বাঘের পেছনে ফেউ; করোনার দ্বিতীয় ঢেউ!
- মীযানুল করীম
- ২১ নভেম্বর ২০২০, ২০:২৩
‘পদ্মার ঢেউরে, মোর শূন্য এ হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা, যা-রে’ নজরুলের একটি বিখ্যাত গানের প্রথম কলি এটি। ফেরদৌসী রহমানের কণ্ঠে এ সুমধুর সঙ্গীত অনেকেই শুনেছেন। তবে আমরা যে ঢেউ নিয়ে আলোচনা করছি, তা পানির ঢেউ নয়, মহামারী সংক্রমণের ধাক্কা। এটা পদ্মার ঢেউয়ের চেয়ে অনেক বড় বিপদ ডেকে আনে।
করোনা মহামারী চলছে ২০২০ সালের শুরু থেকেই। এখন বছর শেষের দিকে। বাংলাদেশে এর সূচনা বিগত মার্চে। এর মধ্যে করোনার তাণ্ডব কিছুটা কমেছিল। তবে আসন্ন শীত যত এগিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে এর প্রকোপ এবং তা নিয়ে মানুষের শঙ্কা। অন্য দিকে করোনার সংক্রমণ এবং এতে মৃত্যু না থামলেও মানুষের ভ্রমণ ও বিনোদন প্রবণতাও থামছে না। বর্তমান এ পরিস্থিতি ফুটে উঠেছে ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতার একটি গল্পে। লেখকের ভাষায়, ‘পতেঙ্গার সমুদ্রসৈকত লোকারণ্য। করোনা এখনো বিদায় হয়নি। টিকা কখন আবিষ্কৃত হবে, তা বোধহয় বিজ্ঞানীর চেয়ে জ্যোতিষীরা ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু মানুষের আচরণে একটা ‘মরলে মরছি’ ধরনের বেপরোয়া ভাব এসে পড়েছে। নইলে ঘরে বসে যাদের দিন গোনার কথা, তারা সমুদ্রের ঢেউ গুনতে এসেছে কেন!’ তবে বাহ্যিকভাবে জীবনযাত্রা যতই স্বাভাবিক ও কর্মচঞ্চল মনে হোক, প্রতিদিনই কোভিডে মানুষ মরছে। শীত যত বাড়বে, ততই এর তাণ্ডব বাড়বে বলে ডাক্তাররাও আশঙ্কা করছেন।
এ অবস্থায় কথা হলো- সত্যিই কি করোনার এ ঢেউ দেশে হানা দেবে? না কি দেবে না? এ দিকে পত্রিকা বলছে, ভারতের রাজধানী দিল্লিতে করোনার তৃতীয় ঢেউ চলছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় কি দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়বে? বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী ড. রওনক জাহানের মতো অনেকে মনে করছেন, ‘হঠাৎ করোনার নয়া ঢেউ শুরু হবে প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ না দিয়েই।’ এমনিতেই বাংলাদেশে করোনায় মৃতের যে সংখ্যা তুলে ধরা হচ্ছে, তাতে আন্তর্জাতিক মহলের আস্থা নেই। বরং বিশ্বে সুপরিচিত, বৈজ্ঞানিক জার্নাল ‘ল্যানসেট’ বলেছে, আসলে বাংলাদেশে ঘোষিত সংখ্যার চার গুণ মানুষ কোভিডে প্রাণ হারাচ্ছে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ জাতীয় অর্থনীতির ওপর আগের চেয়ে বড় আঘাত হানতে পারে। এই হুঁশিয়ারি দিয়ে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, ‘বৃহত্তর স্বার্থে স্বাস্থ্যবিধি কড়াকড়ির সাথে মেনে চলার বিকল্প নেই।’
অন্য দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির সাবেক ভিসি প্রফেসর কামরুল হাসান খানের মতে, শীতে করোনা সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পাওয়ার যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, এর কারণ রয়েছে। তিনি বলেছেন, বিশ্বখ্যাত জার্নাল ‘ফোর্বস’-এর গত ১০ অক্টোবর সংখ্যায় স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ ব্রুস ওয়াই লি করোনার সম্ভাব্য দ্বিতীয় ঢেউয়ের অন্তত আটটি কারণ জানিয়েছেন। এর মধ্যে আছে, ক. কম আর্দ্রতা ও কম তাপমাত্রা; খ. ব্যবসায়-বাণিজ্য আবার চালু হয়ে যাওয়া; গ. স্কুল আবার খুলে দেয়া; ঘ. বাইরের লোকসমাগম এখন ঘরের ভেতর পরিলক্ষিত হওয়া; ঙ. ইনফ্লুয়েঞ্জা ও শ্বাসতন্ত্রের নানান অসুখ-বিসুখ; চ. স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় গণমানুষের সচেতনতার অভাব; ছ. প্রচারণায় বিভ্রান্তি এবং জ. জাতীয় পর্যায়ে সমন্বয়হীন পরিকল্পনা।
আমাদের এ দেশে যদিও তাপমাত্রা শীতকালেও বরফ পড়ার পর্যায়ে নেমে যায় না এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলেনি, তবে উল্লিখিত অন্যান্য কারণ এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বৈকি। কারণ, বিশ্বের বহু দেশের মতো বাংলাদেশেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। এ দিকে মাস্ক পরাসহ জরুরি স্বাস্থ্যবিধি মানতে মানুষের আগ্রহের অভাব ব্যাপক ও ক্রমবর্ধমান। অন্য দিকে শীতের সময়ে বেড়ে যাচ্ছে ধূলিদূষণ ও শ্বাসতন্ত্রের রোগব্যাধি। আর বিভ্রান্তিকর নানান প্রপাগান্ডার সাথে জাতীয় পরিকল্পনার হ-য-ব-র-ল দশার কথা সবার জানা।
স্মর্তব্য, শতবর্ষ আগে ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু এবং এখন থেকে এক দশক আগের এইচ ১ এন ১ ফ্লু শীতকালে দ্বিতীয় ঢেউ তুলে ব্যাপক ক্ষতি করেছিল। সে কথা ভুলে গেলে পস্তাতে হবে।
কথায় বলে, ‘মাঘ মাসের জাড়ে;/বনের বাঘও মরে।’ এবার ভয় হচ্ছে, বনের পশুর আগেই মানুষের প্রাণহানি বেড়ে যায় কি না। কারণ করোনার শিকার হচ্ছে প্রধানত মানুষজনই। এখন অগ্রহায়ণ মাস। এ বছর শীত গতবারের চেয়ে বেশি পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চলতি মাসের শেষ দিকে ঠাণ্ডা জেঁকে বসতে পারে। অতীতেও অনেক সময়ে নভেম্বরের প্রথম থেকে শীতের আবহ দেখা গেছে পুরোপুরি। পাশ্চাত্যে যে শীত নেমেছে, তা টিভির পর্দায় প্রতিনিয়ত প্রমাণিত হচ্ছে। সোয়েটার তো বটেই, লং কোট-জ্যাকেট-মাফলার পরেও শীত মানানো যাচ্ছে না।
শীতের সময়ে করোনা মহামারী কেন বাড়ছে? এর কারণ- ১. শীতপ্রধান দেশগুলোতে এ সময়ে নাকসহ শ্বাসনালীর পর্দা শুষ্ক হয়ে যায়। ফলে করোনাভাইরাস দ্রুত পর্দা ভেদ করতে সক্ষম হয়; ২. বছরের অন্য সময়ের মতো শীতকালে এ পর্দা নাক ও শ্বাসনালীর বালু, ময়লা, জীবাণু ইত্যাদি পরিষ্কার করতে পারে না; ৩. শীতের সময়ে ভাইরাসযুক্ত বালুকণা বাতাসে অধিকক্ষণ ভাসে। ফলে বেশি মানুষ সংক্রমিত হতে পারেন; ৪. শীত ঋতুতে ফ্লু, শ্বাসনালী ও ফুসফুসের রোগ, শিশুদের অসুখ-বিসুখ ইত্যাদি বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। এতে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। সুযোগটা নিতে পারে করোনাভাইরাস।
কিন্তু কথা হলো, এসব আশঙ্কার বাস্তবতার মাত্রা নিয়ে। সব কিছুর অনিশ্চয়তা উদ্বেগ আরো বাড়িয়েছে। দেশের বিশিষ্ট চিকিৎসক, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইউজিসি অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস সম্পর্কিত অনেক কিছু রয়ে গেছে গবেষণার পর্যায়ে, করোনার সংক্রমণ আজো নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি; এর টিকা আবিষ্কার করাও যায়নি। অতএব, কী ঘটবে এখনই বলা যায় না।’ তার মতে, সব কিছু আগের মতো স্বাভাবিকভাবে চলছে। তার অর্থ এ নয় যে, করোনা সংক্রমণ আর হবে না। তিনি আসন্ন ‘ঢেউ’ মোকাবেলায় প্রশাসনিক ও স্বাস্থ্যগত প্রস্তুতির ওপর জোর দিয়ে বলেছেন, সচেতনতার মাঝেই সফলতা। মাস্ক ছাড়া সেবা নয়। নিজের নিরাপত্তা নিজেকেই নিশ্চিত করতে হবে। কোভিডে আক্রান্ত হলে অন্যকে দোষ দিলে কাজ হবে না।’
ডা: আবদুল্লাহ করোনা নিয়ে বেশ কয়েকবার পত্রিকায় লিখেছেন। নিজের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার নিরিখে বারবার সচেষ্ট হয়েছেন মানুষকে সতর্ক করার জন্য। করোনার দ্বিতীয় ঢেউরের ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার সময় এখন বলেই তার অভিমত। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে স্প্যানিশ ফ্লুর তিনটি ঢেউ উঠেছিল এবং প্রথমটির চেয়ে পরেরটি ছিল মারাত্মক। তাই এখন করোনা নিয়ে এত দুশ্চিন্তা। অনেকের মতে, বাংলাদেশে প্রথম ঢেউই শেষ হয়নি। আর পরবর্তী ঢেউ কতটা গুরুতর হবে, সন্দেহ। তবে উৎকণ্ঠার হেতু হচ্ছে- ক. মানুষের ঘরের বের হওয়া ও সমাগম বেড়েছে। অফিস-আদালত আর দোকানপাট চলছে; খ. বহু দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হয়ে গেছে। শিশু কিশোররা উপসর্গহীন বাহকে পরিণত হয়ে যাচ্ছে নিজের অজান্তেই; গ. অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি মানছে না এবং বিনা কাজেও ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ দেশে স্কুল এখনো বন্ধ। তবু শিশুসন্তান নিয়ে মা-বাবা বেড়াচ্ছেন, বিনোদন স্পটে যাচ্ছেন; ঘ. শীতের সময়ে বদ্ধ ঘরে থাকার প্রবণতা বেড়ে যায়। তবে এমন ঘরে করোনা সংক্রমিত হয় বেশি; ঙ. শীতকালে সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, ফ্লু, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিসসহ শ্বাসযন্ত্রের রোগ বাড়ে। এ সময়ে ফুসফুসের ব্যাধিতে সর্বাধিক মৃত্যু ঘটে; চ. এবার অনেক শিশুকে মহামারীর ফলে সময়মতো টিকা দেয়া যায়নি। ফলে চলতি শীতে অনেক বেশি শিশু হাম, হুপিং কাশি, নিউমোনিয়া, মাম্পস, প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কোভিড মহামারী ফুসফুস বা শ্বাসতন্ত্রের রোগ বলে শিশুরা এর শিকার হতে পারে; ছ. শীতের সময়ে বিয়ে ছাড়াও অনুষ্ঠান, উৎসব বেড়ে যায় এবং এগুলোতে লোক সমাগম হয়ে থাকে। অতএব, সংক্রমণের ঝুঁকিও অধিক যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানা হয়; জ. সর্বোপরি, করোনার টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। কবে নাগাদ তা মিলবে, কেউ জানে না। টিকা বা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পর তা সাধারণ মানুষের নাগালে আসার গ্যারান্টি নেই। সুতরাং ‘বেল পাকলে তাতে কাকের কী’?
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, জীবিকার প্রয়োজনে এবং আর্থসামাজিক কারণে দেশে অনেক কিছুই চালু হয়ে গেছে। সরকার দেখাতে চাচ্ছে, জীবনযাত্রা স্বাভাবিক। বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে হয়তো এর পক্ষে যুক্তি আছে। তবে প্রায় সব কিছু খুলে দেয়ার কারণ মহামারী শেষ হয়ে যাওয়া নয়; স্বাস্থ্যবিধি মেনে রোজগারের তাগিদটাই বড়। জীবনের প্রয়োজনে মানুষ অনিচ্ছাসত্ত্বে¡ও অনেক কিছু করে থাকে। তাই বলে নিশ্চিন্তে ভ্রমণ, উৎসব, সমাবেশ, সামাজিকতা ইত্যাদি এখন নয়। কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধির অনুসরণই প্রথম কাজ এবং সতর্কতার বিকল্প নেই।
ডাক্তাররা বারবার বলছেন, বাইরে মাস্ক পরা অপরিহার্য। বেদরকারে বাইরে নয়। কাজ সেরেই ঘরে ফিরুন। দৈহিক দূরত্ব বজায় রাখুন। হাসপাতাল, যানবাহন, দোকানপাট সর্বত্রই এটা করতে হবে। যাদের কোভিডের উপসর্গ আছে, তা যতই মৃদু হোক, প্রথমেই প্রয়োজন আইসোলেশন। এরপর পরীক্ষা ও ডাক্তারের পরামর্শ। বিশেষত শীতের ঋতুতে ভিড়, উৎসব, অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলা বেশি প্রয়োজন। শিশুকে নিয়ে কারো বাড়িতে, রিসোর্টে, সৈকতে কিংবা আর কোথাও এখন বেড়ানো ক্ষতিকর হতে পারে। বাড়িতে বাইরের লোক এলেও তারা যেন ঘরের অসুস্থ কারো কাছে না যান। বয়স্ক লোকরা যদি গুরুতর কোনো রোগে ভোগেন, তাদের করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়েছে। প্রয়োজনে ফ্লু আর নিউমোনিয়ার টিকা নেয়ার এখনই সময়। টেস্ট-ট্রেসিং-আইসোলেশন-কোয়ারেন্টিনের বিষয়ে ঢিলেমি নয়। দেশের অনেক কোভিড হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গেছে। তবে করোনা রোগী বাড়লে যেন দ্রুত হাসপাতালগুলো আবার চালু হতে পারে তার ব্যবস্থা এখনি করা দরকার। ঘন ঘন হাত পরিষ্কার করা, মাস্ক পরিধান আর তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখার অভ্যাস করা চাই। এসব কাজ ভ্যাকসিনের চেয়ে কম কার্যকর নয়। ভ্যাকসিন যখন আসার আসবে, সে জন্য হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার মানে হয় না।
বাঘের পেছনে পেছনে ‘ফেউ’ থাকে মানুষকে সতর্ক করার জন্য। এতে বাঘ বিরক্ত হলেও মানুষ উপকৃত হয়। করোনারূপী বাঘের তাণ্ডব সম্পর্কে সাবধান করার মতো কোনো ফেউ কি নেই? বিশেষ করে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে এর অধিক প্রয়োজন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা