২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

একটি সমাধিফলক ও কিছু প্রশ্ন

-

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী কয়েকটি মৃত্যু ঘটনার মধ্যে সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হান আহমেদ নামে এক যুবকের মারা যাওয়া অন্যতম। অভিযোগ রয়েছে, ফাঁড়িতে কর্মরত কয়েজন পুলিশ সদস্য নির্যাতন করে তাকে হত্যা করেন। এ হত্যামামলার তদন্ত এখনো চলছে। দোষীদের বিচারের আওতায় আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর আগে আমি এই কলামেই আমাদের বিচারব্যবস্থার নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে বলেছি। সেগুলো দূর করার যথাযথ উদ্যোগ আমরা নিতে পারিনি। পুলিশ আন্তরিক না হলে কিভাবে জনগণের দুর্ভোগ সৃষ্টি হতে পারে সে কথাও আমি বলেছি (২৪ অক্টোবরের লেখায়)। আমি বলার চেষ্টা করেছি যে, কেউ খারাপ হলে আইন বদল করলেই সে ভালো হয়ে যাবে না। নৈতিক ভিত্তি জোরদার না করে শুধু আইন কঠিন করলে অপরাধ দূর হবে না। মানুষের মন থেকে জবাবদিহির অনুভূতি চলে গেলে সে সহজেই অপরাধ করতে পারে। কার্যকর শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের মনে এ চেতনা জাগিয়ে তোলা প্রয়োজন। আজকের সমাজে নৈতিক অবক্ষয়ের যে মহামারী লেগেছে তার একমাত্র প্রতিষেধক হলো আমাদের সন্তানদের জন্য কার্যকর নৈতিক শিক্ষা। আরো বড় যে জিনিসটি আজকের সমাজ প্রায় হারিয়ে ফেলেছে সেটি হলো মানুষের জন্য ভালোবাসা। মানুষ হিসেবে মানুষকে ভালোবাসতে হবে এবং এই ভালোবাসার শিক্ষাটিও যে দিতে হবে সেই বোধ হারিয়ে গেছে। এ শিক্ষাদান যে খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে আমার এই বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়েছে রায়হান আহমেদের কবরের পাশে লাগানো সমাধিফলকের লেখা (পত্রিকার ছবি) দেখে। তাতে লেখা ‘রায়হান আহমেদ... বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশের নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেন।’

আমার জন্ম ব্রিটিশ ভারতে, যে বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। বলাবলি হতো আমি নাকি যুদ্ধ নিয়ে এসেছি। আমার যখন ৬-৭ বছর বয়স তখন মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের দাবিতে চার দিকে তুমুল আন্দোলন চলছে। মুসলিম লীগের সমর্থকরা এই দাবিতে যখন মিছিল করার সময় ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ (লড়াই করে পাকিস্তান আদায় করব) স্লোগান দিতেন। এক দিন বাড়ির পাশ দিয়ে এমন একটি মিছিল যেতে দেখে আমিও ছোট্ট একটি লাঠি হাতে নিয়ে দৌড়ে মিছিলের পেছনে পেছনে যাওয়ার চেষ্টা করি। তখন মা ধরে ফেলেন। আমার ভাব এমন ছিল যে আমি পুলিশের সাথে মারামারি করব। এরপর পাকিস্তান হলো। ১৯৫৩ সালে যখন যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলো তখন আমি কলেজে পড়ি, মোটামুটি বুঝতে শিখেছি। তখন কলেজে রাজনীতির সাথে জড়িত হই। বুঝতে পারি যে পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন মেনে নেয়া যাবে না। তারা আমাদের শোষণ করছে। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলন আমার মনে গভীর দাগ কেটে ছিল। এর কারণ হিসেবে বুঝেছিলাম যে, ভাষার অধিকার কেড়ে নেয়ার মানে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হওয়া। সরকারি চাকরিতে সুবিধা হারানোর বিষয়টিই তখন আমার ভাবনায় ভাষার অধিকার আদায়ের অনেক বড় কারণ বলে মনে হয়েছিল। আমি কলেজে পড়ার সময় মুসলিম লীগ সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং করেছি, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’ বলে স্লোগান দিয়েছি। তখনো পুলিশ ছাত্রদের পিটিয়েছে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নৌকা মুসলিম লীগের হারিকেনকে হারিয়ে দেয়। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের সরকারকে এক পক্ষকালও ক্ষমতায় থাকতে দেয়নি পশ্চিম পাকিস্তানিরা। ১৫ মে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। আর ৩০ মে সেই মন্ত্রিসভা বাতিল করে গভর্নরের শাসন জারি করা হয়। এরপর যুক্তফ্রন্ট নেতাদের গ্রেফতার এবং নানা নিপীড়ন চলে। তখনো আমি পুলিশের নির্যাতন দেখেছি। সব পুলিশ যে খারাপ সেটি আমি বলছি না কিন্তু কিছু পুলিশের এই নিপীড়কের চেহারা সবসময় ছিল। এখনো কিছু পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অনেক অভিযোগ রয়েছে।

কিছু দিন আগে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যার কথা আমরা জানি। এর আগেও এমন অনেক উদাহরণ আছে। কিন্তু এ অবস্থার জন্য আসলে পরোক্ষভাবে কারা দায়ী? এর জন্য আমরা নিজেদেরই দায়ি করব। এর দায়ভার আমাদের। এর জন্য পিতামাতা, সমাজ, রাজনীতি- সবাই দায়ী। এ দায় আমাদের নিতে হবে। এই দায় না নিলে পুলিশ কখনোই জনবান্ধব হবে না, দরদি মানুষ হবে না। পুলিশ তো আমাদেরই সন্তান, কোনো ভিনগ্রহের বাসিন্দা নয়। তা হলে তাদের অনেকে কেন এতটা খারাপ হবে? পুলিশ কি শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে সে কি আমাকে সহায়ক ভূমিকা পালন করার জন্য নয়? তার দায়িত্ব তো জনগণ কোনো দুর্যোগে পতিত হলে তাকে সাহায্য করা।

আমার মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির একটি ঘটনা। সে দিন আমি লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করছি। অন্য দিন নানা জায়গায় কাজ করতে হতো। সে দিন ক্যাম্পাসে পুলিশ এসে আমাকে খুঁজছে। পুলিশ জানতে পারল আমি ইকোনমিক ডিপার্টমেন্টের লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করতে গিয়েছি। ওরা আমাকে খুঁজে বের করে মেসেজ পাঠালো। আমি অবাক। আমি লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে এসে জিজ্ঞেস করতেই তারা বলল, ‘মি. মান্নান তোমার ছেলে অসুস্থ, তুমি বাসায় যাও।’ আমি তাড়াতাড়ি বাসাই চলে যাই। আসলে হয়েছিল কী, আমার ছেলে, সে এখন ডাক্তার, বিছানার ওপর লাফালাফি করতে গিয়ে পড়ে যায়। এতে ওর দাঁত ভেঙে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে। আমার স্ত্রী এতে ভয় পেয়ে পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ বাসায় এসে ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ট্রিটমেন্ট করানোর পর আবার বাসায় পৌঁছে দেয়। তখন আমি বাসায় পৌঁছি। পুলিশের এ কাজকে আমি কী বলব? আমাদের পুলিশ কি এ রকম? তারা কি এমন হতে পারে না? তারাও তো মানুষ। তারাও এমন হতে পারে। কিন্তু সে জন্য তাদের শিক্ষা দরকার। আমেরিকার হাসপাতালে চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল। কিন্তু আমি যেহেতু ছাত্র, তা ছাড়া পুলিশ আমার ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে তাই আমার কাছ থেকে কোনো পয়সা নেয়া হয়নি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলছি, আমাদের পুলিশের ছেলেরা বাংলার দামাল ছেলে; সাহসী, সুদর্শন ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। তাদের কি আমরা ভালো শিক্ষা দিতে পারি না, তারা কী আমাদের বন্ধু হিসেবে কাজ করতে পারে না? কেন তারা নির্যাতন করবে? এ ভাবনা আমাদের ভাবতে হবে।

রায়হান আহমেদের কবরের পাশের সমাধিফলকের লেখা ‘পুলিশের নির্যাতনে মৃত্যু’ আমাকে আরো পীড়া দিয়েছে। সম্ভাবনাময় তরুণ রায়হান মারা গেছে। তার ওপর নির্যাতন জুলুম হয়েছে। আমি তার জন্য দোয়া করি। তার মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিরা দেশের আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ সাজা পাক সেই কামনাও করি। কিন্তু যারা বেঁচে আছে তাদের মধ্যে কেন আমরা ঘৃণার সঞ্চার করছি? এই বাক্যটি কি ঘৃণার উৎস নয়? যারাই তার কবরের পাশে যাবে আর ফলকটি দেখবে তাদের মনে কি পুলিশের বিরুদ্ধে ঘৃণার উদ্রেক হবে না? এ লেখা কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে ঘৃণা ছড়াতে থাকবে। আজ পত্রিকায় ছবি প্রকাশিত হয়েছে বিধায় আমি দেখেছি। এমন আরো লাখ লাখ মানুষ পত্রিকার ছবি দেখেছে। আগামীতেও দেখবে। এই ছবি তাদের মনে কী প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেবে সেটি কি কেউ ভেবেছেন? এভাবে ঘৃণা ছড়িয়ে কি আমরা সমাজকে সংশোধন করতে পারব? তাই যারা বেঁচে আছে, যারা রায়হানের আত্মীয় আমি তাদের অনুরোধ করব ফলকের ওই বিশেষ বাক্যটি মুছে ফেলতে। দেশবাসীর কাছেও অনুরোধ থাকবে যেন কোনো সমাধিফলকে এ ধরনের ঘৃণার উদ্রেককারী কথা লেখা না হয়। যে মারা গেছে তার জন্য দোয়া করি। পুলিশ বাহিনীর জন্যও দোয়া করি এর সব সদস্য যেন জনদরদি, ভালো মানুষ হয়।

মানব সভ্যতা আজ যে সঙ্ঘাত ও সঙ্কটের সম্মুখীন, দুনিয়াজুড়ে যে হানাহানি চলছে তার জন্য এই ভালোবাসার অভাবই দায়ী। আমরা ক্রমাগত সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর উন্নতির দিকে অগ্রসর হচ্ছি। কিন্তু সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে মানবতা যেন চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা এখন ভালোবাসার বদলে ঘৃণাকে সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছি। এই ঘৃণা সমাজের তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে দিনে দিনে আমাদের সামাজিক সম্পর্কটিও শিথিল হয়ে পড়ছে। মানুষে মানুষে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে, সঙ্ঘাতের বিস্তার ঘটছে। অতীতে এগুলো থাকলেও এখনকার মতো মহামারী আকার ধারণ করেনি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সেখানে ঘৃণার অর্থনীতি, ঘৃণার রাজনীতি, ঘৃণার পররাষ্ট্রনীতি- ঘৃণা যেন সব কিছুর ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষকে মানুষ কত হেয় করতে পারে, কে কাকে ডিঙ্গিয়ে যেতে পারে, কে কত বলদর্পী হতে পারে, কে কাকে শোষণ করতে পারে- এগুলোই যেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সবার ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সমাজকে শুদ্ধ করতে হলে আমাদের ঘৃণার পরিবর্তে ভালোবাসার বার্তা ছড়াতে হবে। ঘৃণা শুধু ঘৃণার জন্ম দেবে, তেমনি ভালোবাসা ভালোবাসারই জন্ম দেবে। যারা বেঁচে আছে তাদের জন্য ভালোবাসা প্রয়োজন, ঘৃণা নয়। ভালোবাসা না থাকলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তো ঘৃণার মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠবে। তাতে কি সমাজ থেকে অন্যায় ও অবিচার দূর হবে? আমরা শান্তি চাইলে তা ভালোবাসা দিয়েই অর্জন করতে হবে, ঘৃণা ছড়িয়ে নয়। আমাদের মধ্যে ভালোবাসার অভাবেই এ ধরনের করুণ মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটছে। ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়ানোর আরেকটি কারণ কোনো ঘটনা ঘটলে তার দায় কিন্তু কেউ নিতে চায় না। মনে ক্ষোভের একটি কারণ। সবাই চায় আরেকজনের ঘাড়ে দায় চাপাতে। কেউ যদি বলে হ্যাঁ, আমি দায়ী। তখন মানুষ কিন্তু অনেক শান্ত হয়ে যায়। আসলে কে দায়ী সেটি তো পরে বিচারে নির্ধারিত হবে। আমি একটি ভুল করতেই পরি; কিন্তু সাথে সাথে যেন বলি, এ ভুলের জন্য আমি দায়ী। আমাদের এই সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে হবে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement