২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ম্যাক্রোঁর বিদ্বেষ এবং গাফফার চৌধুরীর বিশ্লেষণ

ম্যাক্রোঁর বিদ্বেষ এবং গাফফার চৌধুরীর বিশ্লেষণ - ছবি : নয়া দিগন্ত

মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ বার্নার্ড লুইস পাশ্চাত্যের ইসলামবিদ্বেষের উৎস সন্ধান করেছেন। নাইন-ইলেভেনের পরপরই ‘হোয়াট ওয়েন্ট রং’ গ্রন্থে তার এ বিশ্লেষণ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই সময়ে ‘ইসলামোফোবিয়া’ বা ইসলামবিদ্বেষ ইউরোপ-আমেরিকাকে আচ্ছন্ন করে। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক বিশ্লেষণ চলছে। পাশ্চাত্যে এবং প্রাচ্যে বুদ্ধিজীবীরা বিভক্ত হয়েছেন দোষারোপে। গ্রাহাম ই. ফুলার, এরশাদ মাঞ্জি, ফয়সাল ডেভজি, দিবাকুমার, নোরাফিল ম্যান এবং রেজা আরসালান প্রমুখ বুদ্ধিজীবী নিজ নিজ মত প্রকাশ করেছেন। অবশেষে এস পি হান্টিংটন সভ্যতার দ্বন্দ্ব প্রত্যক্ষ করেছেন। বিগত দুই দশকে এই দ্বন্দ্বের সমীকরণ ছিল তীব্রতর।

পাশ্চাত্য বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা না করে শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। ‘ওয়ার অন টেরর’ বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রকারান্তরে মুসলিম বিশ্বকে টেররাইজড বা সন্ত্রাস সঙ্কটে নিপতিত করে। আফগানিস্তান, ইরাক ও মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র এর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। সে আর এক ইতিহাস। মুসলিম বিশে^র এক ধরনের ‘নন-স্টেট অ্যাক্টর’স বা রাষ্ট্র বিচ্ছিন্ন গ্রুপ সন্ত্রাসের জবাব সন্ত্রাস দিয়ে মোকাবেলার অপসিদ্ধান্ত নেয়। লন্ডন, প্যারিস, ব্রাসেলস, নাইরোবি ও কলম্বোসহ এই দুই দশকে পৃথিবীর আরো অনেক স্থানে সন্ত্রাসের দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। সে ধারা এখনো যে অব্যাহত আছে ফ্রান্সের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি তার প্রমাণ। গোটা ইউরোপের মধ্যে ইসলামবিদ্বেষ ফ্রান্সে তীব্রতর। কারণ সেখানে প্রায় ৫০ লাখ মুসলমানের বসবাস। আলজেরিয়া, লিবিয়া ও তিউনিসিয়াসহ উত্তর পশ্চিম আফ্রিকান বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশ ফরাসি কলোনি ছিল। আর ওই জায়গাগুলো ভূমধ্যসাগরের এপারে-ওপারে অবস্থিত। মধ্যযুগের সোনালি সময়ে ফ্রান্সের একটি অংশ স্পেনভিত্তিক উমাইয়া সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। এসব কারণে ফ্রান্সে মুসলমানদের মিত্রতা ও শত্রুতার আধিক্য রয়েছে।

পৃথিবীর কোথাও ইসলামের নামে কোনো হত্যা, সহিংসতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সব ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা নিন্দনীয় ও দুঃখজনক। মুসলিম বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রশক্তি বা ব্যক্তিত্ব দৃশ্যত ফ্রান্সে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি অনুমোদন করছে না। এটা ঘটছে অননুমোদিতভাবে, বিচ্ছিন্ন ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। সুতরাং এর দায় সার্বিকভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর চাপিয়ে দেয়া গুরুতর অন্যায়। আইন ও কর্তৃত্বের নিরপেক্ষ ও নিয়মতান্ত্রিক প্রয়োগই যথার্থ। কিন্তু ফরাসি কর্তৃপক্ষ বিপরীত কাজটি করল। গোটা পৃথিবী অবাক হয়ে অবলোকন করল ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ প্রতিশোধের ভাষায় কথা বললেন। বিপথগামী দু-একজন মুসলমানের কর্মকা- ফ্রান্সের চিরায়ত বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও স্বাধীনতার বাণীর অপব্যাখ্যা হতে পারে না। তিনি এক ধরনের উসকানিমূলক কথা বলছেন। আরো মসজিদ, মাদরাসা ও মুসলিম প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। সে দেশের মুসলিমদের জন্য এসব সিদ্ধান্ত বিপজ্জনক। অথচ ফরাসিরা ‘সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা’র দাবিদার। আজকের পৃথিবীতে রাষ্ট্র ও সমাজ যখন সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট তখন ফরাসি সরকার সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে রীতিমতো নিগ্রহ চালাচ্ছে। প্রশ্ন করা যেতেই পারে, ফ্রান্স যে বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও স্বাধীনতার কথা বলে তা কি শুধুই খ্রিষ্টধর্মীদের জন্য? গরিষ্ঠের স্বাধীনতার নামে ম্যাক্রোঁ যে প্রকারান্তরে লঘিষ্ঠের স্বাধীনতা বিপন্ন করে তুলছেন তা কি তিনি বুঝতে অক্ষম? বিগত নির্বাচনে অতি রক্ষণশীলদের বিপরীতে অতি প্রগতির কথা বলে তিনি ফরাসি জনগণকে ধাপ্পা দিয়েছেন। সমাজতন্ত্রের নামে ফ্যাসিবাদের অনুশীলন করছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী নির্বাচনে জেতার জন্য খ্রিষ্ট মৌলবাদীদের তুষ্ট করার প্রতারণামূলক নীতি গ্রহণ করেছেন ম্যাখোঁ।

ম্যাক্রোঁর বক্তব্য ও পদক্ষেপ নিয়ে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে প্রতিবাদ হচ্ছে। মুসলিম বিশ্ব এখন উত্তপ্ত। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে বিবেকবান মানুষরা তাদের কথা ও কাজের মাধ্যমে অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন। বাংলাদেশের একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব লন্ডন প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীর অনন্য বিশ্লেষণটি ইতোমধ্যে বুদ্ধিজীবী মহলে সমাদৃত হয়েছে।

এই দেশে গাফফার চৌধুরী শীর্ষ স্থানীয় বুদ্ধিজীবীর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত দশকের পর দশক ধরে। আমরা জানি, তার নিজস্ব রাজনীতি আছে, মতাদর্শও আছে। যারা তার রাজনীতিবিরোধী তারা তাকে পছন্দ নাও করতে পারেন। তবে তার প্রতি সবাই সম্মান পোষণ করে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ এ গানের জন্য বাঙালি হৃদয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন চিরকাল। সাধারণভাবে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা দু’ভাগে বিভক্ত। ডান ও বাম। গাফফার চৌধুরীর অবস্থান বামে। ডানের বুদ্ধিজীবীরা ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করবেন- এটাই সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয়। কিন্তু আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতো মানুষ যখন কলম ধরেন তা হয়ে ওঠে অসাধারণ। গাফফার চৌধুরী নিজের পরিচিতির বিপরীতে বিষয়টি যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তা অনেক মানুষকে মুগ্ধ করেছে।

গত ১৮ অক্টোবর দৈনিক ইত্তেফাকে তার নিয়মিত কলাম ‘দশ দিগন্তে’ লেখাটি ছাপা হয়। এর শিরোনাম ছিল, ‘প্যারিসে শিক্ষক হত্যার জন্য দায়ী কে?’ দায় দায়িত্বের নিরূপণের শুরুতে তিনি প্রশ্ন তোলেন, ফরাসি শিক্ষককে হত্যার কারণ জানা গেল, কিন্তু আততায়ী যুবককে কেন গ্রেফতার না করে হত্যা করা হলো পুলিশের রিপোর্ট ছাড়া আর কোনো কিছু জানার উপায় নেই। পুলিশ বলেছে, সে আত্মসমর্পণে রাজি হয়নি; কিন্তু তাকে রিপোর্ট অনুযায়ী উপর্যুপরি গুলি করার নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনের কী দরকার ছিল তা জানা যায়নি। তাহলে এটা কি মুসলিম যুবকের বিরুদ্ধে খ্রিষ্টান ফরাসি পুলিশের ‘রিভেঞ্জ কিলিং’-এই প্রশ্নটি এখন উঠতে পারে। গাফফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘আমি হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করি। ওই শিক্ষক হত্যারও নিন্দা করি। নিন্দা করি পুলিশ কর্তৃক ওই যুবকের হত্যাকা-েরও। তাকে গ্রেফতার করে বিচারের জন্য আদালতে সোপর্দ করার দরকার ছিল। ওই তরুণকে হত্যার পর তার একতরফা বিচারের কাজটি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ নিজেই সেরেছেন- He taught students about freedom of expression, freedom to believe or not believe. It was a cowardly attack. ‘তিনি (শিক্ষক) স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের বিষয়টি ছাত্রদের শিক্ষাদান করেছিলেন। তিনি শিক্ষা দান করেছিলেন বিশ্বাস করা ও না করার স্বাধীনতার বিষয়ে। এই হত্যার কাজটি অত্যন্ত কাপুরুষোচিত।’ ফরাসি প্রেসিডেন্ট তো একতরফা রায় দিয়ে দিলেন। অন্য দিকে ফরাসি গোয়েন্দা বিভাগে আততায়ী তরুণের কোনো নাম তালিকাভুক্তিতে না থাকা সত্ত্বেও ফরাসি পুলিশ সে ইসলামী টেররিস্টদের দলভুক্ত কি না সে সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে এবং এ সম্পর্কে খোঁজ খবর নিচ্ছে। আখেরে তাকে ইসলামী টেররিস্ট আখ্যা দিয়ে ফরাসি পুলিশ তাদের হত্যাকা- জায়েজ করার চেষ্টা করে কি না তা এখন দেখার রইল। ওই আততায়ী তরুণের সঠিক পরিচয় পাওয়া যায়নি। কোনো কোনো মহল থেকে বলা হয়েছে, সে চেচনিয়ার মুসলিম বংশোদ্ভূত। বয়স ১৮ বছর। তার জন্ম মস্কোতে।

গাফফার চৌধুরী দ্বিতীয়বার প্রশ্ন তুলেছেন, এই তরুণ কেন শিক্ষককে হত্যা করতে গেল? প্রকাশিত খবরেই বলা হয়েছে, ৪৭ বছর বয়স্ক শিক্ষক ক্লাসে পড়াতে গিয়ে ১২-১৪ বছরের ছাত্রদের হজরত মুহাম্মদ সা:-এর ব্যঙ্গাত্মক ছবি দেখাচ্ছিলেন। ওই ছবি ফ্রান্সের স্যাটায়ারিক্যাল নিউজ পেপার শার্লি এবদোতে প্রকাশিত হয়েছিল। ইতঃপূর্বে এই পত্রিকা ইসলামের নবীর ব্যঙ্গাত্মক ছবি ছাপায় তাদের এক সম্পাদককে হত্যা করা হয়েছিল এবং প্যারিসে দাঙ্গা হয়েছিল। পত্রিকার অফিসও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। এ কথা জানা থাকা সত্ত্বেও ওই ফরাসি শিক্ষক কেন ক্লাসে- তা-ও আবার ১২-১৪ বছর বয়সের ছাত্রদের সামনে ইসলামের নবীর ক্যারিক্যাচার কোন বুদ্ধিতে দেখাতে গেলেন তা আমার বুদ্ধির অগম্য। এই ছবি দেখানো চেচনিয়ান যুবককে অবশ্যই ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত করেছে। তাতে সে ক্লাসে প্রতিবাদ জানাতে পারত; কিন্তু তার তরুণ মস্তিষ্কে হত্যা যে একটি অপরাধ হয়তো সেই উপলব্ধি তখন কাজ করেনি। এ কথা বলা তার অপরাধের জন্য সাফাই নয়। বাস্তব অবস্থার কথা বলা মাত্র। খবরেই বলা হয়েছে, ওই ক্যারিকেচার দেখানোর পর ছাত্রদের অনেক অভিভাবক ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এমনকি শিক্ষকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করাও হয়েছিল। এর পরও ক্লাসে হজরত মুহাম্মদ সা:-এর ক্যারিকেচার দেখানো কি সঙ্গত হয়েছে? নাকি মোরাল অ্যান্ড সিভিল এডুকেশন সম্পর্কে শিক্ষাদানে এই ক্যারিকেচার দেখানো কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত। যদি অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে তাহলে বলতে হবে, ফরাসি শিক্ষাব্যবস্থা ধর্ম ও বর্ণবিদ্বেষ-ভিত্তিক?

গাফফার চৌধুরী উত্থাপিত অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের পাশ্চাত্যের মানস প্রবণতা বুঝতে হবে। নাইন-ইলেভেনের ঘটনাবলির পর ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অযাচিত ও অনাকাক্সিক্ষতভাবে ঘৃণ্য প্রচারণা চালানো হচ্ছে সর্বত্র। আর তাদের স্বাধীনতার মানেই হচ্ছে অবাধ স্বাধীনতা। গাফফার চৌধুরী সালমান রুশদির উদাহরণ দিয়েছেন। সালমান রুশদি যখন তার স্যাটানিক ভার্সেস উপন্যাসে হজরত মুহাম্মদ সা: সম্পর্কে অশ্লীল ও আপত্তিকর মন্তব্য করেন তখন তারা এমনকি পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীরাও তাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলে বাহবা দিয়েছেন। কিন্তু ইসরাইল গত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হলোকাস্টের (ইহুদি গণহত্যা) যে কথা বলে, তা ঐতিহাসিক গবেষণা দ্বারা সত্য নয় বলে উল্লেখ করায় এক ব্রিটিশ অধ্যাপককে ব্রিটেনে চাকরিচ্যুত করে জেলে পাঠানোর জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। এমনকি হলোকাস্টকে যারা বিশ্বাস করে না তাদের জন্য আইন প্রণয়নও করতে চেয়েছিলেন। গাফফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘বিশ্বের মুসলমানরা যতই অনগ্রসর হোক তারা মুসা, ঈসা (যিশু) প্রমুখকেই পয়গম্বর বলে স্বীকার করে এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো কুৎসা রটনা করে না। ইসরাইল রাষ্ট্রকে তারা রাজনৈতিক শত্রু মনে করে; কিন্তু খ্রিষ্টানদের তারা শত্রু মনে করে না। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, মুসলমান আরবদের সাথে ইহুদিদের রাজনৈতিক বিরোধ শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু খ্রিষ্টান বুদ্ধিজীবীদের একটি দল এবং বেশির ভাগ খ্রিষ্টান শাসকেরই টানা ইসলামবিরোধিতা ও শত্রুতার কোনো সীমারেখা নেই। শুধু মুসলমানদের বিরোধিতা নয়, তার পয়গম্বরের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা তাদের একটি ফ্যাশন বা অভ্যাস।’

গাফফার চৌধুরী অতঃপর মুসলিম-খ্রিষ্টান বিরোধের উৎসের দিকে তাকিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, এই বিরোধ সেই প্রথম ক্রুসেডের যুদ্ধ থেকে। চৌধুরীর এই পয়েন্টে স্মরণ করা যায়, সিনিয়র ডব্লিউ বুশ নাইন-ইলেভেনের ঘটনার পর ক্রুসেড শব্দটি উল্লেøখ করেছিলেন। অবশ্য পরে দ্বিতীয়বার তিনি ওই শব্দটি উচ্চারণ করেনি। এ থেকে তাদের ইসলামবিরোধী স্পিরিটটি বোঝা যায়। যা হোক, আমরা চৌধুরীর বয়ানে ফিরে যাই। তিনি যথার্থভাবেই বলেছেন, মুসলমানরা যেমন ভুলতে পারে না খ্রিষ্টান ইউরোপীয় শক্তি তাদের খেলাফত উসমানীয় সাম্রাজ্য ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপনিবেশ তৈরি করেছে। তাদের বুকের ওপর একটি ইসলাইলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। তেমনি খ্রিষ্টানরাও ভুলতে পারে না, ইউরোপের অর্ধাংশজুড়ে মুসলমানরা তাদের শাসন করেছে ৫০০ বছর। পরবর্তীকালে তারা কমিউনিজমকে যতটা ভয় করেছে, ততটাই ভয় করেছে ইসলামকে।

এখন কমিউনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর ইসলামকে আরো বেশি ভয় করছে। এ কথা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরই বলেছিলেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার। বলেছিলেন, ‘কমিউনিজমের পতন হলে কী হবে, পশ্চিমা শক্তির আর একটি প্রতিপক্ষ মাথা তোলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এই শক্তিকে তারা অপবাদ দিয়েছিল ইসলামী সন্ত্রাস হিসেবে। যেমন ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামকে তারা অ্যাখ্যা দিচ্ছে ইসলামী সন্ত্রাস হিসেবে। একালের মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক জামাল নাসের, মোসাদ্দেক, সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফি প্রমুখ আধুনিক মুসলমান রাষ্ট্রনায়কদের প্রত্যেকের তারা বিরোধিতা করেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে অপবাদ ছড়িয়েছে। ইসলামকে তারা টেররিস্টদের ধর্ম এবং মুসলমানদের যেকোনো মুক্তি আন্দোলনকে তারা টেরোরিস্ট তৎপরতা আখ্যা দিয়েছে। কমিউনিজমের প্রবর্তক কার্ল মার্কসকে যেমন তারা নানা অপবাদ দেয়, তেমনই ইসলামের প্রবর্তক হজরত মুহাম্মদ সা:কেও। কারণ, ধর্ম হিসেবে একমাত্র ইসলাম এবং তত্ত্ব হিসেবে কমিউনিজম পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও ধনবাদী স্বার্থের বিরুদ্ধে কথা বলে। কমিউনিজম এখন বিপর্যস্ত। কিন্তু ইসলাম এখন রক্ষণশীল হাতে বন্দী থাকা সত্ত্বেও তার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার নীতি রয়েছে।

কমিউনিজম যেমন শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলে তেমনি ইসলাম বলে জিহাদের কথা। এ দুটিকেই বর্তমান খ্রিষ্টান শক্তি ভীষণ ভয় করে। কমিউনিজম ও কমিউনিস্ট রাষ্ট্রনায়কদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার জন্য পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সব দেশে একশ্রেণীর নামকরা বুদ্ধিজীবীকে ভাড়া করেছিল। এখন ভাড়া করেছে ইসলামের বিরুদ্ধে অপবাদ ছড়িয়ে যেকোনো মুসলিম জাগরণকে নিরুৎসাহিত করার জন্য। অতীতে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার জন্য যেমন আর্থার কোয়েসলারের মতো বিশ^বিখ্যাত বুদ্ধিজীবীকে ভাড়া করেছিল, তেমনি ইসলামের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার জন্য সালমান রুশদিসহ বহু ছোট-বড় বুদ্ধিজীবীকে ভাড়া করা হয়েছিল। এখন তো জানতে বাকি নেই যে, সালমান রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ গ্রন্থ লেখার প্রণোদনা ছিল ইসরাইলের এবং আর্থিক উৎসাহ ছিল ইউরোপীয় খ্রিষ্টানদের। রুশদির পক্ষ সমর্থন করে যে শতাধিক বুদ্ধিজীবী সংবাদপত্রে যুক্ত বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাদের বেশির ভাগই ছিলেন ইহুদি বুদ্ধিজীবী। বর্তমানে ইসলামী টেররিস্ট নামে ঘাতক বাহিনী তৈরি করা হয়েছে। এদের তৈরি করেছে বিশেষভাবে আমেরিকা ও ইসরাইল। এককালে কমিউনিজমকে নিন্দিত করার জন্য পশ্চিমা শক্তির অর্থে সন্ত্রাসী কমিউনিস্ট তৈরি করা হয়েছিল।

উপসংহারে গাফফার চৌধুরী মন্তব্য করেছেন, ‘ফ্রান্সে শিক্ষক হত্যার যে ঘটনাটি ঘটেছে তা দুঃখজনক ও নিন্দাজনক।’ তিনি আবারো প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, ‘১৮ বছরের এক তরুণের হঠকারিতাকে আর কিভাবে নিন্দা করব?’ উত্তর দিয়েছেন তিনি নিজেই। সে যদি চেচনিয়া বংশোদ্ভূত হয়ে থাকে তাহলে সেখানে তার পিতৃপুরুষদের নির্মমভাবে হত্যার কথা জানে। সুতরাং তার চোখের সামনে তার প্রিয় নবী সা:কে নিয়ে ক্যারিকেচার দেখানো তার হয়তো সহ্য হয়নি। এ ধরনের সহিংসতা ততদিনই চলতে থাকবে, যতদিন পশ্চিমা শক্তিগুলোর উসকানিমূলক কাজ ও ইসলামবিদ্বেষী প্রচার বন্ধ না হবে, ইসলাম কেন, কোনো ধর্মই যে সন্ত্রাস ও হিংসা প্রচার করে না- এ কথা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষাদানের কোনো সাহসী তৎপরতাও আমাদের আলেম সম্প্রদায় বা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে নেই। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে যত দিন হিংসা সন্ত্রাসের পথ থেকে ফেরানো না যাবে, তত দিন ফ্রান্সের শিক্ষক হত্যার মতো ঘটনা ঘটতেই থাকবে। একজন, দুইজন সন্ত্রাসীকে হত্যা করে কোনো লাভ হবে না।

এই নিবন্ধে যে ভাষা ও আবেগ, তত্ত্ব ও তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তাতে একজন পরিপূর্ণ বিশ্বাসী মানুষের প্রত্যয় ফুটে উঠেছে। তবে তার সম্পর্কে এখানকার ডানদের ‘পারসেপশন’ বা লালিত বিশ্বাস ইতিবাচক নয়। এ লেখাটি যদি তার নাম ছাড়া ছাপা হয় তাহলে কেউ বলবে এটি হয়তো কোনো মৌলবাদীর লেখা। কিন্তু আবদুল গাফফার চৌধুরী মৌলবাদী নন। তিনি মোল্লাতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না। কখনো কখনো মনে হয়েছে তিনি শত্রুপক্ষের লোক। আসলে তিনি সত্য পথ্যের লোক। এভাবে সত্য প্রকাশের দূরন্ত সাহস দেশজ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বিরল। আবারো বলি, আমাদের মতো সাধারণ লেখক যখন কোনো তথ্য প্রকাশ করে তখন তা বিশ্বাসযোগ্য না ও হতে পারে। কিন্তু গাফফার চৌধুরীর মতো অসাধারণ ব্যক্তিত্বকে অস্বীকার করার স্পর্ধা আমাদের নেই।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
মিরসরাইয়ে আইনজীবী সাইফুলের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত আইনজীবী সাইফুল হত্যায় সিলেটে ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের প্রতিবাদ বরিশালে জুলাই গণহত্যার বিচারের দাবিতে ছাত্রশিবির বিক্ষোভ জাতীয় ঐক্যের সাথে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার অন্তর্বর্তী সরকারকে শক্ত হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের আহ্বান তারেক রহমানের সিলেটে হোটেল থেকে লাশ উদ্ধার সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছড়াচ্ছে ইসকন : মামুনুল হক ইসলামি আন্দোলনকে নিঃশেষ করতে আ'লীগ ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে : মাসুদ সাঈদী বাড়ল স্বর্ণের দাম নিরাপদ অঞ্চলই রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান ‘ফ্যাসিবাদের দোসরদের জামিন হওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক’

সকল