২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ক্ষমতার পালাবদলের পাঁচালি

গোলাম মাওলা রনি - ছবি : নয়া দিগন্ত

আপনি যদি সংবেদনশীল মানুষ হন এবং আপনার বুদ্ধিশুদ্ধি বা কমন সেন্স যদি একেবারে সাধারণ মানের হয় তবুও বিষয়গুলো আপনি সহজে বুঝতে পারবেন। আপনি যদি রগচটা প্রতিশোধপরায়ণ মানুষ হন তবুও কেবল একটি মনুষ্য শরীর ও মনের কারণে আপনি অমন পরিস্থিতিতে রাগ করতে পারবেন না। আপনার নিষ্ঠুরতা যদি খুবই নিকৃষ্ট মানের হয় এবং নিজের অসভ্যতা দেখে যদি আপনি নিজেই মাঝে মধ্যে আঁতকে ওঠেন তবুও আপনি কিছু লোকের সাথে ইচ্ছা করলেও নির্মমতা দেখাতে পারবেন না। আপনার মধ্যে যদি ফ্যাসিজম-নাৎসিজমের মতো অপরাধপ্রবণতা থাকে- চেঙ্গিস, হালাকুদের মতো রক্ত নিয়ে হোলি খেলা এবং মনুষ্য মাথার খুলি দিয়ে পিরামিড বানানোর নিদারুণ শখ থাকে তবুও আপনি কিছু মানুষকে চেষ্টা করলেও অপমান করতে পারবেন না।

আপনি যদি দেখেন আপনার বাপ-দাদা, ময়মুরুব্বি ও পাড়া প্রতিবেশীরা কাউকে বহুকাল ধরে সম্মান করে আসছেন তবে সেই শ্রেণীর মানুষকে অপমান করার জন্য আপনাকে মনুষ্য শ্রেণীর বাইরে নিয়ে নতুন ধাতু দিয়ে গঠিত অমানুষ হতে হবে। আপনি নিজে যাকে সম্মানিত অবস্থায় দেখেছেন কিংবা যার অধীনে কাজ করেছেন এবং যার শিক্ষা-দীক্ষা ও যোগ্যতার বিষয়ে আপনার যখন কোনোকালে সন্দেহ ছিল না সেই প্রকৃতির মানুষজনের সাথে অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন এবং তাদেরকে সামাজিক ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার মতো যোগ্যতা যদি আপনার অর্জন করতে হয় তবে শয়তানির সর্ব নিম্নস্তরে নেমে এসে আপনাকে মনুষ্য উপাধি পরিত্যাগ করে নতুন জীবে রূপান্তরিত হতে হবে।

আমাদের বর্তমান দেশ-কাল-সমাজের যে কী হাল হয়েছে তা বোঝানোর জন্যই মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে মস্তবড় একটা ভূমিকা টানলাম। আমাদের সমাজে এখন যে সব বিরোধ হয় সেগুলোর কার্যকারণ মেলানো যায় না। আমাদের রাজনীতি অর্থনীতি, সমাজ-সংসার, পরিবার থেকে শুরু করে নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, পরিবেশ-প্রতিবেশ কোনো কিছুই নিয়মমাফিক চলছে না। কোথাও গিয়ে দু’দণ্ড শান্তি লাভ, আশ্রয় গ্রহণ, নিরাপত্তাবোধ, প্রাণ খুলে কারো কাছে মনের দুঃখের কথাগুলো বলা এবং কারো বিচার-বিবেচনা অথবা বিবেকের ওপর নিজেকে সঁপে দেয়ার মতো পরিবেশ কোথাও নেই। সর্বত্রই সাপের ভয়াল ফোঁস ফোঁস শব্দ বিরক্তিকর ঝিঁঝি পোকার ডাক এবং রক্তপাতের চমকানির মতো ভয় সৃষ্টিকারী উপাদান জীবনকে অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরে আছে। মানুষ যে প্রাণভয়ে একটু চিৎকার করবে কিংবা ব্যথা-বেদনায় উহ্ আহ্ শব্দ করবে সেই শক্তিটুকু কতজনের রয়েছে তা নিয়েও আমার যথেষ্ট সন্দেহ।

আপনি যদি দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের দিকে তাকান তবে অনায়াসে দু’টো সমীকরণ দাঁড় করাতে পারবেন। যাদের ক্ষমতা রয়েছে তাদের অর্থ-বিত্তের ঝলকানিতে আপনার চোখের আলো নিভে যেতে পারে। তাদের কণ্ঠের বজ্রনিনাদে আপনি বধির হতে বাধ্য এবং তাদের জিহ্বার ধার এবং সুচালো অগ্রভাগের নড়াচড়া দেখলে আপনি তলোয়ার-গজাল-পেরেক, বর্শা, ভোজালি, রামদা অথবা কুড়াল-কোদালের নাম পর্যন্ত ভুলে যেতে পারেন। আপনি যদি তাদের পেটের ধারণক্ষমতা এবং পরিপাকতন্ত্রের হজম প্রণালী সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করেন তবে বুঝবেন, ওদের পেটে পৃথিবীর সব কিছু অনায়াসে ঢুকে যেতে পারে এবং সেগুলো অবলীলায় হজম হয়ে বর্জ্যে পরিণত হতে পারে। ওরা ময়লা-আবর্জনা থেকে শুরু করে সোনা-দানা, টাকা-পয়সা, মান-ইজ্জত, ক্ষমতা থেকে শুরু করে অন্যের আশা-আকাক্সক্ষা, প্রেম-ভালোবাসা এবং মানবিক অধিকার সবকিছু রাক্ষসের মতো গলাধঃকরণ করে যখন পশ্চাৎদেশ দিয়ে বের করে দেয় তখন সবকিছুর রূপ-রস-গন্ধ আমাশয় রোগীর বিষ্ঠার মতো হয়ে যায়।

আপনি যদি ক্ষমতাধরদের হাঁকডাক, হুঙ্কার শোনেন তবে পৃথিবীর যাবতীয় তাল-লয় সঙ্গীত, সারেগামা, কবিতা এবং গীতিনাট্যকে ভুলে যেতে বাধ্য হবেন। তাদের বজ্রনিনাদে আপনি সত্য-মিথ্যার পার্থক্য ভুলে যাবেন এবং মাথা নিচু করে সব অন্যায় কিভাবে মেনে নিতে হয় তা খুব সহজে রপ্ত করে ফেলবেন। তাদের জীবনযাত্রা, রং-ঢং, হর্ষ বিলাস দেখলে আমাদের মধ্যকার সহজাত শালীনতাবোধ এবং অশ্লীলতার প্রতি বিরোধ কর্পূরের মতো উড়ে যাবে। আপনি তখন অনায়াসে এবং নির্বিকারভাবে যেকোনো লোকের উলঙ্গপনা, বেহায়াপনা, অশ্লীল কর্মকাণ্ড, নোংরামি এবং অনাচারকে অনুকরণীয় শুদ্ধাচাররূপে মেনে নেয়ার অদ্ভুত এক যোগ্যতার অধিকারী হয়ে পড়বেন।

উপরোক্ত অবস্থায় আপনার চলাফেরার মধ্যে একধরনের মাতলামির লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠবে। কথা-বার্তার মধ্যে তোতলামিসহ অন্য সব বাকযন্ত্রের জড়তা প্রকট হবে। দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে যাবে এবং চিন্তাশক্তি কেবলমাত্র বর্তমানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে। মানুষের কণ্ঠের সাথে, মেজাজ-মর্জি, ইচ্ছা-অনিচ্ছার সাথে এবং হুকুমের সাথে তাল মেলানোর অসাধারণ এক ক্ষমতা আপনি পেয়ে যাবেন। তখন আপনার বাঁচতেও ইচ্ছে করবে না- আবার মরতেও চাইবেন না। স্বপ্ন দেখা, কল্পনা করা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করা অথবা অন্যের কল্যাণের কথা ভাবা আপনার কাছে রীতিমতো ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে।

আপনি যদি অলৌকিকভাবে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যে আক্রান্ত হয়ে না যান তবে নিম্নোক্ত বিষয়াদি আপনার নজরে আসবে। আপনি রাস্তা-ঘাটে, গ্রাম-গঞ্জে কিছু রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে দেখতে পাবেন যাদেরকে কিছু লোক সরকারবিরোধী লোক বলে প্রচার করে থাকে। আপনি যদি খোঁজখবর নেন তবে নিশ্চয়ই জানতে পারবেন, তথাকথিত সরকারবিরোধী লোকজনেরও একসময় অনেক ক্ষমতা ছিল এবং তাদের বেশির ভাগ লোকই ক্ষমতার দাপটে বর্তমান জমানার ক্ষমতাধরদের চেয়ে কোনো অংশে অযোগ্য ছিলেন না। এমন একটা সময় ছিল যখন তাদের চামড়ায় স্নেহজাতীয় পদার্থের আধিক্য এবং পোশাক-আশাকে অযাচিত কৌলীন্য ছিল। তারা উচ্চৈঃস্বরে অট্টহাসি দিতেন এবং আঙ্গুল উঁচিয়ে কথা বলতে পছন্দ করতেন। তারা চলাফেরার সময় ডানে-বামে ঘাড় ঘোরাতেন যেন লোকজন তাদেরকে চিনতে পারে এবং কারণে-অকারণে সালাম দেয়। তারা মাঝে মধ্যে এমনভাবে বাচালতা দেখাতেন যার ফলে তাদের কথার ফুলঝুরির সামনে অন্য কেউ মুখ খুলতে সুযোগ পেত না। এরপর তারা আবার হঠাৎ করেই গম্ভীর হয়ে যেতেন যেন লোকজন তাদের গাম্ভীর্যতা দেখে ভয় পেয়ে খামোশ হয়ে যায়। আপনার দেখা আদিকালের উল্লিখিত লোকজনকে যদি বর্তমান জমানায় দেখেন তবে লক্ষ করবেন, তাদের শরীর থেকে স্নেহজাতীয় পদার্থ ঝরে গেছে। ক্ষমতার দাপটে তাদের মধ্যে যাদের চোখ হরিণের মতো মায়াবী হয়ে উঠেছিল সেই চোখ এখন গোল হয়ে এমনভাবে কোটরাগত হয়ে পড়েছে যা দেখে আপনার মনে হতে পারে, ওখানে দুর্ভিক্ষ বাসা বেঁধেছে। অন্য দিকে ক্ষমতার গরমে একদা যাদের চোখ লাল হয়ে থাকত ওগুলো এখন ফ্যাঁকাসে হয়ে পড়েছে। যারা বাজখাই গলায় কথা বলত তাদের কণ্ঠস্বর কেমন যেন মিনমিনে হয়ে পড়েছে। রেডিওর ব্যাটারি শেষ হয়ে গেলে বক্তার কণ্ঠ যেমন ম্যাড়-ম্যাড় করে তদ্রূপ ক্ষমতা হারিয়ে বাজখাই গলাগুলোতে সিজনাল ফ্লুর আক্রমণে মারাত্মক বিবর্তন ঘটে গেছে।

যদি তাদের পোশাক-আশাকের দিকে লক্ষ করেন তবে দেখবেন, পাঞ্জাবি পাজামাগুলো আর আগের মতো ঝিলিক দেয় না। সেগুলোর রং বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। ঠিকমতো মাড় দেয়া হয় না- ইস্ত্রিও নিয়মিত হয়ে ওঠে না। ফলে কাপড়ের অবাঞ্ছিত ভাঁজের কারণে কেমন যেন একটা অভাবী অভাবী পরিবেশ ফুটে ওঠে। তারা যখন কোথাও বসেন এবং সেখান থেকে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করেন তখন পাজামা ও পাঞ্জাবির পেছনের কিছু অংশ শরীরের ফাঁকে এমনভাবে গুঁজে থাকে যা দেখে আপনার মনে অবশ্যই মায়ার উদ্রেক হবে। তাদের হাঁটা-চলা, কথা-বার্তার মধ্যে সব সময় একধরনের ভীরুতা এবং জড়তা বিরাজ করে। তাদের কান সব সময় পুলিশের বাঁশির শব্দে আতঙ্কিত বোধ করে এবং পুলিশের লাঠির দৃশ্য তাদের চোখ-মন-মস্তিষ্ক এবং শরীরের মধ্যে ভয়ঙ্কর এক রসায়ন সৃষ্টি করে। চলতে ফিরতে তারা লাঠি-বাঁশি, দৌড়, জেল-মামলা-হামলা, কোর্ট-কাচারি, জামিন-মুক্তি এবং সংসারের চাল-ডালের চিন্তা একত্রে করতে গিয়ে সব কিছুতে তালগোল পাকিয়ে ফেলে।

উল্লিøখিত শ্রেণীর লোকজনকে দেখলে আপনার মধ্যে এক ধরনের দরদ উথলে উঠবে। মনে হবে আ-হারে। আমার যদি ক্ষমতা থাকত তবে লোকগুলোর দুঃখ-কষ্ট দূর করে দিতাম। আপনার আরো মনে হবে, যদি লোকগুলোকে সম্মান নাও করতে পারি কিন্তু মরে গেলেও অপমান করব না। লোকগুলোর মধ্যে যারা নিরপরাধ তাদের জন্য আপনার দোয়া করতে ইচ্ছে হবে এবং যারা অপরাধী তাদের বর্তমান দুরবস্থার কারণে আপনি হয়তো তাদেরকে লঘু শাস্তি অথবা ক্ষমা করে দেয়ার কথা ভাববেন।

আপনি যদি দেখেন, ক্ষমতাহীন অসহায় লোকগুলোর ওপর ক্ষমতাধররা একটার পর একটা মিথ্যা অপবাদ দিয়ে যাচ্ছে এবং ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ না পেয়ে ক্ষমতাধরদের জেদ বেড়ে যাচ্ছে; তখন আপনার ইচ্ছে হবে নিজের গালে চপেটাঘাত করতে। আপনি যদি এ রূপটি হতে দেখেন তবে নিশ্চিতভাবে বুঝে নেবেন, ক্ষমতাধররা মিথ্যার বেসাতি করছে এবং চোরাবালির ওপর তাসের ঘর বানিয়ে ওপরে ওপরে দাম্ভিকতা দেখালেও মনে মনে নিদারুণ আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় মরণ যন্ত্রণা ভোগ করছে। আপনি যদি ক্ষমতাধরদের এক দিকে অত্যাচার এবং অন্য দিকে উল্লাস করতে দেখেন তবে বুঝবেন, মানুষ নামক পদটি তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। আপনি যদি তাদেরকে নিরাকার খোদার দোহাই দিয়ে পাথরের মূর্তির সামনে মাথা নত করতে দেখেন তখন ধরে নেবেন, তাদের দিন শেষ হয়ে আসছে এবং তারা সদলবলে ঝড়ের বেগে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement