার ভরাট কণ্ঠের আবৃত্তি শ্রোতার মনে দাগ কাটত। তবে এ কথাও অনস্বীকার্য, সৌমিত্রের সব কীর্তি ভারতীয় সংস্কৃতির অংশ। তিনি মনেপ্রাণে ছিলেন একজন ভারতীয়। তার জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পশ্চিম বাংলার কৃষ্ণনগরে।

সৌমিত্রকে নিয়ে ঢাকাই মিডিয়ার মাত্রাজ্ঞানের অভাব এবং কাঙালপনা দেখে প্রথিতযশা লেখক আহমদ ছফার ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ বইটির কথা মনে পড়ল। বইটি ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশ করা হয়। বইয়ের নাম প্রবন্ধটি তিনি ১৯৭৭ সালে লিখেছিলেন। সেই প্রবন্ধে বাঙালি মুসলিমমানসকে নতুনভাবে তুলে ধরেন তিনি। তিনি লিখেছিলেন, যে জাতি নিজের ভালোমন্দ নিরূপণ করতে অক্ষম, তাকে দিয়ে উন্নত রাষ্ট্র সম্ভব নয়। তার এ বিশ্লেষণ এখনো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি। প্রবন্ধটিতে তিনি বাঙালি মুসলমানের নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন। সাহিত্য ও ইতিহাস ঘেঁটে খোঁজার চেষ্টা করেছেন, বাঙালি মুসলমান কেন পিছিয়ে। কেন একটি আদর্শে বেশি দিন স্থির থাকতে পারে না। পশ্চাৎপদতার কারণ হিসেবে বাঙালি হওয়া বা মুসলমান হওয়াকে নয়, বরং এই অঞ্চলের মানুষ দীর্ঘ একটা সময় যে বৈষম্যের মধ্য দিয়ে গেছে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে, সব কিছুকেই এর জন্য দায়ী করেছেন তিনি।

ছফা লিখেছিলেন, বাঙালি মুসলমান সমাজ স্বাধীন চিন্তাকেই ভয় করে। ভাসা ভাসা জ্ঞান থাকলেও, ভাব করে যেন অনেক জানে। তিনি আরো লিখেছেন, যে নিজের ভালোমন্দ নিরূপণ করতে পারে না, অপরের পরামর্শ ও শোনা কথায় কাজকর্ম করে, তাকে খোলা থেকে আগুনে কিংবা আগুন থেকে খোলায়, এইভাবে পর্যায়ক্রমে লাফ দিতেই হয়। এদের চিন্তা ও মননের গভীরতা বাড়েনি, বাইরের কথা শোনে, কারো কথা শুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছফার পরামর্শ ছিল, বাঙালি মুসলমানদের মন যদি নির্মোহভাবে জানা যায়, তাহলে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটা উপায় বেরিয়ে আসতে পারে। সেই চেষ্টা খুব যে গভীরভাবে হয়েছে চোখে পড়ে না। ছফা বলেছিলেন, ‘সুবিধার কথা হলো, নিজের পঙ্গুত্বের জন্য সবসময়ই দায়ী করার মতো কাউকে না কাউকে পেয়ে যায়।’ ছফা সে কারণেই বলেছিলেন, নিজেদের বুঝতে হবে। ঘৃণা নয়, ভালোবাসা দিয়ে একটা সাম্য ও সহমর্মিতার সমাজ যেখানে সবার অধিকার সংরক্ষিত, এমন একটি সমাজ গঠন করায় মনোযোগী হতে হবে।
অনেকেই ছফার বিশ্লেষণের সাথে ভিন্ন মত পোষণ করতেই পারেন। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু ছফার পর্যবেক্ষণ এখনো প্রাসঙ্গিক বলেই মনে হয়। আমরা স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছি তা-ও পাঁচ দশক হয়ে গেল। অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও একটি মজবুত জাতি গঠনে কতটুকু অগ্রসর হয়েছি, বুদ্ধিবৃত্তিক পাটাতন কতটুকু শক্ত ভিত পেয়েছে- তার একটি নির্মোহ মূল্যায়ন দরকার। এখনো অন্যের অর্জনকে যেভাবে নিজের কৃতিত্ব ভেবে আত্মভোলা হই; তাতে এ পর্যালোচনা সময়ের দাবি। সৌমিত্রের অর্জনকে একটি স্বাধীন দেশের গণমাধ্যম শুধু ভাষার কারণে যেভাবে নিজেদের ভেবে কাঙালপনায় মেতে উঠেছিল; তা স্রেফ হীনম্মন্যতা।

ন্যূনতম মর্যাদাবোধ থাকলে এমন কাণ্ড করার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু ঢাকাই মিডিয়ার ওই বোধবুদ্ধি আছে বলে মনে হয় না। এই আচরণকে গ্রামীণ মানসের প্রতীকী চিত্রায়ণের মাধ্যমে আমরা বোঝার চেষ্টা করতে পারি। ধরা যাক, কোনো এককালে তদানীন্তন পূর্ব বাংলার অজপাড়াগাঁ থেকে ভাগ্যান্নষণে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায় ডেরা গাড়েন একজন। কলকাতায় বৈষয়িক একটু কলকে পেয়ে পৈতৃক ভিটেমাটির পাট চুকিয়ে সব পোষ্য নিয়ে গ্রামছাড়া হন। প্রোথিত হন নগর কলকাতায়। পরিবারটির পরবর্তী প্রজন্ম কলকাতায় প্রতিষ্ঠা পায়। স্বাধীন ভারতে ওই পরিবারের একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হন। তিনি বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হলে পত্রিকায় খবর পড়ে পূর্বপুরুষের জন্মভিটেতে গ্রামবাসী চাঁদা তুলে শ্রাদ্ধের আয়োজন করে। কিন্তু দশ গায়ের লোক এ নিয়ে হাসাহাসি করলে গর্বের সাথে তারা বলতে থাকে, তার পূর্বপুরুষ এ গায়েরই লোক। তবে নিজেদের আলাপে উঠে আসে আসল তথ্য। ওই গ্রামের বাসিন্দাদের আশপাশে পাত্তা ছিল না। অন্য সব গ্রামে পাত্তা পেতে এমন কাণ্ড। যেন পরের ধনে পোদ্দারি। সৌমিত্রের সংবাদ কভারে ঢাকাই মিডিয়ার অবস্থাও হয়েছে একই দশা।

কিন্তু কেন এমন মানসিকতা? জবাবে বলা যায়, দীর্ঘ দিন এ জনপদের মানুষ নানাজনের তাঁবেদারি করে অবশেষে বিপুল রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেলেও এখনো আত্মপরিচয় সঙ্কটে ভুগছে। মনোজগতে উপনিবেশ বাসা বেঁধে আছে। সেই অবসাদের প্রতিক্রিয়াতেই অস্বাভাবিক এই আচরণ। স্বাধীন চিন্তাশক্তি শাণিত না হওয়ার বিষফল আর কী। একই সাথে ভিনদেশীরা সুকৌশলে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালাতে সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের মোড়কে গণমাধ্যম দিয়ে নিজের কর্মসূচির বাস্তবায়নে কসুর করে না।

আমাদের কিছু পত্রিকা ভারতীয় কোনো সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে যত না আপন মনে করে যত্নসহকারে সংবাদ পরিবেশন করে; সেখানে সর্বভারতীয় বাদই দিলাম, পশ্চিম বাংলার পত্রিকাগুলোও সামান্য জায়গা দিতেও কার্পণ্য করে। এর টাটকা দৃষ্টান্ত হলো, বাংলাদেশী বিশিষ্ট অভিনেতা আলী যাকের গত হয়েছেন দিন কয়েক আগে। কই তাকে নিয়ে তো কলকাতার খবরের কাগজ আদিখ্যেতা দেখায়নি। ঠিক একইভাবে বাংলা ভাষার জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ শুধু বাংলাদেশী হওয়ায় তার মৃত্যুতে কলকাতার পত্রিকাগুলো নীরবতা পালনই শ্রেয় মনে করেছে। অথচ বিটিভিতে প্রচারিত হুমায়ূনের নাটকগুলো পশ্চিম বঙ্গেও ছিল তুমুল জনপ্রিয়। সাংবাদিকতার ভাষায় একটি কথা আছে; খবরের সংবাদমূল্য। হুমায়ূন আহমেদের বেলায় সংবাদমূল্য থাকার পরও কলকাতার মিডিয়া তা উপেক্ষা করেছে। অথচ কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর আমাদের গণমাধ্যমের মাতামাতি ছিল রীতিমতো দৃষ্টিকটু। ঢাকা এবং কলকাতার সংবাদমাধ্যমের এই যে আচরণগত পার্থক্য, একি শুধুই ঈর্ষা নাকি জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা কিংবা হীনম্মন্যতা? সেই প্রশ্নেরও মীমাংসা হওয়াও জরুরি। তা না হলে ব্রিটিশ ভারতে আমরা যে তিমিরে ছিলাম; সেখানেই পড়ে থাকতে হবে। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও নিজস্ব সত্তায় দাঁড়ানোর বিষয়টি থেকে যাবে দূরপরাহত।

[email protected]

 


আরো সংবাদ



premium cement