২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আইনের শাসনের তুফান গতি

-

সিলেটে পুলিশ ফাঁড়িতে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় প্রধান আসামি এখনো গ্রেফতার হয়নি। এত বড় জঘন্য অপরাধের বিচার পেতেও মানুষকে আন্দোলনে নামতে হয়েছে। ওই যুবকের মা দিনের পর দিন রাস্তায় নেমে বিচার চাইছেন। আসামি ধরার ক্ষেত্রে পুলিশের আগ্রহ সামান্য। অথচ যারা ওই যুবককে পিটিয়ে হত্যা করছে আর যারা এ হত্যাকাণ্ডকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চেয়েছিল তাদের নামধাম অবস্থান পুলিশের সম্পূর্ণ জানা ছিল।

অপরাধ যেখানে স্পষ্ট, অপরাধী যেখানে সন্দেহাতীতভাবে চিহ্নিত, সেখানে এমন গড়িমসি চলছে। আমরা দেখেছি আইনের শাসনের গতি আরো অনেকগুলো ঘটনায় ভয়াবহ শ্লথ। কোনো কোনো ঘটনায় এই গতি শূন্যও বলা যায়। এ ধরনের সম্ভবত হাজার হাজার ঘটনার উল্লেখ করা সম্ভব। যেমন- সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিকে হত্যা করা হয়েছে ২০১২ সালে। ঘটনার পরই স্বরাষ্ট্র্রমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল- ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বিচারকার্যক্রম বেগবান করা হবে।’ এরপর এমন আশ্বাস দান সরকারি বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে শত শত বার শোনা গেছে। ওই হত্যার বিচার ও তদন্ত নিয়ে ডাহা মিথ্যাচার করা হয়েছে। ৭৫ বার ওই বিচারের তদন্ত পেছানো হয়েছে।

কোনো অপরাধ ঘটলে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কী বক্তব্য দেবেন তা দেশের সচেতন মানুষের মুখস্থ হয়ে গেছে। কমন বক্তব্যটি হচ্ছে, ‘অপরাধী যেই হোক ছাড় দেয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রী এ ঘটনার বিচারের কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। নিজের দলীয় ব্যক্তিরা দায়ী হলেও তার বিচার করা হবে। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।’ একই কথা ক্ষমতাসীন দলের অন্য নেতাও আওড়ে যান। একটি দায়িত্বপূর্ণ অবস্থানে থেকে বোগাস বাণী বছরের পর বছর এভাবে চালিয়ে দেয়ায় দায়িত্বপূর্ণ সরকারি পদগুলো মানুষের কাছে উপহাস, ঠাট্টা-মশকরার বিষয়ে পরিণত হয়। সরকার হয়তো ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য মিথ্যা বলে থাকে। তাদের জানা উচিত, ১৮ কোটি মানুষের দেশে এমন আপাত মন ভোলানো রাজনৈতিক কথাবার্তা অপরাধীদের পক্ষে যায়। তারা যখন দেখে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এসব আশ্বাসের সাথে বিচারের গতির কোনো সম্পর্ক নেই, তখন তারা আরো বেশি উৎসাহিত হয় অপরাধ করতে। যারা অপরাধ করতে ইতস্তত করে তারাও নেমে পড়ে খুন-জখম-জালিয়াতি ও প্রতারণায়। এভাবেই আজ পুরো দেশ যেন খুনি-ধর্ষকদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।

সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে এরফান সেলিমের বিরুদ্ধে আইন যেভাবে বেগবান হলো, সেটি একটি অস্বাভাবিক ব্যাপার। মানুষ বিচার চায়। সেটি হচ্ছে একজন ব্যক্তি যতটুকু অপরাধ করেছে বিচারে তার ততটুকু শাস্তি হোক। মুলা চুরির অপরাধে ফাঁসি কেউ চায় না। আবার মানুষ হত্যার জন্য অর্থদণ্ড বা লঘুদণ্ড দিয়ে কারো হত্যার অপরাধকে খাটো করা হোক, সেটিও চায় না। খুনিরা কোনোভাবে ফাঁকফোকর গলিয়ে কিংবা রাষ্ট্রপতির কোটায় মাফ পেয়ে আসুক তা কোনোভাবে প্রত্যাশিত নয়। এমনটি হলে একটি সমাজ কখনো টিকবে না। এমন ভারসাম্যহীন বিচার-আচার করে আপাতত ক্ষমতাসীনরা রক্ষা পেলেও দীর্ঘমেয়াদে নিশ্চয়ই সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় অরাজকতার নেতিবাচন লক্ষণ এখন স্পষ্ট।

এরফান ও তার সহযোগীরা নৌবাহিনীর কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ওয়াসির মোটরসাইকেলকে প্রথমে ধাক্কা দিয়েছে। ওয়াসি যখন এর প্রতিকার চান তখন এরফান ও তার সহযোগীরা মেরে তার দাঁত ভেঙে দিয়েছে। তার স্ত্রীর গায়েও হাত তুলেছে। সৌভাগ্য, উপস্থিত আমজনতা অসহায় নৌবাহিনীর কর্মকর্তার দাঁত ভেঙে দেয়া ও তার কান্নারত একটি বক্তব্য ধারণ করেছিল মোবাইলে। সেই দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। এ ধরনের হামলাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা কেউ বলেনি। তবে বাংলাদেশের সম্মানিত সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর মর্যাদার ওপর একটা আঘাত হিসেবে সাধারণ মানুষ এটাকে দেখেছে। তারা সমবেদনা জানিয়েছে। তবে এর সাথে আরো কয়েকটি ঘটনা মানুষ উল্লেখ করার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের শান্তি ও নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাহিনীগুলো কতটুকু মানুষের জন্য কাজ করছে? ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নৈশ ভোটের নির্বাচনে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো জনগণের অধিকার রক্ষা করতে পারেনি বলে অনেকেই মন্তব্য করতে ছাড়েনি। অনেকে বলতে ছাড়েনি যে, দেশের মানুষ গুম-খুন হয়ে গেলে প্রতিকার না পাওয়া ভুক্তভোগীরা নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে কোনো প্রতিকার পায়নি।

এরফানের ঘটনায় লক্ষ করার বিষয় হচ্ছে বিচারের তুফান গতি। ঘটনার ১৮ ঘণ্টার মধ্যে তাকে সাজা দিয়ে দিলেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এত কম সময়ের ব্যবধানে একজন সংসদ সদস্যের ছেলে এমনকি যিনি নিজেও কাউন্সিলর- তাকে শাস্তি প্রদান বাংলাদেশে কল্পনাতীত। কারণ এর চেয়ে আরো অনেক কম প্রভাবশালী সরকারি দলের সদস্যও নানা অপরাধ করে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। তাদের কোনো ধরনের বিচার হবে কেউ এখন চিন্তাও করতে পারে না। মাদক রাখার দায়ে এক বছর ও অবৈধ ওয়াকিটকি রাখার জন্য এরফানকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। যদিও এ যাত্রায় তার বিরুদ্ধে নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধর ও অপমান লাঞ্ছিত করার অভিযোগ ছিল। এর সাথে ছিল তার স্ত্রীকে নির্যাতন ও কটূক্তি করা। বিচারের স্বাভাবিক গতি এখানে দেখা যাচ্ছে না। যেসব অপরাধে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি, সেগুলো ছাড়াই তার শাস্তির ব্যবস্থা হয়ে গেল। আমাদের দেশে বিচার যে কখনো কখনো সরকারের ইচ্ছায় চলে সেটাই যেন আমরা দেখতে পাচ্ছি।

আগের দিন মধ্যরাতে তিনি নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধর করেন। পরদিন দুপুর সাড়ে ১২টায় পুরান ঢাকার তার বাড়িতে র‌্যাব অভিযান শুরু করে। সন্ধ্যায় তার সাজা হয়ে যায়। এখানে সরকারের আইন ও বিচার সুপারসনিক গতিতে চলেছে। এমন গতি কোনোভাবে স্বাভাবিক বলা যায় না। এর রয়েছে ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এ দেশে দরকার আইনের স্বাভাবিক গতি। যেখানে অনেক ক্ষেত্রে আইন কোনো গতিই পায় না। ভুক্তভোগীদের কান্নায় বছরের পর বছর আকাশ-বাতাস কেবল ভারী হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বরং ওই বিচারপ্রার্থীদের জন্য একটি জগদ্দল পাথর। এমন ব্যবস্থাপনা না থাকলে বরং তারা এমন নির্যাতিত নিপীড়িত হতেন না এমন ধারণাও অনেকের।

এরফানের বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় লাইসেন্সবিহীন বিদেশী অস্ত্র, বিদেশী মদ ও ৪০০ পিস ইয়াবা, দুরবিন, ৩৮টি ওয়াকিটকি ও তিনটি অতি উচ্চ ক্ষমতাম্পন্ন সেট, যেগুলো দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত নজরদারি করা যায়। এসব সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার হতো বলে র‌্যাব জানায়। একজন সংসদ সদস্য বাবার কাউন্সিলর সন্তানের জন্য এগুলো রাখা এত দিন বৈধই ছিল। কেবল তখনই এগুলো অবৈধ হতে পারল যখন তিনি সামরিক বাহিনীর কোনো কর্মকর্তাকে মারধর করলেন। তাই যদি না হবে তা হলে এত দিন তিনি কিভাবে এসব ব্যবহার করছিলেন? এমন প্রশ্ন মানুষের মনে জাগাই স্বাভাবিক। এ ধরনের সংসদ সদস্যের ছেলে দেশে শত শত। তাদের কাছেও কি সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালানোর অবৈধ জিনিসপত্র রয়েছে? তারা এরফানের মতো কারো বিরুদ্ধে গুরুতর কোনো গুণ্ডামি করলেই কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে? অন্যথায় এমন অবৈধ কর্মকাণ্ড চালাতে তাদের কি কোনো সমস্যা নেই?

এরফানের অন্য একটি আস্তানায় আরো পাওয়া গেছে হ্যান্ডকাফ, ছুরি, দুরবিন, হকিস্টিক, হাড় ও ওয়াকিটকি। বেশ কয়েক বছর ধরে আমরা সরকারের জঙ্গিবিরোধী অভিযান দেখেছি। ওই সব অভিযানে দা-বঁটি যাই পাওয়া যেত, সবই ভয়াবহ অস্ত্র হিসেবে কঠিন সিজার লিস্ট হতো। কায়দা করে সেগুলো সাজিয়ে রাখা হতো মিডিয়ায় ছবি প্রকাশের জন্য। আর মিডিয়া এসব দা-বঁটিকে ‘ভয়াবহ’ সব জঙ্গি উপাদান হিসেবে জোর দিয়ে প্রকাশ করত। নিরাপত্তাবাহিনীর জোর তৎপরতা আর মিডিয়ার উৎসাহ ছিল লক্ষ করার মতো। জঙ্গি বলতে যদি বোঝানো হয় মানবতার জন্য ক্ষতিকর কিছু তা হলে এরফানের কাছে যা পাওয়া গেছে তাতে ক্ষতির পরিমাণ পূর্ববর্তী জঙ্গিদের চেয়ে কম নয়।

তার এ আস্তানাটি টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার হতো। লিফটম্যান জানান, এখানে এরফান একাই আসতেন। প্রথম ভবনের পাঁচতলায় তার কক্ষে প্রবেশ করার জন্য চারতলা থেকে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। সেটি ছিল তাদের নিজের মাফিয়া সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। চার কিলোমিটার পর্যন্ত কে কী কথা বলে তিনি সেটি শুনতে পেতেন। একটি ব্রিফকেস পাওয়া যায়, এ ধরনের ব্রিফকেস আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চৌকস কর্মকর্তারা ব্যবহার করেন। এসব আলামত অনুযায়ী এরফান যে একজন মাফিয়া, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তিনি পুরান ঢাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন।

এখন মিডিয়া এরফানের মাফিয়া সাম্রাজ্যের খবর প্রকাশ করছে। হাজী পরিবারের বিরুদ্ধে এখন সবাই আজান দিয়ে নেমে পড়েছে। প্রতিদিন মিডিয়া এমন অপরাধের ফিরিস্তি প্রকাশ করছে। এর শুধু একটি অপরাধও একজন সাধারণ নাগরিকের জন্য মহাপাপ। কিন্তু সংসদ সদস্য ও তার কাউন্সিলর ছেলের জন্য নৌ কর্মকর্তাকে মারার আগ পর্যন্ত অঘোষিতভাবে বৈধ ছিল। হাজী সাহেব একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখল করে মার্কেট বানিয়েছেন। ব্যাংকের জমি দখল করে রেখেছেন। প্রতিবন্ধীদের জমিও তিনি দখল করে বসে আছেন। তিনি বছরের পর বছর লঙ্ঘন করে চলছিলেন উচ্চ আদালতের রায়ও। এখন ঝাঁপিয়ে পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনও। তারা হাজীদের বিরুদ্ধে একটি ফাইল খুলেছে।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, অপরাধের ষোলোকলা পূর্ণ হওয়ার পর পদক্ষেপ। সাহেদ-সাবরিনারা যখন জনগণের বারোটা বাজালেন, তার পরই কেবল সংশ্লিষ্টদের খবর হলো। এখন দেশে আর কোনো সাহেদ-সাবরিনা বা হাজী নেই এমন নয়। বরং যত সংখ্যক কাকতালীয়ভাবে জালে আটকা পড়েছে তার চেয়ে ঢের বেশি সংখ্যায় তারা রয়েছেন। পড়ে যাওয়া হাজী সেলিমদের চেয়েও তাদের বিরুদ্ধে জিহাদে নামা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মিডিয়া ও দুদকের দায়িত্ব। যারা এখনো বহাল তবিয়তে তাদের মাফিয়া সাম্রাজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন, সবাই মিলে তাদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। এতে জনগণের মুক্তি মিলবে, আপনাদেরও দেশপ্রেম প্রমাণিত হবে।

jjshim146@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement