২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

প্রবৃদ্ধি নিয়ে কিছু কথা

-

নয়া দিগন্তের ২৫ নভেম্বর সংখ্যায় উপ-সম্পাদকীয়গুলোর একটি হলো, বিখ্যাত প্রবাসী শিক্ষাবিদ ও লেখক অধ্যাপক আবু এন এম ওয়াহিদের ‘জিডিপিই শেষ কথা নয়’। চমৎকার লেখা। বাংলাদেশে যখন গণতন্ত্র দাবিয়ে হলেও উন্নয়নের রাজঘোটক ছোটাতে সরকার ব্যতিব্যস্ত, তখন প্রবৃদ্ধি-বিভ্রান্তির বিষম ঘোর যেন এ লেখার দ্বারা কশাঘাত খেলো। বাংলাদেশের মানুষের জন্য বর্তমানে বড় সমস্যা কী, সেটা নির্ধারণ করা গেলে প্রবৃদ্ধির বিলাসিতায় কোনো মহল মেতে উঠতেন না। জিডিপি বা প্রবৃদ্ধিই যে শেষ কথা নয়, এর আরেক নজির হচ্ছে- ব্যাংক খাতের ঋণখেলাপি সংস্কৃতি। দেশে এখন তা বাড়ছে প্রবৃদ্ধির মতো। অথচ হওয়ার কথা উল্টো। ব্যাপার কী?

দেশের মানুষ শান্তি খুঁজছে; পাচ্ছে না। নিরাপত্তার কোনো বালাই নেই। নানামুখী আগ্রাসনে জাতি উদ্বিগ্ন। বিভিন্ন ভয়াবহ অপরাধের ক্রমবিস্তৃতি দেশকে চরম দুর্দশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ দিকে সরকার জোর গলায় বলছে, এ দেশ উন্নয়নের রথে চড়ে ছুটছে; আর জিডিপি শনৈঃ শনৈঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু যে প্রবৃদ্ধি দেশবাসীর শান্তি-স্বস্তি, নিরাপত্তা এতটুকুও বৃদ্ধি করে না, যে প্রবৃদ্ধি দেশের অবকাঠামো গড়লেও নাগরিকদের দেহের কাঠামোটাকেই প্রতি মুহূর্তে বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়া থেকে বাঁচাতে পারে না, সে প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমরা কী করতে পারি?

জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধিও যে খেলাপি ঋণের বহর কমাতে পারছে না, তা তুলে ধরেছে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান- বিআইবিএম, মানে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট। এক গবেষণা প্রতিবেদনে বিআইবিএম এটা উল্লেখ করেছে। গত ২৬ নভেম্বর একটি ওয়েবসাইট সেমিনার তথা ওয়েবিনারে এটি উপস্থাপন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানের আলোচ্য বিষয় ছিল- ‘বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে এনপিএল (খেলাপি ঋণ) : বৃহত্তর অর্থনীতি এবং ব্যাংক খাতের প্রেক্ষাপট।’

সাধারণত মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি বাড়লে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে যায় উন্নত অর্থনীতির দেশে। তবে আমাদের বাংলাদেশে তা হয়নি। অর্থাৎ প্রমাণিত হচ্ছে, এ দেশের অর্থনীতি আসলে উন্নত নয়। জিডিপি আর এনপিএলের প্রবৃদ্ধি পরস্পর বিপরীত আনুপাতিক। কারণ প্রকৃত জিডিপির শক্তিশালী ও ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির সুফল হলো, অধিক আয় করা। এতে ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধের প্রবণতা বাড়ে। ফলে খেলাপি ঋণ কমে যায়। এ কথা বিআইবিএমের রিপোর্টেও বলা হয়েছে। বাংলাদেশে জিডিপি বাড়ে, তবে ঋণখেলাপি হওয়ার মন্দ প্রবণতা কমে না। বিষয়টা কৌতূহলোদ্দীপক বলে মনে করা হচ্ছে। এর কারণ হলো, ‘বাংলাদেশে উল্লেøখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তি রয়েছেন যারা ইচ্ছা করেই ঋণ শোধ করেন না।’ এই মন্তব্য আলোচ্য রিপোর্ট বা প্রতিবেদনের প্রণেতা ও বিআইবিএমের সহযোগী অধ্যাপক মো: আলমগীরের।

উল্লেখ্য, গত জুন মাসের শেষে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। এটা ব্যাংকসমূহের বণ্টন করা সর্বমোট ঋণের ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ।

আলোচ্য নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, ঋণ প্রদানের হার খেলাপি ঋণকে প্রভাবিত করে থাকে। এমন অবস্থায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা আর ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে। ঋণসুদের নিম্নহার ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়াবে।

এ দিকে দেখা যায়, বণ্টিত মোট ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও পার্সেন্টেজ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ অর্থনৈতিক সঙ্কট অথবা ব্যাংকের ব্যর্থতা কিংবা এর দুটোই। এতে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত।

খেলাপি ঋণ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে বিআইবিএম কয়েকটি সুপারিশ করেছে। যেমন- দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংযোগকারী, ডাটার অংশীদারিত্বের ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এর ফলে সংশ্লিষ্ট ঋণদাতা ব্যাংক ঋণের মন্দ গ্রহীতার ব্যাকগ্রাউন্ড খতিয়ে দেখতে পারবে। তখন তাদের চিহ্নিত করা যাবে। এটা করা হলে ব্যাংকগুলো কেবল তাদেরকে ঋণ দেবে, যাদের বিশ্বাসযোগ্যতা বেশি। এটা ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের মাধ্যমে সম্ভব বলে বিআইবিএম মনে করে।

ওই ওয়েবিনার অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মনিরুজ্জামান বলেছেন, ‘ব্যাংকের জোরালো অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা ও সুশাসন এনপিএল বা খেলাপি ঋণ হ্রাস করতে পারে। তার ভাষায়, বাংলাদেশের এমন আত্মতুষ্টি আছে যে, আমরা দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বা সার্কের দেশগুলোর মাঝে বেশি মন্দ অবস্থানে নেই। তবে এনপিএল সহনীয় পর্যায়ে তোলার জন্য এখনো অনেক কাজ করা দরকার। তিনি বলেন, ঋণগ্রহীতাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য অতীব গুরুত্ববহ। এ জন্য মনিটরিং সিস্টেম জোরদার করার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

বিআইবিএমের মহাপরিচালক মো: আখতারুজ্জামান বলেন, ‘ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রহীতার ভুয়া কাগজপত্রের দরুন ব্যাংক ভুল করতে পারে। তবে এ ব্যাপারে মনিটরিং অব্যাহত থাকলে খেলাপি ব্যক্তিরা ব্যাংকের টাকা মেরে দেয়ার প্রবণতা কমবে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার আরেক কারণ হলো, ঋণগ্রহীতার বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রয়ের কাজে বিচার বিভাগের বিলম্ব। কারণ কোনো ব্যাংক এ প্রক্রিয়া শুরু করলেই খেলাপি ব্যক্তিরা আদালত থেকে ‘স্থগিতাদেশ’ নিয়ে আসেন।

রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী আতাউর রহমান প্রধান বলেন, ১৯৮৫ সালের মামলার আজো সুরাহা হয়নি। তাই ঋণের বন্ধকি সম্পত্তি বেচে সে অর্থ আনা যায় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটা হচ্ছে। অথচ ব্যাংকগুলোর অভিমত গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্ভাবনা বিপুল। ঋণ দেয়ার সময়ে ভালোভাবে দেখেশুনে তা প্রদানের জন্য সভায় জোর দেয়া হয়েছে। আরো বলা হয়, যোগ্য জনশক্তি নিয়োগ করে ব্যাংকগুলোকে দেখতে হবে, কেন ঋণ চাওয়া হচ্ছে।

বিআইবিএম মনে করে, একই ব্যক্তির একাধিক ব্যাংকের ঋণ পাওয়া বন্ধ করতে হবে। ব্যাংকের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। ঋণগ্রহীতার প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকের এজেন্ট নিয়োগ করে সবকিছু মনিটর করা চাই। ঋণগ্রহীতার যথাযথ মূল্যায়ন আর করপোরেট গভর্ন্যান্সকেও গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়েছে। রাজনৈতিক চাপযুক্ত ঋণই খেলাপি বেশি হয় বলে একটি বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান উল্লেখ করেছেন।


আরো সংবাদ



premium cement