২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ইসলামী অর্থনীতি : প্রয়োগ ও বাস্তবতা

-

(শেষ কিস্তি)
হাজার বছর শাসনের পর মুসলিম শাসনের পতন হলো। জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা মুসলমানরা পিছিয়ে পড়লাম। তারই ফলে আমরা সর্বক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়লাম। জ্ঞানের সাথে সাথে সামরিক ক্ষেত্রেও পিছিয়ে পড়লাম। কারণ মিলিটারি হার্ডওয়্যার বা এর যে সুপিরিয়রিটি তার পেছনে রয়েছে নলেজ। আবার টেকনোলজি তারও পেছনে রয়েছে নলেজ। এই জ্ঞানের দিক থেকে পিছিয়ে পড়ার কারণে আমরা সবদিক থেকে পিছিয়ে পড়লাম। ফলে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো জোর করে আমাদের দেশ দখল করার সুযোগ পেয়ে গেল। আর তারা আমাদের দেশে এসে দুনিয়ার যত অবৈধ ব্যবসা সম্ভব তা শুরু করল। মদের ব্যবসা শুরু করল। অন্যান্য সুদভিত্তিক কাজ কারবার চালু করল। পরবর্তীকালে সুদিভিত্তিক ব্যাংক চালু করা হলো। ফলে এই কলোনিয়াল প্রভাবের কারণে মুসলিম বিশ^ ইসলামী অর্থনীতি থেকে অনেকটা দূরে সরে গেল। ব্যক্তিগত জীবনে তারা মুসলিম হিসেবে থাকল। যতটা সম্ভব ইসলামী কালচার রইল। কিন্তু তা সত্ত্বেও অর্থনীতিতে অনৈসলামিক উপাদান বাড়তে থাকে।

এরপর আবার ইসলামের নব উত্থান ঘটে। শুরু হলো ইসলামের নতুন করে জাগরণ। সেটি ঘটে গত এক শ’ বছর আগে। এরপর পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে বিভিন্ন দেশ স্বাধীন হতে থাকে। পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া স্বাধীন হলো। আস্তে আস্তে অন্যান্য মুসলিম দেশ স্বাধীন হলো। সবশেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে যেসব মুসলিম দেশ ছিল সেগুলো স্বাধীন হয়ে গেল। এসব রাষ্ট্রের মধ্যে বহু লোকই ইসলামের জন্য কাজ করতে লাগলেন। ইসলামী আন্দোলনের উত্থান হলো। তারা ইসলামকে ব্যাখ্যা করতে লাগলেন এবং নতুন করে ইসলামী আইন লেখা শুরু করলেন। পাকিস্তানে অনেক ধরনের আইন হলো- জাকাতের ওপর, ওশরের ওপর। এমনকি তারা নতুন পেনাল কোড করল। সাক্ষ্য আইন তৈরি করল। অন্যান্য আইনে ইসলামী ধারা সংযোজন করল। ইসলামী কনস্টিটিউশন প্রণয়ন করল। এভাবে ইরান, সুদানে একই ব্যাপার হলো। আবার মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াতে কিছু হলো। এভাবে সব মুসলিম দেশে কিছু-না-কিছু ইসলামী আইন হতে লাগল। বাংলাদেশেও কিছু করা হলো। শাসনতন্ত্রে কিছু ইসলামী ধারা যোগ হলো।

অর্থনীতির সবচেয়ে বড় একটা উপাদান বা টুল হচ্ছে ব্যাংকিং। এই ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেই অর্থের আদান-প্রদান হয় এবং এরই মাধ্যমে অর্থনীতি গড়ে ওঠে। আমরা যদি ইসলামী ব্যাংকিংকে এগিয়ে নিতে পারি, ইসলামী ব্যাংকিং যদি জাতীয় ব্যাংকিং সিস্টেম হয়ে যায় তাহলে সুদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে উঠে যাবে। আবার সুদের ওপর মানুষের এমনিতেই আস্থা নেই। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি, মুসলিমরা সুদ চায় না, বাধ্য হয়েই সুদে জড়ায়।

ইসলামী ব্যাংকিং যদি সাকসেসফুল হয়, অনেক দেশে ইসলামী ব্যাংকিং মেজর ফ্যাক্টর হয় অথবা বেশির ভাগ ব্যাংক ইসলামিক হয়ে যায় কিংবা রাষ্ট্র যদি এটাকে গ্রহণ করে, যেমন ইরানে করেছে, পাকিস্তানে হতে যাচ্ছে (কিছুটা একবার হয়েছে; আবার সুপ্রিম কোর্ট বলেছে পুরোপুরি করতে হবে), মালয়েশিয়ায় ইসলামী ব্যাংকিং যে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে- এ রকম যদি হয় তাহলে সুদ ক্রমেই দূর হয়ে যাবে বলে আমরা ধরে নিতে পারি।

নতুন যুগে এই ইসলামী ব্যাংকিংয়ের যে প্রয়োগ শুরু হলো তাকে ইসলামী অর্থনীতিতে ইসলামী ব্যাংক একটা বড় ভূমিকা পালন করছে। প্রায় সব মুসলিম দেশেই এখন ইসলামী ব্যাংক কায়েম হয়ে গেছে। প্রায় ২০০-এর মতো ইসলামী ব্যাংক তাদের অনেক শাখা নিয়ে বিশে^র বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। এই ব্যাংকগুলো আরো ব্যাপক হচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয়েছে যে, ইসলামী ব্যাংকিং সফল। ইসলামী ব্যাংকগুলো সুদমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালুর চেষ্টা করছে। এ ছাড়াও তারা ইসলামের যে সামাজিক অর্থনৈতিক লক্ষ্য, তা কার্যকর করার জন্য চেষ্টা শুরু করেছে।

এসব লক্ষ্যের মধ্যে আছে মানুষের প্রয়োজনকে পূর্ণ করতে হবে, সুবিচার করতে হবে এবং তা যদি করতে হয়, মানুষের চাহিদা পূর্ণ করতে হয় তাহলে অনেক কিছুই আমাদের করতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো পূর্ণ কর্মসংস্থান। অর্থনীতিকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে মানুষের পূর্ণ কর্মসংস্থান হয়। কর্মসংস্থান হলে আয় হবে আর আয় হলে তাদের চাহিদা পূর্ণ হবে। আমরা যদি তাই কাজের বা নিয়োগের ব্যবস্থা করতে না পারি তাহলে আয় হবে না- আর আয় না হলে চাহিদাও অপূর্ণ থেকে যাবে, প্রয়োজনও পূর্ণ হবে না। সমাজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে আর সেটি ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য নয়। ইসলামী অর্থনীতি চায়, যেসব লোক কোনোভাবেই কাজ জোগাড় করতে পারছে না (যেমন অসুস্থ বা অতি বৃদ্ধ বা বিধবা এ রকম অন্যান্য অসুবিধা যাদের আছে) সেসব ব্যক্তিকে তার পরিবার প্রথমত চালাবে। আর যদি তা সম্ভব না হয় আত্মীয়-স্বজনও সাহায্য করবে। আর যদি তা না করতে পারে, তাহলে তা রাষ্ট্র করবে। এ ছাড়া ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য হচ্ছে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজে রোজগার করবে, ভালো রোজগার করবে। অর্থনীতিতে সফল হতে হবে। সে রোজগার করতে পারবে এবং সেই রোজগারের ভেতর তাকে চলতে হবে।

এসব করতে গেলে আজকের যুগে পুরো মুসলিম বিশ্বে রুরাল ইকোনমি গড়ে তুলতে হবে। কারণ জনগণের একটা বিরাট অংশ, কোনো কোনো মুসলিম রাষ্ট্রে ৮০ ভাগ গ্রামে বাস করে। আরব দেশের কোথাও ১০ বা ২০ ভাগ গ্রামে বাস করে। পাকিস্তানে ৬০ বা ৬৫ ভাগ লোক গ্রামে বাস করে। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে ৭০ ভাগ লোক গ্রামে বাস করেছে। এসব কারণে আমাদের রুরাল অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে হবে। শুধু ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করলে চলবে না। ইন্ডাস্ট্রি করতে হবে কিন্তু কৃষিকে আমাদের গড়ে তুলতে হবে, যাতে গ্রামীণ জনগণের আয়-রোজগারের ব্যবস্থা উন্নত হতে পারে।

তেমনিভাবে শহরাঞ্চলকে যদি সামনে রাখি তাহলে বড় ইন্ডাস্ট্রি তো প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। সাথে ছোট ইন্ডাস্ট্রিও করতে হবে। কারণ ছোট ইন্ডাস্ট্রি করতে পারলেই বেশি কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা যায়। সেই সাথে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। এগুলো ব্যাপকভাবে করতে হবে। এসব কাজ বিভিন্ন এনজিও করতে পারে। সমাজ সাহায্য করতে পারে। আমরা একে অপরকে সাহায্য করতে পারি। ব্যাংকিং সিস্টেমের একটি অংশ এ কাজে ব্যয় হতে পারে। সরকারও এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।

এভাবে আমরা ইসলামের সামাজিক লক্ষ্য নিড ফুলফিলমেন্ট, জাস্টিস যদি কায়েম করতে পারি তাহলেই একটা সঙ্ঘাতমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন করা সম্ভব হবে।

ইসলামী অর্থনীতির প্রয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যা আছে। আমাদের দেশেই শুধু নয়, প্রত্যেক মুসলিম দেশেই যারা সমাজ চালাচ্ছেন- তাদের মধ্যে ইসলামের জ্ঞানের অভাব রয়েছে। এগুলো দূর করতে হবে। মানুষের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে নানা কারণে, নানা ভীতি রয়েছে- যেহেতু ইসলাম খুব কঠিনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সে ভীতিগুলো দূর করতে হবে। তাহলেই আমাদের এলিট শ্রেণী, উচ্চ শ্রেণী বা সবচেয়ে শিক্ষিত শ্রেণী, তারা ভয়মুক্ত হবে। তারা তখন ইসলামের প্রয়োগের ব্যাপারে আগ্রহী হবে।

তেমনিভাবে পাশ্চাত্য এ ব্যবস্থা চায় না- সে সমস্যাও রয়েছে। তারা তাদেরটা বাদ দিয়ে আমাদেরটাই বা চাইবে কেন? সে ক্ষেত্রেও সমাধান কঠিন। কিন্তু আমরা যদি যোগ্য হয়ে উঠি- আমরা যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি, যদি সবাই শিক্ষিত হয়ে যাই, আমরা যদি আমাদের অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে পারি; যদি সম্পদকে ব্যবহার করতে পারি তাহলে পাশ্চাত্যের কাছে আমরা তত দায়বদ্ধ থাকব না। আর আমরা যদি তাদের কাছে দায়বদ্ধ না থাকি তাহলে পাশ্চাত্যের সাথে সঙ্ঘাত না করেও আমরা আমাদের পদ্ধতি ফলো করতে পারব। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বীকার করতেই হবে, মুসলিম দেশগুলোতে নানা রকম ডিক্টেটরশিপ রয়েছে, রাজতন্ত্র রয়েছে। এগুলো সহায়ক নয়। এগুলো ইসলামীও নয়। আমাদেরকে আল্লাহর আইনের অধীনে জনগণের সরকার, যেটাকে আমরা শূরাভিত্তিক শাসন বলি বা যেটাকে আমরা গণতন্ত্র বলি সেটির প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। হিউম্যান রাইটস প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জবাবদিহিতামূলক সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এসব কথাই ইসলামী চিন্তাবিদরা বলেছেন। এগুলো যদি আমরা করতে পারি তাহলে আমাদের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। ডিক্টেটরের অধীনে কোনো কোনো সময় সাময়িকভাবে উন্নতি হয়। কিন্তু ডিক্টেটরের অধীনে দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণমুখী অর্থনীতি গড়ে ওঠে না।

আমরা সামনের দিকে লক্ষ করলে দেখি, যদি ইসলামের সঙ্কটগুলো দারিদ্র্যের সঙ্কট, শিক্ষার সঙ্কট, পাশ্চাত্য শক্তির সাথে আমাদের যে সঙ্ঘাত- এই সঙ্ঘাতগুলোকে আমরা যদি কাটিয়ে উঠতে পারি, আমরা যদি আমাদের নিজেদের যে দুর্বলতাগুলো রয়েছে, আমাদের মধ্যে যে অতি গোঁড়ামি রয়েছে, কোথাও কোথাও যার কোনো ইসলামী ভিত্তি নেই- সেগুলো যদি আমরা দূর করতে পারি, আমরা যদি একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ উপলব্ধি (ফিকহ) অর্জন করতে পারি- তাহলে আমি মনে করি, ইসলামী অর্থনীতি ক্রমাগতভাবে শক্তিশালী হতে থাকবে।

এর জন্য ইসলামী জ্ঞানের ব্যাপক বিস্তার করা দরকার। ইসলামী সাহিত্যের ব্যাপক বিস্তার দরকার। ইসলামের যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে ওঠা দরকার। ইসলামী আন্দোলন আরো যোগ্য হওয়া দরকার। এসব যদি করা সম্ভব হয় তাহলে মুসলিম বিশ্ব ক্রমাগতভাবে ইসলামী অর্থনীতির কাছে চলে আসবে। তাহলে মুসলিম বিশ্ব থেকে সুদ উঠে যাবে। অবৈধ ব্যবসা উঠে যাবে, জালিয়াতি কমে যাবে। ভেজাল, মিথ্যা, ধোঁকাবাজি কমে যাবে- যদিও রাস্তা যে দুর্গম তা অস্বীকার করা যায় না। এর জন্য অনেক পরিশ্রম দরকার, অনেক প্রচেষ্টা দরকার, সেগুলোকেও অস্বীকার করা যায় না।

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার


আরো সংবাদ



premium cement