এত কাছে, তবু দূরে
- মীযানুল করীম
- ০১ নভেম্বর ২০২০, ১৮:৫৬
নিজের এলাকা কিংবা গ্রামে তেমন যাওয়া হয় না। এবার এক নিকটাত্মীয়ার ইন্তেকালে একাধিকবার গ্রামে যেতে হলো। এতে ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালনের দিকটি ছাড়াও গ্রামাঞ্চল কিংবা মফঃস্বল সম্পর্কে সরেজমিন জানার সুযোগ হয়েছে।
গোটা শরীরের রক্ত মানুষের মুখে উঠে আসা যেমন দৈহিক সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়, তেমনি কেবল রাজধানী ঢাকাকে ‘ তিলে তিলোত্তমা’ করে উন্নয়নের নজির স্থাপন করা হলেই তাতে বাংলাদেশ উন্নত হয়ে যাবে না। অপর দিকে, এটা ঠিক যে, মানুষের দৈনিক অবয়ব বা কাঠামোর ক্ষেত্রে চেহারা বা মুখমণ্ডল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তেমনি, একটা রাষ্ট্রের পরিচয় বহির্বিশ্বে তুলে ধরার ক্ষেত্রে এর রাজধানী বা প্রধান শহর নিঃসন্দেহে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এখন জাতি হিসেবে আমাদের এ দুটি বিষয়ের ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে হবে। সুষম খাদ্যের মতো বজায় রাখা চাই আনুপাতিক বণ্টন ব্যবস্থা। বাস্তবতা হলো, ঢাকার বাইরে আমাদের পা পড়লে টের পাওয়া যায় এ দেশের উন্নয়ন কত বেশি রাজধানীকেন্দ্রিক এবং দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল আজো যেন ‘প্রদীপের নিচে পরিব্যাপ্ত অন্ধকার।’ তবে কবির ভাষায়- “এই সব ম্লান মুখে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা;/ এই সব মূঢ় মূক মুখে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে ভাষা।’
রাজধানীতে বর্ষার আগমনে সাময়িক হলেও, স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় কম। তবে গ্রামের দিকে ‘পচা বর্ষা’র তাণ্ডবে সর্বত্র প্যাচপেচে কাঁদা আর শেওলাজমা, পিচ্ছিল পথঘাট বুঝিয়ে দেয়, এ দেশের ওহহড়পবহঃ ঞববসরহম সরষরড়হং দেশের জনগণের কী হাল অবস্থা। ঢাকার ভিআইপি মোড়ে পানি জমার উপায় নেই। এর বিপরীতে, গ্রামের রাস্তা থেকে অনেক সময় পানি সরার উপায় থাকে না। উল্লেখ্য, মফঃস্বলের অনেক রাস্তা নামে মাত্র পাকা হলেও দু’দিনেই কার্পেটিং উঠে, খানা-খন্দে ভরে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এসব সড়কের একেকটি যেন ভাঙ্গাচোরা চন্দ্রপৃষ্ঠের রূপ ধারণ করে। তাছাড়া, গ্রামের পথঘাটের বেশির ভাগই কাঁচা রয়ে গেছে। সেগুলোর দশা বর্ষায় হয়ে ওঠে অবর্ণনীয়।
গ্রামের দিকে ‘পচা বাইড়া’ বা ‘পচা’ বর্ষার কী রূপ, তা ভুক্তভোগী মাত্রই ভালো জানেন। এ ছাড়াও, সড়ক-সেতুসহ অবকাঠামোর ভাগ্য নিয়ে প্রতিনিয়ত চুরিদারি বা দুর্নীতি যে, ‘পুকুর, দীঘি, নদী ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তা অন্তত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জানা থাকার কথা। তবে এ নিয়ে প্রশাসনের ত্বরিত পদক্ষেপ বা কঠোর ব্যবস্থা চোখে পড়ে কমই। এদিকে, ‘সরকারের মাল’ ‘দরিয়াতে ঢালা’ই শুধু নয়, যথেচ্ছ ‘নয় ছয়’ করা বা বিরাট অংকের টাকা মেরে দেয়ার পালা কিন্তু বন্ধ হয় না।
বৃহত্তর নোয়াখালীতে একটা কথা আছে, ‘বাড়ি কাছে, ঘাটা দূরে।’ এর মানে হলো, কারো বাড়ি কাছে হলেও রাস্তার অভাবে বা আর কোনো কারণে সেখানে যেতে ঘুরে যাওয়া অথবা বিলম্ব ঘটা। এ অবস্থা এবার দেখা গেল ফেনী জেলার দক্ষিণাঞ্চলীয় এক এলাকাতে। সেখানে ‘পাকা’ রাস্তার অল্প কিছুটা অংশ ভেঙে যাওয়ায় এখন প্রধান সড়ক ধরে, পরের বাসস্ট্যান্ড ঘুরে অনেক দূর দিয়ে এলাকাবাসীকে যেতে হয়। খুব সম্ভবত এবার বর্ষার দরুন এই অবস্থা। হয়তো শুকনা মৌসুম না আসা পর্যন্ত এটাকেই এলাকাবাসী নিজেদের ভবিতব্য বলে ধরে নিয়েছে। তবে রাস্তার ঠিকাদারদের ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে জনগণকে যে বিপুল গচ্চা দিতে হচ্ছে, সে জন্য দায়ী কে?
কয়েক বছর আগে ফেনী জেলার উত্তরাংশের একটি গ্রামে যেতে হয়েছিল। সীমান্তবর্তী সে প্রত্যন্ত পল্লীর আনাচে কানাচে অত্যাধুনিক ক্রিকেট খেলার ধুম হয়তো এখন স্বাভাবিক। তবে সে এলাকার একটি ‘কমিউনিটি সেন্টার’ দেখে আক্কেলগুড়–ম। একটি জরাজীর্ণ ক্ষুদ্রকায় পাকা দালানকে কেন ‘কমিউনিটি সেন্টার’ নাম দেয়া হলো এবং এখানে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান করা সম্ভব কিনা, তার রহস্য বোঝা কঠিন নয়। তবে খুব সম্ভবত এমন করুণ অবস্থা দেশের বহু জায়গাতেই। মানুষ এ অবস্থার মধ্যেই দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। যত দিন স্বাধীন দেশের মানুষ Innocent Teeming milions -এর মর্যাদায় কার্যত উন্নীত না হবে, হয়তো ততদিন এ দশাই থাকবে। স্বাধীনতাকে অর্থবহ, তথা সবার জীবনে ফলপ্রসূ করার জন্য সরকার, সমাজ, মিডিয়া, এনজিও, সুশীল সমাজ- সবার সচেতন ভূমিকা তথা দায়িত্ববোধ থাকতে হবে।
গত কিছু দিন রাজধানীতে বেজায় গরম। এমনিতেই শ্রাবণ-ভাদ্র-আশ্বিন মাসে গরম পড়ে ‘তাল পাকা।’ এবার মনে হচ্ছে, এর মাত্রা বেশি। সাধারণত গাছপালা বেশি থাকলে বৃষ্টির পরিমাণ হয়ে থাকে বেশি। কিন্তু গ্রামে তো আজো বৃক্ষ সম্পদ শহরের চেয়ে বেশি, অন্তত রাজধানী ঢাকার তুলনায় তো অধিক বটেই। তবুও ঢাকার বাইরে গেলে দুঃসহ গরমে হাঁসফাঁস করতে হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে কেউ কেউ বলছেন, গ্রামাঞ্চলে অনেকেই থাকেন এমন ঘরে যার চালা তো বটেই, চার দিকেও টিনে ঘেরা। তদুপরি, গ্রামে আজো বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন নয়। এ অবস্থায় ফ্যান ঘোরে না এবং বাতি জ্বলে না। এদিকে, হাতপাখার প্রচলন প্রায় উঠেই গেছে। ফলে মানুষকে গরমে কষ্ট পেতে হয়।
গ্রামের দিকে গিয়ে মনে হয়েছে, বিদ্যুৎ যতটা ঘরে এসেছে, রাস্তাঘাটে তা আসেনি। ফলে সন্ধ্যায় ঘরে ঘরে বাতি জ্বলে উঠলেও পথঘাট ডুবে থাকে অন্ধকারের ঐতিহ্যে। বিশেষ করে ভাঙ্গাচোরা ও গর্তভরা রাস্তা, অন্ধকার ঝোপঝাড় ও কাঁটাগাছ তখন মানুষের অবস্থা শোচনীয় করে তোলে। এর পাশাপাশি, গাঁ গ্রামের পুকুরগুলোর প্রায় সবই মাছ চাষের জন্য নির্দিষ্ট। খুব কম পুকুরেই গোসল করা চলে। অনেক পুকুরের পাড় ভেঙে বড় বড় গাছপালা পড়ছে পানিতে। দেখার কেউ নেই।
এক বিকেলে একটি গ্রামে অনেক দূর ঘুরেও লোকজনের দেখা মেলেনি। বিশেষত ঢাকাবাসীর কাছে এটা অবিশ্বাস্য। আসলে গাঁয়ের লোকজন জীবিকার তাগিদে শহরমুখো অথবা হাটে-বাজারে ও গঞ্জে বন্দরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। অন্য দিকে, গ্রামের শ্যামল প্রকৃতির রাস্তাঘাট হয়ে পড়ছে জনবিরল। আধুনিক যুগের এই সঙ্কট কিভাবে কাটানো যায়; কেমন করে নগরায়ণ-শিল্পায়নজনিত বৈষম্য নিরসন করে গ্রামের ঐতিহ্য ফেরানো যেতে পারে, তা নিয়ে সুধীজন সবিশেষ ভেবে দেখা দরকার। এ দেশের গ্রামগুলো যে এক ধরনের নেয়ামতে পরিপূর্ণ, তা সাতশ’ বছর আগে ইবনে বতুতা বলে গেছেন।
ফেনী জেলার দক্ষিণাংশের সোনাগাজী উপজেলা এবং সংলগ্ন, চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার বিস্তীর্ণ উপকূলে গড়ে উঠছে দেশের বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল। এটা নিছক রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল বা ইপিজেড-এর চেয়ে অনেক বড় কিছু। সোনাগাজী উপজেলা আর মিরসরাই উপজেলা জুড়ে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্পগুলোর একটি- মুহুরি প্রজেক্ট। এই সোনাগাজী অঞ্চলে দেশের বৃহত্তম বায়ুকল বা উইন্ডমিল প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার কথা। এখানে আছে আঞ্চলিক ধান গবেষণা কেন্দ্র, উন্নতমানের হাঁস প্রজনন কেন্দ্র, প্রভৃতি। তবে ফেনী থেকে সোনাগাজী যাওয়ার রাস্তাটি এখনকার ক্রমবর্ধমান চাহিদার চেয়ে অনেক সঙ্কীর্ন মনে হয়। যানবাহনের চাপ বেড়েছে; প্রযুক্তির উন্নতি ঘটেছে। তবে রাস্তা অপরিসর হওয়ায় তা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ব্যাটারিচালিত যানের প্রাচুর্য এর একটা প্রধান কারণ।
এদিকে, দেশজুড়ে চলছে করোনা মহামারীজনিত জরুরি পরিস্থিতি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি তাই অনেক প্রলম্বিত হয়েছে। অপর দিকে, রাস্তাঘাটে কিংবা খেলার মাঠে কিশোর ও তরুণদের তেমন দেখা যাচ্ছে না। তা হলে তারা কি ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবাদে অনলাইন ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত? বাস্তবতা তা বলে না। গত সাত মাসের মহামারী দেশবাসীকে অর্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত করে দিয়েছে। অনেক মানুষের আয়-রুজি বন্ধ। অনেকে বাধ্য হয়ে শহর থেকে গ্রামে চলে গেছেন সপরিবারে। বহু পরিবারের ছেলেমেয়েরা জীবিকার তাগিদে পড়াশোনা স্থগিত রেখে কাজ করতে নেমেছে। দেশের এই বাস্তবতা ভুলে যাওয়া অনুচিত। ঢাকায় বসে গ্রামের বাড়ি চেনা যায় না। এই ছোট দেশে মানুষের চাপ বিষম। গ্রামের লোকজন শহরের এত কাছে, তবু অনেক দূরে। এই দূরত্ব যে বৈষম্যের জন্ম দিয়েছে, তা ঘোচেনি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা