সাকিবের সেরাটা দেখার অপেক্ষায় বাংলাদেশ
- সৈয়দ আবদাল আহমদ
- ১৩ নভেম্বর ২০২০, ১৯:৪৪
স্বাগত, সাকিব আল হাসান। স্বাগত, বাংলাদেশের ক্রিকেট কিংবদন্তি। আইসিসির নিষেধাজ্ঞামুক্ত হয়ে সম্প্রতি সাকিব দেশে ফিরেছেন। শিগিগরই আমরা তাকে মাঠে দেখতে পাবো, ব্যাটিং-বোলিংয়ের সেই অপূর্ব নৈপুণ্যে। বাংলাদেশ অপেক্ষায় আছে সাকিবের সেরাটা দেখার।
গত ২৯ অক্টোবর সাকিবের নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হয়। ওই দিনই আনন্দিত সাকিব নিজের ফেসবুক পেজে লিখেন, ‘খেলবে টাইগার, জিতবে টাইগার, আবারো ফিরছি ২২ গজের ঠিকানায়।’ অর্থাৎ ক্রিকেট পিচে।
নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই ৪ নভেম্বর সাকিবকে সুখবর দেয় আইসিসি। আইসিসির সর্বশেষ ওয়ানডে অলরাউন্ডার আপডেট রেংকিংয়ে তার শীর্ষস্থান বহাল আছে। তিনি ৩৭৩ রেটিং পয়েন্ট নিয়ে সবার উপরে আছেন। দেড় বছর আগে তার এ রেটিং ছিল ৩৯৪। নিষেধাজ্ঞাকালে তিনটি ওয়ানডে হাতছাড়া হওয়ায় রেটিং ৩৭৩-এ নেমে আসে।
দেশে ফেরার আগে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে ভক্ত ও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন সাকিব। তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞার সময়টায় অনুতপ্ত হয়েছি, আফসোস করেছি। মনে হয়েছে এ ধরনের ভুল করা উচিত হয়নি। শাস্তি মাথা পেতে নিয়েছি। ভুল থেকে অনেক শিক্ষা নিয়েছি। আমার মতো আর কেউ যেন এমন ভুল না করে। সাকিব বলেন, এ সময়টায় তিনি বাংলাদেশকে অনেক মিস করেছেন। তবে তার দুঃসময়ে দেশ-বিদেশের ভক্ত মানুষ তার পাশে ছিলেন, তাকে সমর্থন দিয়েছেন। এখন সবচেয়ে বড় কাজ হলো, তাদের আস্থা ও ভালোবাসার প্রতিদান দেয়া। বাংলাদেশকে তিনি সেরাটাই দিতে চান।
সাকিব ছাড়া বাংলাদেশের ক্রিকেট ছিল অনেকটা জৌলুসহীন। সেই ক্রিকেট আবার প্রাণ ফিরে পাবে। তাই ক্রিকেট মাঠে সাকিবের উপস্থিতি সবার জন্যই আনন্দের। সতীর্থ ক্রিকেটাররাও সাকিবকে পেয়ে উৎফুল্ল।
ক্রিকেট অঙ্গনে আপাতত আন্তর্জাতিক কোনো খেলা নেই। এ মাসের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার কথা। এই টুর্নামেন্ট দিয়েই সাকিব ফিরছেন মাঠে।
ইতোমধ্যে তিনি করোনা টেস্ট করিয়েছেন। টেস্ট নিগেটিভ হয়েছে। অর্থাৎ সাকিব করোনামুক্ত। ১১ নভেম্বর বুধবার তার ফিটনেস পরীক্ষা হওয়ার কথা। টুর্নামেন্টে অংশ নিতে এরই মধ্যে ব্যাট ও বল হাতে অনুশীলনও শুরু করছেন। এবার এই অনুশীলন বিকেএসপিতে নয়, দেশের হোম ক্রিকেট খ্যাত শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে চলছে। গত সেপ্টেম্বরে সাকিব শ্রীলঙ্কা টেস্ট সামনে রেখে বিকেএসপিতে অনুশীলন করেছিলেন। সেই টেস্ট আর হয়নি। ফলে সাকিব ফিরে গিয়েছিলেন আমেরিকায়। পাঁচটি দল নিয়ে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের জন্য প্লেয়ার্স ড্রাফট হলে সাকিবকে পেতে আগ্রহী হবে দলগুলো। সাকিবের খেলা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে ভক্ত-অনুরক্তরা।
এক বছর ক্রিকেট থেকে বিরত ছিলেন সাকিব। মাঠে নেমে কেমন খেলবেন তিনি? তার ঘনিষ্ঠদের মধ্যে রয়েছেন পুরনো দুই গুরু নাজমুল আবেদীন ও মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। সেপ্টেম্বরে তাদের তত্ত্বাবধানে সাকিব প্রায় মাসখানেক অনুশীলন করে গেছেন। তারা সাংবাদিকদের বলেছেন, ভালো খেলার জন্য নিজেকে দারুণ উজ্জীবিত রেখেছেন সাকিব। ম্যাচ না খেলায় ঘাটতি খুব একটা থাকবে না। তবে এক বছর খেলা থেকে বিরত থাকায় ব্যাটিং-বোলিংয়ের ছন্দে ফিরতে দু-তিনটে ম্যাচ সময় লাগবে তার। অবশ্য খেলায় ঢুকে যেতে সময় লাগবে না। তাকে নিয়ে দুই কোচই আশাবাদী। সাংবাদিকদের তারা বললেন, আগের চেয়ে ভালো খেলবে সাকিব। মাঠে অন্য এক সাকিবকে দেখা যাবে।
সাকিব ছাড়াও বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের গর্বিত আরো খেলোয়াড় আছেন। মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবাল, মুস্তাফিজ, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মুমিনুল, শান্ত, মিঠুন, লিটন দাস, সৌম্য, রুবেল, তাইজুলসহ অন্যরা। মাশরাফি বিন মর্তুজাও ছিলেন। এখন তিনি অবসরে। সাকিব ক্রিকেটে ফেরায় তারাও উজ্জীবিত। কারণ দলে একজন স্টার অব দ্য স্টারসের প্রয়োজন হয়। সাকিব আমাদের সেই গর্বিত স্টার অব দ্য স্টারস।
নিষেধাজ্ঞার এক বছর সময়ে সাকিব
জুয়াড়িদের কাছ থেকে ম্যাচ ফিক্সিং বা পাতানোর প্রস্তাব পেয়েছিলেন সাকিব। আচরণবিধি অনুযায়ী এ কথা তিনি আইসিসি বা বিসিবিকে জানাননি। এটাই ছিল তার অপরাধ। ফলে আইসিসি ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর সাকিবকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে। এর মধ্যে এক বছর স্থগিত নিষেধাজ্ঞা। আইসিসির এ শাস্তিতে শুধু সাকিব নন, বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরাও ভেঙে পড়েন। তবে সাকিব শাস্তি মেনে নেন। তিনি ভুল বুঝতে পেরে এ সময়টাকে নেন নিজেকে শোধরানোর জন্য।
অন্যরা যাতে এ ভুল না করেন সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সতীর্থ এবং নতুন ক্রিকেটারদের সামনে তার পরামর্শ, এমন ভুল করা যাবে না।
নিষেধাজ্ঞার এক বছরে সাকিবের ৩৬টি ম্যাচের বাইরে থাকার কথা ছিল। কিন্তু করোনা মহামারীর কারণে অনেক ম্যাচ স্থগিত বা বাতিল হয়ে গেছে। ১৪টি ম্যাচ তিনি খেলতে পারেননি। ফলে তার খুব একটা ক্ষতি হয়নি। এ সময়টায় কোনো আইন না ভাঙায় আইসিসিও সাকিবের ওপর খুশি। তাকে বাকি এক বছরের স্থগিত নিষেধাজ্ঞার শাস্তিও ভোগ করতে হবে না।
সাকিব আল হাসান ক্রিকেট থেকে বিরত থাকার এক বছর হেলায় হারাননি। নিজের ফিটনেস ধরে রাখতে অনুশীলনে ব্যস্ত থেকেছেন। নতুন প্রজন্মের কাছে তার নিজের ক্রিকেট অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে বেশির ভাগ সময় পরিবারের সাথে কাটিয়েছেন। এ সময় তার দ্বিতীয় কন্যার জন্ম হয়। মানবতার সেবায়ও এগিয়ে এসেছেন তিনি। সাকিব আল হাসান ফাউন্ডেশন গঠন করে গরিব দুঃখীদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। করোনাকালে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। করোনা ও বন্যাদুর্গতদের মাঝে খাবার বিতরণ করেছেন। করোনা মোকাবেলায় চিকিৎসকদের পিপিই ও মাস্ক এবং হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স দিয়েছেন। নিলামে তুলেছেন নিজের বিশ্বকাপ ব্যাট। এ ছাড়া তার স্বাক্ষর করা ব্যাট ও টি শার্ট বিক্রির মাধ্যমে ফান্ড করেছেন গরিবদের উপকারার্থে।
শুধু তাই নয়, সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। ধর্ষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। সাকিব বলেছেন, ‘চমৎকার একজন নারীর ছেলে সন্তান আমি। জীবন চলার পথে স্ত্রী হিসেবে পেয়েছি অপূর্ব একজন নারীকে। দারুণ একজন নারীর ভাই আমি। আর দু’টি ফুটফুটে কন্যাসন্তানের বাবা আমি। এক শ্রেণীর বর্বর মানুষ নারী ও শিশুদের প্রতি যে জঘন্য অন্যায় করছে তাতে চুপ থাকতে পারি না। এই নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে আসুন লড়াই করি, রুখে দাঁড়াই।’ এ সময় তিনি নিজের একটি ইউটিউব চ্যানেলও খোলেন ভক্ত ও সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য।
এগিয়ে যান বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার
সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি ক্রিকেটার স্যার ডোনাল্ড জর্জ ব্রাডম্যান। ভারতের আছে শচীন টেন্ডুলকার, পাকিস্তানের ইমরান খান, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্রায়ান লারা। তেমনি আমাদেরও গর্ব সাকিব আল হাসান।
নিউজিল্যান্ডের কিংবদন্তি ক্রিকেটার স্যার রিচার্ড হ্যাডলি সাকিবের ভক্ত। তার মন্তব্য, ‘সাকিব ইজ অ্যা হিরো। সবসময় আমি ওর ব্যাটিং দেখতে পছন্দ করি। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের এক নম্বর অলরাউন্ডার ছিল সে। ওর বাঁ হাতে বাহারি মার, দৃষ্টিনন্দন স্ট্রোক প্লে এবং হাত খুলে খেলা আমাকে খুব টানে।’
রিচার্ড হ্যাডলি ঠিক বলেছেন। বাংলাদেশের হয়ে খেলায় সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে বিবেচিত সাকিব বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার রেকর্ডের অধিকারী। এখনো ওয়ানডে ও টেস্ট ফরম্যাটে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বোচ্চ র্যাংকিং ধরে রেখেছেন।
১৯৮৭ সালের ২৪ মার্চ মাগুরায় জন্মগ্রহণ করেন সাকিব। ২০০৬ সালের আগস্ট মাসে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচে তার অভিষেক। চৌদ্দ বছরে সাকিবের অসাধারণ ক্রিকেট নৈপুণ্যে মুগ্ধ হয়ে যাই আমরা। তার দুর্দান্ত ব্যাটিং, বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং সঙ্গে দারুণ ফিল্ডিংয়ের জাদু ভক্তদের উদ্দীপ্ত না করে পারে না। ইতিহাসে টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি তিন ধরনের ক্রিকেটে একই সময়ে এক নম্বরে থাকা একমাত্র ক্রিকেটার তিনি। ২০১৫ সালে এই কৃতিত্ব প্রথম করে দেখান সাকিব। এটা অনন্য রেকর্ড। এ কৃতিত্ব আর কেউ দেখাতে পারেনি। বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি উইকেট সাকিবের। ২০১৯ সালের জুনে তিনি দ্রুততম খেলোয়াড় হিসেবে মাত্র ১৯৯ ম্যাচে ৫ হাজার রান ও ২৫০ উইকেট নেয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের খুব নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়। ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর তিনি বিয়ে করেন উম্মে আহমেদ শিশিরকে। তাদের দু’টি কন্যাসন্তান আলাইনা হাসান অব্রি ও ইরাম হাসান। ক্রিকেটে নতুন করে এগিয়ে যান সাকিব। ব্যাটে-বলের নৈপুণ্যে রাঙিয়ে দিন মাঠ।
লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাতীয় প্রেস ক্লাব
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা